বুধবার, ২৪ মার্চ, ২০২১ ০০:০০ টা

বাংলাদেশ-ভারত ঐতিহাসিক বন্ধুত্ব ও উগ্র সাম্প্রদায়িকতা

পীর হাবিবুর রহমান

বাংলাদেশ-ভারত ঐতিহাসিক বন্ধুত্ব ও উগ্র সাম্প্রদায়িকতা

একাত্তরের সুমহান মুক্তিযুদ্ধে যে উগ্র সাম্প্রদায়িক শক্তি পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর দোসর হিসেবে পরাজিত হয়েছিল, স্বাধীনতার ৫০ বছর পর আজ গৌরবের সুবর্ণজয়ন্তীকালে গোটা দেশে তাদের উত্তরাধিকাররাই হিংস্র চেহারায় দাঁড়িয়েছে।

১৯৭৫ সালে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে পরিবার-পরিজনসহ নৃশংস হত্যাকান্ডের পর সেনাশাসক জিয়াউর রহমান নিষিদ্ধ সাম্প্রদায়িক শক্তিকে রাজনীতিতে পুনর্বাসিত করায় আজ গোটা জাতি খেসারত দিচ্ছে। দিনে দিনে দেনা বাড়তে বাড়তে এখন এমন উগ্রমূর্তি ধারণ করেছে যেন মনে হয় লাখো শহীদের রক্তে রঞ্জিত বাংলাদেশ আজ উগ্র সাম্প্রদায়িক শক্তির ঔদ্ধত্য ও ত্রাসের অভয়ারণ্য। বিএনপি তো হেফাজতের শাপলা চত্বরের ভয়াবহ তান্ডবে অকুণ্ঠ সমর্থন দিয়েছিলই। রাজনৈতিক সম্পর্ক আছেই। আওয়ামী লীগের অনেক মাঠ নেতা-কর্মী আদর্শহীন বোধহীন রাজনীতির কারণে এদের সঙ্গে বুক মিলিয়ে মঞ্চে ওঠেন। বঙ্গবন্ধুর লেখা বই ছড়িয়ে দিতে পারলেও এক যুগে আওয়ামী লীগ তার নেতা-কর্মীদের চিন্তা-চেতনা-কর্মে মহান নেতার আদর্শ-নীতি-নৈতিকতায় তৈরি করতে পারেনি। তাই কেউ জামায়াত প্রডাক্ট আজহারীর ওয়াজে যায়, কেউ যায় উগ্র মামুনুল হকের সঙ্গে। আর এরা বঙ্গবন্ধুর ভাস্কর্য বুড়িগঙ্গায় ভাসিয়ে দেওয়ার হুমকি দেয়। এরা যখন তখন সাম্প্রদায়িকতার হিংসা-বিদ্বেষের বিষাক্ত উন্মাদনা ছড়ায়। যখন তখন সংখ্যালঘুদের বাড়িঘরে নানা অজুহাতে হামলা-ভাঙচুর করে জাতির জন্য কলঙ্ক বয়ে আনে। প্রশাসন ও আইন এদের কখনো কঠোরভাবে দমন করে না। এবার শাপলা চত্বরের এ উগ্রশক্তি ভাটির জনপদ প্রকৃতির অপরূপ লীলাভূমি হাওর-বাঁওড় নদী আর মরমি সাধক কবি ও বাউলের তীর্থভূমি জল-জোছনার সুনামগঞ্জের শাল্লায় সংখ্যালঘু হিন্দুদের বাড়িঘরে হামলা-ভাঙচুর চালিয়েছে। শাল্লা সংখ্যালঘু অধ্যুষিত এলাকা। প্রগতিশীল রাজনীতির তীর্থভূমি। মরহুম আবদুস সামাদ আজাদ, প্রয়াত অক্ষয় কুমার দাস, কমরেড বরুণ রায় ও পার্লামেন্টারিয়ান সুরঞ্জিত সেনগুপ্তের রাজনীতির স্মৃতিময় জায়গা। সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত বারবার দিরাই-শাল্লা থেকে নির্বাচিত হয়েছেন। হাড্ডাডাড্ডি লড়াইয়েও শাল্লার ভোটই তাঁকে বিজয়ী করেছে। সুনামগঞ্জের সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির ঐতিহ্যের ওপরই আঘাত নয়, নিরীহ গরিব হিন্দুদের ঘরবাড়ি আক্রমণ করে আতঙ্কিত করা হচ্ছে। এ দেশ সব ধর্মের মানুষের রক্তে অর্জিত। এখানে সবার সম-অধিকার। কিন্তু একাত্তরের পরাজিত শক্তির আদর্শের উত্তরাধিকাররাই বারবার এমন জঘন্য বর্বর ঘটনা বিভিন্ন এলাকায় ঘটায়। মামুনুল হকদের উগ্রতার বিরুদ্ধে আজ বাংলাদেশকে রুখে দাঁড়ানোর সময়। এরা ইসলামের শান্তির বাণী নয়, হিংসা-বিদ্বেষভরা সাম্প্রদায়িক রাজনীতির বয়ান করে জেহাদি সুরে। এটা আলেম-ওলামার সুর নয়। প্রশাসন এসব দেখেও দেখে না কেন জানি না। ভারতে ধর্মনিরপেক্ষতার সৌন্দর্য যেমন উগ্র হিন্দুত্ববাদ ধূসর করেছে তেমনি এ দেশে বঙ্গবন্ধু হত্যার পর ধর্মনিরপেক্ষতাসহ মুক্তিযুদ্ধের আদর্শ সংবিধান থেকে মুছে দেশকে আজ মডারেট মুসলিম কান্ট্রির তকমা দিয়েছে। একটি দেশে সব ধর্ম-বর্ণের মানুষ যখন তার সাংবিধানিক অধিকার নিয়ে নিরাপদে বাস করতে পারে না তখন সে রাষ্ট্র চরিত্র হারায়। রূপ হারায়। শাল্লায় হামলাকারীদের আটক করা হয়েছে। কঠোর শাস্তি চাই। তার আগে উগ্রপন্থিদের বিরুদ্ধে কঠোর হওয়া চাই। ধর্মের নামে, সমাজবিপ্লবের নামে এ দেশে উগ্রপন্থিরা অভিশাপ এনেছে। উগ্রতার স্থান জনগণ দেয়নি ভোটে, প্রশাসন দিতে পারে না।

জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মশতবার্ষিকী ও স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীর উৎসবে রাষ্ট্রনায়করা আসছেন। করোনা না হলে রাষ্ট্রীয় অতিথির সংখ্যা অনেক হতো। বাড়ত তার বর্ণিল আয়োজন, বিশ্ববরেণ্য নেতা ও ব্যক্তিদের মিলনমেলা। স্বাধীনতার ৫০ বছর পূর্তি উৎসবে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির আগমন বাড়তি তাৎপর্য বহন করে। মোদির আগমনের বিরোধিতা আরেক সাম্প্রদায়িক উসকানি। আমাদের জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ও ভারতের গণতন্ত্রের মহান নেত্রী শ্রীমতী ইন্দিরা গান্ধীর মাধ্যমে এক কথায় মুজিব-ইন্দিরার হাত ধরে দুই দেশের উষ্ণ আন্তরিক বিশ্বস্ত বন্ধুত্বের যে শুভসূচনা ঘটেছিল আজ ৫০ বছর পরে শেখ হাসিনা-নরেন্দ্র মোদির নেতৃত্বে সে সুসম্পর্ক বহাল রয়েছে। ভারত আমাদের বৃহত্তম গণতান্ত্রিক প্রতিবেশী রাষ্ট্রই নয়, মহান স্বাধীনতা সংগ্রাম ও সুমহান মুক্তিযুদ্ধের রক্তে লেখা ইতিহাসে নিবিড় পরীক্ষিত বন্ধু। ১৯৬২ সালে স্বাধীনতার মহানায়ক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান স্বাধীন বাংলাদেশের স্বপ্ন নিয়ে যে সংগ্রাম শুরু করেন সেখানে তিনি ভারতের সমর্থন চেয়েছিলেন আত্মমর্যাদার ভিত্তিতে। সে সময় ঢাকায় নিযুক্ত ভারতীয় উপ-হাইকমিশনের পলিটিক্যাল সেক্রেটারি শশাঙ্ক শেখর ব্যানার্জির সঙ্গে রাতভর বৈঠক করে ইত্তেফাক ভবনে তফাজ্জল হোসেন মানিক মিয়ার মধ্যস্থতায় বঙ্গবন্ধু তাঁর পরিকল্পনা তুলে ধরেন। বঙ্গবন্ধুই সেই নেতা যিনি এ দেশের স্বাধীনতার স্বপ্ন প্রথম দেখেন, সে লক্ষ্যে আন্দোলনের রূপরেখা তৈরি করে দল ও জনগণকে সংগঠিত করেন এবং তা বাস্তবায়ন করেন। সেই রাতভর মিটিংয়ে তিনি ভারতের প্রধানমন্ত্রী পন্ডিত জওহরলাল নেহরুকে আনুষ্ঠানিক চিঠি দেন এবং তাঁর এ সম্পর্কিত পরিকল্পনা শশাঙ্ক এস ব্যানার্জির হাতে হস্তান্তর করেন। সে চিঠি তাঁরা নেহরুর কাছে পাঠালে তিনি ইতিবাচক সাড়া দেন। নেহরুর মৃত্যুর পর তাঁর কন্যা ইন্দিরা গান্ধী ক্ষমতায় আসেন। ইতিমধ্যে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানও বাঙালি জাতির অবিসংবাদিত নেতা হয়ে ওঠেন। জনগণ তাঁর নেতৃত্বে ঐক্যবদ্ধ হয়। বাংলাদেশের স্বাধীনতা-সংগ্রামে শ্রীমতী ইন্দিরা গান্ধীর সহযোগিতার শক্ত হাতও প্রসারিত হয়। ’৬৯ সালে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান লন্ডন সফরকালে সেখানকার ভারতীয় হাইকমিশনের কর্মকর্তা ইন্দিরা গান্ধীর বিশ্বস্ত ফণীন্দ্রনাথ ব্যানার্জির সঙ্গে দীর্ঘ বৈঠক করে স্বাধীনতাযুদ্ধের পরিকল্পনা চূড়ান্ত করেন। কথা ছিল এখান থেকে গ্রুপে গ্রুপে দল যাবে আর ভারত সশস্ত্র প্রশিক্ষণ দেবে। একদল ফিরবে, আরেক দল যাবে। এর মধ্যে ’৭০ সালে প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান এক ব্যক্তি এক ভোটের ভিত্তিতে সাধারণ নির্বাচন ঘোষণা করলে বঙ্গবন্ধু লুফে নেন। দলের ভিতরের নির্বাচনবিরোধী অংশ, যারা সশস্ত্র যুদ্ধের মাধ্যমে স্বাধীনতা অর্জনের পক্ষে ছিলেন তারা এতে নাখোশ হলেও বঙ্গবন্ধু তাদের পাত্তা দেননি। সে নির্বাচনে নিরঙ্কুশ বিজয়ের মাধ্যমে বঙ্গবন্ধুই হয়ে ওঠেন বাঙালি জাতির মহান স্বাধীনতা আন্দোলন ও মুক্তিসংগ্রামের একক নেতা। তিনি জানতেন জাতি তাঁর পেছনে ঐক্যবদ্ধ। তাই নির্বাচনে ও মুক্তিযুদ্ধে জনগণ তাঁর ডাকেই স্বতঃস্ফূর্ত সাড়া দিয়েছে। পাকিস্তানিরা ক্ষমতা হস্তান্তর না করে আলোচনার মাধ্যমে যেমন সময় ক্ষেপণ করে তেমনি বঙ্গবন্ধুও মুক্তিযুদ্ধের প্রস্তুতি নেন আর ভারতই সেখানে বড় আশ্রয় ও সমর্থনদাতা হয়ে ওঠে। ভিতরে ভিতরে বঙ্গবন্ধু চূড়ান্ত প্রস্তুতি নেন স্বাধীনতাযুদ্ধের আর পাকিস্তানি শাসকরা প্রস্তুতি নেয় হামলার। এদিকে উত্তাল মার্চ ’৭১ স্বাধীনতার সংগ্রামকে বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে উদ্ভাসিত করে তোলে। ৭ মার্চ বঙ্গবন্ধু ঐতিহাসিক সোহরাওয়ার্দী উদ্যান অর্থাৎ তৎকালীন রেসকার্স ময়দানে ১৮ মিনিটের কাব্যিক আবেগঘন ভাষণে স্বাধীনতার ডাক দেন। বাঙালি জাতিকে স্বাধীনতার জন্য প্রস্তুতির নির্দেশ দেন। তার পর গোটা জাতি এক মোহনায় মিলিত হয়ে স্বাধীনতার জোর প্রস্তুতি নিতে থাকে। ২৫ মার্চ রাতে পাকিস্তানি সামরিক বাহিনীর আক্রমণের মুখে বঙ্গবন্ধু স্বাধীনতা ঘোষণা করেন এবং দখলদার পাকিস্তানি বাহিনীর বিরুদ্ধে সারা দেশে প্রতিরোধযুদ্ধ গড়ে ওঠে। দলের নেতারা ও আক্রান্ত মানুষ ছুটে যান ভারতে। সেখানে মুজিবনগর সরকার বা স্বাধীন বাংলাদেশ সরকার গঠনে ও মুক্তিযুদ্ধে অস্ত্র-অর্থ-ট্রেনিং এমনকি এক কোটি শরণার্থীকে ইন্দিরা গান্ধীর সরকার আশ্রয় ও সহযোগিতা দেন। ভারতের সব রাজনৈতিক দল এবং জনগণ আমাদের মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে দাঁড়ায়। ইন্দিরা গান্ধী একদিকে শরণার্থী, মুক্তিযোদ্ধা ও মুজিবনগর সরকারকে সহযোগিতা করেছেন; অন্যদিকে পাকিস্তানিদের বর্বর গণহত্যার বিরুদ্ধে এমনকি পাকিস্তানে কারাবন্দী বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের মুক্তি দাবিতে বিশ্বসম্প্রদায়কে দিয়ে একযোগে চাপ সৃষ্টি করেন। তিনি ইউরোপসহ বিভিন্ন দেশ সফর করে বাংলাদেশের পক্ষে জনমত গড়ে তোলেন। দুই সুপার পাওয়ারের সেই যুগে সোভিয়েত রাশিয়াকে কঠিনভাবে পক্ষে টানেন এবং স্বাধীনতার বিরুদ্ধে পাকিস্তানের পক্ষ নেওয়া মার্কিন প্রেসিডেন্টের সঙ্গে তাদের বৈরী মনোভাবের মুখে লাগাম পরানোর উদ্দেশ্যে সাক্ষাৎ করেন। একপর্যায়ে মুক্তিবাহিনী ও ভারতীয় সামরিক বাহিনী তথা মিত্রবাহিনীর সমন্বয়ে গড়ে ওঠে যৌথ কমান্ড। ’৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর পাকিস্তান পরাজয়ের লজ্জা ও গ্লানি নিয়ে আত্মসমর্পণ করলে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ বিজয় অর্জন করে। ’৭২ সালের ৮ জানুয়ারি বঙ্গবন্ধুকে মুক্তি দিতে বাধ্য হয় পাকিস্তান। লন্ডন হয়ে ১০ জানুয়ারি স্বাধীন দেশে ফিরে আসেন স্বাধীনতার মহানায়ক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। পথে দিল্লির পালাম বিমানবন্দরে তাঁকে স্বাগত জানান ভারতের রাষ্ট্রপতি ভি ভি গিরি ও ইন্দিরা গান্ধী। সেখানেই তিনি তাঁর স্বাধীন দেশ থেকে ভারতীয় সেনা প্রত্যাহার করে নেওয়ার প্রস্তাব দেন এবং ইন্দিরা গান্ধী তা মেনে নেন।

আমাদের স্বাধীনতা সংগ্রামে ভারতের অবদান, ইন্দিরা গান্ধীর সাহসী ভূমিকা, যুদ্ধে ভারতীয় মিত্রবাহিনীর অনেকের জীবন দান, এমনকি শরণার্থীদের আশ্রয়দানে ভারতের জনগণের ভূমিকা ইতিহাসে কৃতজ্ঞচিত্তে লেখা থাকবে। একটি যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশ পুনর্গঠনে ভারত সেদিন অর্থ ও খাবার সহায়তাও পাঠাতে ভোলেনি। এভাবেই বন্ধুত্বের আবেগঘন একটি বিশ্বাস, আস্থা ও আদর্শের ওপর দুই দেশের সম্পর্ক গড়ে ওঠে। কিন্তু যুদ্ধের ভয়াবহতা কেটে ওঠার আগেই যে চীন আমাদের স্বাধীনতার বিরোধিতা করেছিল, সেই চীনাপন্থি দলগুলো এবং অতিবিপ্লবী কিছু দল সক্রিয় হয়ে ওঠে। পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর সহযোগী কিছু রাজনৈতিক শক্তি ধর্মীয় রাজনীতির কারণে নিষিদ্ধ হলে তারা চেহারা পাল্টে ভারতবিরোধী জিগির তোলে। আর চীনপন্থি বামরা তা ছড়িয়ে দেন আগুনের মতো।

’৭৫ সালের ১৫ আগস্ট জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে হত্যা করে খুনিদের শাসন কায়েম হয়। উল্লসিত পাকিস্তান বাংলাদেশকে ইসলামী প্রজাতন্ত্র বলার ঔদ্ধত্য দেখায়। খুনি মোশতাক থেকে সেনানায়ক জিয়ার শাসনামলে পাকিস্তানি ধারায় দেশকে টেনে মুক্তিযুদ্ধের আদর্শ থেকে বিচ্যুত করা হয়। এমনকি নিষিদ্ধ দক্ষিণপন্থিদের রাজনীতিতে পুনর্বাসিত করা হয়। অতি ডান ও অতি বামের মিলনে সামরিক শাসনের গর্ভে বিএনপির জন্ম হয়। সংবিধান থেকে মুক্তিযুদ্ধের আদর্শই মুছে দেওয়া হয়নি, ভারতের সঙ্গেও বন্ধুত্বের জায়গা হোঁচট খায়। ভারতবিদ্বেষ ছড়ানো হয়। সামরিক শাসনকবলিত বাংলাদেশের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ প্রতিবেশী ভারতের সম্পর্ক শীতল হয়ে যায়। নানামুখী টানাপোড়েন তৈরি হয়। দীর্ঘ ২১ বছর পর ’৯৬ সালে আওয়ামী লীগ বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনার নেতৃত্বে ক্ষমতায় এলে বাংলাদেশ-ভারত দুই দেশের বন্ধুত্ব নতুন করে ঘষামাজা হয়, উষ্ণতা পায়।

সে সময় ৩০ বছর মেয়াদি গঙ্গাচুক্তি হয়। গঙ্গার পানিবণ্টনের চুক্তিতে বাংলাদেশের কৃষিতে বিশেষ করে ধান উৎপাদনের যে সুফল আমাদের কৃষকের ঘরে উঠেছে সে কথা সমালোচকরা কখনো বলেন না। তিস্তাসহ অভিন্ন নদ-নদীর পানিবণ্টন চুক্তিতে গঙ্গার পানিচুক্তি হতে পারে রোল মডেল। গঙ্গাচুক্তির নবায়নও সামনে হাতছানি দিচ্ছে। একটি বৃহত্তম প্রতিবেশী রাষ্ট্র যার সঙ্গে ’৭১-এ রক্তে বাঁধা সম্পর্ক তার সঙ্গে উষ্ণ বন্ধুত্বই অপরিহার্য। সম্পর্কের টানাপোড়েন কোনোভাবেই প্রত্যাশিত নয়। কেবল সীমান্ত হত্যা নিয়ে দুই দেশের মৈত্রীর সম্পর্কের বিরুদ্ধে বিষের বাতাস ছড়ানো মতলব ছাড়া কিছু নয়। ’৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধেও পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর দোসর, সহযোগীরা স্বাধীনতা-সংগ্রামী ও মুক্তিযোদ্ধাদের হিন্দুস্থানের দালাল বলেছিল। স্বাধীনতা সংগ্রামেরও বিরোধিতা করেছে তারা। সীমান্ত হত্যা বন্ধে দুই বন্ধু দেশ কূটনৈতিক পর্যায়ে আলোচনার মাধ্যমে সমাধানের যে চেষ্টা চালাচ্ছে তাতেই জট খুলবে। ভারতকে এটা বন্ধ করতেই হবে। বন্ধুতে বন্ধুতে গলাগলি করে একসঙ্গে বসলে সমস্যার সমাধান হবে। আমাদের যেমন ভারতকে দরকার ভারতেরও আমাদের বড় বেশি প্রয়োজন।

মনমোহনের কংগ্রেস ক্ষমতায় থাকতে তিস্তার পানিবণ্টন চুক্তি হওয়ার কথা চূড়ান্ত হয়েছিল। মনমোহনের ঢাকা সফরকালে আগের দিন আকস্মিক পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা ব্যানার্জি বাগড়া দিয়ে বসলেন। আর হলো না। সে সময় আমরা ১২ জন সাংবাদিক ভারত সরকারের আমন্ত্রণে গিয়েছিলাম দিল্লিসহ নানা শহরে। তৎকালীন পররাষ্ট্রমন্ত্রী সালমান খুরশিদ বলেছিলেন, মুজিব-ইন্দিরা চুক্তি অনুসারে বাংলাদেশ ও ভারতের গোটা স্থলসীমান্ত সমস্যার সমাধান হবে। তারা চাইছেন তা সবাইকে নিয়ে করতে। তারা আর করে যেতে পারেননি। নরেন্দ্র মোদি ক্ষমতায় আসার পর দুই দেশের বন্ধুত্বের উষ্ণতায় ভাটা পড়েনি বরং ঘনিষ্ঠতা বেড়েছে। সীমান্তের সমস্যার সমাধান হয়েছে। সমাধান হয়েছে ছিটমহলের। এ এক বিশাল অর্জন যে দুই দেশের মধ্যে ৪ হাজার কিলোমিটারের বেশি স্থলসীমান্ত আছে। এটা চিহ্নিত হয়ে গেছে। সীমান্ত অপদখলীয় ভূমি বিনিময় হয়েছে। সীমান্ত নিয়ে আজ আর কোনো বিরোধ নেই। শেখ হাসিনা-নরেন্দ্র মোদির আন্তরিকতা আমাদেরও অনেক দিয়েছে। কেবল ভারতকে নয়।

সমুদ্রসীমা চিহ্নিত করা বাংলাদেশের বড় অর্জন। দ্বিপক্ষীয়ভাবে সমুদ্রসীমা চিহ্নিত করা সম্ভব হচ্ছিল না। তাই বাংলাদেশ আন্তর্জাতিক আদালতে গেছে। আন্তর্জাতিক আদালতের রায়ের মাধ্যমে বিরোধ নিষ্পত্তি হওয়ায় ন্যায্যতা নিশ্চিত হয়েছে। উভয় দেশ রায় মেনে নিয়েছে। বাংলাদেশের জলসীমা স্থলভাগের চেয়ে অনেক বড়। সেখানে মাছ চাষ, তেল-গ্যাসসহ খনিজ সম্পদ আহরণে এখন আর কোনো বাধা নেই। সমুদ্রসীমা চিহ্নিত না থাকায় দক্ষিণ চীন সাগরে উত্তেজনা বিরাজ করছে। অন্যদিকে বঙ্গোপসাগরে বিরাজ করছে শান্তি। বাণিজ্যসহ নানা প্রকার অর্থনৈতিক কর্মকান্ডে প্রাণচঞ্চল হচ্ছে।

ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশের ব্যবসা-বাণিজ্য, কানেকটিভিটি, সাংস্কৃতিক আদান-প্রদান, মানুষের মধ্যে যোগাযোগ বৃদ্ধি পাচ্ছে। এক বছরে বাংলাদেশের রপ্তানি ৪৩ শতাংশ বেড়ে বার্ষিক রপ্তানি ১ দশমিক ২৫ শতাংশে উন্নীত হয়েছে। ফেনী নদীর ওপর সেতু হওয়ায় ত্রিপুরা থেকে পর্যটকরা চট্টগ্রাম ও কক্সবাজার যেতে পারবেন। ভারত প্রতি বছর ১৪ লাখ বাংলাদেশিকে ভারত সফরে ভিসা দেয়। চিকিৎসা, বাণিজ্য, পর্যটনসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে জনগণের মধ্যে যোগাযোগ ও সহযোগিতা বাড়বে।

কভিডকালে টিকা দিয়ে ভারত সহায়তা করেছে। এতে মহামারী নিয়ন্ত্রণে সহায়ক হচ্ছে। কভিড-পরবর্তী অর্থনৈতিক পুনরুদ্ধারেও দুই দেশ একসঙ্গে কাজ করছে। বাংলাদেশের অবকাঠামো উন্নয়নে ভারত ৮ বিলিয়ন ডলারের ঋণ দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়েছে। ঋণের বাস্তবায়ন চলছে।

বাংলাদেশে শান্তি ও স্থিতিশীলতা রক্ষায় বাংলাদেশ গোয়েন্দা তথ্য বিনিময়সহ নানাভাবে সহায়তা দিচ্ছে। মিয়ানমারের ওপর দিয়ে ব্যাংকক পর্যন্ত যোগাযোগ, নেপাল ও ভুটানের সঙ্গে কানেকটিভিটি জোরদারে ভারত ইতিবাচক। বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে সম্পর্ক বিশ্বে প্রতিবেশী দেশগুলোর মধ্যে সুসম্পর্কের মডেল হতে যাচ্ছে।

বাংলাদেশের সঙ্গে সম্পর্ক জোরদারে কংগ্রেস, বিজেপি, তৃণমূল, বাম সবার মধ্যে মতৈক্য আছে। রাজনৈতিক মতৈক্য কূটনৈতিক সম্পর্ক জোরদারে সহায়ক বলে বিবেচিত হয়।

বিএনপি-জামায়াত শাসনামলে ভারতের নিরাপত্তাব্যবস্থাকে হুমকির মুখে ফেলে দেয় সে সরকার। জঙ্গিবাদ-সন্ত্রাসবাদকে রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতা দেওয়া হয় নির্লজ্জভাবে- সব বন্ধুত্ব ও কূটনৈতিক রীতিনীতি লঙ্ঘন করে। ১০ ট্রাক অস্ত্রের চালানই শুধু ধরা পড়েনি, সে সময় ভারতবিরোধী সন্ত্রাসীদের বাংলাদেশের মাটি ব্যবহার করতে দেওয়া হয়। বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনা ক্ষমতায় এসেই জঙ্গিবাদ-সন্ত্রাসবাদ প্রশ্নে দৃঢ় মনোভাব ব্যক্ত করেন। জঙ্গিবাদের বিরুদ্ধে রীতিমতো অ্যাকশনে যান। জঙ্গিবাদ-সন্ত্রাসবাদ দমনে কঠোর ভূমিকা নেওয়ায় বাংলাদেশের পাশাপাশি ভারতের নিরাপত্তাও নিশ্চিত হয়। বাংলাদেশের মাটি ব্যবহার সন্ত্রাসবাদীদের জন্য বন্ধ হয়ে যায়। সন্ত্রাসবাদ নির্মূল হয়।

লেখক : নির্বাহী সম্পাদক, বাংলাদেশ প্রতিদিন।

সর্বশেষ খবর