লিখতে বসে খবর পেলাম প্রবীণ নেতা রহমত আলী আর নেই। ইন্না লিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউন। তিনি চিরদিনের জন্য না-ফেরার দেশে চলে গেছেন। মাস পার হয়েছে কিনা বলতে পারব না কালিয়াকৈরের এই প্রবীণ নেতাকে দেখতে গিয়েছিলাম। বাড়ির সবাই পরম যত্ন করেছিল। এক বিশাল ফুলের তোড়া দিয়ে অভ্যর্থনা করেছিল। জনাব রহমত আলী সেদিন চিনতে পেরেছিলেন কিনা জানি না। কিন্তু তার মেয়ে রুমানা আলী এমপি দারুণ যত্ন করেছিল। ওরা ছোট থাকতে অনেকবার ওদের বাড়ি গেছি। সেই প্রিয় মানুষটি চলে গেছেন। আল্লাহর কাছে প্রার্থনা করি, তিনি যেন তাকে মাফ করে বেহেশতবাসী করেন, আর তার পরিবার-পরিজনকে এই শোক সইবার শক্তি দান করেন।
আজ কদিন খালেদা জিয়াকে নিয়ে ব্যাপক আলোচনা। একজন আইনবিদের ছেলে হিসেবে খালেদা জিয়ার মামলা ভালোভাবে নিতে পারিনি। কারণ জিয়া ট্রাস্টের অর্থ লেনদেনের সঙ্গে খালেদা জিয়ার কোনো সম্পৃক্ততা নেই, তাঁর কোনো সই-সাবুদও নেই। উপরন্তু যে টাকা তছরুপের অভিযোগ, পদ্মা সেতুতে আবুল হোসেনকে অপরাধী সাজাবার মতো বরাদ্দের আগেই দুর্নীতি এটাও ঠিক তেমন। যে টাকা তছরুপের অপরাধে শাস্তি সে টাকার চার গুণ এখনো ব্যাংকে জমা, তার পরও শাস্তি! তা যাই হোক, অনেকের ক্ষেত্রে এমন হতেই পারে এবং হয়েও থাকে। ৮ ফেব্রুয়ারি, ২০১৮ খালেদা জিয়াকে কারাগারে নেওয়া হয়েছে। দুই বছর পার হয়ে কয়েকদিন। তাঁর শারীরিক অবস্থা ভালো না, এটা সবার জানা। আমি কারও ভয়ে নিজের কথা, বুকের ব্যথা ব্যক্ত করতে কখনো দ্বিধা করিনি। বেগম খালেদা জিয়া কারাগারে মারা গেলে যে যাই বলুন তিনি এক মহান শ্রেষ্ঠ জাতীয় নেতার মর্যাদা পাবেন। মুক্তিযুদ্ধের সময় পাকিস্তানের কারাগারে বঙ্গবন্ধু যদি মারা যেতেন তিনি সারা পৃথিবীতে শ্রেষ্ঠ জনপ্রিয় নেতার স্থান পেতেন। আবরাহাম লিংকন, জর্জ ওয়াশিংটন, মহাত্মা গান্ধী- এঁরা অনেক পিছে পড়ে যেতেন। স্বাধীন বাংলাদেশে মাত্র কদিন বেঁচে থেকে কত প্রশ্নের মুখে পড়েছেন। তাই সরকার তাঁকে জেলে মরতে দেবে না। আর যদি দেন তা হবে চরম বোকামি। তাহলে কী করবে? একদিন অতিসঙ্গোপনে উন্নত চিকিৎসার নামে বিদেশে পাঠিয়ে দেবে। উন্নত চিকিৎসার নামে বিদেশে নিয়ে যাওয়ার জন্য এখন প্রায় সবাই এক পায়ে খাড়া। তাই কাজটা অনেক সহজ হয়ে গেছে। অন্যদিকে বিএনপির অনেক বড় নেতা সরকারের খেয়ে, সরকারের পরে, সরকারের সমালোচনা করে বহাল তবিয়তে আছেন। তাই সরকার যদি ভালোভাবে যেতে পারে তাহলে বিএনপির কোনো সমস্যাই না। বিএনপি সমস্যা হতে পারত রাজনৈতিক হুমকি হতে পারত যদি লন্ডনবাসী তারেক রহমান সবকিছু উপেক্ষা করে বাংলাদেশে এসে জেল-জুলুম সহ্য করতেন অথবা বিএনপিকে তাঁর হাতের মুঠোয় রাখার চেষ্টা না করতেন। আমার বিশ্বাস- দিনে চাঁদ উঠতে পারে, লন্ডনে বসে ছড়ি ঘুরিয়ে তারেক রহমান বিএনপির নেতা হতে পারেন; কিন্তু বাংলাদেশের নেতা হতে পারবেন না।
বহুদিন পর দেশের শেষসীমা সোনা মসজিদের কাছে রহনপুরের প্রসাদপুর গ্রামে অ্যাডভোকেট নুরুল ইসলাম সেন্টুর ছেলে ফেরদৌসের বউভাতে গিয়েছিলাম। সে এক অসাধারণ আয়োজন। আসলে সৎ সরল ভালো মানুষের সঙ্গে মেলামেশার আনন্দই আলাদা। গিয়েছিলাম ১৩ তারিখ। রাজশাহী সার্কিট হাউসে দুপুরের খাবার খেয়ে চাঁপাইনবাবগঞ্জ সার্কিট হাউসে উঠেছিলাম। বেশ কয়েকজন নতুন অফিসার এসেছিলেন। তাদের সঙ্গে সদরের ইউএনও ছিল আমার টাঙ্গাইলের বাসিন্দা। তাদের বেশ ভালো লেগেছে। সন্ধ্যার পর রহনপুর থেকে চাঁপাইনবাবগঞ্জ এসে ফেরদৌস নিয়ে গিয়েছিল। ভালোই হয়েছে। সাত-আট বছর আগে পুরো পরিবার ওদের বাড়ি গিয়েছিলাম। আবার ওর বউভাতে গিয়ে রাত কাটিয়ে এলাম। ওদের বাড়ির পাশে পুরনো প্রসাদপুর কাঁঠালমোড় জামে মসজিদে জুমার নামাজ আদায় করেছি। খুবই ছোট্ট মসজিদ। কিন্তু খুব ভালো লেগেছে। বিশেষ করে যিনি খুতবা দিয়েছেন। অন্যকে হিংসা করা, খারাপ বলা, মেয়েদের অবহেলা করা, পরনিন্দা- এসব বিষয়ের ওপর অসাধারণ খুতবা শুনে তন্ময় হয়ে ছিলাম। সেখানে নুরুল ইসলামের ছেলে ফেরদৌসের বৈবাহিক জীবন আনন্দময় সুখের হোক সবার কাছে দোয়া চাইতে বিশেষ করে নামাজিদের কাছে অনুরোধ করেছি। আমার জন্যও দোয়া করতে বলেছি যত দিন বা যতক্ষণ বাঁচি ততক্ষণ যেন মানুষের কাজে লাগতে পারি, চলাফেরা করতে পারি। মসজিদ থেকে ফেরার পথে আরেকটা ছোট্ট তাঁবু টানানো দেখেছি। কিন্তু বুঝতে পারিনি। পরে ফেরার পথে শুনেছি সেটাও ছিল একটি বিয়ের আসর। আফসোস! আমার লেগেই রইল, ওখানে একটু গিয়ে কনের হাতে যদি দু-এক হাজার টাকা দিতে পারতাম, তাদেরও দোয়া করতে পারতাম সেটা অনেক ভালো হতো। মাঝে মাঝে এমন ভুল হয় যার সংশোধনের কোনো পথ থাকে না। এটাও তেমনই একটি ভুল। নামাজের পর অনুষ্ঠানস্থলে সবার সঙ্গে খেয়ে রওনা হয়েছিলাম। আমাকে নিয়ে আবার বড় বড় অনুষ্ঠানে কিছুটা অসুবিধা হয়। পোলাও-বিরিয়ানি-মাংস খাই না। শাক-সবজি-মাছ-ভাতে মানুষ। তারাও শাক-সবজি-ভর্তা, চ্যালা-মলা-ঢেলা, ছোট মাছ পাক করেছিল। অন্যদের হয়তো ভালো লাগবে না, কিন্তু আমার বেশ ভালো লেগেছে।
আড়াইটায় রহনপুর থেকে রওনা হয়ে নাচোল গোদাগাড়ী রাজশাহীর পাশ দিয়ে সাড়ে ৫টায় বনপাড়া বিমলের আস্তানায় পৌঁছেছিলাম। ৬টায় সেখান থেকে রওনা হয়ে ৮টা ১০ মিনিটে টাঙ্গাইল পৌঁছি। বহুদিন পর দুলালের গাড়িতে চাঁপাই গিয়েছিলাম। তেমন খুব একটা ক্লান্তি লাগেনি। আজ চার দিন ‘আমার দেখা নয়াচীন-শেখ মুজিবুর রহমান’ পড়ছিলাম। বছর ৪০ হবে বই পড়ায় কিছুটা অভ্যাস হয়েছে। ছাত্রজীবনে কোনো দিন পাঠ্যবইয়ের শেষ পাতা পড়ে দেখিনি। এখন হাজার পৃষ্ঠার বই হলেও পড়তে পারি। কোনো কোনো বই তো ক্ষুধা লাগলে ভাত খাওয়ার মতো আগ্রহ নিয়ে পড়ি। এ পর্যন্ত যত বই পড়েছি ‘আমার দেখা নয়াচীন’ তার মধ্যে শ্রেষ্ঠ। এমন এক আগ্রহ জন্মেছিল শেষ না করে শান্তি পাইনি। মূল লেখা ১১৯ পৃষ্ঠা। আরও শতাধিক পৃষ্ঠা নানা কিছু নিয়ে আবর্তিত। ছবিসহ সবকিছু দেখেছি, পড়েছি। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব আমার প্রকৃত ভালোবাসা। তাই তাঁর সবকিছুই ভালো লাগে ভালোবাসি। তার পরও বয়স হয়েছে অবশ্যই কিছু বিচার-বিবেচনা করতে পারি। তাই সবকিছুতেই অন্ধের মতো না। ‘আমার দেখা নয়াচীন’ পড়ে মনে হলো আমার নেতা শেখ মুজিব গঙ্গার বানে ভেসে এসে জাতির পিতা বা বঙ্গবন্ধু হননি। ’৫২ সালে শান্তি পরিষদের সম্মেলনে নয়াচীন সফরে গিয়ে তিনি যা দেখেছেন, যা শুনেছেন এবং বলেছেন ৩২ বছর বয়সের একজন মানুষের অমন দৃষ্টিভঙ্গি সবার হয় না। তিনি পতিতাদের নিয়ে যেভাবে আলোচনা করেছেন তার সেদিনের দৃষ্টিভঙ্গিতে পৌঁছতে আমার ৭০ বছর লেগেছে। ’৬৯-এ গণআন্দোলনে আমরা অনেক কিছু করতে চেষ্টা করেছি। আইয়ুব খানের চেয়ারম্যান, মেম্বার, ঘুষখোর কর্মকর্তা, গ্রামেগঞ্জে মুনাফাখোর, কালোবাজারি, সঙ্গে সঙ্গে কোথাও কোথাও পতিতা উচ্ছেদে হাত দিয়েছিলাম। আমি মির্জাপুর বরাটি নরদানা পাকিস্তান হাইস্কুলে পড়তাম। সেখানে বরাটি বাজারের দক্ষিণে একটা জীর্ণ পতিতালয় আর বিখ্যাত বটগাছ ছিল। বটগাছ ’৬৩-৬৪ সালেই হজম করেছিলাম। মানে প্রাইমারি স্কুল বড় করার সময় বটগাছ বাধা হওয়ায় তাকে কেটেকুটে শেষ করেছিলাম। একটা গাছ কাটা কোনো ব্যাপার না। কিন্তু সেটা ছিল মারাত্মক ব্যাপার। কয়েক দল হিন্দু গাছ কাটার চুক্তি করে দু-এক দিন ডালপালা কেটে দেবদেবীর ভয়ে আর আসে না। পরে আনা হলো মুসলমান দল। দুশ্চিন্তামুক্ত হলেন অনেকেই। কারণ তাদের দেবদেবীর ভয় নেই। কিন্তু দেখা গেল নতুন বিপত্তি। তারাও আসে না। কী ব্যাপার? হিন্দুরা আসে না গাছ কাটলে দেবদেবী তাদের ধ্বংস করবে, বংশ নির্বংশ হবে। মুসলমান আসে না কালসাপের ভয়ে। কদিন পর আমাদের হেডমাস্টার দুখীরাম রাজবংশীকে বললাম, স্যার! আমি গাছ কেটে দিতে পারি। দ্বিধা নিয়ে তিনি রাজি হলেন। আমিও গাছ কাটতে শুরু করলাম। প্রথম দিকে কতজন কত কথা বলল, কত টিটকারী দিল, গাছের ডালে ডালে কালসাপ। কিন্তু আমার ভয় পাওয়ার কিছু ছিল না। গাছের ডালে কুড়ালের আঘাতে সাপগুলোই বরং ভয়ে কুঁকড়ে গিয়ে পালানোর চেষ্টা করত। প্রথম দিকে কিছু সাপ দেখেছি ডালের সঙ্গে মিশে থাকতে। কিন্তু পরে আর কিছু দেখিনি। ভয়ে তারা পালিয়ে গিয়েছিল। আমিও প্রায় ২০-২৫ দিনে গাছের ডালপালা কেটে নাঙ্গা করে দিয়েছিলাম। অবশ্য পরে নিচের মূল কা-টি অন্যদের দিয়েই কাটানো হয়েছিল। এটা ’৬৩-৬৪ সালের কথা। বটগাছ কাটার কারণে ওই অঞ্চলে আমার চাইতে জনপ্রিয় কেউ ছিল না। রণদা প্রসাদ সাহাকে নিয়ে আলোচনা হতো। আমাকে নিয়ে তার চাইতে খুব একটা কম হতো না। সেই বরাটিতে ’৬৯-এ আইয়ুববিরোধী আন্দোলনে পতিতা উচ্ছেদে গিয়েছিলাম। আমি কোনো পতিতালয় চিনতাম না বা ভিতর দেখিনি। ১৩-১৪ বছর বয়সে আউলিয়াবাদে ও রকম এক জীর্ণ পতিতালয়ে ঝড়-তুফানে দৌড়ে গিয়ে উঠেছিলাম। আমরা ছিলাম চার-পাঁচজন। কস্তুরীপাড়ার দিক থেকে ফিরছিলাম। আচমকা ঝড়-তুফান, আউলিয়াবাদ বাজারের রাস্তার পাশে ছিল সেই পতিতার ঘর। আমরা দৌড়ে গিয়ে ঘরে ঢুকেছিলাম। কত হবে, ১০-১২ হাত লম্বা, সাত-আট হাত পাশ, ছনের বেড়া, টিনের ঘর। প্রায় আধঘণ্টা ছিলাম। তুমুল ঝড়-তুফান-বৃষ্টিতে ভেসে যাচ্ছিল। ওর মধ্যেই এক বিদ্যুৎ চমকের ঝাপটা। দরজার দুই-তিন ইঞ্চি ফাঁকে সেই চমক এসে পায়ের গোড়ালিতে লেগেছিল। আমার মনে হচ্ছিল কেউ যেন লাঠি দিয়ে আঘাত করেছে। চমকে উঠেছিলাম। আলোরও যে একটা শক্তি আছে জীবনে সেই প্রথম অনুভব করেছিলাম। তারপর এই প্রথম কোনো পতিতালয়ের ভিতরে আমরা ৮-১০ জন গেছি। দুজন মেয়ে এবং ছোট্ট একটা বাচ্চা সেখানে। পতিতাদের বাড়ি থেকে বের করে দিয়ে জ্বালিয়ে দেব- এই ছিল আমাদের উদ্দেশ্য। আমরা বাড়ির ভিতর ঢুকলে তাদের সে কী কান্না। তারা কোথায় যাবে, কী খাবে- এ নিয়ে চিৎকার। আমরা যে রূঢ় মেজাজে গিয়েছিলাম কয়েক মুহূর্তে কেমন যেন চুপসে গেলাম। মেয়ে দুটির চিৎকারে বাইরের কিছু লোকজনও এসেছিল। আমরা মুষড়ে গেলেও সাধারণ লোকজন খুবই ক্ষিপ্ত ছিল। তারা পারলে তখনই আগুন দেয়। লম্ফঝম্প করছিল, আর কিছু না। তখন ছাত্রদের ওপর সাধারণ মানুষের ব্যাপক আস্থা ছিল। আর আমি ছিলাম হাতে-পায়ে বড়সড় এক তালপাট সিং। কত আর হবে পাঁচ-সাত মিনিটে আমি গুটিয়ে গিয়েছিলাম। আমার বুক ধকধক করছিল। ছোট বাচ্চাটা ভয় পেয়েছিল সব থেকে বেশি। আমার মনে হচ্ছিল ঘর পোড়ানো তো দূরের কথা পতিতাদের বের করে দেওয়াও মানবিক হবে না। চলে এসেছিলাম। বলে এসেছিলাম এদের যেন কেউ বিরক্ত না করে। স্বাধীনতার পর আরেকবার গিয়েছিলাম টাঙ্গাইল পতিতালয়ে। শতাধিক নেতা-কর্মী, দারোগা-পুলিশ, ডিসি-এসপি-ওসি ছিল। সেই প্রথম ঘুরে দেখেছিলাম ওদের পরিবেশ। সেখানে এক অভাবনীয় ঘটনা ঘটেছিল। ’৬৯-৭০-এ ধনবাড়ীর পানকাত্তায় একটা জনসভা ছিল। ছাত্রনেতা হিসেবে চিৎকার করতে গিয়েছিলাম। হাত-পা ছুড়ে পিতার মতো আমিও বক্তৃতা করতে পারতাম। বক্তৃতা করতেন লতিফ সিদ্দিকী। ফজলুল করিম মিঠু, আল মুজাহিদী আর লতিফ সিদ্দিকীর মতো বক্তা আমি খুব একটা দেখিনি। সেই সভায় এইটে পড়া এক মেয়ে আমাকে দেখেছিল। মুক্তিযুদ্ধের সময় পাকিস্তানি হানাদাররা তার বাবা-মা-ভাই-বোনকে মেরে বাড়িঘর জ্বালিয়ে দিয়ে তাকে ক্যাম্পে নিয়ে যায়। তার সম্মান-সম্ভ্রম হরণ করে। কী বেদনার! বাবা-মা-ভাই-বোন সবাই নিহত। তার পরও ছোট্ট মেয়ে হানাদারদের লালসার শিকার। কদিন পর ছেড়ে দিলে মুক্তিযুদ্ধের মাঝেই তার এক দুঃসম্পর্কের চাচা তিন হাজার টাকায় টাঙ্গাইল পতিতালয়ে তাকে বিক্রি করে দেয়। কত আর হবে পাঁচ-ছয় মাস সে টাঙ্গাইল পতিতালয়ে ছিল। সে সময় সবাইকে নিয়ে আমি গেছি সেখানে। অনেকের সঙ্গে কথা হয়, অনেকেই অনেক অভাব-অভিযোগের কথা বলে। হঠাৎই সে মেয়েটি আমি যে পানকাত্তা গিয়েছিলাম সেই মিটিংয়ের কথা এবং পরবর্তী যাতনার কথা বলে। আমি যেন কেমন হয়ে যাই। ডিসি সাহেবকে বলি মেয়েটিকে এখনই মির্জাপুর হাসপাতালে পাঠিয়ে দিন। সেখানে যেন ভালোভাবে রাখা হয়। পরে দেখি কী করা যায়। আমি তাকে তিন-চারবার হাসপাতালে দেখতে যাই। সে সময় হঠাৎই এক সুইডিশ দল জাহাঙ্গীর সেবাশ্রমে আসে। তারা দত্তক নেওয়ার জন্য ঘুরছে। আমি মির্জাপুরে থাকা মেয়েটির কথা বললে তারা আমার সঙ্গে হাসপাতালে যায়। এরপর মেয়েটিকে নিয়ে যায় সুইডেনে। যেখানে সে লেখাপড়া করে। একসময় পিএইচডি করে। বিয়েশাদি করে অধ্যাপকের চাকরি নিয়ে বেশ সুখেই ছিল। ’৮৮-৮৯-এর দিকে আমায় এসব জানিয়ে চিঠি দিয়েছিল। আমি ভীষণ অভিভূত হয়েছিলাম। ’৯০-এ ভারত থেকে দেশে ফিরে কী করে যে বাচ্চাটির কথা ভুলে গিয়েছিলাম আর মনে পড়েনি। বঙ্গবন্ধুর ‘আমার দেখা নয়াচীন’ পড়তে পড়তে এবং চীনের পতিতাপল্লী নিয়ে তার আলোচনা থেকে হঠাৎই তার কথা মনে পড়ে বুকের ভিতর ভীষণ তোলপাড় করছে। আমার নেতা, আমার পিতা যেভাবে ৩২ বছর বয়সে পতিতাদের সমস্যা উপলব্ধি করেছেন ৭০-৭৩ বছর বয়সেও আমি তেমনটা করতে পারিনি। প্রাসঙ্গিকভাবেই সিলেটে গণভোট আলোচনায় এসেছে। আজ কজনই-বা ভাবে শেখ মুজিবের মতো একজন নেতা না হলে সিলেট আজ ভারতের অংশ থাকত। পীর-মওলানারা কীভাবে কংগ্রেসের টাকা খেয়ে পাকিস্তানকে ভোট দেওয়া নাজায়েজ, কোরআনবিরোধী ফতোয়া দিতেন সে এক অভাবনীয় ঘটনা। সিলেটের গণভোটে টাঙ্গাইলের বদিউজ্জামান খান, মির্জা তোফাজ্জল হোসেন, কুদ্দুসনগরের চেয়ারম্যান দুদু মিয়াসহ আরও অনেকেই অংশ নিয়েছিলেন। যার কারণে সিলেট হয়েছিল পূর্ব পাকিস্তানের অংশ, এখন বাংলাদেশ। এমনি কত ঘটনা রয়েছে আমি বললে অনেকেই হয়তো অতিরঞ্জিত ভাববে। চীন হাজার হাজার কোটি ডলার খরচ করে যে জাতীয় প্রচারণা পাবে ‘আমার দেখা নয়াচীন - শেখ মুজিবুর রহমান’ এটা ইংরেজি এবং চীনা ভাষায় অনুবাদ করে সারা বিশ্বে ছড়িয়ে দিলে তার চেয়ে বেশি লাভবান হবে। চীনে ধর্মকর্ম করতে দেওয়া হয় না, কারও কোনো স্বাধীনতা নেই- এসব যে একেবারে মিথ্যা সেই ’৫২ সালে বঙ্গবন্ধুর পরিষ্কার মন্তব্য চীনের জন্য আজ এক জাতীয় সম্পদে পরিণত হতে পারে। চীনা এবং বাংলায় বইটি শ্রেষ্ঠ পুরস্কার পাওয়ার যোগ্য। পরে আমি শব্দে শব্দে অক্ষরে অক্ষরে বইটির পর্যালোচনা করব।
আমার কথা কীভাবে নেবেন জানি না, তবে করোনাভাইরাস নিয়ে আমার মধ্যে একটা সন্দেহ কাজ করছে। কেন এমন হবে? দু-তিন মাস করোনাভাইরাস দৃষ্টিগোচর হয়েছে। সব মিলিয়ে লোক মারা গেছে পনের-ষোলো শ। পনের-ষোলো শ লোক তো এক-দুই মাসে দুর্ঘটনায়ও মরে। আমাদের ছোট্ট দেশ, বিপুল জনসংখ্যা। আমাদের দেশে সড়ক দুর্ঘটনায় মাসে দু-তিন শ লোক মরে। কই, তা নিয়ে তো অত ব্যাপক তোলপাড় হয় না। তাহলে করোনাভাইরাস নিয়ে বিশ্বব্যাপী এত আতঙ্ক কেন? যারা কাঁকড়া-কুঁইচা জাতীয় জিনিস রপ্তানি করত তারা পথে বসেছে। যেসব চীনা যন্ত্রপাতি প্রসাধনী কাপড়-চোপড় যে দামে পাওয়া যেত আর কদিনেই তাতে টান পড়বে, আকাশছোঁয়া দাম হবে, বিশ্ব অর্থনীতিতে এক ওলটপালট দেখা দেবে। আজও চীনের অনেকেই আমেরিকার নাম শুনতে পারে না। এটা তাদের কোনো দোষ নয়। চিয়াং কাইশেককে তাইওয়ানে বিতাড়িত করে মাও সে তুংয়ের নয়া সরকার যখন প্রতিষ্ঠিত হয় তখন ৬০ কোটি মানুষের দেশ চীনকে জাতিসংঘের সদস্য হতে দেওয়া হয়নি। কয়েক লাখ লোক নিয়ে আমাদের পার্বত্য চট্টগ্রামের সমান একটি দ্বীপ তাইওয়ানে চিয়াং কাইশেক আমেরিকার দয়ায় ঘাঁটি গেড়েছিলেন। যে ঘাঁটিটি এক ফুৎকারে নয়াচীন উড়িয়ে দিতে পারত। সেই চিয়াং কাইশেকের চীন ছিল জাতিসংঘের সদস্য আর ৬০ কোটি মানুষের দেশ নয়াচীন জাতিসংঘে ঢুকতে পারেনি বহুদিন। আমাদের মুক্তিযুদ্ধের কিছুদিন আগে চীন জাতিসংঘের সদস্য হয়ে আমাদের বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছিল। অথচ মাও সে তুংয়ের নয়াচীনের পক্ষে ছিলাম আমরা সব সময়। আমার চীনের প্রতি ক্ষোভ আছে দুঃখ আছে। কারণ চীন ছিল বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের বিরুদ্ধে। মুক্তিযুদ্ধে যত মানুষ মারা গেছে তার ৮০ ভাগ মারা গেছে চীনা অস্ত্রে, বাকি ২০ ভাগ আমেরিকা ও ব্রিটিশ অস্ত্রে। তা ছাড়া বঙ্গবন্ধু জীবিত থাকতে চীন বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দেয়নি, স্বীকৃতি দিয়েছে ’৭৫-এর ১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধুর নির্মম হত্যাকান্ডের পর। তার পরও বলছি, করোনাভাইরাস চীনের বিরুদ্ধে একটা বড়সড় ষড়যন্ত্র নয় তো? আমাদের দেশে কতবার কলেরা-বসন্ত-ডিপথেরিয়া ও অন্যান্য অসুখে গ্রামকে গ্রাম সয়লাব হয়ে যেত। তখনো এত আতঙ্ক ছড়ায়নি। কেন যেন আমার মন তোলপাড় করছে- সত্যিই এটা একটা ষড়যন্ত্র নয় তো?
লেখক : রাজনীতিক।
www.ksjleague.com