রবিবার, ১৮ নভেম্বর, ২০১৮ ০০:০০ টা

পাকিস্তান বদলায়নি, বদলাবে না

আফরোজা পারভীন

পাকিস্তান বদলায়নি, বদলাবে না

পাকিস্তানের পাঞ্জাব প্রদেশের শেখুপাড়া জেলার ইথান ওয়ালি গ্রামের আসিয়া বিবির কথা আমাদের জানার কথা নয়। আসিয়া এলাকার রাজমিস্ত্রি আশিক মানিহর দ্বিতীয় স্ত্রী, দুই পক্ষ মিলে পাঁচ সন্তানের জননী। খেত-খামারে কাজ করে সংসার চালাতেন তিনি। তার জীবনকাহিনী ওই গ্রাম এমনকি যে পাড়ায় তিনি বাস করতেন সেখানেই সীমাবদ্ধ থাকার কথা। কিন্তু আজ বিশ্বব্যাপী উচ্চারিত হচ্ছে তার নাম গভীর মমতায়। যদিও তার বিপক্ষে রয়েছেন কিছু ধর্মান্ধ মৌলবাদী মানুষ।

আসিয়া বিবি খ্রিস্টধর্ম সম্প্রদায়ের। এলাকার হিন্দু-মুসলিম-খ্রিস্টান সবার সঙ্গেই ছিল তার সখ্য। কিন্তু এ সখ্য রইল না। ২০০৯ সালের জুনের কোনো একদিন খেতে কাজ করার সময় সহকর্মী নারীদের সঙ্গে পানি নিয়ে ঝগড়া বাধে তার। এ সময় তিনি নাকি মহানবী (সা.)-কে নিয়ে তিনটি অবমাননাকর মন্তব্য করেন। তা ছাড়া তিনি একটি বাটি দিয়ে বালতির পানি পান করেন। তাতে নাকি ওই পানি অপবিত্র হয়ে যায়। তখন ঝগড়ারত নারীরা তাকে ইসলাম গ্রহণ করতে বলেন। তাতে নাকি অপবিত্র পানি পবিত্র হবে। আসিয়া অসম্মত হলে ওই তিন নারী স্থানীয় চার্চে বিচার দেন। কিন্তু চার্চের বিচার তাদের মনঃপূত না হওয়ায় পরবর্তীতে আদালতে মামলা করেন। ওই মামলায় ২০১০ সালে শেখুপাড়ার নিম্ন আদালত আসিয়াকে মৃত্যুদ- দেয়। আসিয়ার পক্ষে কথা বলার জন্য পাঞ্জাবের গভর্নর সালমান তাসিরকে দিনে-দুপুরে গুলি করে হত্যা করে মমতাজ কাদিরি নামের এক লোক।

২০১৪ সালে আদালতের এই রায়ের বিরুদ্ধে হাই কোর্টে আপিল করলে হাই কোর্টও একই রায় বহাল রাখে। ২০১৫ সালে সুপ্রিম কোর্টের দ্বারস্থ হন আসিয়া। সুপ্রিয় কোর্ট এ মামলা থেকে আসিয়া বিবিকে বেকসুর খালাস দেয়। রায়ে বলা হয়, সন্দেহাতীতভাবে অভিযোগ প্রমাণে ব্যর্থ হয়েছে বাদীপক্ষ। তা ছাড়া তুচ্ছ ঘটনা নিয়ে করা এ মামলায় যথাযথ প্রক্রিয়াও অনুসরণ করা হয়নি। মারের কারণে বাধ্য হয়ে তিনি অপরাধ স্বীকার করেছেন। তাই মৃত্যুদন্ড বাতিল করে খালাস দেওয়া হয়েছে তাকে। আসিয়া বিবির বিরুদ্ধে অন্য কোনো মামলা না থাকলে তিনি মুক্তি পেতে পারেন বলেও উল্লেখ করেছে আদালত।

এদিকে রায় ঘোষণার পর উত্তাল হয়ে পড়ে পুরো পাকিস্তান। ইসলামাবাদ, রাওয়ালপিণ্ডি, করাচি, লাহোরসহ বড় বড় শহরে বিক্ষোভ ছড়িয়ে পড়ে। বিভিন্ন প্রদেশের বড় বড় শহরে অবস্থান নিয়ে মুসলমানরা বিক্ষোভ চালায়। রায়ের পর কট্টর ডানপন্থিরা দেশটিকে অস্থিতিশীল করার চেষ্টা করছে। ১৩ অক্টোবর ধর্মভিত্তিক রাজনৈতিক দল তেহরিক-ই-লাব্বাইক (টিএলপি) আসিয়াকে মুক্তি দিলে দেশ অচল করে দেওয়ার হুমকি দেয়। পার্টির নেতা মুহাম্মদ আফজাল কাদরি আদালতের তিন বিচারকের মৃত্যুদ- প্রাপ্য বলে ঘোষণা করেন। এসব ঘটনায় ইসলামাবাদের রেড জোন এলাকা (সুপ্রিম কোর্ট যেখানে অবস্থিত) সিল করে দেয় পুলিশ। আসিয়া বিবির আইনজীবী সাইফ মালুক প্রাণভয়ে দেশ ছেড়ে পালিয়ে গেছেন। আসিয়া বিবি ২০১০ সাল থেকে মৃত্যুদ-াদেশ মাথায় নিয়ে জেলে আছেন। তিনি বরাবরই নিজেকে নির্দোষ দাবি করে বলেছেন, এক বাটি পানি নিয়ে মেয়েদের মধ্যকার বিতর্ককে কেন্দ্র করে তাকে ফাঁসানো হয়েছে।

আসিয়ার মৃত্যুদ- হয়েছে ব্ল­াসফেমি আইনে। পাকিস্তানের রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম। ইসলাম অবমাননা সেখানে মারাত্মক অপরাধ। শুধু আসিয়াই নন, ব্ল­াসফেমি আইন সংস্কার ও আসিয়া বিবির মামলাকে ত্রুটিপূর্ণ বলায় ২০১১ সালে হত্যা করা হয় সংখ্যালঘুমন্ত্রী শাহবাজ ভাট্টিকে।

যে ব্ল­াসফেমি নিয়ে এত কথা সে ব্লাসফেমির উদ্ভব হয়েছিল প্রাচীন ও মধ্যযুগে। এখন থেকে প্রায় সাড়ে চৌদ্দ শ বছর আগে রোমের সামন্ত রাজারা প্রতিক্রিয়াশীল মৌলবাদী খ্রিস্টান ক্যাথলিক চার্চের যাজকদের সহায়তায় জনগণের ওপর ধর্মের নামে অত্যাচারের হাতিয়ার হিসেবে ব্লøাসফেমি ব্যবহার শুরু করেন। তারপর ব্ল­াসফেমি শুরু হয় ইসলাম ধর্মে। মুসলিম মৌলবাদীরা দখল করে নেয় খ্রিস্টান মৌলবাদীদের ব্ল­াসফেমি আইন। ধর্মের ব্যাপারে তারা এক না হলেও অত্যাচারের হাতিয়ার হিসেবে ব্ল­াসফেমিকে দুই পক্ষই পছন্দ করতে থাকে।

আসিয়াকে মুক্তিদানের ঘটনা এবং পরবর্তীতে পাকিস্তানে সহিংস বিক্ষোভের পর প্রাণভয়ে পালিয়ে বেড়াচ্ছিল আসিয়ার পরিবার। তার স্বামী আশিক মাসিহর বলেছেন, তারা মৃত্যুভয় নিয়ে জীবনযাপন করছেন। এর আগে ডয়েচে ভেলের সঙ্গে এক সাক্ষাৎকারেও তিনি একই কথা বলেন। তিনি আমেরিকা, কানাডা, ব্রিটেনসহ কয়েকটি দেশে রাজনৈতিক আশ্রয়ের জন্য আবেদন করেছেন। কয়েকটি দেশ তাদের আশ্রয়দানের আশ্বাসও দিয়েছে। কিন্তু পাকিস্তান সরকার ইতিমধ্যে তেহরিক-ই-লাব্বাইকের সঙ্গে একটি চুক্তি স্বাক্ষর করেছে; যাতে আসিয়া বিবির দেশত্যাগের ওপর নিষেধাজ্ঞা জারি করা হয়েছে। অর্থাৎ আদালত তাকে মুক্তি দিলেও যে কোনো সময় উগ্র মৌলবাদীদের হাতে তার প্রাণসংশয় হতে পারে। পাকিস্তানের তথ্যমন্ত্রী বলেছেন, ‘আসিয়ার নিরাপত্তার যথেষ্ট ব্যবস্থা করা হয়েছে। তার কোনো প্রাণের ঝুঁকি নেই। পরিস্থিতি শান্ত করতে সরকার এটা করছে। এটা আগুনে পানি ঢালার মতো।’ কিন্তু যেখানে প্রকাশ্য দিবালোকে গভর্নর-মন্ত্রী রক্ষা পান না মৌলবাদীদের হাত থেকে, সেখানে আসিয়া রক্ষা পাবেন এমন কোনো নিশ্চয়তাই নেই।

আসিয়া রসুল (সা.)-এর বিরুদ্ধে অবমাননাকর কথা বলেছেন বলা হচ্ছে। কিন্তু কী বলেছেন সে কথা কোথাও আসেনি। আসিয়ার বাড়ি গিয়ে যখন নারীরা মারধর করে তখন তিনি স্বীকার করেছেন বলে জানা যায়। আদালত বলেছে, সেই পরিস্থিতির কারণে বাধ্য হয়েই তিনি স্বীকার করেছেন। সবচেয়ে বড় কথা, তিনি কী বলেছেন তা কেন উল্লেখ করা হচ্ছে না। আসিয়া বিবির দেশত্যাগের ওপর নিষেধাজ্ঞা জারি করে পাকিস্তান সরকার চুক্তি করায় বিশ্বব্যাপী নিন্দার ঝড় ওঠে। পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী ইমরান খানের সাবেক স্ত্রী জেমিমা গোল্ডস্মিথ তার এ কাজের কঠোর সমালোচনা করেছেন।

রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম হলেই অন্য ধর্মের মানুষের প্রতি নির্যাতন, তাদের ওপর জবরদস্তি করা যায় না। তা ইসলামও সমর্থন করে না। প্রত্যেক নাগরিক তার নিজ নিজ ধর্মবিশ্বাস নিয়ে স্বাধীনভাবে বাস করবে। অন্য ধর্ম গ্রহণ করার জন্য কারও ওপর চাপ সৃষ্টি করা যাবে না এটাই ধর্ম, এটাই মানবিকতা।

মানবিক আচরণ পাকিস্তান কোনো দিনই করতে জানত না, আজও শেখেনি। ধর্মকে অবলম্বন করে দ্বিজাতিতত্ত্বের ধুয়া তুলে দেড় হাজার মাইল দূরের একটি দেশকে নিজের দেশের সঙ্গে জুড়ে দিয়ে দীর্ঘ ২৩ বছর শাসন করেছে পাকিস্তান। শুষে নিয়েছে তাদের সম্পদ, লুণ্ঠন করেছে রাজকোষ। বাঙালিদের মেধাশূন্য করার জন্য বড় বড় পদে পাকিস্তানিদের বসিয়ে বাঙালিদের দিয়েছে কেরানির চাকরি। বাংলার কলকারখানার উৎপাদনের অর্থ দিয়ে সাজিয়েছে পাকিস্তানকে। দুঃখিনী বাংলা হয়েছে দরিদ্র থেকে দরিদ্রতর।

বরাবরই নারী নিরাপত্তা নয়, নারীর প্রতি সহিংসতায় তৎপর পাকিস্তান। ১৯৭১ সালেও তারা একই কাজ করেছে। তখন তারা করেছে বাংলাদেশের নারীর ওপর অমানবিক ঘৃণ্য আচরণ। আর আজ ধর্মের দোহাই দিয়ে নিজ দেশের অন্য ধর্মের নারীর প্রতি তুচ্ছ কারণে এত বড় অবিচার করল! তার পুরো পরিবারটিকে ফেলল অশেষ দুর্গতিতে।

পাকিস্তানে এটা নতুন বা বিচ্ছিন্ন কোনো ঘটনা নয়। শিক্ষা ও মানবাধিকার কর্মী ১৭ বছর বয়সী সর্বকনিষ্ঠ নোবেল বিজয়ী মালালা ইউসুফজাইয়ের সঙ্গে পাকিস্তান কী করেছিল তাও বিশ্ববাসীর জানা। স্কুলবাসে তিনটি গুলি করা হয়েছিল তাকে। দীর্ঘদিন  অচৈতন্য থাকার পর বিদেশে নিয়ে চিকিৎসা করায় ধীরে ধীরে মালালা সুস্থ হয়ে ওঠেন।

আসিয়া বিবিকে মুক্তি দিয়েছে লাহোরের কারাগার। মুক্তির পরপরই একটি বিশেষ বিমানে করে তাকে নিয়ে যাওয়া হয় ইসলামাবাদে, তারপর অজ্ঞাত স্থানে। তিনি কোথায় আছেন, কীভাবে আছে জানা যায়নি। পাকিস্তান সরকার বলছে, নিরাপত্তার কারণে তার অবস্থান জানানো হচ্ছে না। অন্যদিকে আসিয়া দেশত্যাগ করেছেন এ খবরের সত্যতা অস্বীকার করছে পাকিস্তানের পররাষ্ট্র দফতর। আসিয়ার মুক্তির পর প্রধানমন্ত্রী মৌলবাদীদের বিরুদ্ধে কিছু কটু কথা বলেছেন। কট্টরপন্থি টিএলপি নেতা এজাজ আশরাফি আসিয়ার মুক্তির পর প্রতিক্রিয়ায়  রয়টার্সকে বলেন, ‘এই কারামুক্তির মাধ্যমে সরকার তাদের সঙ্গে করা চুক্তি লঙ্ঘন করল। শাসকরা তাদের অসততা দেখিয়ে দিল।’

এখন ইমরান খান মৌলবাদীদের বিরুদ্ধে যা-ই বলুন না কেন, তিনি চুক্তি করেছিলেন এটা তো সত্য। কেন তিনি এমন একটি অন্যায় চুক্তি করলেন? আসিয়া যদি পাকিস্তান ত্যাগ করে থাকেন ভালো, আর যদি পাকিস্তানে থেকে থাকেন তাহলে তার জীবনের নিশ্চয়তা কেউ দিতে পারে না। এ ঘটনায় পাকিস্তান সরকার বিশ্বকে আবারও জানিয়ে দিল, পাকিস্তান বদলায়নি, বদলাবে না।     

লেখক : কথাশিল্পী, কলাম লেখক

সর্বশেষ খবর