বৃহস্পতিবার, ৩০ এপ্রিল, ২০২০ ০০:০০ টা

করোনাভাইরাস ও প্রাইমারি কালচার

মোশাররফ হোসেন মুসা

করোনাভাইরাস ও প্রাইমারি কালচার

করোনাভাইরাস প্রতিরোধে এ পর্যন্ত কার্যকর কোনো প্রতিষেধক আবিষ্কৃত হয়নি। ফলে সাবান দিয়ে বারবার হাত ধোয়াকেই প্রধান প্রতিরোধক মনে করা হচ্ছে। পশ্চিমা দেশে এটাকে সচেতনতার প্রাথমিক দিক ধরা হয়। কিন্তু অনুন্নত বিশ্বে এটাকে শেখানোর জন্য ‘হাত ধোওয়া’ দিবস রয়েছে। সংস্কৃতির এ রকম বহু ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র বিষয় আছে যেগুলোকে ‘প্রাইমারি কালচার’ নামে অভিহিত করা যায়। যেমন যেখানে-সেখানে কফ-থুথু না ফেলা, হাঁচি-কাশি দেওয়ার সময় নাকে রুমাল চেপে ধরা, ময়লা-আবর্জনা নির্দিষ্ট স্থানে ফেলা, কথা বলার আগে অনুমতি নেওয়া, কিউ রক্ষা করে যানবাহনে ওঠানামা করা ইত্যাদি। এসব প্রাইমারি কালচার চালুর পেছনে রয়েছে দীর্ঘ ইতিহাস। এখানে হাত ধোয়ার ঘটনাটি প্রাসঙ্গিক হবে। জীবাণু সম্পর্কে উনিশ শতকেও মানুষের মনে তেমন কোনো ধারণা ছিল না। সে সময় বাড়ির চেয়ে হাসপাতালেই মৃত্যুর হার ছিল বেশি। হাঙ্গেরির চিকিৎসক ইগনাজ সেমেলওয়েজ বিষয়টি প্রথম লক্ষ্য করেন। তিনি ১৮৪৪ থেকে ১৮৪৮ সাল পর্যন্ত ভিয়েনা জেনারেল হাসপাতালের চিকিৎসক ছিলেন। হাসপাতালে প্রসূতি মাতার মৃত্যু, সাধারণ জ্বর-কাশিতে মানুষের মৃত্যু, এসব দেখে মর্মাহত হন। তিনি হাসপাতালে পরিচ্ছন্নতার ওপর গুরুত্ব দেন। এটি ব্যয়সাধ্য হওয়ায় তিনি গুরুত্ব দেন হাত ধোয়ার ওপর। তিনি ধাত্রীমাতাদের অ্যান্টিসেপটিক সলিউশন ব্যবহারের জন্য নির্দেশনা দেন। ফলে অবিশ্বাস্যভাবে প্রসূতি বিভাগের মৃত্যুর হার প্রতি হাজারে ১০০ থেকে নেমে ১২ দশমিক ৭ শতাংশে আসে। কিন্তু সেমেলওয়েজের হাত ধোয়া পদ্ধতি অন্য চিকিৎসকরা স্বচ্ছন্দে মেনে নিতে রাজি হন না। তারা বলতে থাকেন, সেমেলওয়েজ নিজের সিদ্ধান্ত অন্যদের ওপর জোর করে চাপিয়ে দিতে চাচ্ছেন। তিনি তার আবিষ্কারের স্বীকৃতি না পেয়ে মানসিকভাবে ভেঙে পড়েন এবং আলঝেইমার্স রোগে আক্রান্ত হয়ে মারা যান। যদিও তার মৃত্যুর পর ভিয়েনায় তার নামে নারীদের জন্য একটি ক্লিনিক নির্মাণ করা হয় (আরফাতুন নাবিলা তার ‘হাত ধুলে বাঁচবে জীবন বলেছিলেন যিনি’ কলামে এ বিষয়ে বিস্তারিত লিখেছেন)। বর্তমান করোনাভাইরাস বিস্তারের কারণে সারা বিশ্ব কম্পমান। এখন পর্যন্ত এর বিরুদ্ধে কার্যকর ভ্যাকসিন আবিষ্কারে বিজ্ঞানীরা কোনো আশার বাণী শোনাতে পারছেন না। তাদের অনেকেই মনে করেন, টিকা আবিষ্কারে কমপক্ষে এক থেকে দেড় বছর লাগবে। সেজন্য বহু দেশ লকডাউন ঘোষণা করেছে। ঘরে থাকার পরামর্শ দেওয়া হচ্ছে, এক জায়গা থেকে আরেক জায়গায় যাওয়া নিষিদ্ধ করেছে এবং মাস্ক পরা বাধ্যতামূলক করা হয়েছে। মজার বিষয় হলো, যেসব দেশ থেকে প্রাইমারি কালচারের উৎপত্তি হয়েছে সেসব দেশেই প্রাইমারি কালচার ভঙ্গের ঘটনা ঘটেছে বেশি। যেমন ইতালি ও স্পেনে সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখা হয়নি, বিভিন্ন বারে হৈ-হুল্লোড়ের অভিযোগ রয়েছে, গির্জায় বেশি লোক সমবেত হয়ে প্রার্থনা করেছে ইত্যাদি। প্রতিটি ধর্মেই প্রাইমারি কালচার রক্ষার কথা বলা আছে। তবে রেনেসাঁ-পরবর্তী সময়ে প্রাইমারি কালচারের সঙ্গে বিজ্ঞান যুক্ত হওয়ায় বিষয়টি সর্বজনীন হয়ে পড়ে। যেমন আহারের পর দাঁত পরিষ্কার করা, নখ কাটা, সাবান দিয়ে হাত ধুয়ে খাবার গ্রহণ করা, স্বাস্থ্যসম্মত টয়লেট ব্যবহার করা- এসব বিষয় নিয়ে আর বিতর্ক নেই। একইভাবে উন্নত বিশ্ব প্রাকৃতিক পরিবেশ রক্ষার বিষয়ে একমত হলেও তাদের কার্যকর পদক্ষেপ নিতে দেখা যায় না। যেহেতু পুঁজিবাদী অর্থনীতি মুনাফাকেই প্রাধান্য দেয় বেশি; সেখানে পরিবেশ রক্ষা হলো কিনা, শ্রমিকদের স্বার্থ রক্ষা হলো কিনা, ইত্যাদি বিবেচনায় নেওয়া হয় না। সন্দেহ নেই, একটি দেশের অর্থনৈতিক ব্যবস্থাপনা সে দেশের সংস্কৃতি নির্ধারণ করে। তবে ইউরোপিয়ান দেশসমূহের অর্থনীতিতে কিছু কল্যাণকর নীতি বহাল থাকায় (সমাজতন্ত্রের বিকল্প হিসেবে) সেসব দেশে করোনাভাইরাস প্রতিরোধে সম্মিলিত প্রচেষ্টা লক্ষণীয়। বর্তমান চীন পুঁজিবাদী বাজার অর্থনীতিতে বিশ্বাসী হলেও সেখানে নেতৃত্বে রয়েছে কমিউনিস্ট পার্টি। ফলে সেখানকার জনগণ শৃঙ্খলা রক্ষা করে চলেছে এবং দ্রুত ভাইরাস বিস্তার রোধ করতে সক্ষম হয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রের প্রধান প্রতিপক্ষ চীন। অনেকে সন্দেহ করছে চীনের উহানের ল্যাবরেটরিতে কভিড-১৯ নামক ভাইরাসের জন্ম ঘটেছে। তারা আত্মরক্ষার জন্য হোক, কিংবা প্রতিপক্ষকে আক্রমণের কারণেই হোক ভাইরাস নিয়ে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করছিল (উল্লেখ্য, উন্নত বিশ্বের সব দেশেই ভাইরাস নিয়ে পরীক্ষা-নিরীক্ষা হয়)। চীন প্রথম থেকেই বিভিন্ন তথ্য গোপন করছে। সম্প্রতি যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প হুমকি দিয়ে বলেছেন, ‘পৃথিবীর এত দেশ থাকতে উহান থেকে কেন ভাইরাস ছড়াল, তা চীনকে জবাবদিহি করতে হবে।’ এতেই চীন তার আগের বক্তব্য থেকে সরে এসে বলেছে, উহানে মৃত্যুহার বেশি ছিল। আগে তারা বলেছে, সেখানে মৃত্যুর সংখ্যা ১ হাজার ২৯০ জন; এখন বলছে, উহানে মোট মৃত্যু হয়েছে ৩ হাজার ৮৬৯। সর্বশেষ হিসাব অনুযায়ী যুক্তরাষ্ট্রের নিউইয়র্কে আক্রান্তের হার বেশি। তারা এটি মোকাবিলা করতে গিয়ে হিমশিম খাচ্ছে। যুক্তরাষ্ট্র হলো অভিবাসীদের দেশ (সেজন্য কেউ কেউ দেশটিকে হিউম্যান মিউজিয়াম বলে)। সেখানে সাংবিধানিকভাবে ব্যক্তিস্বাধীনতা দেওয়া আছে। সরকার ইচ্ছা করলেই জনগণকে ঘরে আবদ্ধ রাখতে পারে না। সেখানকার অধিবাসীরা বিভিন্ন দেশের ও বিভিন্ন সংস্কৃতির হওয়ায় সরকারের আহ্বানও বুঝতে বিলম্ব করে। তারা শুরুতে সামাজিক দূরত্ব মেনে চলেনি। সে কারণে রোগটি দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে। বাংলাদেশ একটি ঘনবসতিপূর্ণ দেশ, এ দেশেও আক্রান্তের হার আশঙ্কাজনক হারে বৃদ্ধি পাচ্ছে। সেজন্য সরকারি ছুটি ৫ মে পর্যন্ত বৃদ্ধি করা হয়েছে। কিন্তু বহু জায়গায় লকডাউন উপেক্ষা করে মানুষ বাড়ি থেকে বের হচ্ছে এবং সামাজিক দূরত্ব রক্ষা করে চলছে না। সরকারের দেওয়া ত্রাণ সুষ্ঠুভাবে বিতরণ হচ্ছে না। বহু জায়গায় ত্রাণ নিয়ে দুর্নীতির অভিযোগ আসছে। কয়েকজন জনপ্রতিনিধিকে গ্রেফতারের ঘটনা ঘটছে। বাংলাদেশে দীর্ঘদিন গণতান্ত্রিক শাসনের অনুপস্থিতি থাকায় সরকারের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান প্রাতিষ্ঠানিকতা লাভ করেনি। একই কারণে স্থানীয় সরকারও গড়ে ওঠেনি। সঠিকভাবে স্থানীয় সরকার গড়ে না ওঠায় তারা জনগণের আস্থা অর্জনে ব্যর্থ হচ্ছে। তাই আশা করা যায়, করোনাভাইরাসের কারণে বিপর্যস্ত পৃথিবীর মানুষ নতুনভাবে শিক্ষা নিয়ে প্রকৃতির বিরুদ্ধে তাদের যাবতীয় কর্মকা- পরিহার করবে। তারা অসুস্থ প্রতিযোগিতা পরিহার করে প্রকৃতি রক্ষা করেই উন্নয়ন- এ নীতি গ্রহণ করবে। সাম্যের পৃথিবী গড়ে তোলার জন্য রাজনীতিবিদরা তাদের অর্থনৈতিক নীতিরও পরিবর্তন আনবেন।

 

লেখক : পরিচালক, প্রাইমারি কালচার ডেভেলপমেন্ট সেন্টার (পিসিডিসি)।

ইমেইল : [email protected]

সর্বশেষ খবর