মঙ্গলবার, ৩ মার্চ, ২০১৫ ০০:০০ টা

দোহাই সংঘাত থেকে সরে আসুন

হাসান আহমেদ চৌধুরী কিরণ

দোহাই সংঘাত থেকে সরে আসুন

দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের বর্ষপূর্তি উপলক্ষে ঢাকায় সমাবেশ করতে না পারায় ৫ জানুয়ারি থেকে বিএনপি নেতৃত্বাধীন ২০-দলীয় জোটের টানা অবরোধের কবলে পড়েছে দেশ। অবরোধের ভিতর সাপ্তাহিক ছুটি বাদে অন্যদিনগুলোতে চলছে হরতাল। সারা দেশের মানুষ বাস করছে চরম নিরাপত্তাহীনতায়। ঝুঁকির মধ্যে কাটছে তাদের দিন। রাস্তায় নামতেও তাদের ভয়। কথায় কথায় পেট্রলবোমার শিকার হচ্ছে তারা। আর মুহূর্তের মধ্যে সুস্থ-স্বাভাবিক মানুষের ঠিকানা হচ্ছে হাসপাতালের বার্ন ইউনিটে। অন্যদিকে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর অভিযান-আটক-জিজ্ঞাসাবাদের সঙ্গে সঙ্গে বেড়েছে বিচারবহির্ভূত শাস্তির ঘটনা। সমাজের সর্বস্তরে এখন আতঙ্ক-ভয় যেন সবকিছুকে গ্রাস করে ফেলেছে। কে, কখন আগুনে পুড়ে মারা যায়, গ্রেফতার হয় তা কেউ বলতে পারে না। এ অবস্থায় দিশাহারা হয়ে উঠছে সাধারণ মানুষ। রাজনৈতিক প্রতিহিংসায় জ্বলছে যানবাহন, জ্বলছে মানুষ, জ্বলছে দেশ, পুড়ছে অর্থনীতি। ১৯৭১ সালের মহান মুক্তিযুদ্ধের পর এমন বিপর্যয়কর অবস্থা আর সৃষ্টি হয়নি। এর মধ্যে মালয়েশিয়ায় সাত বছর প্রবাস জীবনের পর হঠাৎ লাশ হয়ে ফিরলেন শহীদ রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান ও বেগম খালেদা জিয়ার কনিষ্ঠ পুত্র আরাফাত রহমান কোকো। ২৪ জানুয়ারি শনিবার কুয়ালালামপুরে তার আকস্মিক মৃত্যু রাজনৈতিক গগনে এক বিষাদের ছায়া ফেলেছে। রাজনৈতিক পরিবারের সন্তান হলেও রাজনীতিতে তার সম্পৃক্ততা ছিল না।

ছেলের হঠাৎ মৃত্যুতে দুঃসহ বেদনার মুখোমুখি হন খালেদা জিয়া। তার হৃদয়ভাঙা কান্নায় বাংলাদেশের আকাশ-বাতাস যেন ভারি হয়ে গেছে। জিয়াউর রহমানের মৃত্যুর পর বেগম খালেদা জিয়া দুই সন্তানকে বুকে আগলে রেখে জীবনের বাকি সময়টা পার করতে চেয়েছিলেন। রাজনৈতিক আদর্শের ভিন্নতায় মানবিকতার বিপর্যয়কর চিত্র প্রত্যক্ষ করছে বাংলাদেশের মানুষ। কফিনের বাঙ্ েথাকা ছেলের দুই গালে হাত বুলিয়ে বেগম জিয়া বললেন, 'আমার বাবার মুখটা ঢেকে দিও না, বাবাকে আরেকটু দেখি; কোকোরে শেষবার মা বলে ডাক।' চোখের পানিতে ভেজা আবেগাপ্লুত এই কথাগুলো বের হওয়ার পর আর কোনো কথা বললেন না খালেদা জিয়া। নীরবে শুধুই কাঁদছিলেন। সে এক হৃদয়বিদারক দৃশ্য। মায়ের বিদায়ের পর যখন জানাজার জন্য কোকোর মৃতদেহ বায়তুল মোকাররমে আনা হলো তখন লক্ষাধিক মানুষের উপস্থিতি। দেখে মনে হয় জানাজায় মানুষের ঢল নেমেছে। একজন অরাজনৈতিক ব্যক্তির জানাজায় বিপুল মানুষের উপস্থিতি তার পিতার জানাজার কথাই মনে করিয়ে দেয়। উপস্থিত অনেকের মুখে ছিল সেই উচ্চারণ। জীবন ছোট। তাই বলে এত ছোট কেন হবে। মাত্র ৪৫ বছরে কোকোর চলে যাওয়া নিদারুণ কষ্টের, সেই সঙ্গে আক্ষেপেরও বটে। কেননা দীর্ঘ সাতটি বছর মায়ের অকৃত্রিম স্নেহ-ভালোবাসা থেকে তিনি বঞ্চিত ছিলেন। মায়ের সানি্নধ্যের দীর্ঘ অভাব তার হৃদয়কে ক্ষত-বিক্ষত করেছে। তাই প্রশ্ন জাগে এভাবে তার অকালে চলে যাওয়ার দায়ভার আসলে কার? তবে কোকোর এই অকাল মৃত্যুর পর স্মরণ করিয়ে দেয় ইন্দিরা গান্ধীর কথা। তার কনিষ্ঠ তনয় সঞ্জয় গান্ধীও এরকম অপরিণত বয়সে প্লেন দুর্ঘটনায় নিহত হয়েছিলেন। বেগম খালেদা জিয়ার জীবনেও একই ঘটনার পুনরাবৃত্তি হলো।

অন্যদিকে কোকোর মৃত্যু সংবাদ জানার পর সমবেদনা জানাতে খালেদা জিয়ার উদ্দেশে প্রধানমন্ত্রীর ছুটে যাওয়া, আবার ব্যর্থমনোরথে ফিরে আসা জাতিকে হতাশ করেছে। কেননা সব শ্রেণি-পেশার মানুষ বর্তমান উদ্ভূত রাজনৈতিক সংকটের সমাধান চায়। সেক্ষেত্রে বেগম খালেদা জিয়ার গুলশান কার্যালয়ে অবস্থানরত প্রেস উইংয়ের সদস্যের অর্বাচীন আচরণ, ক্ষুদ্র মানসিকতা আমাদের আহত করে। যদিও পুরো বিষয়টা বেগম জিয়া জানতেন না। তারপর থেকে রাজনীতি চলছে আরও অসহিষ্ণু পথে। ডেমরা ও কুমিল্লায় সংঘটিত গাড়িতে পেট্রলবোমা নিক্ষেপের দায়ে মানুষ ও গাড়ি পোড়ানো মামলায় খালেদা জিয়াকে হুকুমের আসামি করা হয়েছে। দেশের মানুষ রাজনৈতিক কৌশল বা খেলার চেয়ে বরং সমস্যার যৌক্তিক সমাধানে দুই নেত্রীর খোলামেলা আলাপ-আলোচনা প্রত্যাশা করে। সরকার ও বিরোধী রাজনৈতিক জোটের কৃতকর্মে বিপন্ন হচ্ছে মানবাধিকার। পেট্রলবোমায় ও কথিত বন্দুকযুদ্ধে ক্রমান্বয়ে লাশের সংখ্যা বৃদ্ধি এ দেশের মানুষ আর দেখতে চায় না। রাজনৈতিক দলের উদ্দেশ্য যদি হয় মহৎ, মানবিক মূল্যবোধ ও মানবতাকে সমুন্নত করা, মানুষের অধিকারকে মূল্যায়ন করা, পরমতকে অগ্রাধিকার দেওয়া- তাহলে সেখানেই কেবল গণতন্ত্র-সুশাসন প্রতিষ্ঠা সম্ভব, অন্যথায় নয়। আর গণতন্ত্রের প্রথম শর্ত হলো জনসমর্থনের ওপর সরকার গঠন করা। একতরফা নির্বাচন কিংবা রাষ্ট্রক্ষমতায় অধিষ্ঠিত থেকে প্রশাসনকে জনগণের বিরুদ্ধে ব্যবহার করা যেমন সমীচীন নয়, তেমনি পেট্রলবোমা ছুড়ে যারা মানুষ মারছে তারাও বন্য ও আদিম হিংস্রতায় চরম মানবতাবিরোধী কাজ করছে, যা মোটেই গ্রহণযোগ্য নয়। গণতন্ত্রের শোভা শক্তিশালী বিরোধী দল। আর সেখানে যদি বিরোধী দলকে উপেক্ষা করার রাজনীতি শুরু হয় তবে তা গণতন্ত্রের জন্য মঙ্গল ডেকে আনবে না। অসহিষ্ণু ও চরমপন্থা থেকে অবশ্যই ফিরে আসতে হবে। বাঁকা পথে কখনো জনগণকে সত্য ও ন্যায়ের অধিকার থেকে ফেরানো যায় না। এতে যে হিতেবিপরীত হতে পারে, তা সবার বোঝা উচিত। চলমান অচলাবস্থার রাজনৈতিক সমাধানের বদলে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীপ্রধানদের 'যে কোনো মূল্যে পরিস্থিতি মোকাবিলা করার যে নির্দেশ' তা সবার জন্য উদ্বেগের বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। বাংলাদেশের সংবিধান ও প্রচলিত আইনকানুন কোনো ব্যক্তি বা গোষ্ঠীকে আইনের ঊর্ধ্বে ওঠার সুযোগ দেয় না।

সরকার যেখানে বর্তমান সমস্যাকে রাজনৈতিক সমস্যা না বলে আইনশৃঙ্খলার সমস্যা বলছে, সেখানে বিরোধী রাজনৈতিক জোটসহ সুশীল সমাজ বলছে এটা রাজনৈতিক সংকট। বৃহত্তর পরিসরে সরকারের দায়িত্ব অনেক। দায় চাপানোর সংস্কৃতি থেকে বেরিয়ে এসে আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে চলমান সংকটের সমাধানের ইঙ্গিত দিচ্ছেন রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা। কোনো অনড় অবস্থান রাজনৈতিক সংকটকে দীর্ঘায়িত করলে মুখ্যত রাষ্ট্র ক্রমাগত দুর্বল হতে পারে। গণতন্ত্র ও সুশাসন মুখ থুবড়ে পড়তে পারে। উন্নয়ন ও অগ্রগতির অর্জিত সম্ভাবনাগুলো তখন বিনষ্ট হয়ে যাবে। উগ্রবাদের বিকাশ হলে রাষ্ট্রের সব নাগরিক চরম নিরাপত্তাহীনতার মধ্যে পড়ে যাবে। প্রকৃত সহিংসতাকারী ও সন্ত্রাসীদের চিহ্নিত করে আইনের অধীনে এনে বিচার করা অসম্ভব হয়ে পড়বে। তাই জনগণসহ নাগরিক সমাজ মনে করে ব্যক্তি ও গোষ্ঠীস্বার্থে আইন এবং বিচার নিজ হাতে তুলে নেওয়া কোনোভাবেই উচিত নয়। জনগণের মনের অভিপ্রায় ক্ষমতাসীন কিংবা বিরোধী জোট না বুঝলে হঠাৎ করে এই জনগণ তাদের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াতে পারে। সে কথা উপলব্ধি করা প্রয়োজন সংশ্লিষ্ট সবার। পরিশেষে বলা যায়, বর্তমান সংকটের শুরু সেই ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারির নির্বাচনের পর থেকে। মোটাদাগে বলা যায়, সংবিধানে সনি্নবেশিত 'তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা' বাতিল ও এর প্রয়োগের পর থেকেই মূল সংকটের উদ্ভব বলে মনে করে বিএনপি ও ২০-দলীয় জোট। আর এই সমস্যা-সংকট থেকে আমরা কেউ মুক্তি পাচ্ছি না। রাজনৈতিক ক্ষমতার মোহে ও দ্বন্দ্বে সামাজিক বিভেদটা এমন এক পর্যায়ে গিয়ে ঠেকেছে যেখানে যুক্তি-বুদ্ধি-সত্যের কোনো স্থান নেই। সাধারণ মানুষের বুকফাটা আর্তনাদের কোনো মূল্য নেই। মূল্য নেই তাদের বেঁচে থাকার আকুতির। আমরা মুক্তিযুদ্ধের কথা বলি কিন্তু মুক্তিযুদ্ধের মূল চেতনার ধারেকাছেও নেই আমরা। গণতান্ত্রিক চেতনার কথা বলি কিন্তু তার প্রত্যাশা ও প্রাপ্তির ফারাক যেন যোজন যোজন দূর। এত ছোট দেশে বিভেদের প্রাচীর যেন পাহাড়সম। অথচ পাশের দেশ ভারতে বৈচিত্র্যময় বহুত্ববাদী সমাজের মধ্যেও গণতন্ত্রের অভিযাত্রা ও প্রাতিষ্ঠানিকীকরণ কী চমৎকারভাবে এগিয়ে চলেছে। সেখানকার রাজনৈতিক সংস্কৃতি সব মত-পথ-আদর্শকে ধারণ করেছে; জাতীয় ঐক্য প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। আর আমাদের এখানে রাজনীতিকদের একতরফা, একগুঁয়েমি ও ভুল সিদ্ধান্ত গ্রহণের কারণে প্রত্যাশিত গণতন্ত্র যেমন হোঁচট খাচ্ছে তেমনিভাবে সাধারণ মানুষের দুর্ভোগ বাড়ছে। এ অবস্থা থেকে আমাদের অবশ্যই সরে আসতে হবে। সংঘাতের পথ এড়িয়ে সরকার ও বিরোধী পক্ষের মধ্যে কীভাবে আস্থার সম্পর্ক গড়ে তোলা যায় সে পথে এগোতে হবে। দুই প্রধান দলের প্রতি আবেদন দোহাই সংঘাতের রাজনীতি থেকে সরে আসুন। সংলাপের মাধ্যমে বিরাজমান সংকটের গ্রন্থিমোচনে এগিয়ে আসুন। তাতেই সবার মঙ্গল।

লেখক : চেয়ারম্যান, ডিবেট ফর ডেমোক্রেসি।

ই-মেইল :[email protected]

 

সর্বশেষ খবর