বৃহস্পতিবার, ৮ জুলাই, ২০২১ ০০:০০ টা

দুই মন্ত্রীর সাহসী বক্তব্য ও বিচারপতি সিনহার আদেশ

বিচারপতি শামসুদ্দিন চৌধুরী মানিক

দুই মন্ত্রীর সাহসী বক্তব্য ও বিচারপতি সিনহার আদেশ

সর্বজনশ্রদ্ধেয় আবদুল গাফ্‌ফার চৌধুরী ১২ জনকে প্রবাসী মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে সনদ প্রদানের সিদ্ধান্ত নেওয়ার বিষয়ে সম্প্রতি যা লিখেছেন তা সত্যিই প্রশংসনীয়। তাঁর ভাষায় এ ১২ জনকে স্বীকৃতি দেওয়ায় প্রবাসে অন্য আরও যে ব্যক্তিবর্গ মুক্তিযুদ্ধকালে বিশ্বজনমত সৃষ্টিতে বিশেষ অবদান রেখেছিলেন তাঁদের স্বীকৃতি পাওয়ার দরজাও উন্মুক্ত হলো, যাঁদের সবাইকেই স্বীকৃতি দেওয়ার দাবিও তিনি জানিয়েছেন, যাঁরা প্রয়াত হয়েছেন তাঁদেরও। মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় বিশ্বাসীদের কাছে গাফ্ফার ভাই পূজনীয় ব্যক্তিত্ব বটে। বঙ্গবন্ধু হত্যার পর গাফ্‌ফার ভাই হত্যার প্রতিবাদী মুখপত্র হিসেবে লন্ডন থেকে ‘বাংলার ডাক’ নামে যে পত্রিকাটি প্রকাশ করেছিলেন সে পত্রিকার সুবাদে তাঁর সঙ্গে কাজ করার যে সুযোগ আমার হয়েছিল, তার জন্য আমি ধন্য বটে। গাফ্ফার ভাই তাঁর সেই লেখনীতে মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রী অ্যাডভোকেট মোজাম্মেল হকের আদালত অবমাননা মামলায় সাজাপ্রাপ্ত হওয়ার যে কথাটি উল্লেখ করেছেন, সত্য এবং ন্যায়ের স্বার্থে তার পটভূমি এবং যে ঘটনা নিয়ে এ মামলাটির উদ্ভব হয়েছিল তার গুরুত্ব বিশ্লেষণ করা জনস্বার্থেই প্রয়োজন। বেশ কয়েক বছর পার হয়ে যাওয়ায় ঘটনাটি বহুজনের স্মৃতির আড়ালে চলে গেছে, আর নতুন প্রজন্মের কাছে এটি তো সম্পূর্ণ অজানা। আমার এ লেখনী দ্বারা এ বিষয়টিই পরিষ্কার করতে চাই, যেহেতু এ ব্যাপারে আমারও বিশেষ ভূমিকা ছিল।

ঘটনার উদ্ভব ২০১৫ সালে। ২০১৩ সাল থেকে বিচারিক ট্রাইব্যুনালে সাজাপ্রাপ্ত যুদ্ধাপরাধীদের আপিলের শুনানি হচ্ছিল আপিল বিভাগে। মাননীয় প্রধান বিচারপতি মোজাম্মেল হোসেনের নেতৃত্বে আপিল বিভাগের পাঁচজন বিচারপতি আপিল শুনছিলেন। আমিও ছিলাম সেই পাঁচ বিচারপতির একজন। এর মধ্যে ২০১৫ সালের ১৬ জানুয়ারি মোজাম্মেল হোসেন অবসরে যাওয়ার পর বিচারপতি সুরেন্দ্র কুমার সিনহা প্রধান বিচারপতি হিসেবে বঙ্গভবনে শপথ নিয়ে সন্ধ্যার পর অফিসে ফিরেই যুদ্ধাপরাধী মামলা শুনানির প্যানেল থেকে বাদ দিয়ে আমাকে আপিল বিভাগের দ্বিতীয় বেঞ্চে বদলি করেন। ইত্যবসরে অবশ্য আপিল বিভাগে যুদ্ধাপরাধী কাদের মোল্লা, সাঈদী এবং কামারুজ্জামানের আপিল শুনানি শেষ হয়ে তাদের সাজা চূড়ান্ত হয়েছে। আমি উল্লিখিত তিনটি আপিলেই অন্যতম বিচারপতি হিসেবে দায়িত্ব পালনের সুযোগ পেয়েছিলাম। আমাকে কেন যুদ্ধাপরাধীদের আপিল শুনানি থেকে বাদ দিয়ে ২ নম্বর আদালতে বদলি করা হলো, প্রধান বিচারপতি সিনহাকে এর কারণ জিজ্ঞেস করলে তিনি অকপটেই বলেছিলেন সাকা চৌধুরীর পরিবারের সদস্যরা এবং ব্যারিস্টার মওদুদ বিচারপতি সিনহার হাত-পা ধরে বলেছিলেন আর যাকেই নেওয়া হোক না কেন, বিচারপতি মানিককে যেন সাকা চৌধুরীর যুদ্ধাপরাধীর মামলায় এবং মওদুদের বাড়ির মামলার শুনানিতে অংশ নিতে দেওয়া না হয় এবং তাদের সেই চাপের কারণেই প্রধান বিচারপতি হওয়ার পর সিনহা আমাকে যুদ্ধাপরাধী সাকা চৌধুরী এবং ব্যারিস্টার মওদুদের বাড়িসংক্রান্ত আপিল শুনানি থেকে বাদ দিয়েছিলেন।

প্রধান বিচারপতি সিনহার কথায় হতভম্ব হয়ে আমি তাকে জিজ্ঞেস করেছিলাম তিনি বিচারক হয়ে কী করে এমন একজনের পরিবারের সদস্যদের (অর্থাৎ সাকা চৌধুরীর পরিবারের সদস্যদের) সঙ্গে দেখা করলেন, যার মামলা তার আদালতে শুনানিধীন? আসামি পরিবারের লোকদের সঙ্গে কোনো বিচারকের দেখা করা তো মস্তবড় অপরাধ। প্রধান বিচারপতি সিনহা জবাব দিতে না পারলেও কে বা কারা আমাদের এ আলোচনা রেকর্ড করলে তা বহুলভাবে প্রচারিত হয়ে যায়। জনমনে সন্দেহ জাগতে থাকে যে প্রধান বিচারপতি সিনহা সাকা চৌধুরীর পরিবারের সঙ্গে একটা বন্দোবস্ত করে ফেলেছেন, না হলে কেন তিনি সাকা চৌধুরীর পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে দেখা করবেন যেখানে তার নেতৃত্বাধীন আদালতে সাকা চৌধুরীর আপিল বিচারাধীন। এখানে উল্লেখ্য যে, আগে বিচারপতি সিনহা (বিচারপতি সিনহা তখনো প্রধান বিচারপতি হননি) ২০১৪ সালের সেপ্টেম্বরে যুদ্ধাপরাধী কামারুজ্জামানের আপিল শুনানির সময় প্রকাশ্য আদালতে বলেছিলেন, মুক্তিযুদ্ধকালীন তিনি শান্তি কমিটির সদস্য ছিলেন এবং পাকিস্তানি সৈন্যদের সাহায্য করতেন। পরদিন গণমাধ্যমে, বিশেষ করে ঢাকা ট্রিবিউনে বিচারপতি সিনহার এ বক্তব্য শীর্ষ সংবাদ হিসেবে বহুল আকারে প্রকাশিত হয়। সাকা চৌধুরীর শুনানি শেষে রায় দেওয়ার আগে প্রধান বিচারপতি সিনহা জনৈক ধনাঢ্য ব্যবসায়ীকে নিয়ে লন্ডন যাওয়ার সব প্রস্তুতি গ্রহণ করলে অনেকের মনে সন্দেহ জাগে যে প্রধান বিচারপতি সিনহা সাকা পরিবারের সঙ্গে আদান-প্রদানের মাধ্যমে বন্দোবস্ত করতে এক ব্যবসায়ীকে নিয়ে লন্ডন যাচ্ছেন। এ পরিস্থিতিতে জনকণ্ঠের নির্বাহী সম্পাদক স্বদেশ রায়, যিনি পরবর্তীতে একুশে পদক পেয়েছিলেন প্রধানমন্ত্রীর কাছ থেকে। ২০১৫ সালের ১৬ জুলাই সাকা চৌধুরীর সঙ্গে বিচারপতি সিনহার যোগাযোগের কথা ফাঁস করে একটি তথ্য এবং যুক্তিবহুল প্রবন্ধ লিখলে তা একদিকে সারা দেশে যেমন আলোড়ন সৃষ্টি করে অন্যদিকে তেমনি সৃষ্টি করে প্রধান বিচারপতি সিনহার মনে গভীর প্রতিহিংসার। প্রধান বিচারপতি সিনহা কালবিলম্ব না করে স্বদেশ রায় এবং জনকণ্ঠ সম্পাদক আতিকউল্লাহ খান মাসুদের বিরুদ্ধে ২০১৫ সালের ৩ আগস্ট আদালত অবমাননার রুল জারি করে তাদের সাজা প্রদান করেন। বিচারপতি সিনহার ইচ্ছা ছিল তাদের কয়েক বছর জেলে পাঠানোর, কিন্তু পরিস্থিতি অবলোকন করে অবশেষে তিনি লঘু সাজারই পথ বেছে নিয়েছিলেন। স্বদেশ রায়ের বিরুদ্ধে আনা আদালত অবমাননা মামলার শুনানিকালে স্বদেশ রায় প্রধান বিচারপতি সিনহার কথোপকথনের রেকর্ডটি আদালতে বাজিয়ে শোনাতে শুরু করলে প্রধান বিচারপতি সিনহা প্রকাশ্য আদালতেই স্বীকার করতে বাধ্য হন যে, তিনি সাকা চৌধুরীর পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে দেখা করেছিলেন। আমার অবসরে যাওয়ার তখন আরও দুই মাস বাকি ছিল। স্বদেশ রায়ের পক্ষ নেওয়া এবং তার পক্ষে সাক্ষী দেওয়ার সিদ্ধান্তের কারণে প্রধান বিচারপতি সিনহা বেআইনিভাবে আমার অফিসকক্ষে তালা ঝুলিয়ে দিয়েছিলেন যাতে আমি রায় লিখতে না পারি। তা ছাড়া তিনি আমার পেনশনও কয়েক মাস আটকে রেখেছিলেন। পরবর্তীতে আইনমন্ত্রীর হস্তক্ষেপে আমি পেনশন পেয়েছিলাম। আমি এ ব্যাপারগুলো মহামান্য রাষ্ট্রপতিকে লিখিতভাবে জানিয়েছিলাম। কয়েক মাস পরে ২০১৬ সালের ফেব্রুয়ারি/মার্চে যুদ্ধাপরাধী মীর কাসেম আলীর আপিল শুনানি চলাকালে প্রধান বিচারপতি সিনহা এমন সব নেতিবাচক মন্তব্য করেন যার থেকে মোটামুটি নিশ্চিত হওয়া যায় যে, বিচারপতি সিনহা মীর কাসেম আলীকে সাজা না দিয়ে মামলাটি পুনঃশুনানির জন্য বিচারিক ট্রাইব্যুনালে পাঠিয়ে দেবেন। তিনি প্রকাশ্য আদালতেই বলেন, সরকারপক্ষের আইনজীবী মামলা প্রমাণে ব্যর্থ হয়েছেন, যার অর্থ দাঁড়িয়েছিল এই যে মীর কাসেম আলীকে সাজা দেওয়া যাবে না। একই সময়ে তিনি একজন গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিকে বলেই ফেলেন যে, প্রসিকিউশন আইনজীবীদের ব্যর্থতার কারণে তিনি মামলাটি বিচারিক ট্রাইব্যুনালে পাঠাবেন পুনর্বিচারের জন্য। আপিল বিভাগের অন্য বিচারপতিদের উপেক্ষা করে প্রধান বিচারপতি সিনহা মীর কাসেম আলীর মামলা দুবার অযথা মুলতবি করলে জনগণের সন্দেহ আরও ঘনীভূত হয়। এখানে উল্লেখ্য, বিচারক প্যানেলে পাঁচজন বিচারপতি থাকলেও হঠাৎ করে যদি প্রধান বিচারপতি অন্য বিচারপতিদের সঙ্গে আলাপ না করে এমনি একটি নির্দেশ দেন, তাহলে অন্য বিচারপতিদের তখন আদালতে বসে কিছু করা কঠিন হয়ে যায়। যুদ্ধাপরাধী মীর কাসেম আলীর ব্যাপারে প্রধান বিচারপতি সিনহার এ মনোভাব প্রকাশ্যে এলে মুক্তিযুদ্ধের চেতনার পক্ষের সবাই চিন্তিত হয়ে পড়লে ২০১৬ সালের ৫ মার্চ এক গোলটেবিল বৈঠকের আয়োজন করা হয় সাংবাদিক শাহরিয়ার কবির এবং অধ্যাপক মুনতাসীর মামুনের প্রচেষ্টায়। কথা উঠেছিল প্রচুর অর্থসম্পদের মালিক মীর কাসেম আলীর সঙ্গে সিনহার একটি সমঝোতা হয়েছে। সে বৈঠকে বক্তব্য দেওয়ার জন্য আহ্‌বান জানানো হয়েছিল দুজন মন্ত্রী, যথা অ্যাডভোকেট আ ক ম মোজাম্মেল হক এবং অ্যাডভোকেট কামরুল ইসলামকে। আমি তখন অবসরপ্রাপ্ত, তাই আমাকেও আহ্‌বান করা হয়েছিল। কিন্তু আমি লন্ডনে অবস্থান করায় আমার লিখিত বক্তব্য পড়ে শোনানো হয়েছিল। সে বৈঠকে মন্ত্রীদ্বয়সহ অন্যান্যজন দাবি তুলেছিলেন মীর কাসেম আলীর আপিলের পুনঃশুনানির জন্য এবং সেই শুনানিতে যেন প্রধান বিচারপতি সিনহা না থাকেন। সমসাময়িককালে একদিন প্রধান বিচারপতি সিনহা প্রকাশ্য আদালতেই বিজ্ঞ অ্যাটর্নি জেনারেলকে উদ্দেশ করে বলেছিলেন, পাকিস্তান সুপ্রিম কোর্ট তাদের প্রধানমন্ত্রীকে পদচ্যুত করেছে, সেটা যেন বাংলাদেশ সরকার ভুলে না যায়, অর্থাৎ তিনি এ বার্তা দিয়ে সরকারকে সতর্ক করেছিলেন যে, তিনিও তাই করে সরকারের পতন ঘটাতে পারেন। গোলটেবিলের পর প্রধান বিচারপতি সিনহা মন্ত্রীদ্বয় অ্যাডভোকেট মোজাম্মেল হক এবং অ্যাডভোকেট কামরুল ইসলামের বিরুদ্ধে আদালত অবমাননার রুল ইস্যু করে তাদের তিন দিন আদালতে দাঁড় করিয়ে এবং পরবর্তীতে অর্থদন্ড প্রদান করলে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের লোকদের মধ্যে প্রতিবাদের ঝড় ওঠে। কেননা সেদিন গোলটেবিল বৈঠক না হলে এবং এ দুজন মন্ত্রী সঠিক ভাষণ না দিলে সিনহা যে মীর কাসেম আলীকে ফাঁসি না দিয়ে তার মামলা বিচারিক ট্রাইব্যুনালে পুনর্বিচারে পাঠিয়ে দিতেন এ ব্যাপারে সবাই নিশ্চিত ছিল। শুধু তাই নয়, মুক্তিযুদ্ধকালীন পাকিস্তানি সৈন্যদের সাহায্য করা, শান্তি কমিটির সদস্য প্রধান বিচারপতি সিনহা তখন চেষ্টা চালাচ্ছিলেন পাকিস্তান সুপ্রিম কোর্টের অনুকরণে বাংলাদেশের নির্বাচিত সরকারকে পদচ্যুত করার। ২০১৪ সালের নির্বাচনে যে ১৫৪ ব্যক্তি বিনা প্রতিদ্ধন্ধিতায় সংসদ সদস্য নির্বাচিত হয়েছিলেন তাদের নির্বাচন অবৈধ বলে ঘোষণা চেয়ে কিছু সুযোগসন্ধানী ব্যক্তি হাই কোর্টে রিট করলে, হাই কোর্ট তা খারিজ করে দেয়। এরপর তারা আপিল বিভাগে আপিল করলে বিচারপতি সিনহার পরিকল্পনা ছিল তিনি এ ১৫৪ জনের নির্বাচন এবং পুরো সরকারকে অবৈধ ঘোষণা করে সরকারের পতন ঘটাবেন। তিনি সে পরিকল্পনা নিয়েই এগোচ্ছিলেন। এ তথ্যটি আমাদের দক্ষ গোয়েন্দাদের নজরে এলে তারা এর গভীরে গিয়ে নিশ্চিত হন যে প্রধান বিচারপতি সিনহা অচিরেই এমনটি ঘটানোর পরিকল্পনায় রয়েছেন। কিন্তু এ দুই মন্ত্রীর ভাষণের পর যা গণমাধ্যমে ব্যাপকভাবে প্রচারিত হয়েছিল, দেশব্যাপী সিনহাবিরোধী রব গড়ে উঠলে, বিচারপতি সিনহা টের পেয়েছিলেন তার সরকারকে ফেলে দেওয়ার পরিকল্পনা সফল হবে না এবং তাই তিনি সে পথে ধীরগতিতে এগোচ্ছিলেন। পরবর্তীতে অবশ্য তার বিরুদ্ধে দুর্নীতির তথ্য-প্রমাণ প্রকাশ্যে এলে আপিল বিভাগের অন্য চারজন বিচারপতি, প্রধান বিচারপতি সিনহার সঙ্গে আদালতে না বসার সিদ্ধান্ত নিলে পদত্যাগ করা ছাড়া বিচারপতি সিনহার সামনে কোনো পথ খোলা না থাকায় তিনি বাধ্য হয়েছিলেন পদত্যাগ করতে, এবং একই সঙ্গে গণতান্ত্রিক সরকার পতন ঘটানোর পরিকল্পনাও ভেস্তে যায়, যেটাকে বিচার বিভাগীয় অভ্যুত্থান (জুডিশিয়াল ক্যু) পরিকল্পনা হিসেবে আখ্যায়িত করা হয়েছিল। সে অর্থে এ দুই মন্ত্রী সেদিন শুধু মীর কাসেম আলীর যথোপযুক্ত বিচারই নিশ্চিত করেননি, তাঁরা গণতান্ত্রিক সরকার তথা দেশকে অসাংবিধানিক হস্তক্ষেপ থেকেও রক্ষা করেছিলেন। যদিও এ কাজের জন্য তাঁদের আদালত অবমাননার শাস্তি পেতে হয়েছিল; কিন্তু সে শাস্তি ছিল গৌরবের, কৃতিত্বের। দেশ রক্ষার মহান ব্রত নিয়েই তাঁদের সেই শাস্তি গ্রহণ করতে হয়েছিল, যে কথা আমাদের সব সময় মনে রাখা উচিত উপরোক্ত দুই মন্ত্রীর প্রতি কৃতজ্ঞতাভরে।

বিচারপতি সিনহার সততা প্রশ্নবিদ্ধ হওয়ার বড় কারণ তার অতীত দুর্নীতির ইতিহাস। ২০০৭ সালে সেনা সমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকার সময়ের রাষ্ট্রপতি ইয়াজউদ্দিন বিচারপতি সিনহাসহ তিনজন বিচারপতিকে বঙ্গভবনে ডেকে তাদের বিরুদ্ধে দুর্নীতির যে প্রমাণসমূহ রয়েছে তা দেখিয়ে এ তিন বিচারপতিকে পদত্যাগ করতে বললে তাদের একজন সঙ্গে সঙ্গে পদত্যাগ করেন। কিন্তু বিচারপতি সিনহা দুই দিন সময় নিয়ে পরে সে সময়ের এক অতি প্রভাবশালী আইনজ্ঞের, যিনি তখন দন্ডমুন্ডের কর্তা বলে পরিচিত ছিলেন, সাহায্যে সে দফা বেঁচে যান। এ ছাড়া তার দুর্নীতির কথা দেশব্যাপী প্রচলিত ছিল। তার বিরুদ্ধে দুর্নীতির মামলা এখন চলমান। উল্লেখ্য, ৪ কোটি টাকার চেকের মাধ্যমে তিনি একটি দুর্নীতি করেছিলেন তা গণমাধ্যমে দেখানো হয়।

আদালত অবমাননার জন্য সাজা হতে পারে, জেল হতে পারে, সেই ঝুঁকি কাঁধে নিয়েই এ দুই আইনজ্ঞ মন্ত্রী মহোদয় সেদিন সরকার এবং দেশকে রক্ষা করার জন্য এবং যুদ্ধাপরাধী মীর কাসেম আলীর সঠিক বিচার নিশ্চিত করার জন্য যা করেছেন তার জন্য তাঁরা সবার প্রশংসাযোগ্য। সেদিন গোলটেবিল বৈঠকে উল্লিখিত মন্ত্রীদ্বয়, শাহরিয়ার কবির, অধ্যাপক মুনতাসীর মামুনসহ অন্য বক্তারা প্রকাশ্যে মুখ না খুললে কী হতে পারত তা আঁচ করাও কঠিন। নিশ্চিতভাবে যা বলা যায়, তা হলো প্রধান বিচারপতি সিনহা মীর কাসেম আলীর মামলা পুনঃ শুনানির জন্য বিচারিক ট্রাইব্যুনালে পাঠানোর চেষ্টা করতেন। আরও উল্লেখ্য, পরবর্তীতে কানাডায় থেকে সিনহা মীর কাসেম আলীর ভাইয়ের কাছ থেকে যে প্রচুর পরিমাণ ডলার পেয়েছিলেন তার প্রমাণও ছড়িয়ে পড়েছে। বিচারপতি সিনহার পদত্যাগ এবং দেশত্যাগের (তার বিরুদ্ধে দুর্নীতি দমন কমিশন তদন্ত চালাচ্ছে এ কথা জানার পরই তিনি আর দেশে ফেরেননি) পর তার দুর্নীতির পর্বতসম প্রমাণ বেরিয়ে পড়েছে। এ দুই মন্ত্রীসহ অন্য যাঁরা প্রধান বিচারপতি সিনহার অমঙ্গলকর এবং ধ্বংসাত্মক অগ্রযাত্রা থামানোর ব্যাপারে ভূমিকা রেখেছিলেন তাঁরা সবাই সাধুবাদ পাওয়ার দাবিদার।

বিচারপতি সিনহার শান্তি কমিটির সদস্য থাকার ব্যাপারে সে সময়ের যুদ্ধাপরাধসংক্রান্ত তদন্ত কমিটির চেয়ারম্যান আবদুল হান্নান জানিয়েছেন, তিনি তদন্তকাজে মৌলভীবাজার জেলায় গমন করলে জানতে পান যে দেশ স্বাধীন হওয়ার পর মুক্তিযোদ্ধারা সিনহাকে গ্রেফতার করে সে এলাকার মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম কমান্ডার মহসিনের (যিনি পরবর্তীতে মন্ত্রী হয়েছিলেন) ক্যাম্পে কয়েক দিন বেঁধে রেখেছিলেন। পরবর্তীতে মণিপুরি সম্প্রদায়ের লোকেরা (সিনহা যে সম্প্রদায়ের লোক) এসে মহসিনকে বলেন, সিনহা তাদের সম্প্রদায়ের একমাত্র শিক্ষিত লোক, তাকে যেন ছেড়ে দেওয়া হয়। মহসিন মণিপুরি সম্প্রদায়ের লোকদের দাবিতে সিনহাকে মুক্তি দিয়েছিলেন। এসব কথা যারা ভুলে গেছেন এবং নতুন প্রজন্মের সবার জানা উচিত।

লেখক : আপিল বিভাগের অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতি।

সর্বশেষ খবর