মঙ্গলবার, ৮ অক্টোবর, ২০১৯ ০০:০০ টা

রঙের খনি যেখানে দেখেছি

হোসেন আবদুল মান্নান

বেশ কদিন ধরে ভাবছি একান্ত ব্যক্তিগত আত্মতুষ্টিবিষয়ক একটি ছোট্ট প্রবন্ধ লিখব। তাই আসন্ন শারদীয় দুর্গোৎসবের মহালগ্নে আজকের ছুটির দিনটি বেছে নেওয়া হলো। লেখার শিরোনাম করা হয়েছে প্রখ্যাত গণসংগীতশিল্পী ভূপেন হাজারিকার একটি জনপ্রিয় গানের সবচেয়ে আকর্ষণীয় কলির অংশবিশেষ থেকে। অবশ্য এ ক্ষেত্রে গানটির স্রষ্টা বা গীতিকারের নাম আড়ালে ফেলে রাখার কোনো অর্থ হয় না। তিনি শিবদাস বন্দ্যোপাধ্যায়। আর গানটি হলো ‘আমি এক যাযাবর’।

গত দুই বছর চট্টগ্রাম বিভাগে চাকরি করার সুযোগে আমার এ অঞ্চলের নানা ঐতিহাসিক স্থান, হাট-বাজার, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, পাহাড়-পর্বত, নদী-নালা, সমুদ্রসৈকতসহ বিচিত্র সব জনপদ দেখার সৌভাগ্য হয়। দাফতরিক দায়িত্ব পালনের পাশাপাশি আমি নিজের দেশকে, নিজের জন্মভূমিকে যেন স্পর্শ করে বা কখনো আলিঙ্গন করে অবলোকনের চেষ্টা করেছি। এ রকম দেখাকে কেবল তাকানো বলা যাবে না। গভীর মনোযোগের সঙ্গে আত্মোপোলব্ধির ভিতর দিয়ে প্রত্যক্ষ করার নিরন্তর প্রয়াস বলা যায় একে। আমরা অনেক অর্থ ব্যয় করে বিদেশ গিয়ে প্রকৃতির কত শত নিসর্গ বন্দনা করি অথচ ঘরের কাছে অবহেলায় পড়ে আছে শত সহস্র রত্ন-ধন ভান্ডার। আমরা কেউ এতে বেশি গুরুত্ব দিতে চাচ্ছি না। রবিঠাকুর বলেছেন, ‘দেখা হয় নাই চক্ষু মেলিয়া, ঘর হইতে শুধু দুই পা ফেলিয়া’ জাতি হিসেবে আমাদের এমন বদনাম আছে। একে মস্তবড় অমার্জনীয় অপরাধ বলেও গণ্য করা যায়। যদিও ভালো করে না দেখার প্রবণতা দুনিয়ার আরও কতিপয় জাতির মধ্যে বিরাজমান। তবে স্বদেশকে জানো, মাতৃভূমিকে নমো। এ স্লোগান এখন সর্বজনীন।

বাংলাদেশের দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চলে ছড়িয়ে থাকা নানা প্রাকৃতিক সম্পদের ভিড়ে মনে হয় আমরা অনেক ইতিহাস-প্রসিদ্ধ, ঐতিহ্যবাহী, সংস্কৃতি ও সভ্যতা বিনির্মাণকারী প্রাচীন শিক্ষানিকেতন বা বিদ্যালয়গুলোকে ক্রমাগত অবজ্ঞা করে চলেছি। জাতির প্রধান অবলম্বন শিক্ষাকেই গুরুত্বহীন বিবেচনা করছি কিনা তাও ভাবতে হবে। আমরা উচ্চশিক্ষিত সমাজ সচেতনরাও কি কখনো জানতে চাই- নিজের প্রথম জীবনের হাতেখড়ি যেখানে সেসব বিদ্যালয় আজকে কীভাবে চলেছে? দেশে এর অবস্থান কোথায়, নতুন প্রজন্ম কেমন বিদ্যার্জন করে বছরান্তে বের হয়ে যাচ্ছে। আসলে কোথায় যাচ্ছে তারা, এখন শিক্ষক কারা, ব্যবস্থাপনাই বা কার হাতে, আমরা সবাই কী করছি? এমন সব প্রশ্নের পাহাড় এসে আপনাকে হয়তো সহসা কিংকর্তব্যবিমূঢ় করে তুলতে পারে। কারণ বাস্তবতা হলো, আমরা এসব নিয়ে খুব বেশি জড়িত, বিচলিত বা ভাবিত নই।

আমার কর্মজীবনের এই সময়ে এসে আসা-যাওয়ার পথের ধারে দুই চোখ ভরে দেখছি, কখনো তন্দ্রাকে ছুটি দিয়ে প্রাণ খুলে গ্রাম-গঞ্জ, পাড়া-মহল্লা, হাট-ঘাট, শ্যামল ধানের খেত, অগণিত মানুষ আর সারি সারি সবুজ বৃক্ষের মিছিল উপভোগ করে চলেছি। যখনই দেখেছি পুরনো ভবন, বটের শাখা গজানো শতাব্দীপ্রাচীন শিক্ষালয়, শিক্ষার্থীদের কোলাহল, বর্ণিল পোশাকে পরিপাটি শিশুর দল, তাৎক্ষণিক থেমে গেছি, ভিতরে গিয়ে জানার চেষ্টা করেছি। বিদ্যালয়টি কবেকার, নামকরণের তাৎপর্য কী? কোন প্রেক্ষাপটে এটি স্থাপিত হয়। কারা ছিল এই প্রতিষ্ঠানের সাবেকরা ইত্যাদি। এখন কীভাবে চলছে শতবর্ষী এসব সরস্বতীর পুণ্য পাদপীঠ? কখনো আনন্দিত হয়েছি, উচ্ছ্বসিত হয়েছি, কখনো বা অশ্রুসিক্ত বেদনাবিধুর হয়েছি। তবু থেমে থাকিনি। যেখানেই যাচ্ছি পথের টানে আকস্মিক অনেকটা অনধিকার, অপ্রত্যাশিত প্রবেশ করেছি বিদ্যালয়গুলোয়। কথা বলেছি, মতবিনিময় করেছি। হারানো দিনের কথা, জীবনধর্মী, জীবনব্রতী নিষ্পাপ সেকালের শিক্ষকদের কথা, ভালো ছাত্রছাত্রীর কথা, দেশের কথা, স্বাধীনতার কথা, জাতির পিতার কথা, আমাদের বদলে যাওয়া দেশের কথা, মানবিক বাংলাদেশ গড়ার কথা। আরও প্রসঙ্গক্রমে বলতে বলতে দ্রুত হেঁটে চলে গেছি দূরে। আমার সন্তানদের সঙ্গে আলাপ করেছি বহুবার। তারা প্রতিদিন যা শিখছে যথার্থভাবে শিখছে কিনা, প্রমিত শুদ্ধভাবে শিখছে কিনা, বস্তুনিষ্ঠতা রয়েছে কিনা, ইতিহাস বিকৃতির শিকার হচ্ছে কিনা তাও যতেœর সঙ্গে পরখ করে দেখার চেষ্টা করেছি।

শ্রেণিকক্ষে প্রবেশ করে উজ্জ্বল ঝলমলে একঝাঁক তরুণ-তরুণীকে কিছু প্রশ্ন করে কখনো হতাশ হলেও আনন্দ পেয়েছি অনেকবার। কেননা তাদের হাতেই সবচেয়ে নিরাপদ থাকবে আমাদের কাক্সিক্ষত উন্নত বাংলাদেশ। শিক্ষকদের উদ্দেশ করে মাঝেমধ্যে বলেছি, ‘শ্রেণিকক্ষে ছাত্রছাত্রীরা অমনোযোগী এর কারণ শিক্ষকদের মাঝে খুঁজতে হবে। এতে ছাত্রছাত্রীরা দায়ী নন।’ একই সঙ্গে ব্রার্ট্রান্ড রাসেলকে স্মরণ করে বলেছি ছাত্রছাত্রীদের ভালো শ্রোতা হতে হবে।Listener  হওয়ার উপকারিতা নিয়েও নানা কথা বলেছি। কখনো আলবার্ট আইনস্টাইনের উক্তি- It is the supreme art of the teacher to awaken joy in creative expression and knowlede - অর্থাৎ এর দায় বহুলাংশে শিক্ষকদের। ছাত্রছাত্রীদের নিত্য আকৃষ্ট করে তোলাই একজন শিক্ষকের সবচেয়ে বড় সফলতা। কখনো বলেছি, A teacher can never truly teach unless he is still learning himself -শিক্ষককেই অধিক পড়তে হবে। তার প্রস্তুতির ওপর নির্ভর করবে শ্রেণিকক্ষটি পরিপূর্ণ থাকবে কিনা। অন্যদিকে প্রস্তুতিবিহীন কালক্ষেপণে দিন দিন শ্রেণিকক্ষ ফাঁকা হতে থাকে। এসব প্রসঙ্গ প্রায়ই এসেছে আমার অনির্ধারিত প্রবেশে এবং প্রভাষণে; যা শিক্ষার্থীরা সাময়িক হলেও মুগ্ধতায় আচ্ছন্ন করতে পেরেছে।

দুই বছরে চট্টগ্রাম বিভাগের বিভিন্ন জেলা, উপজেলা এমনকি ইউনিয়ন পর্যায়ে গিয়েও বেশ কিছু জনশ্রুতিখ্যাত বিদ্যালয়ে ঢুকেছি, কথা বলেছি বা প্রতিষ্ঠানের অভ্যন্তরীণ পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতার প্রতি নজর দিয়েছি। কখনো কিছু কিছু স্থানে আর্থিক অনুদান পাঠিয়েছি এমন তালিকা থেকে বলা যায়, ব্রাহ্মণবাড়িয়ার বিখ্যাত অন্নদা সরকারি উচ্চবিদ্যালয় যা ১৮৭৫ সালে প্রতিষ্ঠিত। বলা যায়, অসংখ্য মহারথীর জন্মদানকারীর মধ্যে অদ্বৈত মল্লবর্মণকে বাংলা ভাষা কখনই ভুলে যাবে না। সর্বদক্ষিণে সেন্ট মার্টিন বি এন ইসলামিক উচ্চবিদ্যালয়, টেকনাফ যা ১৯৯০ সালে প্রতিষ্ঠিত হয়। বান্দরবান পার্বত্য জেলার থানচিতে গিয়ে নৃতাত্ত্বিক জনগোষ্ঠী অধ্যুষিত এক বালিকা বিদ্যালয় পরিদর্শন করে সত্যিই অভিভূত হই। ১৯১৬ সালে প্রতিষ্ঠিত চান্দিনা সরকারি মডেল উচ্চবিদ্যালয়, কুমিল্লা। নোয়াখালী জিলা স্কুল যা ১৮৫০ সালে জনৈক ব্রিটিশ কর্মকর্তার উদ্যোগে প্রতিষ্ঠিত হয়। চৌমুহনীর মদন মোহন উচ্চবিদ্যালয় ১৯১৭ সালে স্থাপিত। ফেনী সরকারি বালিকা বিদ্যালয় স্থাপিত হয় ১৯১০ সালে। দুবার দেখা হয় কালেক্টরেট স্কুল অ্যান্ড কলেজ, লক্ষ্মীপুর। ১৯১৭ সালে স্থাপিত চাঁদপুরের মতলব জে বি পাইলট উচ্চবিদ্যালয়ও একসময় দেখতে যাই। এ ছাড়া চট্টগ্রাম মহানগরের অসংখ্য স্কুল-কলেজের সঙ্গে সরাসরি সম্পৃক্ত থাকার সুবাদে দর্শন-পরিদর্শনের সুযোগ হয়। উল্লেখ করা যায়, চট্টগ্রামের কিংবদন্তি বিপ্লবী প্রীতিলতা ওয়াদ্দেদারের স্কুল ডাক্তার খাস্তগীর বালিকা উচ্চবিদ্যালয় ১৯০৬ সালে স্থাপিত হয়। প্রীতিলতা ১৯২৭ সালে এ স্কুল থেকে ম্যাট্রিকুলেশন পরীক্ষায় অসাধারণ রেজাল্ট করেছিলেন। ফটিকছড়ির করোনেশন হাইস্কুল পরিদর্শন করি একাধিকবার। এ স্কুলটি ১৯১২ সালে স্থাপিত হয়। বিপ্লবী বিনোদ বিহারী চৌধুরী এ স্কুলেরই ছাত্র ছিলেন। ১৮৩৬ সালে স্থাপিত হয় চট্টগ্রামের বিখ্যাত কলেজিয়েট স্কুল। দাফতরিক ও সাংস্কৃতিক আয়োজনে অনেকবার গিয়েছি এ স্কুলের আঙিনায়। বিস্তীর্ণ মাঠ দেখে সব সময় মুগ্ধ হয়েছি। এমন আরও অনেক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে সম্পূর্ণ স্বতঃস্ফূর্তভাবে গিয়েছি। ছাত্র-শিক্ষকের সঙ্গে নানা বিষয়ে আলোচনা করেছি। লেখাপড়ার সার্বিক মানোন্নয়ন নিয়েও আলাপ করেছি।

ঘুরে ঘুরে আমি সর্বত্র ছড়িয়ে পড়া আলোর সন্ধান করেছি। যেন গোটা মাতৃভূমিই আলোয় উদ্ভাসিত হয়ে উঠেছে। ছাত্রছাত্রীদের চোখে, মুখে, ভাষায়, পোশাকে, আচরণে তা ক্রমেই প্রতিভাত হয়ে উঠছে। এখন আমাদের প্রয়োজন কেবল সরকার নয়, যার যেমন অবস্থান সেখান থেকে এবং নিজের অধিকার ও দায় থেকে প্রতিষ্ঠানগুলোর দিকে খেয়াল রাখা। ভাবতে হবে, প্রতিষ্ঠানগুলো মরে গেলে বা পথ হারালে আপনি নিজেও এর জন্য খানিকটা দায়ী হবেন। কারণ, এর নেতিবাচক প্রভাব আপনাকেও ক্রমে স্পর্শ করে যাবে। নিজে সামান্য বিচ্ছিন্ন থাকলেও ভবিষ্যতে আপনার সন্তান মুক্ত থাকতে পারবে না। এখন দেশের সব বিদ্বান, শিক্ষিত, বিত্তবান, খ্যাতিমান, নিবেদিতপ্রাণ সমাজসেবীকে একসঙ্গে এগিয়ে আসতে হবে। তারা স্ব স্ব এলাকার নিজের শৈশব-কৈশোরের স্মৃতিময় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো দর্শন-পরিদর্শন এবং ন্যূনতম হলেও দায়িত্ব পালন করবেন।

আমাদের মানুষই আমাদের বড় সম্পদ। আমাদের ছাত্রছাত্রীর সংখ্যা প্রায় ৫ কোটি। ভাবলে যে কোনো দেশ বিস্মিত হয়ে যায়। বিনামূল্যে বই, শিক্ষা উপকরণ, মিড-ডে-মিল, বিনা বেতনে পড়ার সুযোগ এসব কি অতীতে আমরা কল্পনাও করতে পেরেছিলাম? এমন ছাত্রাধিক্যের দেশে মানসম্মত শিক্ষকের প্রবল সংকটকে দীর্ঘস্থায়ী হতে দেওয়া যায় না। ৫ অক্টোবর বিশ্ব শিক্ষক দিবস। দেশে শিক্ষকের সংখ্যা পায় ১০ লাখ। ইউনেস্কো এ বছর দিবসটির প্রতিপাদ্য করেছে- ‘তরুণ শিক্ষকরাই পেশার ভবিষ্যৎ’। তরুণরাই গড়বে জাতি, করবে জয়। নিশ্চয়।

                লেখক : গল্পকার ও প্রবন্ধকার।

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর