শনিবার, ৬ এপ্রিল, ২০১৯ ০০:০০ টা

ব্যাংকঋণ অবলোপন মানে ঋণের দায়মুক্তি নয়

তপন কুমার ঘোষ

ব্যাংকঋণ অবলোপন মানে ঋণের দায়মুক্তি নয়

ব্যাংক খাতের অনাদায়ী তথা খেলাপি ঋণ উদ্বেগের বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। বিষয়টি ভাবাচ্ছে ব্যাংক কর্তাদের তো বটেই, রাষ্ট্র পরিচালনার দায়িত্বে যারা আছেন তাদেরও। ব্যাংকের ঋণ আদায়ে অনিশ্চয়তা দেখা দিলে বাংলাদেশ ব্যাংকের গাইডলাইন অনুসারে ‘কু বা ক্ষতি’ মানে শ্রেণিকৃত ঋণ রাইট অফ বা অবলোপন করা হয়। ঋণ অবলোপন-সংক্রান্ত আগের নীতিমালা বাতিল করে বাংলাদেশ ব্যাংক সম্প্রতি নতুন নীতিমালা জারি করেছে। (বিআরপিডি সার্কুলার নম্বর ১; তারিখ ৬ ফেব্রুয়ারি, ২০১৯)। দীর্ঘদিন যাবৎ অনাদায়ী ঋণ যা অদূর ভবিষ্যতে আদায়ের কোনো সম্ভাবনা নেই এরূপ ঋণ ব্যাংকের ব্যালান্স শিট বা স্থিতিপত্রে দেখানোর ফলে ব্যালান্স শিটের আকার অনাবশ্যকভাবে স্ফীত হতে থাকে। খেলাপি ঋণ বা অনুৎপাদক সম্পদ অবলোপন করে ব্যালান্স শিটে সম্পদের স্ফীত অংশটুকু ছেঁটে ফেলা হয়। উদ্দেশ্য, হিসাবের খাতা পরিচ্ছন্ন করা। বিষয়টি অনেকটা শরীরের অপ্রয়োজনীয় মেদ ঝরিয়ে ফেলার মতো।

ঋণ অবলোপনের শর্ত : প্রথমত, ঋণটি ‘মন্দ/ক্ষতি’ মানে শ্রেণিকৃত হতে হবে। নতুন নীতিমালা অনুযায়ী একাদিক্রমে তিন বছর যাবৎ ‘মন্দ/ক্ষতি’ মানে শ্রেণিকৃত রয়েছে এমন ঋণ হিসাব অবলোপন করা যাবে। দ্বিতীয়ত, ঋণ হিসাবটির বিপরীতে শতভাগ প্রভিশন অর্থাৎ সঞ্চিতি রাখতে হবে। ঋণ হিসাবের স্থিতি থেকে ‘স্থগিত সুদ’ বাদ দিয়ে অবশিষ্ট স্থিতির সমপরিমাণ প্রভিশন রাখতে হবে। তৃতীয়ত, ঋণটি আদায়ের জন্য অর্থ ঋণ আদালতে মামলা করতে হবে। অর্থ ঋণ আদালত আইন, ২০০৩-এর আওতায় অত্যাবশ্যকীয়ভাবে মামলাযোগ্য না হলে ২ লাখ টাকা পর্যন্ত ঋণ মামলা দায়ের ছাড়াই অবলোপন করা যাবে। এ ছাড়া অর্থ ঋণ আদালত আইন, ২০০৩ অনুযায়ী মামলাযোগ্য না হলে মৃত ব্যক্তির ক্ষেত্রে মামলা দায়ের না করেই ঋণ অবলোপন করা যাবে, তা ঋণের শ্রেণিমান যাই হোক না কেন।

ঋণ শ্রেণিকরণ : ঋণ নিয়ে সময়মতো পরিশোধ না করলে তা শ্রেণিকৃত হয়ে যায়। বাংলাদেশ ব্যাংকের গাইডলাইন অনুসারে প্রতি তিন মাস অন্তর ব্যাংকের ঋণ শ্রেণিকরণ করা হয়। ঋণের গুণগতমান ও আদায়ের সম্ভাবনা (বা অনাদায়ের ঝুঁকি) বিবেচনা করে ঋণ হিসাবগুলো মোট পাঁচটি শ্রেণিতে বিন্যাস করা হয়। এগুলো হলো- স্ট্যান্ডার্ড, স্পেশাল মেনশন অ্যাকাউন্ট, নিম্নমান, সন্দেহজনক ও মন্দ বা ক্ষতি।

প্রভিশন সংরক্ষণ : ব্যাংকের ঋণ ও বিনিয়োগের বিপরীতে প্রভিশন অর্থাৎ সঞ্চিতি সংরক্ষণ গুরুত্বপূর্ণ। সম্পদের সম্ভাব্য ক্ষতির বিপরীতে অর্থের সংস্থান রাখা হচ্ছে প্রভিশনিং। ব্যাংকের আয় তথা পরিচালন মুনাফা থেকে অর্থ স্থানান্তর করে প্রভিশন হিসেবে জমা করা হয়। মূলত, সুদ মওকুফ বা ঋণ অবলোপনের জন্যই প্রভিশনিং বা অর্থের সংস্থান রাখা হয়।

প্রভিশনের হার : ঋণের ঝুঁকি বিবেচনায় ও ঋণের প্রকারভেদে বিভিন্ন হারে প্রভিশন রাখতে হয়। বাংলাদেশ ব্যাংকের গাইডলাইন অনুসারে বিরূপভাবে শ্রেণিকৃত ঋণের তিনটি পর্যায় রয়েছে- নিম্নমান, সন্দেহজনক ও মন্দ বা ক্ষতি। নিম্নমান ঋণের ক্ষেত্রে ২০, সন্দেহজনক ঋণের ক্ষেত্রে ৫০ ও মন্দ বা ক্ষতির ক্ষেত্রে ১০০ শতাংশ হারে প্রভিশন রাখতে হয়। অশ্রেণিকৃত (স্ট্যান্ডার্ড ও স্পেশাল মেনশন অ্যাকাউন্ট) ঋণের বিপরীতে ক্ষেত্রভেদে দশমিক ২৫ থেকে ৫ শতাংশ হারে সাধারণ প্রভিশন রাখার বাধ্যবাধকতা আছে।

স্থগিত সুদ : শ্রেণিকৃত ঋণ হচ্ছে ব্যাংকের নন-পারফরমিং অ্যাসেট (অনুৎপাদক সম্পদ)। শ্রেণিকৃত ঋণের সুদ, আদায় না হওয়া পর্যন্ত, আয় খাতে জমা না করে ‘স্থগিত সুদ’ হিসেবে জমা রাখা হয়। আবার মন্দ বা কুমানে শ্রেণিকৃত ঋণের ওপর সুদ আরোপ স্থগিত থাকে।

শ্রেণিকৃত ঋণের নেতিবাচক প্রভাব : একদিকে ‘স্থগিত সুদ’, অন্যদিকে ‘প্রভিশন’ সংরক্ষণ- এ দুইয়ের কারণে ব্যাংকের আয় তথা মুনাফা হ্রাস পায়। ঋণের মানের অবনতি হওয়ায় ঋণঝুঁকির বিপরীতে ব্যাংকের আবশ্যকীয় মূলধনের পরিমাণ বেড়ে যায়। ফলে ব্যাংকের মূলধন ভিত্তির ওপর চাপ পড়ে এবং অনেক ক্ষেত্রে ব্যাংক মূলধন ঘাটতির মুখোমুখি হয়। ব্যাংকের সার্বিক পারফরম্যান্স পরিমাপের জন্য কেন্দ্রীয় ব্যাংক আন্তর্জাতিকভাবে ব্যবহৃত পদ্ধতি ‘ক্যামেলস’ রেটিং ব্যবহার করে। শ্রেণিকৃত ঋণের নানা নেতিবাচক প্রভাব ‘ক্যামেলস’ রেটিংয়ের ওপর পড়ে। সবচেয়ে বড় কথা, ঋণের টাকা আটকে পড়ায় ব্যাংকের নতুন ঋণ দেওয়ার সক্ষমতা কমে যায়। সোজা কথায়, ঋণখেলাপিদের কারণে নতুন ব্যবসায়ী ও শিল্পোদ্যোক্তারা ব্যাংক ঋণ থেকে বঞ্চিত হন। অবলোপন-পরবর্তী আদায় অবলোপনের পরও ব্যাংকের দাবি বহাল থাকে। পাওনা আদায়ের লক্ষ্যে আইনি প্রক্রিয়াও অব্যাহত থাকে। অবলোপনের পর ঋণ হিসাবটি চোখের আড়ালে চলে যায়, এটা ঠিক। কিন্তু তাই বলে মনের আড়াল হলে চলবে না। এর সঙ্গে ব্যাংকের লাভ-লোকসানের প্রশ্ন জড়িত। অবলোপনকৃত ঋণ আদায়ের পর প্রভিশন অ্যাকাউন্টে জমা করা হয়। কোনো কোনো ব্যাংক সরাসরি আয় খাতে জমা করে। অবলোপনকৃত ঋণ আদায় হলে শেষমেশ ব্যাংকের আয় তথা মুনাফা বাড়ে, এটা ব্যাংকের কর্তারা ভালো করেই জানেন। ঋণ অবলোপন মানে ঋণ মওকুফ নয়। এটা ঋণের দায়মুক্তি নয়। অবলোপনকৃত ঋণের হিসাব একটি পৃথক লেজারে সংরক্ষণ করা হয়। অবলোপন করা হলেও ঋণগ্রহীতা যথারীতি ঋণখেলাপি হিসেবেই চিহ্নিত হন। সিআইবিতে এটা রিপোর্ট করা হয়। ব্যাংকের আর্থিক বিবরণীতেও এটা রিপোর্ট করার ব্যাপারে সুস্পষ্ট নির্দেশনা আছে।

উপসংহার হলো, অবলোপনকৃত ঋণ আদায়ের ব্যাপারে ব্যাংককর্তাদের বিশেষ মনোযোগ দিতে হবে। চোখের আড়াল হলেই মনের আড়াল হয়- এ প্রবাদটা যেন এ ক্ষেত্রে ভুল প্রমাণিত হয়। ঋণখেলাপিদের কাছ থেকেও দায়িত্বশীল আচরণ কাম্য।

লেখক : সাবেক উপব্যবস্থাপনা পরিচালক জনতা ব্যাংক লিমিটেড।

সর্বশেষ খবর