বৃহস্পতিবার, ৩ ডিসেম্বর, ২০২০ ০০:০০ টা

ভাস্কর্য থাকবে নাকি থাকবে না?

তসলিমা নাসরিন

ভাস্কর্য থাকবে নাকি থাকবে না?

বাংলাদেশে হঠাৎ ভাস্কর্য পতনের আন্দোলন হচ্ছে কেন? আসলেই কি এ আন্দোলন ভাস্কর্য পতনের আন্দোলন নাকি সরকার পতনের আন্দোলন? দুধকলা দিয়ে কালসাপ পুষলে একদিন সেই কালসাপ তোমাকে ছোবল দেবে- সেটির চমৎকার প্রমাণ আমরা দেখতে পাচ্ছি।

সব মুসলিম দেশেই ভাস্কর্য আছে। বিশ্বের বৃহত্তম মুসলিম দেশ ইন্দোনেশিয়ার ভাস্কর্য নিয়ে কোনো মুসলিমের সমস্যা হচ্ছে না। বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম মুসলিম জনগোষ্ঠীর অর্থাৎ ভারতের মুসলিমদেরও কোনো ভাস্কর্য নিয়ে সমস্যা হচ্ছে না। ইরান, সৌদি আরব, পাকিস্তান ইত্যাদি কট্টর মুসলিম দেশেও ভাস্কর্য নিয়ে সমস্যা হচ্ছে না। মিসরে প্রাক-ইসলাম যুগের মূর্তিপূজকদের স্ফিংস আজও মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে আছে, এ নিয়েও মিসরের কোনো মুসলিমের সমস্যা হচ্ছে না। শুধু বাংলাদেশের মুসলিমদের সমস্যা হচ্ছে। ভাস্কর্য নিয়ে কিন্তু জিহাদি জঙ্গি গোষ্ঠী আইসিসদের সমস্যা হতো, তাহলে কি বাংলাদেশে যারা ভাস্কর্য ভেঙে ফেলার দাবি করছে, তারা আইসিস-মানসিকতার? তালিবানি মানসিকতার? তালিবানরা আফগানিস্তানের বিখ্যাত বামিয়ান বুদ্ধকে উপড়ে ফেলেছে। মেসোপটেমিয়ার প্রাচীন ভাস্কর্যগুলো হাজার বছর ধরে ছিল, আইসিসরা গুঁড়ো করে দেওয়ার আগ পর্যন্ত। বাংলাদেশের মোল্লারা হুমকি দিয়েছে, রাস্তায় রাস্তায় লাশ পড়বে, রক্তে ভেসে যাবে রাজপথ যদি কোনো ভাস্কর্য স্থাপন করা হয়। তারা যে ব্যানারেই আজ বাংলাদেশে হুমকি দিক না কেন, তাদের হুমকি পক্ষান্তরে জঙ্গি-আইসিসের হুমকি ছাড়া অন্য কিছু নয়। গুলশানে হোলি আর্টিজানে জঙ্গি হামলার পর শেখ হাসিনা-সরকার যেভাবে বাংলাদেশ থেকে জঙ্গি নির্মূলের উদ্যোগ নিয়েছিলেন, সেভাবে ফের জঙ্গি নির্মূলের, সেই কালসাপ নিধনের সময় এসেছে। এদের আস্ফালন না কমাতে পারলে দেশকে আসলেই এরা রক্তে ভাসিয়ে দেবে, লাশের পর লাশ ফেলবে, গুলশান হোলি আর্টিজানের চিত্র হয়ে উঠবে গোটা বাংলাদেশের চিত্র।

একের পর এক এদের অন্যায় দাবি মেনে নিয়ে এদের মাথায় চড়িয়েছে সরকার, আর সেই ফল আজ ভোগ করছে গোটা বাংলাদেশ। আমি নিশ্চিত, সুপ্রিম কোর্টের সামনে থেকে থেমেসের ভাস্কর্যটি যদি সেদিন মোল্লাদের দাবির কারণে না সরাতো, তাহলে বঙ্গবন্ধুর ভাস্কর্য নিয়ে আজ কোনো সমস্যা হতো না। দুষ্ট লোকের দাবি, বিশেষ করে গণতন্ত্রবিরোধীদের দাবি কখনও মেনে নিতে হয় না। এই মোল্লাগুলো এমন ভাব করছে যেন ইসলাম ধর্মটি তাদের ব্যক্তিগত সম্পত্তি, যেন তাদের ইসলামের দূত বানিয়ে পৃথিবীতে পাঠানো হয়েছে। দিনরাত এই লোকগুলো শের্ক করছে। এক ওয়াজ ব্যবসায়ী তো বলে বসল, ‘অমুক মার্কায় ভোট দেওয়া মানে আল্লাহ আর আল্লাহর নবীকে ভোট দেওয়া’! আরেকজন বলল, ‘মামুনুল হককে অপমান করা মানে আল্লাহকে অপমান করা, আল্লাহর নবীকে অপমান করা’! এদের ওয়াজে এদের ভাষণে এদের কীর্তিকলাপে এরাই কিন্তু আসলে নিরবধি ইসলামের অবমাননা করে চলেছে। এই কালসাপদের ভয় পাওয়ার কিচ্ছু নেই, এই অপশক্তিকে নির্মূল করাই দেশ বাঁচানোর, এমনকি ইসলাম বাঁচানোর একমাত্র উপায়। এদের হাতে দেশ বা ইসলাম কোনোটি গেলে দুটোরই সর্বনাশ এরা করে ছাড়বে।

বাংলাদেশে বিভিন্ন ধর্মের, বিভিন্ন বিশ্বাসের মানুষ বাস করে। হিন্দু হলেও সব হিন্দুর বিশ্বাস এক রকম নয়। একই রকম মুসলমান হলেও সব মুসলমানের চিন্তা এক রকম নয়। কেউ উদার, কেউ কট্টর, কেউ আরবের পোশাক পরে, কেউ দেশি পোশাক পরে, কেউ বোরখা পরে, কেউ হিজাব পরে, কেউ আবার বোরখা হিজাব কিছুই পরে না, কেউ পাঁচ বেলা নামাজ পড়ে, কেউ আবার নিয়মিত নামাজ পড়ে না, - কিন্তু তারা সবাই মুসলমান। কট্টর বা উগ্রবাদীদের ইসলামই সত্যিকারের ইসলাম, সেটিই সবাইকে পালন করতে হবে, এই ধারণা ভুল। কট্টরপন্থিরাই বেহেস্তে যাবে, অন্যরা সবাই দোযখে যাবে, এই ধারণাও ভুল। শেষ বিচারের দিনে, যদি সেরকম কোনো অলৌকিক বিচার ব্যবস্থা থেকে থাকে, তবে শেষ বিচারের মালিকই বিচার করবেন। বিচারে তিনি নামাজ রোজা আর জিহাদকে মূল্য দেবেন বেশি, নাকি সততা এবং উদারতাকে মূল্য দেবেন, তা তিনিই জানেন। বাংলাদেশের মুসলমানরা অন্যের ক্ষতি না ক’রে, অন্যের অধিকার লংঘন না করে, যে যার বিশ্বাস নিয়ে থাকলে কোনো সমস্যা হওয়ার কথা নয়।

এক সময় কত মানুষের কত বিশ্বাস নিষিদ্ধ ঘোষিত হয়েছে, গোপনে গোপনে সেই বিশ্বাসকে তাদের জিইয়ে রাখতে হয়েছে! পরিস্থিতির ভিত্তিতে পৃথিবীর সব ধর্ম-পালনে পরিবর্তন এসেছে। বহুঈশ্বরবাদী ধর্মের রমরমা অবস্থার মধ্যে একদা একেশ্বরবাদী ধর্মের প্রবর্তন হয়েছিল। ইহুদি এবং খ্রিস্টানদের বাইবেলেও বহুঈশ্বরবাদী মূর্তিপূজকদের বিরুদ্ধে লেখা হয়েছে। ধর্ম প্রতিষ্ঠার স্বার্থে প্রতিকূল পরিবেশে ধর্ম প্রচারকরা মূর্তিপূজকদের বিরুদ্ধে দাঁড়াবার প্রস্তাব করেছিলেন। পরবর্তীকালে অনুকূল অবস্থায় সেই ধর্মের অনুসারীরা ধর্ম প্রচারকদের সেই আদি প্রস্তাব মানেনি। এতে ধর্মের কোনো অপমান হয়নি, বরং অপমান থেকে ধর্ম রক্ষা পেয়েছে। আজ তো কোনো ইহুদি বা খ্রিস্টান মূর্তি ভেঙে দিতে হাতুড়ি শাবল হাতে নেবে না। তবে মুসলিমদের মধ্যে কেন এই প্রবণতা? সাধারণ মুসলিমদের মধ্যে নয়, কট্টরদের মধ্যেই সাধারণত এই প্রবণতা দেখা যায়, কিন্তু কট্টররাই বা কেন হাতুড়ি শাবল নেয় বা নিতে চায়? এর উত্তর খুব সহজ। তারা ধর্মকে আর ধর্ম হিসেবে দেখতে চায় না, তারা একে রাজনীতি হিসেবে দেখে। তারা দেশ নয় শুধু, তারা ধর্ম দিয়ে বিশ্ব শাসন করতে চায়। তাদের এই লেলিহান বাসনা অনেক সময় তাদেরই পুড়িয়ে ছাই করে।

মক্কার মূর্তিপূজকদের মূর্তি ভাঙার নির্দেশ দিয়েছিলেন ইসলামের নবী। ইসলামের প্রতিষ্ঠার জন্য তা তখন তিনি জরুরি মনে করেছিলেন। কিন্তু ইসলাম আজ প্রতিষ্ঠিত। পৃথিবীর দ্বিতীয় বৃহত্তম ধর্ম আজ ইসলাম। যে অবস্থায় মূর্তি ভাঙা হয়েছিল, সেই অবস্থাটি বর্তমান বিশ্বে নেই। তাই কোনো মুসলিম দেশেই মূর্তিপূজা নিয়ে কোনো সমস্যা হয় না। এ ক্ষেত্রে গণতন্ত্রের প্রয়োজনে ইসলামের এই উপদেশটিই মেনে চলতে হয় ‘যার যার ধর্ম তার তার কাছে, ইসলামে কোনো জবরদস্তি নেই’।

বাংলাদেশের মাদ্রাসা-পাস মোল্লারা ঘোষণা দিয়েছে তাদের দৌড় আর মসজিদ পর্যন্ত নয়, তাদের দৌড় পার্লামেন্ট পর্যন্ত। এ বিরাট হুমকি বটে। তারা আজ দেশ শাসনের স্বপ্ন দেখছে। কী যোগ্যতা তাদের আছে দেশ শাসন করার? গণতন্ত্র সম্পর্কে যাদের কোনো ধারণাই নেই, তারা কী করে দেশ শাসন করবে। মোল্লাতন্ত্র বা জিহাদি আদর্শ দিয়ে দেশ শাসন এই একবিংশ শতাব্দীতে চলবে না। সে কারণেই আইসিসকে সারা বিশ্ব মিলে নির্মূল করেছে। পৃথিবীটা বাংলাদেশ নয়। পৃথিবীর একটি ক্ষুদ্র অংশ বাংলাদেশ। এই পৃথিবীকে চলমান রাখার পেছনে, সভ্য এবং শিক্ষিত করার পেছনে সব দেশের সব ধর্মের সব সংস্কৃতির সব রকম বিশ্বাসের মানুষের অবদান আছে। সবাইকে অস্বীকার করে শুধু নিজের ধর্ম এবং সংস্কৃতিকে শ্রেষ্ঠ মনে করে, আমিই বেহেস্তে যাব, বাকিরা নরকে যাবে, এই মানসিকতা নিয়ে বেশি দূর এগোনো যায় না। সবার প্রতি শ্রদ্ধা প্রদর্শন, সবার অধিকারকে, এমনকি বিধর্মী ও নাস্তিকের অধিকারকে মর্যাদা দেওয়া গণতন্ত্রের আদর্শ। এই আদর্শকে অস্বীকার করলে বিশ্বে কোনো স্থান নেই।

কাবার কালো পাথরকে মুসলমানরা চুমু খেয়ে বা একটু স্পর্শ করে ধন্য হয়, বিশ্বাস করে এতে তাদের মঙ্গল হয়, পাথরই শুষে নেয় তাদের পাপ, তারা পাপমুক্ত হয়। ইসলামের দ্বিতীয় খলিফা উমর ইবনে আল-খাত্তাব সেই কালো পাথরকে উদ্দেশ করে বলেছিলেন, ‘আমি জানি তুমি একটা পাথর, তুমি মানুষের অপকারও করতে পার না, উপকারও করতে পার না, যদি আমি নবীকে না দেখতাম তোমাকে চুম্বন করতে, তাহলে আমিও তোমাকে চুম্বন করতাম না।’ তাহলে জিনিসটা ভাস্কর্য, বা মূর্তি বা পাথর সেটা বিষয় নয়, বিষয় হলো মুসলমানের মনন। তাহলে যাদের কাছে এখন ভাস্কর্য, মূর্তি বা পাথর বিষয় হয়ে উঠছে, তাদের কাছে নিশ্চিতই মননের মূল্য নষ্ট হচ্ছে।

ইসলাম ধর্মটিকে ধর্ম হিসেবে রাখার দায়িত্ব নিতে হবে সরকারকে। রাজনীতির সঙ্গে ধর্ম মেলালে, বা ধর্মের সঙ্গে রাজনীতি মেলালে তার পরিণাম কখনও শুভ হয় না। কারণ এর ফলে মন্ত্রী হয়ে যায় মোল্লা, আর মোল্লা হয়ে যায় মন্ত্রী।

বাংলাদেশে আদিকাল থেকে ভাস্কর্য আর মূর্তি দুই-ই ছিল। আইসিস-মানসিকতার ঠাঁই বাংলাদেশে হলে শুধু বাংলাদেশ নয়, গোটা উপমহাদেশেরই অকল্যাণ। আমি প্রচলিত ধর্মে নয়, মানববাদে বিশ্বাস করা মানুষ। আমি পুজো করি না, কারও পায়ে মাথাও ঠেকাই না। কিন্তু আমি বাংলাদেশের লালনের পাদদেশে ফুল দেবে, কারণ লালনের জাতপাতের বিরুদ্ধে লেখা মানবতার পক্ষে লেখা গানগুলোকে আমি মহান বলে মনে করি। এর মানে এই নয় তাঁকে আমি পুজো করছি, এর মানে এই - তাঁকে আমি শ্রদ্ধা প্রদর্শন করছি। আমি শহিদ বেদিতে, স্মৃতিসৌধের বেদিতে ফুল দেব। যুগে যুগে আমরা ফুল অর্পণ করেই শ্রদ্ধা প্রদর্শন করে আসছি। উপমহাদেশের সুফি-সাধকদের মাজারে মোমবাতি দিয়েও মানুষ যুগে যুগে শ্রদ্ধা প্রদর্শন করে আসছে। যুগে যুগে নমস্যদের পায়ের ধুলো মাথায় নিয়ে শ্রদ্ধা প্রদর্শন করে আসছে। ভারতীয় উপমহাদেশের ইসলামন্ডপালন আর আরব দেশের ইসলামন্ডপালনে ভিন্নতা তো থাকবেই। এই ভিন্নতা যারা বোঝে না, তারা ইতিহাস বোঝে না।

শেষ কথা, বঙ্গবন্ধুর ভাস্কর্য শেখ হাসিনাকে স্থাপন করতেই হবে, এতেই যদি এতদিন কালসাপ পোষার দায়মুক্তি ঘটে তাঁর।

                লেখক : নির্বাসিত লেখিকা।

সর্বশেষ খবর