বৃহস্পতিবার, ১১ জুলাই, ২০১৯ ০০:০০ টা

ভারতের ভয়াবহ জাতপ্রথা

তসলিমা নাসরিন

ভারতের ভয়াবহ জাতপ্রথা

আর্টিক্যাল ফিফটিন নামে ভারতে একটি সিনেমা বানানো হয়েছে। ওতে হিন্দুরা যে এখনও তাদের ভয়াবহ জাতপ্রথা ঘটা করেই চর্চা করছে, তা দেখানো হয়েছে। পৃথিবীতে নিকৃষ্ট যে কটি প্রথা আছে, এর মধ্যে জাতপ্রথা অন্যতম। নিচু জাতের পুরুষ এবং নারী উভয়ে উঁচু জাত দ্বারা অত্যাচারিত হয়। সবচেয়ে বেশি অত্যাচারিত হয় নিচু জাতের মেয়েরা। তাদের গণধর্ষণ করে গলায় দড়ি বেঁধে গাছের ডালে ঝুলিয়ে দেয় ধর্ষক দল। গ্রামে ছড়িয়ে দেওয়া হয় খবর, এরা খারাপ পথে গিয়েছিল, তাই ধরা পড়ার পর লজ্জায় আত্মহত্যা করেছে। মেয়েদের আত্মীয়রাও এমন মিথ্যে বলতে বাধ্য হয়। বাঁচার জন্য।

লক্ষ করেছি অধিকাংশ নিচু জাতের লোক মেনে নেয় যে, তারা নিচু জাত, তারা দলিত, উঁচু জাতের কারও সামনে তাদের চেয়ারে বসা নিষেধ, উঁচু জাতের সামনে গ্লাসে জল খাওয়া নিষেধ, জুতো পরা নিষেধ, উঁচু জাতের কারো ছায়া মাড়ানো নিষেধ। উঁচু জাত খাবার খেয়ে এঁটো কাঁটা যা ফেলে দেয়, তার ওপর গড়াগড়ি খেলে দলিতদের রোগ শোক দূর হয়। হাজারো কুসংস্কারে কিলবিল করছে সমাজ। ভগবানের বিধান বলেই মানা হয় এই জাতপ্রথাকে। উঁচু জাত যেমন ভগবানের বিধান মেনে নেয়, নিচু জাতও মেনে নেয়।

সংবিধানে জাতপ্রথার বিরুদ্ধে বলা হলেও, মানুষ জাতপ্রথা মেনে চলে। যারা মানে না বলে গর্ব করে, তাদের অনেককে দেখেছি মনে মনে মানে। তারা নিচু জাতের সঙ্গে বন্ধুত্ব হয়তো করছে, এক সংগে এক টেবিলে বসে খাচ্ছে হয়তো। কিন্তু বিয়ের সময় ঠিকই জাত দেখছে। উঁচু জাতের কেউ জেনে বুঝে নিচু জাতের কাউকে বিয়ে তবেই করে, যদি নিচু জাতটির ধনসম্পদ প্রভাব-প্রতিপত্তি আকর্ষণীয় রকম বেশি।

সংবিধানের ১৫ ধারায় লেখা আছে, কোনও মানুষের জাত, ধর্ম, লিংগ, বর্ণ, জন্মস্থানের ভিত্তিতে কারও ওপর বৈষম্য তো করা যাবেই না, অন্য কোনও কিছুর ভিত্তিতেও বৈষম্য চলবে না। মোদ্দা কথা জাতি, ধর্ম, বর্ণ নির্বিশেষে রাষ্ট্রের সব নাগরিকের অধিকার সমান। কিন্তু মুশকিল হলো, অধিকাংশ মানুষের কাছে রাষ্ট্রের চেয়ে বড় ধর্ম। এখন আবার ধর্মভিত্তিক রাষ্ট্র বানানোর জন্য কিছু হিন্দুত্ববাদীর একটি শক্তিশালী অংশ বদ্ধপরিকর। যদি কোনও দিন ভারতবর্ষ সত্যি সত্যিই হিন্দু রাষ্ট্র হয়ে ওঠে, তবে অহিন্দুদের জন্য তো বটেই, নিচু জাতের হিন্দুদের এবং দলিতদের বেঁচে থাকা অসম্ভব হয়ে উঠবে।

পুলিশদের রক্ষক ভাবতে শিখিয়েছিলেন আমাদের পূর্বপুরুষরা। এই পুলিশরাই কখন যে আমাদের অজান্তেই ভক্ষকে পরিণত হয়েছে! এই আর্টিক্যাল ১৫ ছবিটিতেও দেখি উঁচু জাতের লোকদের সংগে মিলে পুলিশেরাও গণধর্ষণে অংশ নিয়েছে। পুলিশদের মানুষ আর শ্রদ্ধা করে না। সন্ত্রাসীদের যেমন ভয় পায়, পুলিশদেরও পায়। সব পুলিশ তো আর অন্যায় করে না, সৎ পুলিশের, সৎ উকিলের, সৎ বিচারকের, সৎ রাজনীতিকের জন্য এখনও সৎ মানুষেরা অপেক্ষা করে এই অসততায় ছেয়ে যাওয়া পৃথিবীতে।

আর্টিক্যাল ১৫ দেখে অনেক মানুষই বাহ্বা বলছে। যারা বলছে তাদের মধ্যে যারা উঁচু জাত, তারা কি জাতপ্রথায় একেবারেই বিশ্বাস করে না? এই ছবি দেখার পর তারা কি নিচু জাতকে আর নিচু চোখে দেখবে না? তারা কি মেয়েদের সমানাধিকারে বিশ্বাস করতে শুরু করবে? আমার কিন্তু মনে হয় না তারা শৈশব থেকে যে বৈষম্য শিখে এসেছে সেই শেখা এক ফুঁয়ে হাওয়ায় উড়িয়ে দেবে। তবে এইভাবে শিল্পে সাহিত্যে জাতপ্রথার বিরুদ্ধে, লিংগ বৈষম্যের বিরুদ্ধে শুভবুদ্ধিসম্পন্ন মানুষকে কথা বলে যেতে হবে। ভারতবর্ষে মুসলিমদের নিয়ে যেমন রাজনীতি হয়, দলিতদের নিয়েও রাজনীতি হয়। সংবিধান বা আইন জাতপ্রথাকে স্বীকার করে না, কিন্তু সমাজ করে। শতাব্দীর পর শতাব্দী দলিতদের প্রাপ্য সুবিধে থেকে বঞ্চিত করার পর ক্ষতিপূরণের পালা চলছে, দলিতদের শিক্ষা এবং চাকরি ক্ষেত্রে সরকারি সুবিধে দেওয়া হয়। কিন্তু আজও সমাজে তারা ঘৃণ্য, আজও তারা স্পর্শের অযোগ্য, আন্টাচেবল। আর্টিক্যাল ১৫ ছবিটি ছবি হিসেবে উঁচু মাপের কিছু নয়। কিছুদিন আগে কানের পাম দ’র পাওয়া জাপানি ছবি ‘শপলিফটার্স’ দেখার পর আর্টিক্যাল ১৫-কে লাগছে একটা চড়া মাপের মেলোড্রামা। কিন্তু তা হলেও কিছু সত্য ঘটনার ওপর ভিত্তি করে চলচ্চিত্রটি নির্মিত। জাতপাতের অত্যাচার আর গণধর্ষণের পর মেয়েদের গলা টিপে মেরে ফেলা, বা বাস থেকে ফেলে দিয়ে মেরে ফেলা, বা গাছের ডালে জ্যান্ত ঝুলিয়ে দিয়ে মেরে ফেলা, বা কুচি কুচি করে কেটে মেরে ফেলা- সবই ঘটছে এই ভারতবর্ষে। এই উপমহাদেশে, মাঝে মাঝে আমি ভাবি, নারী নির্যাতন নিয়ে উপন্যাস লিখতে গেলে বা চলচ্চিত্র নির্মাণ করতে গেলে কল্পনার আশ্রয়ের দরকার পড়ে না, শুধু সত্য কিছু ঘটনার বর্ণনা করলেই হয়। বাস্তবের বর্বরতা বা বীভৎসতা কুৎসিততম কল্পনাকেও হার মানাবে।

উঁচু জাত নিচু জাতের মানুষদের কী রকম ঘৃণা করে, সে আমরা দেখেছি। উঁচু জাতের পুরুষেরা নিচু জাতের মেয়েদের ধর্ষণ করে তাও দেখেছি। কিন্তু নিচু জাতের পুরুষেরা কি উঁচু জাতের মেয়েদের ধর্ষণ করে না? মেরে ফেলে না? এমন ঘটনা কিন্তু ঘটে না, তা নয়। তাহলে সমস্যাটা শুধু উঁচু জাতের মধ্যে নয়। সমস্যাটা সব জাতের পুরুষের মধ্যে। সব জাতের পুরুষেরা সব জাতের সব শ্রেণির সব ধর্মের মেয়েদের অত্যাচার করে। জাত বৈষম্য ঘোচানোর জন্য যত উদ্যোগ ভারতবর্ষ নিয়েছে, লিংগ বৈষম্য ঘোচানোর তত উদ্যোগ কিন্তু নেয়নি। সম্ভবত এই কারণে যে, উঁচু নিচু সব জাতের সমাজই ভয়াবহ রকম পুরুষতান্ত্রিক। পুরুষতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থায় বাস করে নারীর সমানাধিকারের ব্যাপারে সচেতন, এমন মানুষ, সে নারী হোক, বা পুরুষ হোক, অত্যন্ত কম। লিংগ বৈষম্যকে বৈষম্য হিসেবে না মানার লোকের সংখ্যা আশংকাজনকভাবে বেশি।

এই উপমহাদেশে, উচ্চবিত্ত এবং মধ্যবিত্ত মেয়েরা ইস্কুল কলেজে যাচ্ছে, চাকরি বাকরি করছে, স্বনির্ভর হচ্ছে। কিন্তু এই সমাজে মেয়েরা যে জাতেরই হোক, যে ধর্মেরই হোক, যে শ্রেণিরই হোক, যে বিত্তেরই হোক, যে বিদ্যারই হোক, সব এক। মেয়েরা সব জাতের, সব ধর্মের, সব শ্রেণির, সব বিত্তের, সব বিদ্যার পুরুষের কাছে এক। তারা শুধু শরীর। এই শরীরগুলোয়, সব পুরুষই মনে করে, হাত দেওয়ার অধিকার, এই শরীরগুলো তছনছ করার, ধর্ষণ করার, রক্তাক্ত করার অধিকার তাদের জন্মগত।

লেখক : নিবাসিত লেখিকা

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর