মঙ্গলবার, ২৬ ফেব্রুয়ারি, ২০১৯ ০০:০০ টা

বিমান ছিনতাই... তারপর?

সামিয়া রহমান


বিমান ছিনতাই... তারপর?

চকবাজার টু চট্টগ্রাম অদ্ভুত অদ্ভুত সব ঘটনা ঘটে চলেছে বাংলাদেশে। বাংলাদেশ বিমানের দুবাইগামী উড়োজাহাজ বিজি ১৪৭ ছিনতাইয়ের চেষ্টা হলো। চট্টগ্রামে আমাদের নিরাপত্তা বাহিনীর প্যারাকমান্ডো ট্রুপ দারুণ দক্ষতার সঙ্গে বিমান ছিনতাইকারীকে গ্রেফতার করতে সক্ষম হয়েছে, যদিও মৃত অবস্থায়। শোনা গিয়েছিল হাতে আগ্নেয়াস্ত্র আর শরীরে বোমা পেঁচিয়ে বিমানে উঠে জিম্মি করার চেষ্টা চালানোর পর কমান্ডো অভিযানে মারা পড়েছে সেই যুবক। যদিও এখন শোনা যাচ্ছে খেলনা পিস্তল দিয়ে বিমান ছিনতাইয়ের প্রচেষ্টা হয়েছে। সব যাত্রী নিরাপদে ইমারজেন্সি দিয়ে অবতরণ করতে পেরেছেন। চট্টগ্রামে জরুরি অবতরণ করে পাইলটের উপস্থিত বুদ্ধির যেমন প্রশংসা করতে হয়, আমাদের কমান্ডো বাহিনীর দক্ষতার প্রশস্তি স্বীকার করতে হয়, তেমনি বাংলাদেশের বিমানের নিরাপত্তা নিয়ে সত্যিই শঙ্কিত হতে হয়। প্রশ্ন হলো, কীভাবে ঢাকার শাহজালাল বিমানবন্দরের নিরাপত্তার বেড়াজাল ডিঙিয়ে অস্ত্র নিয়ে একটি বিমান ছিনতাইয়ের মতো ঘটনা ঘটায় ওই যুবক? গাফিলতি কার? বিমানবন্দরের নিরাপত্তার চাদর ভেদ করে কীভাবে অস্ত্রসহ ওই লোক প্রবেশ করতে পারল? এতগুলো চেক পয়েন্ট তাহলে কাজ করেনি? শরীর, ব্যাগ, পোশাক, জুতা, বেল্ট যেখানে চেক করা হয় সেখানে অস্ত্রসহ কীভাবে তার প্রবেশ ঘটে? যদিও শোনা যাচ্ছে খেলনা পিস্তল, কিন্তু নকল পিস্তল দিয়ে হলেও বিমান ছিনতাইয়ের চেষ্টাও তো সাংঘাতিক!

ময়ূরপক্সক্ষী উড়োজাহাজটি বোয়িং ৭৩৭ মডেলের। ১৩৪ যাত্রী ও ১৪ জন ক্রু নিয়ে বিজি ১৪৭ ফ্লাইটটি ঢাকা থেকে চট্টগ্রাম হয়ে দুবাই যাচ্ছিল।

এ কম্বিং অপারেশনে আমাদের আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর দক্ষতার প্রশংসা করতেই হয়। কমান্ডো অভিযান শুরুর ৮ মিনিটের মাথায় সন্ধ্যা ৭টা ২৪ মিনিটে উড়োজাহাজটিকে মুক্ত করা হয় বলে জানিয়েছিলেন বেসামরিক বিমান চলাচল কর্তৃপক্ষের (বেবিচক) চেয়ারম্যান এয়ার ভাইস মার্শাল এম নাঈম হাসান। মাত্র ৮-১০ মিনিটের মাথায় এত বড় একটি অপারেশন এত দক্ষতার সঙ্গে সমাপ্তি- বিশাল ব্যাপার। এবং বলতেই হয় আমাদের কমান্ডো বাহিনী আন্তর্জাতিক দক্ষতাসম্পন্ন বলেই মিশনটি সফলভাবে সম্পন্ন হয়েছে। এয়ার কমোডর মফিদের নেতৃত্বে অপারেশনটি পরিচালিত হয়।

কিন্তু একটা প্রশ্ন, ঘটনার পেছনে ঘটনা জানার জন্য লোকটিকে কি বাঁচিয়ে রাখা যেত না? শুনলাম সে আমাদের প্রধানমন্ত্রী এবং তার নিজের স্ত্রীর সঙ্গে কথা বলতে চেয়েছিল। তাকে ফোনে ব্যস্ত রাখার চেষ্টা করেছিল আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। জানার কি উপায় ছিল না কেন সে প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে দেখা করতে চায়? ছিনতাইয়ের উদ্দেশ্য কী।

রাত ৮টার কিছু আগে এয়ার ভাইস মার্শাল মফিদুর রহমান সাংবাদিকদের জানান, সংকটের অবসান ঘটেছে। ছিনতাইয়ের চেষ্টাকারীকে জখম অবস্থায় আটক করা হয়েছে। তার পৌনে এক ঘণ্টা পর চট্টগ্রামে সংবাদ সম্মেলনে এসে সেনাবাহিনীর চট্টগ্রাম অঞ্চলের জিওসি মেজর জেনারেল এস এম মতিউর রহমান জানান, আহত ওই ব্যক্তি মারা গেছেন।

নিহত ব্যক্তির নাম মাহাদী এবং তার বয়স ২৬-২৭ বছর- শুধু এতটুকুই বলতে পেরেছেন অভিযানে থাকা যৌথ বাহিনীর কর্মকর্তারা। তার আর কোনো পরিচয় তারা দিতে পারেননি, পারেননি তার উদ্দেশ্য সম্পর্কেও কিছু জানাতে। এক যাত্রীর বরাতে শোনা যায়, ওই যুবক নাকি প্লেনে পিস্তল নিয়ে উঠে দাঁড়িয়ে যাত্রীদের বলেছিল, কেউ উঠে দাঁড়ালে বা নড়াচড়া করলে গুলি করা হবে। এ সময় যাত্রীরা আতঙ্কিত হয়ে পড়েন। তখন নাকি ওই যুবক কয়েক রাউন্ড গুলিও ছোড়ে। শোনা যায় তার শরীরে নাকি বোমা লাগানো ছিল। যদিও গণমাধ্যমগুলো এখন চট্টগ্রাম মহানগর পুলিশ কমিশনার মোহাম্মদ মাহবুবার রহমানের বরাত দিয়ে জানাচ্ছে ছিনতাইকারীর কাছে যে অস্ত্রটি পাওয়া গেছে সেটি ফেইক, খেলনা পিস্তল।

একটি গণমাধ্যমে শুনলাম, যুবক নাকি কোনো নায়িকার ব্যর্থ প্রেমিক? তাই কি? বিষয়টি কি সত্যিই এত হালকা? পেছনের ঘটনাটি কি আর জানার উপায় আছে? বেবিচক চেয়ারম্যান নাঈম হাসানের মতে, ওই যুবকের আচরণ অসংলগ্ন ছিল। আমাদের জাতীয় নিরাপত্তার স্বার্থেই লোকটির কাছ থেকে তথ্য আদায় জরুরি ছিল। তদন্ত হবে নিশ্চয়ই। কিন্তু জানা কি যাবে কার প্রশ্রয়ে বা কাদের গাফিলতিতে বিমানবন্দরের মতো স্পর্শকাতর জায়গায় ওই যুবক অস্ত্রসহ প্রবেশ করে (সেটি নকল হোক আর আসল হোক), বিমান ছিনতাইয়ের মতো ঘটনা ঘটানোর সাহস রাখে? রহস্যের কূলকিনারা হবে কি?

একটি প্রশংসা আমাদের গণমাধ্যমেরও প্রাপ্য। দায়িত্বশীলতার প্রশংসা। হলি আর্টিজানের ঘটনার সময় আমাদের গণমাধ্যমগুলো ব্রেক ইভেনের প্রতিযোগিতায় এমন সব তথ্য দেওয়া শুরু করেছিল যে, জঙ্গিরা সুবিধা পেয়ে যাচ্ছিল। এবার প্রায় সব গণমাধ্যম কাছাকাছি সময়েই তৎক্ষণাৎ ঘটনা দর্শকদের জানিয়েছে এবং কমান্ডো অপারেশন চলাকালে লাইভ সম্প্রচার থেকে বিরত থেকেছে। হয়তো সেই সময়টুকু দর্শকরা টেনশনে ছিলেন, কিন্তু রাষ্ট্রীয় স্বার্থে এর প্রয়োজন ছিল। প্রতিযোগিতার নামে আমরা এবার দর্শকদের অন্তত বিভ্রান্ত করিনি, দেশের স্বার্থে ঐক্যবদ্ধ থাকতে পেরেছি।

কিন্তু প্রশ্নটা থেকেই যায়। চকবাজারের চুড়িহাট্টার আগুনের ভয়াবহতা আর অস্ত্রসহ বিমানে ঢুকে উড়োজাহাজ ছিনতাইয়ের চেষ্টা সম্ভব হয় কাদের কাজের গাফিলতিতে, কাদের দায়িত্বহীনতার ঘাটতিতে? নিরাপত্তা বাড়াতে নানা পদক্ষেপের মধ্যে বিমানবন্দর পেরিয়ে রাষ্ট্রায়ত্ত বিমান সংস্থার উড়োজাহাজে কীভাবে আগ্নেয়াস্ত্র হাতে এই যুবক উঠে পড়ল, সেই প্রশ্নের উত্তর দেবে কে? যেখানে স্ক্যানিং মেশিনে নেইল কাটার থেকে শুরু করে আয়না, লাইটার সব ধরা পড়ে সেখানে আগ্নেয়াস্ত্র ওই যুবক লুকাল কীভাবে? খেলনা পিস্তল হলেও তো স্ক্যানিংয়ে ধরা পড়ে।

বার বার শুনছি আমাদের বিমানবন্দরের নিরাপত্তা বাড়ানো হয়েছে। কিন্তু চরম অব্যবস্থাপনার মধ্যে আছে শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর। বিশেষ করে যাত্রী হয়রানি, লাগেজ হ্যান্ডলিং, নোংরা-অপরিচ্ছন্ন টয়লেট, দক্ষ কর্মীর অভাব প্রকট সেখানে। পৃথিবীর মধ্যে বাংলাদেশই বোধহয় একমাত্র দেশ, যেখানে অবতরণের পর সব প্রক্রিয়া সম্পন্ন করার পরও শুধু লাগেজপ্রাপ্তির জন্য দেড় থেকে দুই ঘণ্টা দাঁড়িয়ে থাকা নিত্যনৈমিত্তিক ব্যাপার। যদিও আমাদের ভিভিআইপি বা ভিআইপিরা এ কষ্ট বুঝবেন না, কারণ তাদের লাগেজ প্রথমে আসে আর লাগেজ বহনের জন্য বিমানবন্দরের কর্মীরাই দাঁড়িয়ে থাকেন। কিন্তু আমাদের বাদবাকি সাধারণ মানুষের কষ্ট বুঝবে কে? এখন এর সঙ্গে আবার যুক্ত হলো নিরাপত্তাহীনতা। উন্নয়নের দেশ বাংলাদেশে বিমানবন্দর ডিজিটাল হয় না কেন? এমনকি পাশের দেশ ভারতের দিল্লির বিমানবন্দরের পাশেও কি দাঁড়াতে পারবে আমাদের বিমানবন্দর? এই সমালোচনা দেশকে সমালোচনা নয়, সরকারকে সমালোচনা নয়। এটি আমার আত্মসমালোচনা। কারণ এ দেশের বাসিন্দা, নাগরিক তো আমিও।

কমিটি হবে। অনুসন্ধান হবে। ছিনতাইকারী তো নিহত। তার দুরভিসন্ধির কারণ জানতে পারব কি? সাধারণ মানুষ হিসেবে দাবি, সত্যিটা উন্মোচিত হোক আমাদের সামনে। কারণ এর সঙ্গে আমাদের রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তার বিষয়টি জড়িত। আমাদের সাধারণ মানুষের নিরাপত্তার বিষয়টি জড়িত। দাবি আন্তর্জাতিক মানের বিমানবন্দরের। নামে শুধু নয়, ব্যবস্থাপনার দিক থেকেও আন্তর্জাতিক মানের। এক মাসের মধ্যে একের পর এক ঘটনা ঘটছে। চকবাজারের অগ্নিকা- আর তারপর বিমান ছিনতাইয়ের প্রচেষ্টা। পুরান ঢাকায় মৃত্যুকূপে বসে আছে সেখানকার জনগণ। এটি আমার বক্তব্য নয়, বিশেষজ্ঞদের বক্তব্য। আবার যে কোনো সময় ঘটতে পারে এমন ঘটনা। সরকারের কাছে একটি অনুরোধ- যে উন্নয়নের দাবি নিয়ে আপনারা ক্ষমতায় এসেছেন, আমাদের মতো ভুক্তভোগী সাধারণ মানুষদের সেই নিরাপত্তার উন্নয়ন দিন। সুস্থভাবে বেঁচে থাকার সুযোগটুকু করে দিন। যাদের দায়িত্বহীনতায় সরকার বিপদগ্রস্ত হচ্ছে, সমালোচনার মুখোমুখি হচ্ছে, রাষ্ট্র বিপন্ন হচ্ছে, সাধারণ মানুষ ভুক্তভোগী হচ্ছে- তারা যে-ই হোক, যে দলের নামধারী হোক, তাদের পরিষ্কার করুন। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী, আপনিই তো একসময় বলেছিলেন আগাছা যে দলেরই হোক না কেন, তা উপড়ে ফেলবেন। এখনই কি তার প্রকৃত সময় নয়?

                লেখক : সহযোগী অধ্যাপক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।

 

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর