আজ ২৪ জানুয়ারি ভারতবর্ষে কৃষক আন্দোলনের ৭৬ দিন। সারা দেশের ৬৮টি কৃষক সংস্থা যৌথভাবে এ আন্দোলন চালিয়ে যাচ্ছে। অগ্রহায়ণে আন্দোলন শুরু হওয়ার পর মাঘের প্রবল ঠান্ডার মধ্যে দাঁড়িয়ে দিল্লি প্রবেশের জন্য তারা অপেক্ষা করে আছে। অ-বিজেপি-শাসিত বিভিন্ন রাজ্য থেকে আসা কৃষক দাবি আদায়ের জন্য একচুলও নড়তে নারাজ। মোদি সরকার সংখ্যাগরিষ্ঠতার জোরে কয়েক মাস আগে কৃষকের সব ফসল কেড়ে নেওয়ার জন্য যে বিল পাস করিয়েছে, কৃষকসহ সারা দেশের মানুষ মনে করছে এ বিল কৃষকদের হত্যার শামিল। হাড়কাঁপানো শীতে ইতিমধ্যে ৮০ জনের বেশি কৃষক মারা গেছে। মোদি সরকার ইতিমধ্যে কৃষক নেতাদের সঙ্গে ১০ দফা আলোচনা করেছে। কোনো আলোচনা থেকেই মীমাংসার সূত্র পাওয়া যায়নি। কৃষকের দাবি, যে তিনটি বিল সংসদে পাস হয়েছে তা প্রত্যাহার। মোদি, অমিত শাহ, মোহন ভাগবতরা বিল প্রত্যাহারে নারাজ। কৃষক, কংগ্রেসসহ সব বিরোধী দলের বক্তব্য, এ বিল কার্যকর হলে কৃষক ন্যায্যমূল্য পাবে না। তাদের উৎপাদিত পণ্য বিক্রি করতে পারবে না। মাঠ থেকে সরাসরি ফসল কিনবেন মোদির বন্ধু আম্বানি-আদানিরা। বিল পাস হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে সারা ভারতের মেট্রোপলিটন শহরগুলোয় ‘রিলায়েন্স ফ্রেশ’-এর অন্তত ৩০টি দোকান খোলা হয়েছে। সেখানে পাওয়া যাচ্ছে কাশ্মীরের আপেল, দক্ষিণ ভারতের কফি, নারকেল, পাঞ্জাব, হরিয়ানা ও মধ্য প্রদেশের বাসমতী চাল, বিভিন্ন প্রকারের ডাল, আলু, পিঁয়াজ, রসুনসহ নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্য। রিলায়েন্স ফ্রেশ ইতিমধ্যে শীতকালীন ফুলকপি, বাঁধাকপি, মুলা, শিমসহ সব রকম সবজি মাঠে গিয়ে কিনতে শুরু করেছে। পশ্চিমবঙ্গের জেলাগুলোয় কৃষকের সঙ্গে কথা বলে তাদের ক্ষোভের বিষয় জানা গেছে। বর্তমানে পশ্চিমবঙ্গের গ্রামগঞ্জে মাঠে বড় সাইজের একটি ফুলকপি কৃষক বিক্রি করছে ৩ টাকায়। কৃষক বলছে, একটি বড় ফুলকপি উৎপাদনে তাদের খরচ হয় ১০ টাকা। আর রিলায়েন্স ফ্রেশের আউটলেটে সেই কপি বিক্রি হচ্ছে ২০ থেকে ২৫ টাকায়। দক্ষিণ ভারতের কপি, নারকেল ছাড়াও আঙ্গুর, কাজুবাদাম, লবঙ্গ, দারচিনি, কিশমিশ সবই এখন আরএসএসের কব্জায়।
আম্বানির নজরে মুম্বাইয়ের বিখ্যাত আলফানসো আম, পশ্চিমবঙ্গের হিমসাগর, ল্যাংড়া থেকে মালদার ফজলি পর্যন্ত। আর যেসব কৃষক কঠোর পরিশ্রম করে উৎপাদন করছে তারা ন্যায্যমূল্য তো পাচ্ছেই না উল্টো মড়ার উপর খাঁড়ার ঘা। সারা দেশে একজন লোক সব কিনে নিয়ে মুনাফা লুটবে। আর এর অংশীদার হবে আরএসএস-বিজেপি। আরএসএস-বিজেপির লক্ষ্য এক জাতি, এক ধর্ম, এক ব্যবসায়ী। সবকিছু হাতের মুঠোয় নিয়ে সাধারণ মানুষকে বিপর্যস্ত করে তোলা। এ ধনকুবেররা ইতিমধ্যে অনেক শিল্পও কিনে নিয়েছেন। যেমন গৌতম আদানিকে দেওয়া হয়েছে ৫৪টি নতুন বিমানবন্দর তৈরির দায়িত্ব এবং বেশ কিছু কয়লা খনি। গৌতম আদানি অস্ট্রেলিয়ায় কয়লা খনি কিনতে গেলে সেখানকার খনিশ্রমিকরা তাকে এমন বাধা দেন যা তিনি কোনো দিন ভুলতে পারবেন না। দিল্লি-হরিয়ানার কাছে সিঙ্গু সীমান্তে হাজার হাজার কিষান-কিষানি ৭০ দিন ধরে দাঁড়িয়ে আছে। সারা দিন ধরে তারা বিক্ষোভ দেখাচ্ছে। নিজেরাই সেখানে রান্নাবান্না করে খাচ্ছে। গোটা বিশ্বের প্রচারমাধ্যমে এ খবরগুলো রোজই দেখানো হচ্ছে।
মোদি, অমিত শাহ, মোহন ভাগবতরা মনে করেন এভাবে কৃষককে দাবিয়ে রাখা যাবে। এই অর্ধশিক্ষিত দিল্লির শাসক দল ভুলে গেছে পাকিস্তানের অত্যাচারের সময় বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন, ‘আমারে তোমরা দাবায়ে রাখতে পারবা না।’ তারা তাঁকে দাবিয়ে রাখতে পারেনি। একইভাবে ভারতের কৃষককেও দাবিয়ে রাখা যাবে না, যার প্রমাণ তারা প্রতি মুহূর্তে দিয়ে যাচ্ছে। এ আন্দোলনে যোগ দিয়েছে ১৯৬৫ ও ’৭১ সালে ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধের সময় যারা লড়াই করেছিল সেসব অবসরপ্রাপ্ত হাজার হাজার সৈনিক। যোগ দিয়েছে পাঞ্জাবি শিল্পীরাও। তারা সেখানে দাঁড়িয়ে গান করছে। পাঞ্জাবি সিনেমার শিল্পীরা সেখানে এসে অভিনয় করছে। পরিস্থিতি ক্রমেই মোদি-শাহের হাতের বাইরে চলে যাচ্ছে। আন্দোলনকারী কৃষক ইতিমধ্যে ঘোষণা করেছে, ২৬ জানুয়ারি সাধারণতন্ত্র দিবসে হাজার হাজার ট্রাক নিয়ে রাজধানীতে ঢুকে তারা শোভাযাত্রা করবে। পরিস্থিতি সামাল দিতে না পেরে মোদি, অমিত শাহ তাদের বিরুদ্ধে দেশদ্রোহিতার অভিযোগ এনেছেন। যেসব শিল্পী আন্দোলনকারী কৃষকের পাশে দাঁড়িয়েছে তাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ আনা হয়েছে তারা সব খালিস্তানপন্থি। এনআইএ ইতিমধ্যে বহু কৃষকের বিরুদ্ধে সমন জারি করেছে। অনেক নেতা সমন নেননি। উত্তরে কৃষক বলেছে, আমরা যাব না। সরকারি কাজকর্ম দেখে মনে হচ্ছে তারা ফ্যাসিবাদকেও ছাড়িয়ে যাচ্ছে। কৃষকদের একটি বক্তব্য- আমরা কঠোর পরিশ্রম করে উৎপাদন করি। তা আমরা রিলায়েন্সকে কিছুতেই খেতে দেব না। সারা দেশে কোটি কোটি কৃষক আজ রাস্তায়। তারা মোদি-শাহ-মোহন ভাগবতের কাছে কোনোমতেই আত্মসমর্পণ করবে না। বিজেপির ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে তারা লড়াই চালিয়ে যেতে বদ্ধপরিকর। এ লড়াইয়ের সঙ্গে গোটা দেশের কোটি কোটি মানুষ রাস্তায় নেমে পড়েছে। আগামী দিনে ভারত কোন পথে কীভাবে যাবে তা নির্ভর করছে কৃষকের এ আন্দোলনের ওপর। ভারতের গণতন্ত্র এখন বিপন্ন। বিপন্ন মানবিকতা। শিক্ষা, স্বাস্থ্য থেকে শুরু করে মানুষের জীবন ধারণের সব রকম ব্যবস্থা। স্বাধীনতার আগে ১৯৪৬ সালে অবিভক্ত বাংলায় কৃষক বিদ্রোহ হয়েছিল যা আজও ইতিহাসে ‘তেভাগা আন্দোলন’ নামে পরিচিত। অর্থাৎ কিনা উৎপাদনের এক-তৃতীয়াংশ কৃষককে দিতে হবে। আন্দোলনের কেন্দ্রবিন্দু ছিল মূলত দিনাজপুর ও দক্ষিণ ২৪ পরগনা জেলা। জমিদারদের হয়ে ব্রিটিশ পুলিশ ভয়ংকর অত্যাচার করে। আন্দোলন শুরু হয় ১৯৪৬ সালে। ’৪৭ সালের ১৫ আগস্টের পর দেশীয় সরকার কৃষকের দাবি অনেকটা মিটিয়ে দেয় এবং জেলবন্দী কৃষকদের ছেড়ে দেয়।
এ আন্দোলনের অন্যতম নেতা ছিলেন মনসুর হাবিবুল্লাহ। হাবিবুল্লাহ সাহেব ১৯৭৭ সালে জ্যোতি বসু সরকারের আমলে প্রথম পাঁচ বছর বিধানসভার স্পিকার ছিলেন। পরের পাঁচ বছর জ্যোতি বাবুর মন্ত্রিসভায় মন্ত্রী ছিলেন। তিনি খুুঁড়িয়ে হাঁটতেন। সাংবাদিকরা এ নিয়ে প্রশ্ন করলে তিনি তাদের ঘরে ডেকে নিয়ে গিয়ে তেভাগা আন্দোলনে ব্রিটিশ সরকার ও দেশীয় জমিদারদের অত্যাচারের কথা বর্ণনা করতেন। তাই রাজনৈতিক বিশেষজ্ঞ ও ইতিহাসবিদরা মনে করেন- ভারতের কৃষকবিরোধী যে তিনটি আইন মোদি সরকার লোকসভায় পাস করিয়েছে তা প্রত্যাহার করা না হলে আগামী দিনে উদ্ভূত ভয়ংকর পরিস্থিতি মোদি সরকার সামাল দিতে পারবে কি?
লেখক : ভারতীয় প্রবীণ সাংবাদিক।
 
                         
                                     
                                                             
                                     
                                     
                                     
                                     
                                     
                                     
                                     
                                     
                                     
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                        