মঙ্গলবার, ১৭ আগস্ট, ২০২১ ০০:০০ টা

আজ বড় অভাব ইমাম হোসাইনের সাহসিকতার

মাওলানা সেলিম হোসাইন আজাদী

আজ বড় অভাব ইমাম হোসাইনের সাহসিকতার

হিজরি সালের প্রথম মাস মহররম। এ মাসের ১০ তারিখ ঐতিহাসিক ঘটনাবহুল ও তাৎপর্যময় একটি দিন। ৬১ হিজরির ১০ মহররম ইরাকের কুফা নগরীর কাছে ফোরাত নদীর তীরঘেঁষা কারবালা প্রান্তরে নবী-দৌহিত্র ইমাম হোসাইন (রা.) অত্যাচারী শাসক ইয়াজিদের নিষ্ঠুর বাহিনীর হাতে অবরুদ্ধ অবস্থায় পরিবার-পরিজনসহ নির্মমভাবে শাহাদাতবরণ করেন। অবরুদ্ধ দিনগুলোর ছোট্ট একটি ঘটনা বলছি। অবরুদ্ধ ইমাম বাহিনীর তাঁবুর পাশেই ফোরাত নদী। তাঁবু থেকে নদীর বয়ে যাওয়া কলকল ধ্বনি কানে আসে, কিন্তু ফোরাতের এক ফোঁটা পানিও মুখে পড়ে না ইমাম বাহিনীর। ইয়াজিদের পাপিষ্ঠ সৈনিক দল নদীও অবরুদ্ধ করে রেখেছে। হে ফোরাত! তোমার পানি পান করে কত শত প্রাণ তৃষ্ণা মেটাল। ইয়াজিদের কত সৈনিক তোমাতে শীতল হলো। সৃষ্টির শুরু থেকে কিয়ামত পর্যন্ত আরও কত তৃষিত প্রাণে তুমি স্পন্দন জোগাবে। কিন্তু নবী-দুলাল তোমার থেকে এক চুমুক পানি পাননি- এ যন্ত্রণা তুমি কী করে ভুলবে? যেদিন ইমাম হোসাইন শিশু আসগরকে নিয়ে ইয়াজিদ সৈনিকের কাছে বলেছিলেন, ‘তোমাদের শত্রুতা আছে তো আমার সঙ্গে, এই মাসুম শিশুর সঙ্গে তো কোনো শত্রুতা নেই। পিপাসায় তার প্রাণ ওষ্ঠাগত। পান করার মতো দুধও পাচ্ছে না সে। দাও! একে একটু পানি দাও।’ ইমাম যখন এভাবে পানি চাইছিলেন তখন তোমার শান্ত জলে কি কোনো ঢেউ উঠেছিল হে ফোরাত? যখন পানির বদলে রক্তমাখা তীর নিয়ে ফিরল শিশু আসগর, হে কারবালা! তখন তুমি কী প্রার্থনা করেছিলে প্রভুর কাছে? তুমি কি চাইছিলে তোমার থেকেই প্রবাহিত হোক নতুন কোনো আবে জমজম কিংবা গভীর স্রোতে ইয়াজিদ বাহিনীর কবর রচনা হোক তোমার ভিতর? আমি নিশ্চিত, যত দিন ফোরাত বয়ে যাবে সাগর মোহনায়, কারবালা থাকবে নিজ মহিমায়- ততদিন এজিদ বাহিনীর বিরুদ্ধে অঝোর ধারায় অভিশাপ ঝরতে থাকবে। উম্মত তার নবীকে ভুলতে পারে, কারবালাকে ভুলতে পারে, কিন্তু ‘কারবালা’ ও ‘ফোরাত নদী’ নবীকে ভুলবে না, ভুলবে না হোসাইনকেও। কারণ ইতিহাসের করুণতম নৃশংসতা ফোরাতের তীরে কারবালার বুকেই ঘটেছিল। ইমাম হোসাইন (রা.) কারবালার ময়দানে অন্যায়-অসত্যের বিরুদ্ধে লড়াই করে শাহাদাতবরণ করেছেন; কিন্তু অসত্য, অধর্ম ও অন্যায়ের কাছে মাথা নত করেননি। ইসলামের মহান আদর্শকে বাঁচিয়ে রাখার জন্য তাঁর এ বিশাল আত্মত্যাগ যুগ যুগ ধরে ইতিহাসে স্মরণীয়-অনুকরণীয় হয়ে থাকবে। কারবালার ঘটনার মধ্য দিয়ে বিশ্ববাসীর কাছে তিনি অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ ও ন্যায়ের পক্ষে প্রতিরোধ সংগ্রামের এক জ্বলন্ত দৃষ্টান্ত রেখে গেছেন। ঐতিহাসিক ১০ মহররম চিরকাল বিশ্বের নির্যাতিত, অবহেলিত এবং বঞ্চিত মানুষের প্রতি অন্যায়ের বিরুদ্ধে সোচ্চার হওয়ার দিকনির্দেশনা ও অনুপ্রেরণা জোগাবে। কারবালার সবচেয়ে বড় শিক্ষা হলো ইমাম হোসাইন (রা.) নিজের জীবন উৎসর্গ করেছেন, তবু ক্ষমতার লোভে এবং ন্যায়নীতির প্রশ্নে আপস করেননি। ইমাম যখন কুফায় রওনা করছেন তখন কয়েকজন বললেন, হজের আর মাত্র দুই দিন আছে। আপনি এখন কেন রওনা হচ্ছেন? ইমাম বললেন, হজ করা ইবাদত, আর ইয়াজিদের বিরুদ্ধে জিহাদ করা ফরজ। কেউ কেউ ইমামের জীবন নিয়ে শঙ্কা প্রকাশ করলেন। তিনি বললেন, নবীজির নাতি হয়ে আমি না অন্যায়কে বরদাশত করব, না অন্যায়ের সঙ্গে আপস করব। এ বলেই তিনি আল্লাহর ওপর ভরসা করে রওনা হয়েছেন। ইমামের রওনা হওয়ার ঘটনায়ও আমাদের জন্য বড় শিক্ষা রয়েছে। অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করার মতো ফরজ ইবাদত আজকের উম্মত ভুলে গেছেন। ইমাম স্পষ্টভাবে বলেছেন, হজ করা বড় ইবাদত কিন্তু তার চেয়ে বড় দাবি হলো ইয়াজিদের বিরুদ্ধে জিহাদ। হায় আফসোস! আমরা আজ ইয়াজিদের বিরুদ্ধে ঘুরে দাঁড়াতে পারিনি, তাই বিশ্বব্যাপী ইয়াজিদের উত্তরসূরিরা মুসলমানদের অবরুদ্ধ করে রেখেছে।

লেখক : চেয়ারম্যান, বাংলাদেশ মুফাস্সির সোসাইটি।

সর্বশেষ খবর