সোমবার, ৩১ মে, ২০২১ ০০:০০ টা

ইসরায়েলের দখলদারিত্ব ও শান্তি একসঙ্গে হবে না

মেজর জেনারেল এ কে মোহাম্মাদ আলী শিকদার পিএসসি (অব.)

ইসরায়েলের দখলদারিত্ব ও শান্তি একসঙ্গে হবে না

বৈশ্বিক ব্যবস্থায় ভূ-রাজনীতির চরম স্বার্থপরতা ও কর্তৃত্বের কাছে মানুষ, মানবতা ও মূল্যবোধ কীভাবে পদদলিত হয় তার একটা করুণ চিত্র বিশ্ববাসী পুনরায় দেখল কয়েক দিন আগে, যখন ইসরায়েলের যুদ্ধবিমান, ট্যাঙ্ক আর আর্টিলার কামানের মুহুর্মুহু গোলার আঘাতে একের পর এক ধসে পড়ছিল গাজা অঞ্চলের বড় বড় ভবন এবং সেখানকার ১০ বছরের কিশোরী নাদিন আবদেল  তাইফ আর্তনাদ করছে, ‘আমি এখন কী করব, আমার বাবা-মা, ভাইবোন সবাই শেষ, বাড়িঘর শেষ, আমি কোথায় যাব।’  নাদিন একা নয়, এরকম শত শত কিশোর-কিশোরীর আর্তনাদ এবার যেমন শুনছে, তেমনি ৭৩ বছর ধরে শুনে আসছে বিশ্ববাসী। কিন্তু এর কোনো শেষ নেই। ইসরায়েল ও প্যালেস্টাইনের গাজা অঞ্চলের কর্তৃপক্ষ হামাসের সশস্ত্র শাখার মধ্যে ১১ দিন ধরে চলা সম্প্রতি যুদ্ধটির আপাতত বিরতি ঘটেছে। কিন্তু অদূর ভবিষ্যতে আরও বড় সংঘাত ও ধ্বংসযজ্ঞ যে ঘটবে না, তার কোনো নিশ্চয়তা নেই। আগের মতো এবারও ছিল ইসরায়েলের পক্ষে একতরফা যুদ্ধ। ইসরায়েলের চেয়ে প্রায় ৩০ গুণ বেশি হতাহত ও ধ্বংসের শিকার হয়েছে গাজাবাসী। একেবারে অসম যুদ্ধ। ফিলিস্তিনের জাতীয় কবি মাহমুদ দারবিশের রচিত আরবি কবিতার একটি লাইনের বাংলা করেছেন একজন, ‘শেষ প্রান্তে ঠেকে গেলে যাবটা কোথায়’। দেওয়ালে পিঠ ঠেকে গেলে যা হয় আর কি। নিজেদের তৈরি সীমিত পাওয়ারের রকেট ছাড়ছে ইসরায়েলের ওপর। যার শতকরা ৯০ ভাগ আয়রন ডোম আকাশ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থার আওতায় অ্যান্টি রকেট মিসাইল ছুড়ে ভূমিতে পড়ার আগে আকাশেই ধ্বংস করে দিয়েছে ইসরায়েল। বাকি যা ভূমিতে পড়েছে তার প্রায় সবই লক্ষ্যভ্রষ্ট হওয়ায় ইসরায়েলের ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে একেবারে কম। কিন্তু ইসরায়েলের বড় ভয় ছিল মজুদকৃত সীমিত সংখ্যক অ্যান্টি রকেট মিসাইল শেষ হওয়ার আগেই যদি হামাসের রকেট হামলার সক্ষমতা শেষ করে দেওয়া না যায় তাহলে সেটি ইসরায়েলের জন্য মহাবিপদ ও ধ্বংসযজ্ঞ ডেকে আনবে। এই ভয় থেকেই ইসরায়েলের যুদ্ধবিমানগুলো নির্বিচারে বোমাবর্ষণ করেছে। সুতরাং দেখা যায় এবারের যুদ্ধে ইসরায়েলের সামরিক লক্ষ্য ছিল হামাসের রকেট হামলার সক্ষমতা শেষ করে দেওয়া। আমেরিকার প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন ও ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী নেতানিয়াহুর কথায় বোঝা যায়, ইসরায়েলের সামরিক লক্ষ্য অনেকটাই অর্জিত হয়েছে। আর নেতানিয়াহু যুদ্ধ বিরতিতে তখনই রাজি হয়েছে যখন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন আয়রন ডোম আকাশ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থাকে শক্তিশালী করার জন্য প্রয়োজনীয় অ্যান্টি রকেট মিসাইল আমেরিকা ইসরায়েলকে সরবরাহ করবে।

বিশাল ধ্বংসযজ্ঞের শিকার হয়েও হামাসের জন্য অর্জন এতটুকু যে, এবার তারা ইসরায়েলের মনে একটা শঙ্কা সৃষ্টি করতে সক্ষম হয়েছে। সবাই মুখে সংকট সমাধানের কথা বলছে। কিন্তু ৭৩ বছর ধরে চলে আসা সংকটের সমাধানের পথ ক্রমশই রুদ্ধ হয়ে যাচ্ছে এবং তা হচ্ছে ইসরায়েলের একতরফা আগ্রাসন ও দখলদারিত্বের কারণে। এবারের সংঘর্ষ ও যুদ্ধটা যেভাবে শুরু হলো, মে মাসের প্রথম সপ্তাহে ইসরায়েলের নিম্ন আদালত থেকে একটা আদেশ জারি হয়। তাতে বলা হয়, পূর্ব জেরুজালেমের বসবাসকারী পাঁচটি প্যালেস্টাইন পরিবারকে তাদের বসতবাড়ি ছেড়ে দিতে হবে, যেখানে তারা অনেক বছর ধরে বসবাস করছে। আদালত বলেছে, ওই জায়গায় ১৯৪৮ সালের আগে কয়েকটি ইহুদি পরিবার বসবাস করত। প্যালেস্টাইন জনগণ ওই আদেশে ক্ষুব্ধ হয়েছে। কারণ, ১৯৪৮ সাল থেকে সাড়ে ৭ লাখ প্যালেস্টাইনবাসীর বসতবাড়ি, জায়গা-জমি সব দখল করে আছে ইহুদিরা। কিন্তু শত আবেদন-নিবেদনের পরও তার কিছুই তারা ফেরত পায়নি। সংগত কারণেই পাঁচটি পরিবারের উৎখাত আদেশের বিরুদ্ধে প্যালেস্টাইনবাসীর প্রতিবাদ ও বিক্ষোভ। পাল্টা শুরু হয় ইসরায়েল পুলিশ বাহিনীর নির্যাতন ও ধরপাকড়। পরে আল আকসা মসজিদে শবেকদরের নামাজে বাধা দিলে তা সংঘর্ষে রূপ নেয় এবং প্রতিবাদস্বরূপ গাজা থেকে হামাস রকেট নিক্ষেপ করে। এভাবেই শুরু হয় ১১ দিনের যুদ্ধ। তবে এটা নতুন কিছু নয়। ৭৩ বছর ধরে যা ঘটে আসছে এবারও সেটিই ঘটেছে। কিন্তু ৭৩ বছর ধরে ইসরায়েল যা করছে তার সব কিছুই যে সন্ত্রাসী কর্মকান্ড সে কথা কেউ বলছে না। ইসরায়েল রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার প্রাক্কালে জাতিসংঘের প্রস্তাব নম্বর ১৮১ সর্বসম্মতিক্রমে গৃহীত হয়। তাতে বলা হয়, ব্রিটিশ ম্যান্ডেটকৃত ২০৭৭০ বর্গকিলোমিটার আয়তনের প্যালেস্টাইন সমান দুই ভাগে ভাগ হয়ে দুটি স্বাধীন রাষ্ট্র গঠিত হবে, ইসরায়েল ও প্যালেস্টাইন। কিন্তু ব্রিটিশ সেনাবাহিনীর প্রচ্ছন্ন সমর্থনে ইহুদিদের গোপন সশস্ত্র বাহিনীর গণহত্যার মুখে সাড়ে ৭ লাখ প্যালেস্টাইনবাসী ১৯৪৮ সালেই নিজেদের বসতবাড়ি ছেড়ে পালিয়ে পার্শ্ববর্তী দেশগুলোতে শরণার্থী হয়। বিতাড়িত সেই ভাগ্যহত মানুষের উত্তরসূরিরা সংখ্যায় আজ প্রায় ৫০ লাখ, যারা সবাই এখনো শরণার্র্থী। তাদের ঘরবাড়ি, জমিজমা, সহায়-সম্পত্তি সবকিছু ১৯৪৮ সালে ইহুদিরা দখল করে নেয়, যার ঈষৎ অংশও কেউ আজ পর্যন্ত ফেরত পায়নি। যদিও নিরাপত্তা পরিষদের ১৯৪ নম্বর প্রস্তাব অনুসারে বিতাড়িতদের মধ্যে যারা ফেরত আসতে চায় তাদের ফিরতে দিতে হবে, আর যারা আসতে চায় না, তাদের ক্ষতিপূরণ দিতে হবে। এর কিছুই আজ পর্যন্ত ইসরায়েল বাস্তবায়ন করেনি। তারপর ১৯৬৭ সালে ৫ জুন থেকে ১০ জুন, মাত্র ছয় দিনের যুদ্ধে জর্ডানের দখলে থাকা জেরুজালেমসহ পশ্চিমতীর এবং মিসরের দখলে থাকা গাজা স্ট্রিপ ইসরায়েল দখল করে নেয়। এই দুটি এলাকার আয়তন ৬০২০ বর্গকিলোমিটার। ১৯৬৭ সালের নভেম্বরে নিরাপত্তা পরিষদে প্রস্তাব নম্বর ২৪২ পাস হয় এবং তাতে বলা হয়, ইসরায়েল অতিসত্বর ছয় দিনের যুদ্ধে যেসব এলাকা দখল করেছে তা ছেড়ে দিতে হবে। কিন্তু বিগত ৫৪ বছরে এই প্রস্তাবের প্রতি সামান্য কর্ণপাত করেনি ইসরায়েল। ১৯৭৮ সালে মিসর ও ইসরায়েলের মধ্যে ক্যাম্প ডেভিড চুক্তি স্বাক্ষরের পর জাতিসংঘে পুনরায় প্রস্তাব নম্বর ৪৪৬ পাস করে। তাতে উল্লেখ করা হয়, ১৯৬৭ সালের অধিকৃত এলাকা ইসরায়েল ছেড়ে দেবে এবং পশ্চিমতীরে অতিসত্বর ইহুদি পুনর্বাসন বন্ধ করতে হবে। কিন্তু এবারও কিছুই হলো না। অধিকৃত এলাকায় অনবরতভাবে ইহুদি পুনর্বাসন চলতে থাকলে ভবিষ্যতে তা শান্তি স্থাপনের পথে একটা বড় বাধা হিসেবে কাজ করবে এই উপলব্ধিতে ১৯৮০ সালে জাতিসংঘ পাস করে প্রস্তাব নম্বর ৪৬৫। তাতে জেরুজালেমসহ পশ্চিমতীরে ইহুদি পুনর্বাসন ভেঙে ফেলতে বলা হয় এবং এতদসংক্রান্ত সব কাজকর্ম জরুরি ভিত্তিতে বন্ধ রাখার জন্য ইসরায়েলের প্রতি আহ্বান জানানো হয়। কিন্তু সব প্রস্তাব অগ্রাহ্য করে ইসরায়েল আজও পূর্ণ উদ্যমে নতুন ইহুদি পুনর্বাসনের কাজ চালিয়ে যাচ্ছে। তাই ১৯৪৮ সাল থেকে জাতিসংঘসহ সব আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে ইসরায়েল যেভাবে অবৈধ দখলদারিত্ব চালিয়ে যাচ্ছে এবং সব হারা মানুষ প্রতিবাদ করলেই যেভাবে গুম, হত্যা ও নির্যাতনের শিকার হচ্ছে তার প্রতিকার তাহলে কীভাবে হবে। এ পর্যন্ত তো কিছুই হয়নি। ১৯৪৮ সাল থেকে যা ঘটে আসছে তা না ঘটলে ১৯৮৭ সালে হামাসের জন্ম হতো না। হামাস কর্তৃক নিজেদের তৈরি সীমিত ক্ষমতার ও প্রায় অকার্যকর রকেট হামলার বিপরীতে ইসরায়েলের যুদ্ধবিমানের আক্রমণে যে ধ্বংসযজ্ঞ এবং নারী-শিশুর প্রাণহানি সেটিকে পশ্চিমা বিশ্ব বলছে এটা ইসরায়েল আত্মরক্ষার জন্য করেছে, সে অধিকার তাদের রয়েছে। তাহলে ১৯৪৮ সাল থেকে ইসরায়েল যা করে চলেছে তার থেকে বাঁচার জন্য প্যালেস্টাইনবাসী আত্মরক্ষা কীভাবে করবে, তাদের আত্মরক্ষার সংজ্ঞা ও পরিধি কী হবে-এসব কথা কিন্তু শক্তিধর রাষ্ট্রগুলো বলছে না। ৭৩ বছরের লেগেসির সূত্রে পরিস্থিতি আজ এমন দাঁড়িয়েছে, ইসরায়েল যা চাইবে, যা বলবে, তার সবকিছু নীরবে প্যালেস্টাইনকে মেনে নিতে হবে। প্রতিবাদ করলেই তারা সন্ত্রাসী আখ্যা পাবে এবং সন্ত্রাস দমনে পারমাণবিক বোমার অধিকারী ইসরায়েল যা করবে তার সবকিছু আত্মরক্ষার অজুহাতে জায়েজ হবে। সুতরাং সংকটের সমাধান কীভাবে হবে। জাতিসংঘসহ সবাই মুখে বলছে দুই রাষ্ট্র ব্যবস্থা, অর্থাৎ ইসরায়েল আছে, তার সঙ্গে স্বাধীন প্যালেস্টাইন রাষ্ট্র গঠিত হলে সমস্যার সমাধান হবে। কিন্তু স্বাধীন প্যালেস্টাইন রাষ্ট্র গঠনের সব পথ ইসরায়েল ইতিমধ্যে বন্ধ করে দিয়েছে। জাতিসংঘের ১৮১ নম্বর প্রস্তাব অনুযায়ী ব্রিটিশ ম্যান্ডেটকৃত প্যালেস্টাইন সমান দুই ভাগ হলে ১০৩৮৫ বর্গকিলোমিটার আয়তনের স্বাধীন প্যালেস্টাইন রাষ্ট্র হওয়ার কথা। তারপর জাতিসংঘের ২৪২ নম্বর প্রস্তাবের মর্মার্থ এবং ১৯৯৩ সালে স্বাক্ষরিত অসলো শান্তি চুক্তির ফ্রেমওয়ার্ক অনুযায়ী সম্পূর্ণ জেরুজালেমসহ পশ্চিমতীর ও গাজা নিয়ে স্বাধীন প্যালেস্টাইন রাষ্ট্রের পূর্বাভাস দেওয়া হয়। তাতে প্যালেস্টাইন রাষ্ট্রের আয়তন হয় ৬০২০ বর্গকিলোমিটার। কিন্তু ইতিমধ্যে এই জায়গারও অর্ধেকের বেশি এলাকা ইসরায়েল দখল করে নিয়েছে এবং সেটিকে ইসরায়েলের অবিচ্ছেদ্য অংশ হিসেবে ঘোষণা করেছে। তার মানে গাজাসহ পশ্চিমতীর মিলে প্যালেস্টাইন রাষ্ট্রের জন্য ৩ হাজার বর্গকিলোমিটার জায়গাও নেই। তারপর গাজার সঙ্গে পশ্চিমতীরের কোনো সংযোগ নেই।  সুতরাং ইসরায়েলি দখলদারিত্ব বজায় রেখে টেকসই স্বাধীন প্যালেস্টাইন রাষ্ট্র হবে, এমন সম্ভাবনা একদম নেই।  তাই এবার সাময়িক যুদ্ধবিরতি হলেও শান্তি সুদূরপরাহত।

 

লেখক : রাজনৈতিক ও নিরাপত্তা বিশ্লেষক।

[email protected]

সর্বশেষ খবর