মঙ্গলবার, ৮ সেপ্টেম্বর, ২০২০ ০০:০০ টা

অধমদেরই রাজত্ব : উত্তম লুপ্তপ্রায়

মনজুরুল আহসান বুলবুল

অধমদেরই রাজত্ব : উত্তম লুপ্তপ্রায়

বাঙালিকে কি সংরক্ষণের প্রয়োজন হয়ে পড়েছে? সংরক্ষণ তাদেরই প্রয়োজন, যারা লুপ্তপ্রায়। বাঙালি কি তাহলে লুপ্তপ্রায় যে তাদের সংরক্ষণ করতে হবে? ওপার বাংলায় এ নিয়ে বিস্তর বিতর্ক। বাঙালি যে কখনো মুসলমানত্বে বা কখনো হিন্দুত্বে বিলীন হচ্ছে শুধু তাই নয়, বদলে যাচ্ছে জীবনাচরণেও। সেজন্যই এ বিতর্ক। ‘কপালকু-লা’র কথা মনে পড়ে? যা পড়ে একটি সত্যকে জীবনের বেদবাক্য মেনেছিলাম- ‘তুমি অধম তাই বলিয়া আমি উত্তম হইব না কেন’? বাঙালি উত্তম-অধমের পার্থক্য করতে শিখল, নিজে উত্তম হওয়ার ব্রত গ্রহণ করল। সেটাই জীবনের স্বাভাবিক গতি। কিন্তু শেষাবধি নবকুমারের উদ্দেশে কপালকু-লা যখন বলে : পথিক, তুমি পথ হারাইয়াছ?

আজ বুঝি বাঙালির জীবনে এ প্রশ্নই বড় হয়ে দেখা দিয়েছে। উত্তম হওয়ার ব্রত থেকে বাঙালি কি পথ হারাইয়াছে?

কারণ দৃশ্যত উত্তম হওয়ার ব্রত নিলেও বাঙালি এখন অধমের চক্রে আটকে পড়েছে। কে উত্তম, কে বেশি উত্তম, আমি তার বা তাদের মতো হতে চাই কিনা। তার চেয়ে এখন মূল আলোচনা- কে কত অধম, কে কার চেয়ে বেশি অধম। সে অধম; কাজেই আমার অধম হতে বাধা কোথায়? এমন আলোচনাকেই আমরা যুক্তি বলে ধরে নিই। এ অধম অধমে হাত ধরাধরি দেখে এই দেশ, কাল থেকে উত্তম বুঝি বিলুপ্তপ্রায়!

বিষয়টা সহজভাবে বোঝার জন্য হাল আমলে ফিরি। প্রায় সবাই জানেন এমন কয়েকটি ঘটনার চিত্রই তুলে ধরি।

১. তিন মাঝারি শাসকের আড্ডা। আলোচনা হালফিল বিষয় নিয়ে।

প্রথম জন : যাই বলেন, জামালপুরের ডিসি কাজটা ঠিক করেনি। তুই ব্যাটা এক বিসিএস ক্যাডার; গেছিস এক ফোর্থ গ্রেডের কাছে। মুখ দেখাতে পারি না কোথাও!

দ্বিতীয় জন : সে তুলনায় নেত্রকোনার জন ভালো। কাজটা খারাপ, কিন্তু করেছে এক ক্যাডার অফিসারের সঙ্গেই। ইজ্জত রক্ষা। [ক্ষমা চেয়ে নিই সেই নিগৃহীতার কাছে]।

তৃতীয় জন : কুড়িগ্রামের ডিসি করলটা কী? সরকারি টাকায় নিজের নামে সরোবর!! রাতের বেলা মোবাইল কোর্ট বসিয়ে সাংবাদিক নির্যাতন! এবার ঠেলা সামলাও।

দেখেন না, ...জেলার ডিসিকে। ও তো সাংবাদিকদের কাছে ঘেঁষতেই দেয় না। মারপিটও লাগে না। সাংবাদিকরা এমনিতেই দূরে থাকে। কিছু করলেই চাঁদাবাজির অভিযোগ, ডিজিটাল আইনে মামলা।

দেখুন চারজনই অভিযোগগুলো নাকচ করছেন না; আলোচনা করছেন কোনটার চেয়ে ভালো তা নিয়ে। আলোচনায় না বিষয় উত্তম, না ব্যক্তি উত্তম। সব আলোচনা অধম নিয়েই। দেশে উত্তম ডিসি সাহেবদের কোনো উত্তম কাজ নেই তা তো নয়। কিন্তু আলোচনা অধমদের নিয়েই কেবল। কে কত নিম্নমুখী সেটাই দেখা হচ্ছে উদাহরণ হিসেবে।

২. ফরিদপুর জেলা ছাত্রলীগের সভাপতি ২ হাজার কোটি টাকা পাচারের কথা স্বীকার করেছেন।

দুই ছাত্রনেতার আলোচনা শুনুন :

প্রথম নেতা : এক জেলার সভাপতি যদি ২ হাজার কোটি টাকা পাচার করে তাহলে কি দোষ ছিল শুধু শোভন আর রব্বানীর? ওরা তো মাত্র ৮০ লাখ টাকা চেয়েছিল জাহাঙ্গীরনগরের ভিসির কাছে। জেলাই যদি হাজার হজম করতে পারে তাহলে কেন্দ্রের এরা তো শতেও যায়নি, তাতেই এত হইচই!

দ্বিতীয় নেতা : আরে এত টাকার বিষয়। ...জেলায় এক ছাত্রলীগ নেতা আরেক নেতার হাত কেটে নিয়েছে। অব্যাহতি ছাড়া আর কিছুই তো হয়নি তার।

ছাত্রলীগের উজ্জ্বল কাজ আছে অনেক। কিন্তু আলোচনায় শুধু অপকর্মের ফিরিস্তি। কোন নেতা কত অপকর্ম করেছে তাই নিয়ে আলোচনা, তার সঙ্গেই তুলনা। ভালো কাজের উদাহরণ অদৃশ্যপ্রায়।

৩. একটি প্রদীপের আলোয় যদি সারা দেশ উজ্জ্বল হতো কতই না ভালো হতো। কিন্তু এক অন্ধকার ওসি প্রদীপকে নিয়ে আলোচনায় সারা দেশ।

প্রথম জন : এ রকম ওসি ‘যা আছে তা’ হিসাব করলে প্রায় সব ওসিকে ক্লোজ করতে হবে। সব থানা বন্ধ হয়ে যাবে।

দ্বিতীয় জন : খালি ওসির পেছনে লাগছেন কেন? ডিআইজি মিজানের কান্ড ভুলে গেছেন?

তৃতীয় জন : ভাইরে! ঢাকার মধ্যে ক্যাসিনোশিল্পের পাহারা দিল যে কমিশনার আর কর্মকর্তারা তাদের কথা কেউ বলেন না! খালি গ্রামের ওসিদের নিয়ে আছেন।

পুলিশের উত্তম কোনো কাজ নেই এমন তো নয়। এই যে করোনাকালে পুলিশের যে জনদরদি ভূমিকা তা কি কেউ অস্বীকার করতে পারবে? কে যেন বলছিলেন : মাস্ক পরে দিনভর ডিউটি করায় মুখে দাগ পড়ে গেছে তাদের নিয়ে টেলিভিশনে আবেগ, কিন্তু দিনভর বুট পায়ে কাজ করে যে পুলিশ বা সেনা সদস্য পায়ে ফোসকা নিয়ে রাতে ঘুমাতে পারছেন না সেদিকে নজর দেয় না কেউ। কিন্তু দিনভর আলোচনা অধম প্রদীপ আর লিয়াকতদের নিয়ে। তারাই যেন দৃষ্টান্ত!

৪. সোনালী ব্যাংকের এমডি বললেন : তার ব্যাংকের একমাত্র কলঙ্ক হলমার্ক। বেসিক ব্যাংকের অবস্থা কত খারাপ, কিন্তু বেসিক নিয়ে সব চুপচাপ, হলমার্ক নিয়ে সবার চিৎকার!

প্রথম জন : হলমার্কের কার কী হয়েছে? সে সময়কার চেয়ারম্যান, এমডি, বোর্ড মেম্বাররা তো বহাল তবিয়তে, কেউ কেউ এই ব্যাংক ওই ব্যাংকে ঘোরাফেরা করছেন এখনো।

দ্বিতীয় জন : সেজন্যই তো বেসিক ব্যাংকের বাচ্চুর দেখা নেই।

একটার পর একটা মামলা হয় আর ফারমার্স ব্যাংকের চিশতী বলেন : সব দোষ অডিট কমিটির, ব্যাংকের মালিক, চেয়ারম্যান কই? সোনালী ব্যাংকের উত্তম কাজের উদাহরণ নিশ্চয়ই আছে। কিন্তু সে আলোচনা চাপা পড়ে যায় সহযোগী অন্য অধমদের অপকর্মের কাছে। বাচ্চু যেহেতু ধরা পড়ে না, হলমার্কের কারও যখন কিছু হয় না, ফারমার্স ব্যাংকের মূল কুশলী যখন ধরাছোঁয়ার বাইরে, তখন অন্যদের দোষ ধরেন কেন- প্রশ্নটা সে রকমই। অথচ বলা উচিত ছিল, অন্যরা দুষ্কর্ম করেছে আমরা তাদের মতো করিনি। তারা অধম, আমরা উত্তম।

৫. নানা ব্যাংক থেকে টাকা সরিয়ে বিদেশে পাচারের হিসাব প্রকাশ্যে।

প্রথম ব্যাংকার : আমার পেছনে লাগছেন কেন? ... গ্রুপ তো ‘বিদেশ’ কিন্যা ফালাইছে।

দ্বিতীয় ব্যাংক মালিক : আমি ‘বিদেশ’ কিনছি তো কী হইছে? আমি তো এমডিরে গুলি কইরা টাকা নেই নাই।

ৃতৃতীয় জন : গুলি করাটাই দেখলেন, তারা যে দেশের জন্য এত কিছু করছে তা দেখলেন না!

আলোচনা শুরু টাকা লুট আর পাচার নিয়ে তা ঠেকল এসে গোলাগুলিতে। টাকা পাচারকারী, বিদেশ কিনে ফেলা মহাজন আর গুলি ছোড়া অধম ব্যাংক মালিকদের মধ্যে হারিয়ে যান তিনি, যিনি হয়তো কিছু উত্তম করার চেষ্টা করেছেন। তার বা ভালো প্রতিষ্ঠানের নাম কেউ আর দৃষ্টান্ত হিসেবে উল্লেখ করে না।

৬. স্বাস্থ্যে তো ভয়াবহ অবস্থা।

মিঠু আর আবজালের দাবি : আমরা তো কিছু টাকাই মারছি, নিজেদের আখের গোছাইছি মাত্র, মানুষ তো মারি নাই। যারা ভুয়া মাস্ক দিয়া, ভুয়া রিপোর্ট দিয়া মানুষ মারছে আমরা তো তাদের মতো খারাপ না! খুন তো করি নাই।

তুলনাটা টাকা লুটকারী আর মানুষ খুনিদের মধ্যে। এ যেন ড্রেনের বাঁ দিকের পানি বলছে ডান দিকের পানি খারাপ বেশি। নর্দমার পানি নর্দমার পানিই, তার ডান বাম নেই।

এ কঠিন করোনাকালে যে স্বাস্থ্যকর্মীরা সামনে থেকে যুদ্ধ করলেন, জীবন দিলেন তাদের বীরত্বগাথা হারিয়ে গেল এ টাকা লুটকারী আর মানুষ খুনি অধমদের কারণে।

৭. জি কে শামীম আর ক্যাসিনো ব্রাদার্সের টাকা, ফ্ল্যাট আর এফডিআরে হতভম্ব দেশ।

বিরুদ্ধ জন : এরাই তো দেশটারে শেষ করল।

সমর্থক জন : আরে ভাই! এরা তো দেশের টাকা দেশেই রাখছে। পি কে হালদার তো ২৪ হাজার কোটি টাকা নিয়ে গেছে বিদেশে। আর যাই করুক এরা তো বেগমপাড়ায় বাড়ি করে নাই। কোনো কোনো সংবাদমাধ্যমও প্রশ্ন তোলে : খালি কি ওরাই খারাপ, আর কেউ খারাপ নেই?

তুলনাটা উত্তম অধমে নয়, অধমে অধমেই।

৮. পিএইচডি অভিসন্দর্ভে ৯৮ ভাগ নকল করার অভিযোগে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সহযোগী অধ্যাপককে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশাসনিক ও শিক্ষা কার্যক্রম থেকে অব্যাহতি দেওয়া হয়েছে।

শিক্ষকের দাবি : আমার কাছে অন্তত ৫০ শিক্ষকের তালিকা আছে, যাদের নামে প্রকাশিত গবেষণায় লাইন বাই লাইন নকল করা। তাদের ধরেন না কেন?

হায় শিক্ষক! নিজের অপকর্মের জন্য লজ্জিত না হয়ে তার মতোই আরও চোরদের তালিকা নিয়ে বলছেন : আমি কেন? আমার মতো আরও তো আছে!!!

অধম শিক্ষক আরও অধমদের নাম নিয়ে প্রমাণ করার চেষ্টা করছেন : আমরা সবাই চোরের রাজা, কাজেই লজ্জার কী আছে?

৯. সিলেট কারা কর্তৃপক্ষের ডিআইজি পার্থ গোপাল বণিকের ফ্ল্যাট থেকে ঘুষ-দুর্নীতির ৮০ লাখ টাকা উদ্ধার করেছে দুর্নীতি দমন কমিশন-দুদক। ফ্ল্যাটের বিভিন্ন কক্ষে তোশক, বালিশের কভার ও আলমিরায় লুকানো অবস্থায় এ টাকা পাওয়া গেছে।

পার্থ সুহৃদের মন্তব্য : খালি পার্থর কথা বলেন কেন? নগদ ৪৪ লাখ ৪৩ হাজার টাকা ও ১২ বোতল ফেনসিডিলসহ চট্টগ্রাম কেন্দ্রীয় কারাগারের জেলার সোহেল রানা বিশ্বাসকে গ্রেফতার করেছে রেলওয়ে পুলিশ, সেটা দেখেন না?

পার্থ-সোহেল মাসতুতো ভাই! তুলনাটা সেই অধমে অধমেই। এই অধমদের অন্য সহযোগীরাও কথা বলেন একই সুরে।

১০. বিএনপি নেতার মন্তব্য : ক্রসফায়ার, বিচারবহির্ভূত হত্যাকান্ডে দেশবাসী অতিষ্ঠ। এর মাধ্যমে মানবাধিকার লঙ্ঘিত হচ্ছে।

আওয়ামী লীগ নেতার জবাব : আরে! এসব তো শুরু হয়েছে আপনাদের আমলে। অপারেশন ক্লিন হার্ট দিয়ে শুরু, দায়মুক্তিও দিয়েছেন আপনারাই।

তথ্য সঠিক। কিন্তু আপনাদের করা খারাপ কাজ, আমাদের পর্যন্ত আসতে আসতে ভালো হয়ে গেছে, বিষয়টা এমন আর কি! ভালো কাজ যে নাই এমন নয়। আপনার কাজটা খারাপ, বিপরীতে আমরা এ কাজটা ভালো করেছি এমন উদাহরণ তুলে ধরছি না। আপনিও যা করেছেন আমিও তাই করছি। তাই দুই খারাপে ‘কাটাকাটি’।

আরও উদাহরণ তুলে ধরা যায়। তাতে পাঠকের হতাশা আরও বাড়বে।

একসময় আবদুল্লাহ আল মামুন লিখেছিলেন : ‘সুবচন নির্বাসনে’। সু-বচন, মানে ভালো কথা নির্বাসনে গেছে বলে তিনি হতাশ হয়েছিলেন। তিনি হতাশ হয়েছিলেন এই দেখে যে, এই সময়ে কেউ আর ভালো কথা শুনতে বা তা অনুসরণ করতে চাইছে না। আজ চারদিকে ভালো কথার ছড়াছড়ি, কিন্তু ভালো কাজই সব নির্বাসনে।

ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানের যে শিক্ষক পবিত্র বাণী শোনান, ছাত্রী ধর্ষণ ও পুড়িয়ে হত্যার দায়ে তার বিচার করতে হয়। শুদ্ধাচারে পদক পাওয়া কর্মকর্তা অশুদ্ধাচারে নিমজ্জিত। বীর হিসেবে পদক পাওয়া খুনের দায়ে কাঠগড়ায়। রাজনীতির প্রবল উত্তাপে সমাজের সব ‘উত্তম’ যেমন বিলীনপ্রায়, তেমনি অধমদের পরিচালিত প্রশাসনের দাপটে জবুথবু সুশাসন। উত্তম কাজের দৃষ্টান্ত নিয়ে এখন কারও কোনো সন্তুষ্টি নেই, নগদ প্রাপ্তির ঢেঁকুরে বিভোর সবাই। সেটা চাকরিতে বা চুক্তিতে যেখানেই থাকুন না তারা।

উত্তম উদাহরণ যে নেই তা নয়, কিন্তু অধমদের উচ্চৈঃস্বরে তা প্রায় নির্জীব। পতিতাকে যেমন ব্যবসার কারণেই ঊর্ধ্বাঙ্গের রূপচর্চায় বেশি নজর দিতে হয়, লুকিয়ে রাখতে হয় দেহের কুৎসিতগুলো। তেমনি আমাদের সমাজের অধমরাও কৌশলী আচরণে লুকিয়ে রাখে তাদের মূর্খতা। সরীসৃপের মতো ঢুকে যায় রাজনীতি, প্রশাসন, প্রতিষ্ঠান, দল বা সংগঠনের প্রাঙ্গণে। তাদের বাকচতুরতায়, জীবনাচরণে বিমোহিত হন নেতা ও নীতিনির্ধারকরা। পরাস্ত হয় উত্তমদের ক্ষুদ্র অংশ।

কি আলোচনায়, কি বৈঠকে, কি সংলাপে, কি টকশোতে, কি রচনায়, কি বক্তৃতায় এ অধমরা তুলনা হিসেবে আরেক অধমকেই সামনে এনে দেখাতে চায়, ওই অধমের চেয়ে সে বা তারা কতটা ভালো। সে বা তারা কখনই কোনো উত্তমের সঙ্গে নিজের তুলনায় যাবে না, কারণ সে বা তারা জানে এ তুলনায় তার বা তাদের পরাজয় অনিবার্য।

সময় এখন খারাপ। অধমে অধমে তুলনা করে কম অধম আর বেশি অধমদের লড়াই এবং দখলদারির কারবার চলছে সর্বত্র। উত্তমরা এখন প্রায় নির্বাসিত। কেউ কেউ হতাশ হয়ে বলেন : অধমদের পদে পিষ্ট হয়ে উত্তমরা বিলীনপ্রায়। এ অবস্থা দল, প্রশাসন, ব্যবসা, সংস্কৃতি এমনকি সাংবাদিকতায়ও।

বহুল ব্যবহারে জীর্ণ কপালকু-লার দুই কালজয়ী বাক্য বিন্যাসের পুনরুক্তি না করে শুধু বলি : আবর্জনায় বা আগাছায় সবুজে বাগান ভরে গেলেও তাকে বাগান বলে না। বাগানকে বাগান হতে হলে সেখানে শোভিত ফুল বা উপকারী ফলের সমাবেশ লাগবেই। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান তাঁর অসমাপ্ত আত্মজীবনীতে আগাছা উপড়ে ফেলার কথাই বলেছেন।

তা না করলে মূল বাগান বা গাছই যে বিপর্যস্ত হয় সে সতর্কবাণীও তিনি উচ্চারণ করেছেন নিজের জীবন অভিজ্ঞতা থেকেই। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাও সেদিন বললেন : ... দীর্ঘদিন ক্ষমতায় থাকলে এদিক ওদিক থেকে কিছু লোক জোটে এবং দলের ভিতর এসে নানা অঘটন ঘটায়, অপকর্ম করে; যার বোঝাটা দলকে বয়ে নিয়ে বেড়াতে হয়।

ভালো বাগান করতে হলে ভালো গাছ খুঁজে নিতে হয়। অজপাড়াগাঁয়ের এক কিশোর স্কুলছাত্র খোকাকে কিন্তু ঠিকই খুঁজে নিয়েছিলেন কেন্দ্র থেকে আসা নেতা হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী। এ খোকাই পরে আমাদের জাতির পিতা শেখ মুজিব। অধমরাই ‘ইউজ মি’ বলে পায়ের কাছে ঘোরাঘুরি করতে থাকে, উত্তমদের খুঁজে নিতে হয়। এরা পায়ের কাছে ঘোরাঘুরি করে না। উত্তমকে খুঁজে নেওয়াও নেতৃত্বের যোগ্যতার একটি মাপকাঠি।

সেই সতর্কবাণী অনুসরণ করেই বলি : উত্তমদের সরিয়ে রেখে অধমদের চিৎকার, পদলেহন আর চাকচিক্যে আপাতত সব ভরপুর মনে হলেও ঠুনকো ভিত একসময় ধসে পড়বেই। নিজের যোগ্যতায় যেহেতু অধমরা টিকে থাকতে পারবে না, সময় পাল্টালে এ পরাগাছাদের নতুন আশ্রয় খুঁজে নিতে হবে। উত্তমরা টিকে থাকবে নিজেদের যোগ্যতাবলেই।

উত্তম পুষ্প আর উত্তম ফলই বাগানের জীবন, অধমরা শুধুই বিষবৃক্ষ। শুধু বাগানের জন্য নয়; দেশ, দল, রাজনীতি, প্রশাসন, সংগঠন সবার বেলায়ই এটা সত্যি। এ সত্যিটা বুঝতে পারবেন তেমন উত্তমের জন্যই এ রচনা।

লেখক : সিনিয়র সাংবাদিক।

 

সর্বশেষ খবর