অনেককাল আগের কথা। রাজনগর নামে এক রাজ্য ছিল। এ রাজ্যের রাজা খুযাইমাহ যেমন বড় হৃদয়ের, তেমনই দয়ালু। প্রজাদের মঙ্গলই তার জীবনের বড় অভিপ্রায়।
এক দিন রাজা প্রাসাদের বাগানে হেঁটে হেঁটে গভীর চিন্তায় ডুবে আছেন। মন্ত্রী ও প্রধান পণ্ডিতও আশপাশে চুপচাপ দাঁড়িয়ে...
রাজা হঠাৎ বলে উঠলেন, কল্পনাও করিনি পরিস্থিতি এত খারাপ হবে! পানির জন্য মানুষ হাহাকার করছে, ফসল পুড়ে যাচ্ছে রোদের তাপে। মন্ত্রী, আপনি বলেছিলেন না গুদামে তিন মাসের খাদ্য মজুত আছে?
মন্ত্রী মাথা নিচু করে বললেন, জি রাজা মশাই, ঠিক তাই। তবে গত এক বছরে এক ফোঁটাও বৃষ্টি হয়নি। খাল, বিল, পুকুর, নদী সব শুকিয়ে গেছে।
পণ্ডিত তখন বললেন, মহারাজ, যদি আমরা রাস্তা তৈরি করতে গিয়ে গাছ কেটে ফেলার বদলে নতুন চারাগাছ লাগাতাম তবে হয়তো আজ এই খরা আসত না। গাছ থাকলে মেঘ ভেসে আসত।
রাজার মুখে অস্থিরতা ফুটে উঠল। ‘এখন এসব ভেবে লাভ নেই’, বললেন তিনি।
পণ্ডিত শান্তস্বরে বললেন, রাজামশাই, আমাদের গবেষণাগারে এক বিশেষ বীজ আবিষ্কৃত হয়েছে। এ বীজ একবার রোপণ করলে মেঘ ডেকে আসে! এক হাজার গ্রামে এ বীজ ছড়িয়ে দিতে পারলে বৃষ্টি ফিরিয়ে আনা সম্ভব!
রাজা একটু বিরক্ত হয়ে বললেন, পণ্ডিত, এখনই যখন খরা, তখন আপনি দুই বছর পর গাছ হওয়ার কথা বলছেন? এতে কোনো লাভ নেই।
হে রাজা সাহেব, একবার চেষ্টা করে দেখুন। আপনাকে কথা দিচ্ছি চমক পাবেন!
রাজা কিছুক্ষণ চুপ থেকে মাথা নেড়ে রাজি হলেন। বললেন, আচ্ছা, পণ্ডিতের কথামতো কাজ শুরু হোক। তবে পানি কোথায় পাব বীজে ঢালার?
ঠিক তখনই রাজপুত্র এগিয়ে এলো।
বাবা, আমি ও পণ্ডিত একসঙ্গে বেরিয়ে পড়ছি। বৃষ্টির দেশে গিয়ে পানি নিয়ে আসব! আজই লোকজনকে পুকুর, কূপ ও নদীগুলো পরিষ্কার করার নির্দেশ দিন।
রাজার আদেশে রাজ্যজুড়ে হইচই পড়ে গেল। প্রজারা দলবেঁধে এক দিনেই সব জলাধার পরিষ্কার করে ফেলল।
পরদিন ভোরে রাজপুত্র ও পণ্ডিত রওনা দিলেন এক ডানাওয়ালা উড়ন্ত ঘোড়ায়। আকাশে উড়তে উড়তে তারা খুঁজতে লাগলেন বৃষ্টির দেশ। হঠাৎ বিদ্যুৎ চমক দেখা দিল দূরে। সেদিকে এগোতেই তারা দেখতে পেল এক শুকনো মাঠে পড়ে আছে একটি ছোট পাখি।
পাখিটি মানুষের কণ্ঠে বলছে, আহা! জ্বলে গেলাম, পুড়ে গেলাম! আমার কানের মধ্যে পিঁপড়া কামড়াচ্ছে!
রাজপুত্র হেসে পিঁপড়াটি বের করে দিল। পাখিটি কৃতজ্ঞ হয়ে উত্তর-পূর্বের দিকে তাকিয়ে বলল, ওদিকে বৃষ্টি হচ্ছে। তবে সময় কম। একটু পরেই বন্ধ হয়ে যাবে!
রাজপুত্র ঘোড়া ঘুরিয়ে দিল। ঘণ্টাখানেকের মধ্যে তারা পৌঁছে গেল মায়াপুরী দেশের সীমান্তে। তুমুল বৃষ্টি হচ্ছে, রাস্তা জলে ডুবে আছে। একটি ছোট বাড়ির সামনে নেমে তারা এক কৃষকের দেখা পেল। রাজপুত্র বলল, আমরা রাজনগর থেকে এসেছি। বৃষ্টির পানি চাই, আমাদের দেশে খরা।
কৃষক হেসে বলল, এই বৃষ্টি তো সবার। তোমরা যত খুশি নিয়ে যাও। এ দেশে সবাই পরোপকারী, কেউ খারাপ কাজ করে না। তাই নিয়মিত বৃষ্টি হয়। আমাদের পানিতে যে কোনো শুকনো জমিতে সেচ দিলে সেখানেই গাছ গজাবে, ফসল ফলবে।
তারা দ্রুত পানি সংগ্রহ করল বড় পাত্রে। রাজপুত্র ও পণ্ডিত ফিরলেন রাজ্যে।
এদিকে রাজা রাজ্যের প্রতিটি গ্রামে বিশেষ সৈন্য পাঠিয়ে দিয়েছেন। ঘোড়ার পিঠে দ্রুত পৌঁছে গিয়ে গ্রামবাসী গর্ত খুঁড়ে বীজ পুঁতেছে, ঢেলেছে সেই আজব বৃষ্টির পানি। রাজপ্রাসাদের সামনেও একটি বীজ পোঁতা হলো। কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই মাটি ফেটে বেরিয়ে এলো এক বিস্ময়কর চারাগাছ।
রাত পেরোতেই তা হয়ে গেল তালগাছের চেয়েও উঁচু। এর ডালপালা মেঘকে টেনে আনল আকাশ থেকে। মেঘ জমে বজ্রসহ বৃষ্টি নামল রাজনগরে।
পরদিন পুরো রাজ্যজুড়ে জলে টইটম্বুর। পুকুর, নদী, হ্রদ, কূপ সব পানিতে ভরে গেল। সবাই খুশিতে আত্মহারা।
রাজা পণ্ডিতকে পুরস্কৃত করলেন।
পণ্ডিত বললেন, রাজামশাই, এ গাছগুলো এক দিনেই ঝরে পড়বে; কিন্তু সত্যিকার বৃষ্টি চিরকাল পেতে চাইলে একটা কাজ করতে হবে। মানুষের মধ্যে ভালো কাজের অভ্যাস গড়ে তুলুন। সবাই যেন পরোপকারী হয়। তাহলেই প্রকৃতি নিজেই আসবে।
পরদিন রাজা ঘোষণা করলেন, শুধু নিজের জন্য নয়, অন্যের মঙ্গল চেয়ে কাজ করবে। সত্যিই, তারপর আর খরা আসেনি।