সোমবার, ২১ জানুয়ারি, ২০১৯ ০০:০০ টা

ডানা ভারী হয়ে গেছে?

মনজুরুল আহসান বুলবুল

ডানা ভারী হয়ে গেছে?

সরকারি ট্রাস্টের অধীনে সংবাদপত্র প্রকাশের বিষয়টি খুব দূর অতীতের বিষয় নয়। ট্রাস্ট নিয়ন্ত্রিত সংবাদপত্র হলেও নিয়ন্ত্রণের মধ্যে কীভাবে ভালো সাংবাদিকতা করা যায় দৈনিক বাংলা এখনো তার দৃষ্টান্ত। এ ট্রাস্টের অধীনেই প্রকাশিত হতো বাংলাদেশ টাইমস, পরে সাপ্তাহিক বিচিত্রা এবং আনন্দ বিচিত্রা। সাংবাদিকতার মান ভালো হলেও পত্রিকাগুলো ব্যবসা সফল ছিল না। প্রচুর পরিমাণ সরকারি ভর্তুকি দিয়ে এগুলোকে বাঁচিয়ে রাখতে হতো। দেশের সংবাদপত্র শিল্পে ‘লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড’ ছিল না বলে; ট্রাস্ট পত্রিকাগুলোতে বিপুল সরকারি ভর্তুকি নিয়ে প্রশ্ন ছিল সব মহলে। শেষে সরকারও হিসাব কষে দেখল, সরকারি খরচে এ ’শ্বেত হস্তী’ পোষে লাভ নেই। সিদ্ধান্ত হলো ট্রাস্ট অবসানের। পর্যাপ্ত ক্ষতিপূরণ দিয়ে সেই সিদ্ধান্ত কার্যকর হলো। পত্রিকাগুলোতে কর্মরত যোগ্য সাংবাদিকরা তাদের যোগ্যতা দিয়েই পেশায় টিকে রইলেন, কেউ কেউ আজও ভিন্ন ঠিকানায় যোগ্যতার স্বাক্ষর রেখে চলেছেন। কিন্তু ট্রাস্টমুক্ত হয়ে পত্রিকাগুলো নানা মালিকানায় গেলেও আর দাঁড়াতে পারল না। নামসর্বস্ব হয়ে টিকে থাকল হয়তো কিন্তু প্রতিষ্ঠান হিসেবে নিজ পরিচয় বা সত্তা টিকিয়ে রাখতে পারল না। কেন পারল না, কী হলে পারত সে ভিন্ন আলোচনার বিষয়।

পটভূমি বড় না করে মূল কথায় যাই। ট্রাস্টভুক্ত দৈনিক বাংলায় কাজ করতেন প্রবীণ সাংবাদিক শ্রী নির্মল সেন, উপসম্পাদকীয় লিখতেন অনিকেত ছদ্মনামে। ট্রাস্টের পত্রিকাগুলো বেসরকারি খাতে ছেড়ে দেওয়ার সিদ্ধান্ত হওয়ার পর, অনিকেত- শ্রী নির্মল সেন যে উপসম্পাদকীয়টি লিখেছিলেন তার শিরোনাম ছিল ‘ডানা ভারী হয়ে গেছে’। তিনি বলেছিলেন, একটি পাখিকে দীর্ঘ সময় খাঁচায় বন্দী রাখার পর সেটিকে একদিন খাঁচামুক্ত করে ছেড়ে দেওয়া হলেও সে পাখিটি আর মুক্ত আকাশে উড়তে পারে না। কারণ দীর্ঘ খাঁচা জীবনে অভ্যস্ত পাখিটির ডানা ভারী হয়ে যায়, পাখিটি ওড়ার শক্তি হারিয়ে ফেলে। তিনি বলেছিলেন, ট্রাস্টভুক্ত পত্রিকাগুলো দীর্ঘ সময় ধরে সরকারের ভর্তুকিতে অভ্যস্ত হয়ে যাওয়ায় তাদের অবস্থা সেই খাঁচাবন্দী পাখির মতোই। নিয়ন্ত্রণমুক্তভাবে চলার সুযোগ দিলেও তারা স্বাধীনভাবে উড়তে পারবে না, কারণ তাদের ডানা ভারী হয়ে গেছে। নির্মল সেনের ভবিষ্যদ্বাণী শতভাগ সত্য প্রমাণিত হয়েছে।

নিবন্ধটির শিরোনাম শ্রী নির্মল সেনের শিরোনামটি ধার করেই। শুধু শেষে যোগ করা হয়েছে একটি প্রশ্নবোধক। এ প্রশ্নটি মনে এলো দেশের রাজনীতির সর্বশেষ খবরটির দিকে দৃষ্টি দিয়ে। সংবাদ মাধ্যমগুলো বলছে : আওয়ামী লীগ তাদের জোটসঙ্গীদের সংসদে বিরোধী দলের আসনে বসাতে চাইলেও তাতে নারাজ এই দলগুলোর নেতারা; এক প্রতীকে ভোট করার পর এখন তাদের বিরোধী দলে পাঠানোর পরিকল্পনা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন ১৪-দলীয় জোটের নেতারা। গত ৩০ ডিসেম্বর অনুষ্ঠিত একাদশ সংসদ নির্বাচনে মহাজোট গড়ে অংশ নিয়েছিল আওয়ামী লীগ। এই মহাজোটে ১৪-দলীয় জোটের বাইরে জাতীয় পার্টি (জাপা), জাতীয় পার্টি (জেপি), বিকল্প ধারা ছিল। ভোটের ফলাফলে দেখা যায়, মহাজোট ৩০০ আসনের সংসদে ২৮৮ আসনেই জিতেছে। আওয়ামী লীগ এককভাবে পেয়েছে ২৫৭টি আসন। গণমাধ্যমের তথ্য : এ পরিস্থিতিতে ২২ আসনে বিজয়ী এইচ এম এরশাদ নেতৃত্বাধীন জাতীয় পার্টিকে বিরোধী দলের আসনে বসানো হচ্ছে। এরশাদ হচ্ছেন বিরোধীদলীয় নেতা, গতবারের সরকারে জাতীয় পার্টিকে রাখলেও এবার রাখা হয়নি।

জোট শরিক কোনো দলের নেতাকেই মন্ত্রিসভায়ও রাখা হয়নি। আগামী ৩০ জানুয়ারি বসতে যাওয়া সংসদে জোট শরিক অন্য দলগুলোর নেতাদেরও বিরোধী দলের আসনে বসাতে আওয়ামী লীগ চাইছে বলে ক্ষমতাসীন দলটির বিভিন্ন নেতার কথায় ইঙ্গিত মিলছে। আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় এক নেতা গণমাধ্যমকে বলেন, ‘উন্নত গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে বিরোধী দলগুলো গঠনমূলক সমালোচনা করে সংসদে যে ভূমিকা পালন করে থাকে, তেমনভাবে আমরা জোট শরিক দলগুলোকেও শক্তিশালী বিরোধী দলের ভূমিকায় দেখতে চাই। তাই সংসদে বিরোধী দল হিসেবে ভূমিকা পালন করতে শিগগিরই শরিক দলগুলোর সঙ্গে আনুষ্ঠানিক বৈঠকের প্রস্তাব দেওয়া হবে।’

অনলাইন পোর্টাল বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম কথা বলেছে ১৪ দলভুক্ত ওয়ার্কার্স পার্টি, জাসদ, জেপি, তরীকত ফেডারেশনের নেতাদের সঙ্গে। তিনটি আসনে জয়ী ওয়ার্কার্স পার্টির সভাপতি রাশেদ খান মেনন বলেন : এ বিষয়টায় আমরা এখনো সমাধানে আসতে পারিনি। তবে আমরা যেহেতু ১৪-দলীয় জোটের সঙ্গে আছি, সেহেতু ১৪ দলেই থাকব। গণতন্ত্র রক্ষায় আমাদের ভূমিকা থাকবে। আওয়ামী লীগের নৌকা প্রতীকে ভোট করে বিজয়ী হয়েছেন রাশেদ খান মেনন; বিরোধী দলের আসনে বসবেন কিনা- জানতে চাইলে গত সরকারের মন্ত্রী হিসেবে সরকারি দলের আসনে থাকা মেনন বলেন, ‘না, আমরা ১৪ দলেই আছি। ১৪ দল থেকে গত সরকারে মন্ত্রী ছিলেন জাসদের সভাপতি হাসানুল হক ইনু ও জেপির চেয়ারম্যান আনোয়ার হোসেন মঞ্জু। তাদের দল থেকে নির্বাচিত সংসদ সদস্যরা দশম সংসদে সরকারি দলের আসনেই ছিলেন। নবম সংসদেও সরকারি দলের আসনে ছিল এই দলগুলোর নেতারা। সেবার শেখ হাসিনা জোট শরিক দলগুলো থেকে টেকনোক্র্যাট কোটায় মন্ত্রী করেছিলেন সাম্যবাদী দলের দিলীপ বড়ুয়াকে। মঞ্জুর দল জাতীয় পার্টির (জেপি) মহাসচিব শেখ শহিদুল ইসলাম সরাসরিই বলেছেন, তারা বিরোধী দলে যাবেন না এবং অন্যদেরও বিরোধী দলে যাওয়ার সুযোগ নেই। শেখ শহীদ বলেন, মহাজোট থেকে যারা নৌকা মার্কায় নির্বাচন করেছে, তাদের বিরোধী দলে যাওয়ার কোনো সুযোগ নেই। আমাদের পার্টি নির্বাচনে বাইসাইকেল প্রতীকে একটি আসন পেয়েছে। ইচ্ছা করলে আমরা বিরোধী দলে যেতে পারি, কিন্তু যেহেতু আমরা ১৪-দলীয় জোটে আছি, সেই হিসেবে আমরা বিরোধী দলে যাচ্ছি না। একটি আসনে জয়ী তরীকত ফেডারেশনের চেয়ারম্যন নজিবুল বশর মাইজভাণ্ডারীও বলেন, আমরা বিরোধী দলে যাব কেন? আমরা সরকারের সঙ্গে আছি। আমাদের দলের বৈঠকে সিদ্ধান্ত হয়েছে, আমরা বিরোধী দলে যাব না। মাইজভা-ারী আবার বলেন, সরকারের সঙ্গে আমরা কাজ করছি, করে যাব। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী আমাদের কাজ করে যেতে বলেছেন। তিনি যা ভালো মনে করবেন আমরা সেভাবেই থাকতে চাই। দুটি আসনে জয়ী জাসদের একাংশের সভাপতি হাসানুল হক ইনু বলেন, আমরা ১৪-দলীয় জোটে আছি, জোটের সঙ্গে থাকব। বিরোধী দলে যাবেন কিনা- জানতে চাইলে গত সরকারের এই মন্ত্রী বলেন, সেই সিদ্ধান্তটা আমরা জোটগতভাবে নিতে চাই।

নতুন সরকারের মন্ত্রিসভায় মহাজোটের শরিক দলগুলোর কেউ স্থান না পাওয়া প্রসঙ্গে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের বলেছেন, মন্ত্রী করার শর্তে জোট করা হয়নি। তিনি বলেন, আমরা জোট করেছি। জোট করার অর্থ এই নয় যে, আমরা শর্ত দিয়েছি যে, মন্ত্রী করতেই হবে। ১৪ দল আমাদের দুঃসময়ের শরিক। তারা অতীতে ছিলেন, ভবিষ্যতে থাকবেন না সে কথা তো আমরা বলতে পারছি না।

ওবায়দুল কাদের যতই বলুন এ বিষয় নিয়ে জোটে কোনো টানাপড়েন নেই, কিন্তু বাস্তবচিত্র বলছে ভিন্ন কথা। কথাবার্তা যেমন হচ্ছে, বুকে ব্যথার খবরও তো গণমাধ্যমে আসছে। ইতিমধ্যে আওয়ামী লীগ বলে দিয়েছে : আগামী উপজেলা নির্বাচন তারা করবে এককভাবেই। এই জোটভুক্তদের পৃথক সত্তা নিয়ে দাঁড়ানোর জন্য কাজ করছে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার একটি দূরদর্শী ধারণা। তিনি বলেছেন, বাংলাদেশটিকে এমন একটি রাজনৈতিক ব্যবস্থায় থিতু হতে হবে, যেখানে সরকারেও থাকবে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের শক্তি, বিরোধী দলেও থাকবে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের শক্তি।

৩০ ডিসেম্বরের নির্বাচনের পর দেশে একটি ভিন্নতর রাজনৈতিক পরিবেশ তৈরি হয়েছে। বলা যায়, এই পরিবেশ ক্ষমতায় এবং ক্ষমতার বাইরে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের, অসাম্প্রদায়িক ও জঙ্গিবাদবিরোধী শক্তির সমাবেশ ঘটানোর উপযুক্ত পরিবেশ। এমন একটি সুযোগ আমাদের জীবনে আরেকবার এসেছিল ১৯৭১ সালে বিজয় লাভের পর। একটু চোখ দিন আমাদের মুক্তিযুদ্ধকালীন সরকারের দিকে। অবশ্যই আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে মুক্তিযুদ্ধ পরিচালিত হয়েছিল। কিন্তু সেই প্রবাসী সরকারকে সহায়তা করার জন্য যে সর্বদলীয় সাত সদস্যের উপদেষ্টা পরিষদ গঠন করা হয়েছিল; তাতে আওয়ামী লীগের চারজনের বাইরে ছিলেন মওলানা ভাসানী-ন্যাপ, কমরেড মণিসিংহ- কমিউনিস্ট পার্টি, অধ্যাপক মোজাফফর আহমদ- ন্যাপ। কিন্তু বিজয় লাভের পর সদ্য স্বাধীন দেশে সরকার পরিচালনার বিভিন্ন পর্যায়ে আওয়ামী লীগের বাইরের এই দলগুলো প্রায় একীভূত হয়ে যায় বড় দল আওয়ামী লীগের মধ্যে। তখনকার বাস্তবতায় হয়তো সেটি সঠিকই ছিল। কিন্তু আজকের বাস্তবতায় মনে হয়, তখন যদি কমিউনিস্ট পার্টি, ন্যাপ বিরোধী দলের ভূমিকায় শক্তিশালী অবস্থান নিত তাহলে হয়তো এদেশের রাজনৈতিক ইতিহাসটাই ভিন্নরকম হতে পারত। একই আদর্শের মধ্যে থেকেও গঠনমূলক সমলোচনা এবং ভুল সংশোধনের মধ্য দিয়ে এগিয়ে চলা বেশ স্বস্তিদায়ক। কিন্তু মুক্তিযুদ্ধের সব শক্তি একসঙ্গে সরকারে আর বিরোধী শিবিরে এমন শক্তি যারা দেশের মূল আদর্শকে ধারণ করে না, এমন পরিস্থিতি নানাদিক থেকেই ঝুঁকিপূর্ণ। এমন সমীকরণে কোনো কারণে সরকার বদল হলে দেশটি গিয়ে পড়বে এমন একটি শক্তির হাতে যারা দেশটির অস্তিত্ব¡কেই বিপন্ন করে তুলবে। যেমনটি হয়েছিল ১৯৭৫ সালে বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করার পর। এমন পরিস্থিতি কোনোভাবেই মেনে নেওয়া যায় না। সে কারণে, এবারের এই নতুন বাস্তবতাকে কাজে লাগানোই হবে বুদ্ধিমানের কাজ। এবারে নির্বাচনী রাজনীতির প্রচারণাতেও আমরা সেই পরিবর্তনের সূচনা দেখতে পেরেছি। একটু খেয়াল করলে দেখবেন, এবারের নির্বাচনী প্রচারণায় ধর্মকে যেমন ব্যবহার করা হয়নি তেমনি আমাদের রাজনীতি দৃশ্যত ফিরে এসেছে অন্ধ ভারত বিরোধিতা থেকেও। একজন পীরের দল, যেটি বরিশাল সিটি করপোরেশনের নির্বাচনী প্রচারণাতেও ধর্মের হাতপাখার বাতাস ছড়িয়ে দিয়েছিল, জাতীয় নির্বাচনে অংশ নিলেও তারা ধর্মকে ব্যবহার করার সাহস পায়নি। রাজনীতিতে নতুন ভোটারের সংখ্যাই কেবল মূল বিষয় নয়, তাদের মনস্তাত্ত্বিক বিষয়টিও কিন্তু গুরুত্বপূর্ণ। এ নতুন প্রজন্ম যৌক্তিক; পরিচ্ছন্ন রাজনীতিকেই দেখতে চায়। আশার কথা, এ নতুন প্রজন্ম তাদের করোটিতে মুক্তিযুদ্ধকেই ধারণ করে, বাংলাদেশকে ভালোবাসে। কাজেই ক্ষমতায় এবং ক্ষমতার বাইরে মুক্তিযুদ্ধের শক্তির দৃঢ় অবস্থান তৈরি করার এখনই সঠিক সময়। সম্ভবত সেই ভিতটি তৈরি হয়েছে।

এমন একটি প্রেক্ষাপটেও মহাজোটের সবাই কেন সরকারেই থাকতে চান? প্রশ্ন করি শ্রী নির্মল সেনের শিরোনামটির পেছনে প্রশ্নবোধক চিহ্নটি বসিয়ে। আপনাদের ডানা কি আসলেই ভারী হয়ে গেছে? মুক্ত আকাশের ওড়ার শক্তি কি আপনারা আসলেই হারিয়ে ফেলেছেন? ধারণা করতে পারি; যতই সাধারণ মানুষের কথা তারা বলেন, আসলে ক্ষমতার উষ্ণতা অনেকের মধ্যে আলস্য এনে দিয়েছে। বুঝি, এটি হঠাৎ ছেড়ে আসা কষ্টকর। কিন্তু পাশাপাশি নিজেদের দিকে থাকতেও বলি। ১০ বছর, কেউ কেউ তারও বেশি ধরে, আওয়ামী লীগের ছাতার তলেই থাকলেন। কেউ কেউ এ ছায়াকেই স্থায়ী মনে করছেন। এখনো অনেকে নিজের দলের প্রতীক নিয়ে নির্বাচনে জয়ী হওয়ার মতো পরিবেশ তৈরি কেন করতে পারলেন না, এটিও কি ভেবে দেখার মতো বিষয় নয়? একটি দল শুধু নামে ভিন্ন থাকবে কিন্তু নির্বাচনী বৈতরণী পার হতে প্রতীক ধার করতে হবে, ভোটার ধার করতে হবে দীর্ঘমেয়াদে এমনটি তো কখনোই গ্রহণযোগ্য হতে পারে না। এমন একটি দলে নতুনরা কেনইবা যোগ দেবে? ক্ষমতায় থাকার কারণে কিছু সুবিধাভোগী কর্মীদল ছাড়া দেশ, সমাজ, রাষ্ট্র নিয়ে চিন্তা করেন এমন ত্যাগী, আদর্শিক নতুনেরা কখনোই এ ধরনের দলে যোগ দেবে না। রাজনীতির এ বন্ধ্যত্ব মেনে নেওয়া যায় না। এ কথা ঠিক, আমাদের মতো দেশে রাজনীতি মানে শুধু আদর্শের কথা কপচানো নয়। সব রাজনৈতিক দলের লক্ষ্যই হচ্ছে ক্ষমতায় যাওয়া। এটি খারাপ কিছু নয়। কিন্তু ক্ষমতায় যাওয়ার লক্ষ্য অর্জনের জন্য তো নিজেদেরও প্রস্তুত করতে হবে। প্রতীক ধার করে, ভোটার ধার করে তো এই লক্ষ্য অর্জন সম্ভব নয়। দীর্ঘমেয়াদে এমনটি চলতে থাকলে দলের নিজস্ব অস্তিত্বই বিলীন হবে।

সরকারে না থেকেও মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় বিশ্বাসী, অসাম্প্রদায়িক রাজনীতির পরীক্ষিত ধারক, জঙ্গিগোষ্ঠীর বিরুদ্ধে আপসহীন লড়াইয়ে রত এবং সামাজিক ন্যায়বিচারের দাবিতে অবিরাম সোচ্চার অনেক রাজনৈতিক দল, নিজস্ব শক্তি নিয়েই এবারের নির্বাচনে অংশ নিয়েছেন নিজস্ব দলীয় প্রতীক নিয়ে। ফলাফল যাই হোক, এ নির্বাচনে অংশগ্রহণ তাদের দলীয় রাজনীতিতে এক ধরনের উজ্জীবনী হিসেবে কাজ করেছে। তারা আসন্ন উপজেলা নির্বাচনে অংশ নেবেন, এমনটিই তারা ভাবছেন।

রাজনৈতিক দলগুলো অবশ্যই তাদের অগ্রাধিকার, কৌশল ও লক্ষ্য ঠিক করবেন তাদের নিজস্ব বিবেচনা থেকেই। তবে রাজনীতির ঘনিষ্ঠ পর্যবেক্ষক হিসেবে মনে করি, সরকারি জোটে থাকা রাজনৈতিক দলগুলোতে সিদ্ধান্ত নিতে হবে বাস্তবতার নিরিখেই। একটা কথা বলি; বিরোধিতা মানেই শত্রুতা নয়। দেশ ও জাতির বৃহত্তর স্বার্থে জোটে থেকেও সরকারের নীতি ও কর্মকৌশলের সাচ্চা সমালোচনা করা যায়। এটি আপাতত নতুন বলে মনে হতে পারে, কিন্তু পৃথিবীতে এক রাষ্ট্র দুই নীতির দর্শন নিয়েও তো অনেক দেশ পরিচালিত হচ্ছে।

একটি সতর্কবাণী দিয়ে শেষ করি : খাঁচায় বন্দী পাখির ডানা ভারী হয়ে যাবেই। আর যে পাখি ওড়ার ক্ষমতা হারায় সেটাকে আর পাখি বলা যায় না । যে পাখি উন্মুুক্ত আকাশে ডানা মেলে ওড়তে না পারে, তার পক্ষীজীবনের ইতি সেখানেই। সরকারি দলের জোটভুক্ত দলগুলো নিজেদের দিকে তাকিয়ে দেখুক, তাদের ডানা কি আসলেই ভারী হয়ে গেছে?

            লেখক : জ্যেষ্ঠ সাংবাদিক।

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর