খেলনা শুধু বিনোদনের জিনিস নয়, এটি শিশুদের শেখার অন্যতম কার্যকর উপায়। শিশুরা খেলনার মাধ্যমে রং, আকার, সংখ্যা, ভাষা শেখে। সামাজিক আচরণ (ভাগাভাগি, সহযোগিতা, ধৈর্য) শেখে। এগুলো তাদের সৃজনশীলতা ও কল্পনাশক্তি বাড়ায়। সমস্যা সমাধানের দক্ষতা অর্জন করতে সহায়তা করে। এখন প্রযুক্তি ও বিজ্ঞানের যুগ। আজকের শিশুরা এমন এক পৃথিবীতে বেড়ে উঠছে, যেখানে প্রতিদিন নতুন নতুন আবিষ্কার এবং উদ্ভাবনের মাধ্যমে জীবন আরও সহজ, আকর্ষণীয় ও বুদ্ধিবৃত্তিকভাবে উদ্দীপিত হচ্ছে। শিশুর শারীরিক, মানসিক ও সৃজনশীল বিকাশের জন্য খেলাধুলা যেমন গুরুত্বপূর্ণ, তেমনি শিক্ষামূলক খেলনা ও উপকরণের ভূমিকাও বিশেষভাবে আলোচিত। এই প্রেক্ষাপটে ‘ইলেকট্রিক বিল্ডিং ব্লকস’ বা বৈদ্যুতিক নির্মাণ ব্লকস শিশুদের মেধা, সৃজনশীলতা ও সমস্যা সমাধানের দক্ষতা গঠনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে। জন্মের পর থেকেই শিশুর মস্তিষ্ক দ্রুত বিকশিত হতে থাকে এবং সঠিক পরিবেশ, উপকরণ ও শিক্ষণ পদ্ধতি তার বুদ্ধিবৃত্তিক বিকাশে গভীর প্রভাব ফেলে। আধুনিক যুগে প্রযুক্তি শিক্ষার সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে যুক্ত হয়েছে। ফলে শিশুদের শিক্ষার উপকরণও ক্রমে আধুনিক ও বৈচিত্র্যময় হচ্ছে। এগুলো শুধু খেলনা নয়, বরং শেখার মাধ্যম। যেখানে খেলার মধ্য দিয়েই শেখা হয় বিজ্ঞানের মৌলিক ধারণা-বিদ্যুৎ, সার্কিট, যুক্তি ও কাঠামো নির্মাণের নীতি। ইলেকট্রিক বিল্ডিং ব্লকস হলো এমন কিছু শিক্ষণমূলক উপকরণ যা ছোট ছোট মডুলার অংশ নিয়ে তৈরি-প্রতিটি অংশে থাকে নির্দিষ্ট ইলেকট্রনিক উপাদান যেমন ব্যাটারি, LED লাইট, মোটর, সেন্সর, সুইচ বা চুম্বকীয় সংযোগ ব্যবস্থা। শিশুরা এগুলো জোড়া দিয়ে বিভিন্ন সার্কিট বা মডেল তৈরি করতে পারে-যেমন ফ্যান ঘোরানো, আলো জ্বালানো, সেন্সর চালু করা ইত্যাদি। সাধারণ বিল্ডিং ব্লকের সঙ্গে এর পার্থক্য হলো-এগুলো শুধু আকার বা কাঠামো নয়, বরং কার্যক্ষমতা নিয়েও কাজ করে। ফলে শিশু খেলতে খেলতে শিখে যায় কিভাবে বিদ্যুৎপ্রবাহ কাজ করে, কিভাবে সার্কিট বন্ধ বা চালু হয় এবং কিভাবে একটি ছোট মডেল বাস্তব যন্ত্রের মতো কাজ করতে পারে। এই উপকরণগুলো শিশুদের বিজ্ঞান, প্রযুক্তি, প্রকৌশল, শিল্পকলা এবং গণিত-এই পাঁচটি বিষয়ের সঙ্গে পরিচিত করায়। যেমন-একটি সার্কিট তৈরি করতে গিয়ে সে ভোল্টেজ, কারেন্ট ও রেজিস্ট্যান্স সম্পর্কে ধারণা পায়, মোটর চালাতে গিয়ে শেখে কীভাবে শক্তি রূপান্তরিত হয়, সেন্সর ব্যবহার করে বুঝতে শেখে কীভাবে তথ্য সংগ্রহ ও প্রক্রিয়াকরণ করা যায়। ফলে তার শেখা হয়ে ওঠে অভিজ্ঞতাভিত্তিক ও অনুসন্ধানমূলক, যা প্রচলিত মুখস্থ শিক্ষার থেকে অনেক বেশি কার্যকর। এগুলো শিশুদের চিন্তাশক্তিকে বহু দিক থেকে বিকশিত করে। প্রথমত, এগুলো শিশুদের যুক্তিবোধ গঠন করে- একটি সার্কিট কাজ না করলে সে কারণ অনুসন্ধান করে, সমস্যা বিশ্লেষণ করে এবং সমাধান বের করার চেষ্টা করে। দ্বিতীয়ত, এগুলো সৃজনশীল চিন্তাধারার বিকাশ ঘটায়, কারণ প্রতিটি শিশু তার নিজের কল্পনা অনুযায়ী নতুন মডেল বা প্রকল্প তৈরি করতে পারে। তৃতীয়ত, এই খেলাগুলো মনোযোগ ও ধৈর্যশক্তি বৃদ্ধি করে, কারণ কাজটি সফলভাবে সম্পন্ন করতে তাকে ধাপে ধাপে চিন্তাও প্রয়োগ করতে হয়। এ ছাড়া দলগতভাবে কাজ করলে শিশুদের মধ্যে সহযোগিতা, নেতৃত্ব ও যোগাযোগ দক্ষতাও বাড়ে। আধুনিক বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির যুগে ছোটবেলা থেকেই যদি শিশুকে বিজ্ঞানমনস্ক হিসেবে গড়ে তোলা যায়, তাহলে ভবিষ্যতে সে আরও দক্ষ ও উদ্ভাবনী নাগরিক হয়ে উঠবে। এই খেলনাগুলো শিশুকে পূর্ণ স্বাধীনতা দেয়। ফলে সে নিজের মতো করে চিন্তা করতে পারে, পরিকল্পনা করতে পারে এবং নিজের হাতে তৈরি কিছু দেখে গর্ব অনুভব করতে পারে। যখন সে দেখে তার বানানো মডেল আলো জ্বালাচ্ছে বা কোনো চলমান যন্ত্রের মতো কাজ করছে, তখন তার আত্মবিশ্বাস ও কৌতূহল আরও বৃদ্ধি পায়। এভাবেই শিশুর মধ্যে উদ্ভাবনী মানসিকতা গড়ে ওঠে, যা পরবর্তীকালে তাকে বিজ্ঞানী, প্রকৌশলী বা উদ্ভাবক হতে অনুপ্রাণিত করে। এগুলো শুধু শিশুর মেধাবিকাশ নয়, বরং সামাজিক ও মানসিক বিকাশেও সহায়ক। দলগতভাবে কাজ করার সময় তারা একে অন্যের সঙ্গে আলোচনা করে, ধারণা বিনিময় করে এবং যৌথভাবে সমস্যার সমাধান করে। এতে সামাজিক বন্ধন ও সহযোগিতার মনোভাব তৈরি হয়। আবার কোনো মডেল তৈরি করতে ব্যর্থ হলে সে শেখে ব্যর্থতা মেনে নিয়ে নতুনভাবে চেষ্টা করা, যা মানসিক দৃঢ়তা গঠনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। সবচেয়ে বড় সুবিধা হলো এই খেলনাগুলো শিশুদের স্ক্রিন আসক্তি থেকে দূরে রেখে বাস্তব হাতে-কলমে শেখার পরিবেশ তৈরি করে, যা মানসিক ভারসাম্য রক্ষা করে। এটি শুধু বিনোদনের মাধ্যম নয়, বরং শেখা ও সৃষ্টির এক অসাধারণ প্ল্যাটফর্ম। প্রযুক্তিনির্ভর বিশ্বে এগিয়ে থাকতে হলে আমাদের শিশুদের হাতে এমন শিক্ষণ উপকরণ দিতে হবে, যা খেলার মধ্য দিয়ে শেখায়-আর ইলেকট্রিক বিল্ডিং ব্লকস সেই পথেই এক দৃঢ় পদক্ষেপ। চাকরিজীবী মা-বাবারা বাসায় এবং স্কুলে শিক্ষক ও অভিভাবকরা যদি এ ধরনের সৃজনশীল খেলাকে শিক্ষার অংশ হিসেবে অন্তর্ভুক্ত করেন, তাহলে শিশুরা ছোটবেলা থেকেই বিজ্ঞানমনস্ক ও উদ্ভাবনী চিন্তায় সমৃদ্ধ হয়ে উঠবে। তাই বলা যায় এগুলো শুধু খেলার সামগ্রী নয়, বরং এগুলো শিশুর মেধা, মনন ও ভবিষ্যৎ গঠনে এক ধরনের ‘নীরব শিক্ষক।’
লেখক : অধ্যাপক এবং তথ্যপ্রযুক্তিবিদ, আইআইটি, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়