মঙ্গলবার, ৭ মে, ২০১৯ ০০:০০ টা

বঙ্গবন্ধুতে অসাধারণ চোখ অপারেশন

বঙ্গবীর কাদের সিদ্দিকী বীরউত্তম

বঙ্গবন্ধুতে অসাধারণ চোখ অপারেশন

মোবারক মাহে রমজান। নাজাত বা মুক্তির সবচাইতে বড় মাধ্যম নামাজ, রোজা। রোজা পশুত্ব ধ্বংস করে মনুষ্যত্বের জন্ম দেয়। সেই রহমত, বরকতের রোজা হলো প্রত্যেক মুসলমানের জন্য স্রষ্টার এক শ্রেষ্ঠ আশীর্বাদ। আল্লাহ রব্বুল আলামিন আমাদের মাহে রমজানের রোজা কবুল ও মঞ্জুর করুন।

অনেক দিন নিয়মিত লেখা হয়নি। এক. পরিবেশ দুই. শারীরিক অসুবিধা। বহুবার বলেছি, লেখকের কাছে পাঠক সন্তানের থেকেও প্রিয়। এ কদিন কতজনের কত প্রশ্ন, কতজন কতভাবে জানার চেষ্টা করেছেন তারা লেখা পান না কেন। পাঠক বন্ধুরা আকুল। আমার নিজের কাছেও খারাপ লেগেছে কতজনের কত আকুতি- তাই লিখছি। কত জায়গায় কত মানুষ কতভাবে বলার চেষ্টা করে মুক্তিযুদ্ধ-পরবর্তী দিনগুলো নিয়ে লিখতে। বিশেষ করে বঙ্গবন্ধু নিহত হওয়ার পর ভারতে নির্বাসিত দিনগুলো নিয়ে যাতে লিখি, অনেক অজানা তথ্য যাতে তারা জানতে পারেন। এ ধরনের কত বায়না- বলে-কয়ে শেষ করতে পারব না। গত ২৮ এপ্রিল চোখের ছানি কেটেছি। ১৫-২০ বছর হবে চোখে ছায়া দেখতাম। পড়তে অসুবিধা হতো। কিছুক্ষণ পড়লেই চোখ ঝাপসা হয়ে আসত, মাথায় তীব্র যন্ত্রণা অনুভব করতাম। খুনিদের হাতে বঙ্গবন্ধু নিহত হওয়ার আগে চোখ ও চশমা সম্পর্কে কোনো ধারণা ছিল না। চশমার মাহাত্ম্য বুঝেছিলাম ’৭৬-এর নভেম্বর-ডিসেম্বরে। তখন আমরা জোরকদমে বঙ্গবন্ধু হত্যার প্রতিরোধ যুদ্ধ চালিয়ে যাচ্ছি। চান্দভূই নামে এক পাহাড়ি টিলায় ’৭৫-এর প্রতিরোধ সংগ্রামী জাতীয় মুক্তিবাহিনীর প্রধান ক্যাম্পে রাজা দীপঙ্কর, শাহ আজিজ, এম এ জলিল, সুলতান মনসুর, গৌর, বৌদ্ধ, মাহবুব, নাসিম ওসমান; নড়াইলের জিন্নাহ; যশোরের এমপি রওশন আলী, বিশেষ করে অধ্যাপক আবু সাইয়িদ, ডা. এস এ মালেক, বড় ভাই লতিফ সিদ্দিকী, ইসমত কাদির গামা, ফরিদপুরের শামসুদ্দিন মোল্লা, আওয়ামী লীগের দফতর সম্পাদক আনোয়ার হোসেন এ রকম আরও অনেকে ছিলেন। একেবারে গভীর জঙ্গল। প্রয়োজনীয় জামা-কাপড়-জুতা-মোজা নেই। শীতবস্ত্রের অভাবে মাটি খুঁড়ে তার মধ্যে দলবদ্ধভাবে শীতের হাত থেকে রক্ষার চেষ্টা। এই যখন অবস্থা ঠিক তখন একদিন হঠাৎই নারায়ণগঞ্জের নাসিমের মোটা কাচের চশমা ভেঙে গেল। ওর দু-এক দিন আগে নারায়ণগঞ্জের মঞ্জুরুল ইসলাম মঞ্জুর চশমা ভেঙেছিল। তা নিয়ে কেউ তেমন গা করেনি, আমাকেও বলেনি। নাসিমের চশমা আমার সামনেই ভেঙেছিল। কিন্তু তেমন কিছু মনে করেনি। ভেঙেছে সময়-সুযোগ মতো তৈরি করে আনলেই হবে। প্রথমত চশমা তৈরি করার টাকা নেই। তা ছাড়া ১০০ কিলোমিটারের মধ্যে চশমা কেনা বা মেরামত করার কোনো জায়গা নেই। পরদিন বা তার পরদিন কী কাজে নাসিম ওসমানকে ডেকেছি। সামনে আসতেই দেখি চোখ লাল টকটকে বড় বড়। নাসিম তথ্য বিভাগে কাজ করত। সুলতান, জ্যোতির্ময়, রাজা দীপঙ্কর, বারহাট্টার রহমান মাস্টার আরও অনেকেই ছিল তথ্য বিভাগের সঙ্গে। নাসিম ওসমানের হাতের লেখা ভালো ছিল না। কিন্তু ধারণক্ষমতা আর নিষ্ঠা ছিল অসাধারণ। কলম-কাগজ হাতেই ছিল। কী যেন বলছিলাম, নাসিম নোট নিচ্ছিল। এমনিতে ওর হাতের লেখা খারাপ। আমাদের নওশের আলী নশুর চাইতেও অনেক বেশি খারাপ। তার ওপর দুই দিন আগে চশমা ভেঙেছে। চোখ যেন জবা ফুলের মতো টকটকে লাল হয়ে বেরিয়ে পড়তে চাচ্ছে। হঠাৎ হাতের দিকে তাকিয়ে দেখি ওর লেখা কোন দিকে যাচ্ছে ও নিজেও জানে না। শুধু অনুমানের ওপর হাত চালাচ্ছে। তখন এখনকার মতো অবস্থা ছিল না। সেখানে দায়দায়িত্ব, মান্য-গণ্য ছিল। হঠাৎ জিজ্ঞাসা করি নাসিম, একই লাইনের ওপর লিখছ? তোমার কি দেখতে কষ্ট হচ্ছে? আমার প্রশ্নে সে যেন কেমন হয়ে গেল।

- না স্যার, তেমন কিছু হচ্ছে না।

- তোমার চোখ এত লাল কেন?

- চশমা নেই তো তাই বোধহয় লাল হয়েছে।

- তোমার কি অসুবিধা হচ্ছে?

- না, তেমন অসুবিধা হচ্ছে না।

- আচ্ছা ওটা রাখো।

একটা বই হাতে দিয়ে বললাম, পড় তো। নাসিম এক শব্দও পড়তে পারল না। পড়বে কি, সে তো তেমন কিছুই দেখতে পাচ্ছে না। কে যেন একজন বলল, এ দুই রাত নাসিম একটুও ঘুমাতে পারেনি। সে সময় মঞ্জুকে ডাকা হলো। মঞ্জুও তথ্য দফতরে কাজ করে। খুব ভালো কর্মী। নারায়ণগঞ্জের যারা ’৭৫-এর প্রতিরোধ যুদ্ধে অংশ নিয়েছিল তার মধ্যে মনে হয় সব থেকে ভালো। মঞ্জুর চশমা ভেঙেছে আরও আগে। নাসিমের মতোই মোটা কাচের চশমা। তাই মঞ্জুর চোখ ফুলেছে আরও বেশি। লাল হয়েছে বলার মতো না। বোঝা গেল চশমা ছাড়া তাদের চলবে না। কর্তৃপক্ষের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলো, গাড়ি চাই, লোক চাই- চশমা বানাতে হবে। পরদিন সকালে গাড়ি এলে চান্দভূই থেকে প্রায় ১৫০ কিলোমিটার দূরে শহরে গিয়ে সন্ধ্যায় নতুন চশমা নিয়ে এলো। পরদিন চোখ ফোলা মুখ ফোলা সব ঠিক হয়ে গেল। বুঝলাম মোটা কাচের চশমার মাহাত্ম্য। নতুন চশমা চোখে নাসিম আর মঞ্জুর কাজের উদ্দীপনাই বেড়ে গেল শতগুণ। এরপর এলো ভারতের সাধারণ নির্বাচন। সর্বোদয় নেতা শ্রীজয়প্রকাশ নারায়ণের নেতৃত্বে গঠিত হলো জনতা পার্টি। পূর্ব-পশ্চিম-উত্তর-দক্ষিণ, ডান-বাম, নরম-গরম সবাই শ্রীজয়প্রকাশ নারায়ণের নেতৃত্বে একজোট। সে এক অসাধারণ নির্বাচন। স্বাধীন ভারত একটানা কংগ্রেস শাসন করেছে। ১৯৪৭-’৭৭ এই ৩০ বছরে কেন্দ্রীয় সরকারের অন্য কেউ বা কোনো দল কখনো কোনো দিন শাসন করতে পারেনি। আর সত্য কথা বলতে কি, আঞ্চলিক দল থাকলেও তখন পর্যন্ত ভারতে কংগ্রেস ছাড়া আর কোনো সর্বভারতীয় দল ছিল না। পশ্চিমবঙ্গ, কেরালা, ত্রিপুরা ও আরও কয়েকটি রাজ্যে সিপিএম, কোথাও সিপিআই। আরও কয়েকটি আঞ্চলিক দল রাজ্য সরকার গঠন করলেও সর্বভারতীয় কোনো দল ছিল না। সিপিআই যদিও সর্বভারতীয় দল, কিন্তু খুব বেশি সিট পেত না। তাই বলতে গেলে একমাত্র কংগ্রেসই ছিল সর্বভারতীয় দল। এখনো কংগ্রেস সর্বভারতীয় দল। অন্যদিকে শ্রীজয়প্রকাশ নারায়ণের নেতৃত্বে গঠিত জনতা পার্টি ভাগ হয়ে ভারতীয় জনতা পার্টি গঠন করে। পরবর্তী নির্বাচনে ভারতীয় জনতা পার্টি লোকসভায় ৫৪৩ আসনের মধ্যে মাত্র ২টিতে জয়লাভ করে; যার ১টি ছিল অটল বিহারি বাজপেয়ির আসন। সে যাক, নির্বাচনে কংগ্রেস পরাজিত হলে জনতা পার্টির মোরারজি দেশাই হন প্রধানমন্ত্রী। লন্ডনে জিয়াউর রহমানের সঙ্গে এক চুক্তিতে তিনি আমাদের সবকিছু তছনছ করে দেন। প্রায় ছয় হাজার প্রতিরোধ যোদ্ধাকে জিয়াউর রহমানের হাতে তুলে দেওয়া হয়। চার-পাঁচ হাজার যোদ্ধা এদিক-ওদিক গা-ঢাকা দেয়। আমাদের হাজারখানেক যোদ্ধাকে বন্দী করা হয়। নেতাজি সুভাষ বোসের সহকর্মী ফরোয়ার্ড ব্লকের সভাপতি শ্রীসমর গুহ এবং ইটনার ভূপেশ দাশগুপ্ত এমপি ভারতীয় পার্লামেন্ট নাড়িয়ে ফেলেন। লোকসভার প্রায় ৫০ জন সদস্য প্রতিবাদের ঝড় তুললেন। মোরারজি দেশাই কিছুটা শান্ত হন। আমাদের জল্লাদের হাতে তুলে দেওয়া থেকে বিরত হন। ইল্লি-দিল্লি-কলকাতা ঘুরিয়ে আমাকে আনা হয় শিলিগুড়ি। প্রায় ছয় থেকে আট মাস পর মা-বাবা, ভাইবোনদের মাঝে এসে অনেকটা স্বস্তিবোধ করি। দিন কাটতে থাকে। এর মধ্যে কী কারণে বাবা কলকাতায় যান। একদিন শুনি তিনি বাংলাদেশে চলে গেছেন। সময়টা ’৭৭-এর নভেম্বর-ডিসেম্বর। দেশে ফিরে সোজা জেলে প্রায় তিন বছর। হঠাৎ একদিন দেয়ালের দিকে চোখ পড়তে ছায়া দেখি। কয়েক দিন ছায়া দেখে একদিন গেলাম ডাক্তারের কাছে। ডাক্তার বিকাশ মুখার্জি শিলিগুড়িতে নামকরা চক্ষু বিশেষজ্ঞ। উত্তরবঙ্গ মেডিকেল কলেজের অধ্যাপক। সরকারি লোকেরাই তার সঙ্গে সাক্ষাতের ব্যবস্থা করেছিল। গিয়ে দেখি আমাদের কালিহাতী মুন্সীপাড়ার লোক। তিনি জানতেন বাঘা সিদ্দিকী শিলিগুড়িতে। কিন্তু কোথায় তা জানতেন না। আমি চোখ দেখাতে যাব এটা শুনে হাতে চাঁদ পাওয়ার মতো অবস্থা তার। এক ঘণ্টা রোগী দেখা বন্ধ। চেম্বারে গিয়ে দেখি কোনো রোগী নেই। দুটি মেয়ে, ছোট্ট ছেলে আর বউ নিয়ে ডাক্তার বসে আছেন। আমি যেতে যেতেই একগাদা ফুল দিয়ে স্বাগত জানালেন। মিষ্টি খাওয়ালেন। মিষ্টির প্রতি আমার কোনো দিনই লোভ ছিল না। তবু আবদার রক্ষার জন্য একটু খেলাম। তারপর কথা শুরু হলো। এ দেখি আমার বাপ-দাদা চৌদ্দগুষ্টি চেনেন! জিজ্ঞাসা করলাম, এ কী করে সম্ভব? বললেন, ’৫০ সালের দিকে কালিহাতীর মুন্সীপাড়া থেকে তারা শিলিগুড়ি এসেছেন। তারপর এখানেই লেখাপড়া, এখানেই ডাক্তারি। বললেন, ‘মুক্তিযুদ্ধের শুরু থেকেই আপনার কথা শুনেছি। বাঘা সিদ্দিকীর সঙ্গে আমার দেখা হবে এটা ছিল কল্পনার বাইরে।’ এরপর চোখ দেখলেন। দেখে ওষুধ দিলেন। বললেন, চোখে ছয়টা ইনজেকশন দিতে হবে। চোখে ইনজেকশন দিতে হবে বা দেওয়া যায় এ আমার জানা ছিল না। পরদিন বাসায় এসে গরুর ইনজেকশনের মোটা সুইয়ে চোখের নিচে ইনজেকশন দিলেন। জীবনে অনেক জ্বালা-যন্ত্রণা সহ্য করেছি। কিন্তু সেই ইনজেকশনের জ্বালা ভাবা যায় না। প্রায় ১৫ মিনিট কোনো জ্ঞান থাকে না। সারা শরীর ঘেমে ভিজে যায়। তারপর আস্তে আস্তে শান্তি। মনে হয় সাত দিন পরপর ইনজেকশন দেওয়ার কথা ছিল। ছয়টার জায়গায় পাঁচটা দিয়েই শেষ করেছিলেন। কারণ দরকার পড়েনি। আর চোখে ছায়া পড়ে না। মাস তিনেক পর চশমা দিলেন। দূরে ১.৭৫, কাছে ১.২৫, একচেইঞ্জ ১৮০০। যেদিন প্রথম চশমা চোখে দিলাম তখন মনে হলো এত দিন আমি কিছুই দেখতাম না। দূরে যেমন ঝকঝক করছে, বইপত্রের লেখা তেমন চকচকে তকতকে।

সেই যে ’৭৭ সালে শিলিগুড়িতে চশমা নিয়েছিলাম তা আজো নিত্যসঙ্গী হয়ে আছে। তারপর কত কিছু হলো। ২০০২ সালে দিল্লিতে ফেকো করিয়েছি। ডায়াবেটিস ধরেছে প্রায় ২০ বছর। কিন্তু চশমার পাওয়ার অদলবদল হয়নি। সেই যে শিলিগুড়িতে যে পাওয়ার ছিল এখনো তা-ই আছে। চার বছর আগে আগারগাঁও চক্ষুবিজ্ঞান ইনস্টিটিউটে গিয়েছিলাম। নাসিম ওসমান আর মঞ্জুর মতো চোখ লাল হয়ে গিয়েছিল। চোখ দেখে ডাক্তার বলেছিলেন, আপনার ডান চোখ ভালো। কিন্তু বাঁ চোখে ছানি আছে। তাড়াতাড়ি অপারেশন করে নেবেন। না হলে খারাপ হতে পারে। ছানি শক্ত হয়ে গেলে অনেক সময় অসুবিধা হয়। এক দুই করে চার-পাঁচ বছর কেটে গেছে। ছেলেমেয়ে বড় হয়েছে। তারা গোয়েন্দাদের চাইতেও বেশি চৌকস। কার কাছে শুনেছে আমার ছানি অপারেশন দেরি হলে খারাপ হতে পারে। বিশেষ করে কুঁড়ি উঠতে-বসতে তাগাদা দিচ্ছিল। অধ্যাপক ডা. আবদুল্লাহ আমাদের খুবই প্রিয়। আমার স্ত্রী তো তার পরামর্শ ছাড়া একটা নাপাও মুখে তোলেন না। স্ত্রীকে নিয়ে কদিন আগে আবদুল্লাহ ভাইয়ের ওখানে গিয়েছিলাম। তাকে বলেছিলাম, চোখে অসুবিধা। বলুন তো কী করা যায়। তিনি বললেন, ‘বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় চক্ষু বিভাগের প্রধান অধ্যাপক জাফর খালেদ বেশ ভালো ডাক্তার। তার হাত ভালো। এক দিন পরই তার কাছে গিয়েছিলাম। খুব ভালো লেগেছে তার ব্যবহার। অন্যান্য ডাক্তার, নার্স, জুনিয়ররা অসাধারণ। রক্ত পরীক্ষা, ইসিজি অনেক কিছু করে ২৮ এপ্রিল সকাল সাড়ে ৮টায় বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ে চোখের অপারেশন করিয়েছি। বঙ্গবন্ধু বিশ্ববিদ্যালয়ের কেবিন ব্লকের ওপরের দিক পুরোটাই প্রায় চমৎকার ঝকঝকে তকতকে অপারেশন থিয়েটার। ভিসি প্রাণ গোপালের সময় আরও ঝকঝকে ছিল। ২৮ এপ্রিল রবিবার অধ্যাপক জাফর খালেদ আমাকে দিয়েই সেদিনের অপারেশন শুরু করেছিলেন। ১৮-২০ বছর আগে দিল্লিতে সুখদা হসপিটালে ডা. দীপঙ্কর বসু ডান চোখের অপারেশন করেছিলেন। দীপঙ্কর বসুর কাছে যাওয়ার পরামর্শ দিয়েছিলেন লন্ডন থেকে পড়ে আসা শিশু চক্ষু বিশেষজ্ঞ ডা. সাব্বির। সাব্বির আবার আমার খুবই প্রিয় অধ্যাপক ডা. সমীর কুমার সাহার বন্ধু। সমীর যখন বেনারস বিশ্ববিদ্যালয়ে পিএইচডি করতে গিয়েছিল তখন বেশ কয়েকবার আমার বর্ধমানের সদরঘাটের ঠিকানায় গেছে। বড় ভালো মানুষ, মেধাবী ছাত্র। সমীরই সাব্বিরের কাছে পাঠিয়েছিল। সাব্বির পাঠিয়েছিল দিল্লিতে। এবার আর ইল্লি-দিল্লি করতে ইচ্ছা হয়নি। চিকিৎসা শাস্ত্রে দেশে অনেক উন্নতি হয়েছে। তাই বঙ্গবন্ধু মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপক ডা. জাফর খালেদের হাতে অস্ত্রের নিচে চোখ দিয়েছিলাম। দিল্লিতে অজ্ঞান করে অপারেশন করিয়েছিল। অজ্ঞান করলেও চোখের সামনে জোনাকি পোকার মতো এটাওটা জ্বললেও মনে হয় সমস্ত অপারেশন বুঝতে পারছিলাম। কিন্তু চোখে কোনো বোধ ছিল না। এবার দেখলাম নতুন পদ্ধতি। অবশ করার কোনো নাম-নিশানা নেই। আগের দিন থেকে কী এক ওষুধ দেওয়া শুরু করেছিল, অপারেশনের দিন ১০-১৫ মিনিট পরপর ড্রপ দিচ্ছিল। যখন অপারেশন টেবিলে গিয়ে শুলাম তখনো দিচ্ছিল। শোয়ার পর সবকিছু স্বাভাবিক। শুধু চোখের ওপর আঠাওয়ালা এক মাস্ক লাগিয়ে দিল। সবই বুঝতে পারছিলাম। দু-তিন বার একটু একটু ব্যথা পাচ্ছিলাম। ব্যথা-বেদনার চাইতে অস্বস্তি একটু বেশি। আর চোখের ওপর এক আলো জ্বলছিল। একসময় কী যেন সরিয়ে নিল। ঘূর্ণিঝড়, সাইক্লোন, নিম্নচাপে গোধূলি আকাশ ঢেকে থাকলে যেমন হয় আমার চোখ তেমনই ছিল। কিন্তু যেই পর্দা সরিয়ে নিল ঝলমলে আকাশে সূর্যকিরণের মতো আলো এসে পড়ল। এরপর এদিক-ওদিক নাড়াচাড়া করে ডাক্তার বললেন, এখন লেন্স বসাচ্ছি। মাঝে মাঝেই চোখে পানি নাকি অন্য কিছু দিচ্ছিল বলতে পারব না। কিন্তু একটা কিছু চোখের মধ্যে অনুভব করলাম। কিন্তু কিছু বুঝতে পারলাম না। চোখের চারদিকে হাত চালানো বোঝা গেল। মিনিট বিশেকে অপারেশন শেষ। কে একজন উঠে বসতে বললেন। উঠতে গিয়ে ভালো লাগছিল না। নিচের দিকে তাকাতে বারণ করলেন। মিনিট দশেক পর অপারেশন থিয়েটার থেকে ৫০ গজের মধ্যে আইসিইউতে এসে নির্ধারিত বেডে শুয়ে পড়লাম। পরে শুনলাম, ওই বেডে ওর আগেও একদিন কয়েক ঘণ্টা ছিলাম। দীপের আম্মুকে ডাকতে বললাম। দীপের আম্মুসহ ফরিদ, আলমগীর, সোহাগ এলো। দীপের মা আমার বুকের ওপর হাত রেখে বসে রইল। ১০টা ৪০ মিনিটে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বাড়ি ফিরলাম। চোখে পানি দেওয়া বন্ধ। নিচে সিজদা দিয়ে নামাজ পড়া যাবে না, চেয়ারে বসে পড়তে হবে- সেই সই।

আজ ১০ দিন অপারেশন হয়েছে। ভালোই আছি। অত্যাধুনিক চিকিৎসায় আমাদের দেশ যে অনেক এগিয়ে গেছে এটা  মরমে মরমে উপলব্ধি করছি। এদিকে আওয়ামী লীগ সভানেত্রী, প্রধানমন্ত্রী তাঁর চোখে সফল অস্ত্রোপচার করিয়েছেন। তিনি ভালো থাকুন, সুস্থ থাকুন কায়মনে তা-ই কামনা করি। তারও বঙ্গবন্ধু মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ে এ অসাধারণ অপারেশন হলে দেশের চিকিৎসা শাস্ত্রের সঙ্গে জড়িতদের গর্বে বুক কতটাই না ফুলে যেত।

 

                লেখক : রাজনীতিক।

www.ksjleague.com

সর্বশেষ খবর