তিন বন্ধু স্কুল থেকে বাড়ি ফিরছিল। রাহাত, নিবিড় আর শফিক। তিনজনে ভীষণ দুষ্টু আর সাহসী। ওরা পথে যেতে যেতে দেখল, চকচকে লাল কাগজে মোড়ানো চকলেটের প্যাকেট পড়ে আছে। ওরা অবাক হয়ে একে অপরের দিকে তাকাল! রাহাত চকলেটের প্যাকেট তুলে নিল। শফিক বলল, এটা কি ঠিক হলো? নিবিড় মাথা দুলিয়ে বলল, অবশ্যই ঠিক হয়েছে। এখন আমরা ভাগাভাগি করে চকলেট খাব। শফিক বাধা দিয়ে বলল, এটা ঠিক হবে না। রাহাত ওর মুখে জোর করে চকলেট তুলে দিল। শফিক মজা পেয়ে খেতে শুরু করল। নিবিড় চোখেমুখে আনন্দ ফুটিয়ে বলল, এমন মজার চকলেট কিনতে হলে আমাদের অনেক টাকা খরচ হতো। রাহাত সম্মতি জানিয়ে বলল, নিশ্চয়ই। আমাদের ভাগ্য ভালো তাই পথেই কুড়িয়ে পেলাম। শফিক তখনো চুপচাপ। ও কী বলবে বুঝতে পারছে না। শুধু মনে হচ্ছে চকলেট মজা হলেও খাওয়া ঠিক হচ্ছে না।
হঠাৎ বাতাসটা কেমন ঠান্ডা হয়ে গেল। রাহাত আকাশের দিকে তাকাল। সন্ধ্যা হয়ে গেছে। তাড়াতাড়ি বাড়ি ফিরতে হবে।
নিবিড় বলল, গল্প করতে করতে এত সময় পেরিয়ে গেছে বুঝতেই পারিনি। শফিক ভয় পাওয়া গলায় বলল, শরীরটা কেমন ভারি ভারি লাগছে। রাহাত আর নিবিড় শফিকের দিকে তাকাতেই শিউরে উঠল! শফিকের পেছনে দাঁড়িয়ে আছে সাদা শাড়ি পড়া একটি মেয়ে। বড় বড় টকটকে লাল চোখ। এলোমেলো চুল। ধারালো নখ আর ঠোঁটে ভয়ংকর হাসি। হি হি হি কোথায় পালাবে? আজ মজা দেখাব তোমাদের। তিন বন্ধুর অন্তরাত্মা কেঁপে উঠল! রাহাত ঢোক গিলল। শফিক চোখ বন্ধ করল। নিবিড় সাহস করে বলল, কিন্তু কেন? ভয়ংকর মেয়েটি হাসতে হাসতে বলল, হি হি হি। আবার প্রশ্ন করে কেন? হি হি হি। উত্তর দিচ্ছি। আমি গাছের ডালে বসে পা দোলাচ্ছিলাম। আমার হাতে চকলেটের প্যাকেট ছিল। হঠাৎ চকলেটের প্যাকেট পড়ে গেল। তোমরা তুলে নিলে। শুধু তাই নয়, মজা করে খেয়েও ফেললে। কথা বলতে বলতে মেয়েটির চোখমুখ বিকৃত হয়ে গেল। তা দেখে তিন বন্ধুর গলা শুকিয়ে গেল। মেয়েটি ধারালো নখ দেখিয়ে বলল, আমার চকলেট ফেরত দাও। তা না হলে খামচে দেব। আমার মতো ভয়ংকর বানিয়ে দেব তোমাদের। তখন মানুষরাজ্য ছেড়ে ভূতরাজ্যে বাস করতে হবে। রাহাত আর নিবিড় কাঁপা কাঁপা কণ্ঠে বলল, আমরা জানতাম না ওটা তোমার। জানলে কখনো খেতাম না। শফিক বাধা দিয়ে বলল, আমি নিষেধ করেছিলাম। মেয়েটি কর্কশ কণ্ঠে চেঁচিয়ে উঠল। এত কিছু শুনতে চাই না। আমার চকলেট ফেরত দাও। রাহাত অনুনয় করে বলল, ভুল করেছি। ক্ষমা কর। নিবিড় হাত জোর করে বলল, খেয়ে ফেলা জিনিস তো আর ফিরিয়ে দিতে পারব না। কিন্তু এমন চকলেট এনে দেওয়ার চেষ্টা করব। শফিক কান্নাভেজা কণ্ঠে বলল, আমাদের ছেড়ে দাও। আমরা পালাব না কথা দিচ্ছি। মেয়েটি কী যেন ভাবল। তারপর চোখমুখ কঠিন করে বলল, মাত্র একদিন সময় দিলাম। মেয়েটি এই বলে অদৃশ্য হয়ে গেল। তিন বন্ধু ঊর্ধ্বশ্বাসে ছুটতে লাগল।
মধ্যরাত। সুনসান নীরবতা। রাহাত, নিবিড় আর শফিক ঘুমানোর চেষ্টা করছে। কিন্তু ঘুমাতে পারছে না। ওদের মাথায় একটাই চিন্তা। এমন চকলেট কোথায় পাব? যদি না পাই তাহলে কী হবে? তিন বন্ধু ভিন্ন বাড়িতে থাকলেও ওদের মনের কথা যেন একে অপরের কাছে পৌঁছে যাচ্ছিল। হঠাৎ হাসির শব্দ! হি হি হি। নিবিড় হুরমুর করে উঠে বসল। ধরাস ধরাস করছে বুক। নিজেকে সামলে নিয়ে বাতি জ্বালাল। দেখল কেউই নেই। রাহাত ঘুমানোর চেষ্টা করছে। কিন্তু চোখ বন্ধ করলেই ভয়ংকর সেই মেয়েটির মুখ ভেসে উঠছে। শেষ রাতের দিকে চোখ বুজে এলো রাহাতের। ধারালো পাঁচটি নখ রাহাতকে খামচে দিল। ওমনি হাত-পা ছুড়তে ছুড়তে রাহাত জেগে উঠল। চেঁচিয়ে বলল, কে? কে আমাকে খামচে দিল? কোনো উত্তর এলো না। রাহাত আপাদমস্ত কাঁথা মুড়ি দিয়ে বসে রইল। শফিক ওয়াশরুমের দরজা খুলে চিৎকার দিয়ে পিছিয়ে গেল। সন্ধ্যায় দেখা ভয়ংকর সেই মেয়েটা। ঝরনার নিচে দাঁড়িয়ে আছে। শফিক এক দৌড়ে ঘর থেকে বের হয়ে হাঁপাতে লাগল। তিন বন্ধু ভয়ংকর একটা রাত কাটাল।
পরদিন রাত জাগা চোখ নিয়ে ওরা স্কুলে উপস্থিত হলো। কিন্তু কেউই ক্লাসে মনোযোগ দিতে পারল না। স্কুল ছুটি হওয়ার পরপরই ওরা বেরিয়ে গেল। রাহাত চিন্তিত মুখে বলল, চকলেট খুঁজে পেতেই হবে। নিবিড় সম্মতি জানিয়ে বলল, তা তো অবশ্যই। বিষয়টা আব্বু-আম্মুর সঙ্গে শেয়ার করলে ভালো হতো। তাহলে বুদ্ধি পাওয়া যেত। শফিক বলল, যেহেতু শেয়ার করিনি। এখন নিজেদের বুদ্ধিতেই কাজ করতে হবে। ওরা এ দোকান, সে দোকান ঘুরতে লাগল। সন্ধ্যা ঘনিয়ে এলো। কিন্তু কোথাও লাল প্যাকেটের চকলেট পাওয়া গেল না।
ওরা হাঁটছে। ভয়ংকর সেই গন্তব্যের দিকে। ওরা জানে না কী হবে তারপর? তবু এগিয়ে যাচ্ছে। নিবিড় বলল, আমরা পালিয়ে যাব না। শফিক মাথা দুলিয়ে বলল, হ্যাঁ আমরা কথা দিয়েছিলাম। রাহাত আত্মবিশ্বাসের সঙ্গে বলল, আমরা সৃষ্টির সেরা তা দেখিয়ে দিতে হবে। তিন বন্ধু কথা বলতে বলতে এসে দাঁড়াল বিশাল আকৃতির সেই গাছের নিচে। ঠিক তখনই খিলখিল হাসিতে কেঁপে উঠল চারপাশ। ভয়ংকর সেই মেয়ে সামনে এসে দাঁড়াল। চোখমুখ কঠিন করে জানতে চাইল, আমার চকলেট কোথায়? তিন বন্ধু একসঙ্গে উত্তর দিল, পাইনি। বহু খুঁজেছি। না পাওয়ার কারণ হচ্ছে আমরা চকলেটের নাম জানি না। মেয়েটি রাগান্বিত স্বরে বলল, জানতাম তোমরা পাবে না। তাহলে কেন এসেছো এখানে? ভয়ংকর পরিণতি দেখতে? রাহাত সাহস করে উত্তর দিল, হ্যাঁ, আমরা কথা দিয়েছিলাম। তাই ভাগ্যে যা আছে মেনে নেব। মেয়েটির ধারালো নখ লম্বা হতে শুরু করল। এমন সময় নিবিড় বলল, আমরা যদি পালিয়ে যেতাম তাহলে আমাদের ভীতু ভাবতে। শফিক গর্বের সঙ্গে বলল, আমরা সৃষ্টির সেরা তা কথা ও কাজে প্রমাণ করতে হবে। আমাদের ভয়ংকর বানিয়ে দিতে চাইলে বানিয়ে দাও। কিন্তু মনে রেখো, আমরাই জিতে যাব। মেয়েটি কর্কশ কণ্ঠে চেঁচিয়ে উঠল। না, না, যাও তোমাদের ছেড়ে দিলাম। তোমরা খুব সাহসী আর বুদ্ধিমান। তোমাদের মতো মানুষ, এই মানুষরাজ্যে প্রয়োজন আছে। তবে মনে রেখো, এই প্রথম ও শেষবার সুযোগ দিলাম। আর কখনো পথে কুড়িয়ে পাওয়া জিনিস খাবে না। হতে পারে ওটা কারো পছন্দের। হতে পারে ওটা কারো কষ্টের উপার্জিত টাকায় কেনা। হতে পারে ওটা খুবই ক্ষতিকর। তাই কুড়িয়ে পাওয়া জিনিস একদম খাবে না।