বৃহস্পতিবার, ১৯ আগস্ট, ২০২১ ০০:০০ টা

বিদেশের বয়ানে স্বদেশের সত্য খুঁজতে হবে কেন?

তুষার কণা খোন্দকার

বিদেশের বয়ানে স্বদেশের সত্য খুঁজতে হবে কেন?

একবিংশ শতাব্দীর সূচনার দুই দশক আমরা পার হয়ে এসেছি। একবিংশ শতাব্দীর দুই দশকজুড়ে আমরা যেটি টের পাচ্ছি সেটি ‘সত্য’ এবং ‘প্রচার মাধ্যমের সত্য’ এ দুইয়ের মধ্যে বিরাট ব্যবধান। প্রচারমাধ্যমগুলোর প্রতি আমরা আর চোখ বুজে আস্থা রাখতে পারছি না। বর্তমান সময়ে সাধারণ দর্শক-শ্রোতার বিশ্বাস-অবিশ্বাসের দোলাচলকে গণমাধ্যমগুলো গুরুত্ব দিয়ে বিবেচনা করলে খবর কিংবা বিজ্ঞ আলোচনার গ্রহণযোগ্যতা পাওয়ার সম্ভাবনা আছে। বাংলাদেশে কিছু গণমাধ্যম কিংবা বুদ্ধিজীবীকে দেখি আন্তর্জাতিক এনজিওগুলোর প্রচার-প্রপাগান্ডাকে বেদবাক্য বলে দেশবাসীকে গেলানোর চেষ্টা করে। আমাদের দেশের বুদ্ধি পেশাজীবীরা কোনো আন্তর্জাতিক এনজিওর তরফ থেকে কিছু শুনলে সেটাকে ঐশী বাণী বলে প্রচার করতে নেমে পড়ে। এরা ভুলে যায়, এ দেশে বসবাস করে সরাসরি আমরা যা দেখছি কিংবা আমাদের গণমাধ্যমগুলো যেসব খবর প্রচার করছে সেগুলোকে অগ্রাহ্য করলে আমরা প্রকৃত সত্য কখনো জানতে পারব না। দেশি-বিদেশি এনজিওগুলো তাদের দেশের সরকারি কিংবা করপোরেট বাণিজ্য প্রতিষ্ঠানের দান-অনুদান খেয়ে বেঁচে থাকে। কাজেই তারা তাদের স্বার্থসিদ্ধির মতলবে মনমত তথ্য পয়দা করে প্রচার করবে এটাই স্বাভাবিক। লন্ডনভিত্তিক এনজিও অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনালের ওয়েবসাইট খুলে বাংলাদেশ প্রোফাইল অংশে চোখ বুলালে প্রথমেই আপনার মনে হবে, আহারে! বাংলাদেশ নামের দেশটি বসবাসের অযোগ্য চরম অরাজকতাপূর্ণ একটি দেশ। বাংলাদেশে আইনের শাসন বলে কিছু নেই বরং নিবর্তনমূলক আইন তৈরি করে সরকার মত প্রকাশের স্বাধীনতাকে হরণ করেছে। এখানে ডিজিটাল সিকিউরিটি অ্যাক্টের আওতায় সাংবাদিক সমাজের ওপর চরম নির্যাতন চলছে। বিচারবহিভর্‚ত হত্যাকান্ড, নারী নির্যাতন, আদিবাসী নিবর্তন ইত্যাদি ভয়াবহ রূপ নিয়েছে। মিয়ানমার থেকে বাংলাদেশে আসা প্রায় এক মিলিয়ন রোহিঙ্গা শরণার্থীর তাদের নিজ দেশে নিরাপদ এবং সম্মানজনক প্রত্যাবাসন বাংলাদেশ নিশ্চিত করতে পারেনি এটিও একটি অভিযোগ। অ্যামনেস্টির রিপার্টে বাংলাদেশ সম্পর্কে প্রথম যে অভিযোগগুলো তোলা হয়েছে সেগুলো নিয়ে পক্ষে-বিপক্ষে যুক্তি-পাল্টা যুক্তি তোলা যেতে পারে। কিন্তু রোহিঙ্গাদের নিরাপদ স্বেচ্ছামূলক সম্মানজনক স্বদেশ প্রত্যাবর্তন বাংলাদেশ কীভাবে নিশ্চিত করবে এটি আমার মাথায় ঢুকল না। মিয়ানমার সরকার রোহিঙ্গাদের নাগরিকত্ব অস্বীকার, রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর ওপর বর্বর নির্যাতন চালিয়ে তাদের দেশছাড়া করার কাজটি করেছে। মানবিক বিবেচনায় বাংলাদেশ তাদের আশ্রয় দিয়েছে এবং এ জন্য বাংলাদেশ বিশ্ব দরবারে প্রশংসিত হয়েছে। রোহিঙ্গা সমস্যা সমাধান করার জন্য বাংলাদেশ পৃথিবীর সব দেশকে মিয়ানমারের ওপর চাপ প্রয়োগের জন্য অনুরোধ জানিয়ে আসছে, এ তথ্য আমরা গণমাধ্যমে নিয়মিত পাই। এ প্রসঙ্গে আমার প্রশ্ন, বাংলাদেশের বিরুদ্ধে অভিযোগের তীর তোলার আগে অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল কি রোহিঙ্গাদের নাগরিকত্ব সমস্যা কিংবা সে দেশটিতে তাদের মানবাধিকার লঙ্ঘন হওয়ার বিষয় নিয়ে মিয়ানমারের সঙ্গে কখনো আলোচনার উদ্যোগ নিয়েছিল? সে কাজটি যদি অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল এখন পর্যন্ত না করে থাকে তাহলে এনজিওটি কোন অধিকারে মিয়ানমারের ব্যর্থতার দায় বাংলাদেশের ঘাড়ে চাপাতে এসেছে। অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল যদি আগামীকাল সকালে রোহিঙ্গাদের স্বেচ্ছায় সম্মানজনক স্বদেশ প্রত্যাবর্তন নিশ্চিত করতে পারে আমার দৃঢ় বিশ্বাস বাংলাদেশ সরকার তাতে যারপর নাই আনন্দিত হবে। এবার আসি ডিজিটাল সিকিউরিটি অ্যাক্ট প্রসঙ্গে। এ আইনের কয়েকটি ধারা নিয়ে সাংবাদিক সংগঠনগুলো বাংলাদেশ সরকারের সঙ্গে অনেকবার দেন-দরবার করেছে। আমরা আশা করি সরকার ডিজিটাল সিকিউরিটি অ্যাক্টের নিবর্তনমূলক ধারাগুলো রিভিউ করে সাংবাদিক সমাজের মতামতকে গুরুত্ব দিয়ে সেগুলো সংশোধন করবে। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম দিনে দিনে শক্তিশালী গণমাধ্যমে পরিণত হচ্ছে বলে ডিজিটাল সিকিউরিটি অ্যাক্টের প্রয়োজনীয়তা আছে এ কথা কেউ অস্বীকার করছি না। আবার ডিজিটাল সিকিউরিটি অ্যাক্ট নিবর্তনমূলক আইনে পরিণত হোক এটি আমাদের কারও জন্য কোনো সুখবর নয়। ডিজিটাল সিকিউরিটি অ্যাক্টের সংশোধনী প্রয়োজন আছে এটি দেশের সাংবাদিক সমাজ এবং সচেতন দেশবাসী সব সময়ই বলে আসছে। ডিজিটাল সিকিউরিটি অ্যাক্টের নিবর্তনমূলক ধারাগুলো বাদ দেওয়ার দাবি নিয়ে সরকারের সঙ্গে দেন-দরবার করা অথবা সম্পাদকীয় উপসম্পাদকীয় লেখা খুব ভালো কাজ। সম্প্রতি আমাদের দেশের একটি ইংরেজি দৈনিক পত্রিকা তাদের সম্পাদকীয় কলামে জোরালো ভাষায় ডিজিটাল সিকিউরিটি অ্যাক্টের ঢালাও সমালোচনা করেছে। কিন্তু এ ভালো কাজটি করার জন্য উনারা অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল নামের ব্রিটিশ এনজিওর রিপোর্টের ওপর ভর করলেন কেন সেটি আমি বুঝতে পারছি না। উনারা কি ভেবেছেন অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনালের উদ্ধৃতি দিয়ে কথা বললে সত্য অধিকতর সত্যে পরিণত হবে?

অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল নামের ব্রিটিশ এনজিওকে এত গুরুত্ব দিয়ে তাদের রিপোর্ট নিয়ে ১০ পাতা লেখার কোনো প্রয়োজন আছে বলে আমি মনে করি না। তবুও এসব এনজিও রিপোর্ট নিয়ে আমাদের মাঝে মাঝে বকবক করতে হয়, কারণ তাদের রিপোর্টকে বাইবেল-জ্ঞান করে আমাদের দেশের কিছু বুদ্ধি-পেশাজীবী খবরের কাগজ কিংবা ইলেকট্রনিক গণমাধ্যমে ঝড় তুলে বসেন। এ বুদ্ধি-পেশাজীবীদের অবিবেচনাপ্রসূত আলোচনায় জনমনে বিভ্রান্তি সৃষ্টি হয়। জনমনের বিভ্রান্তি মোচনের জন্য আমি অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল নামের ব্রিটিশ এনজিওর পয়-পরিচয় সংক্ষেপে তুলে ধরছি। পিটার জেমস হেনরি সলোমন নামে একজন ব্রিটিশ ভদ্রলোক ১৯৬১ সালে লন্ডনে অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল প্রতিষ্ঠা করেন। পিটার জেমস একসময় ব্রিটিশ সেনাবাহিনীর গোয়েন্দা বিভাগে কাজ করতেন। ইহুদি পরিবারের সন্তান পিটার জেমস তাঁর জীবনে ইউরোপে মোটা দাগে ইহুদি নির্যাতন এবং নিধন হতে দেখেছেন। পৃথিবীর দেশগুলোতে মানবাধিকার রক্ষার কাজে পিটার জেমসের আন্তরিকতা নিয়ে কোনো প্রশ্ন তুলছি না। অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল নামের এনজিওর লক্ষ্য এবং উদ্দেশ্য হচ্ছে এমন একটি পৃথিবী গড়ে তোলা যেখানে প্রতিটি মানুষ আন্তর্জাতিক মানের মানবাধিকার ভোগ করবে। অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল তাদের জন্মলগ্নের এ প্রতিশ্রুতি কতটা রক্ষা করার চেষ্টা করেছে সেটি নিয়ে আমার মনে গুরুতর প্রশ্ন আছে। বাংলাদেশের নাগরিক হিসেবে আমি আমার দেশের ইতিহাসের পাতা ঘেঁটে দেখব আমাদের মানবাধিকার যখন ভূলুণ্ঠিত হয়েছিল তখন অ্যামনেস্টি কী ভূমিকা পালন করেছিল। ১৯৭১ সালে পাকিস্তান যখন আমাদের দেশে নিষ্ঠুরভাবে মানবাধিকার লঙ্ঘন করেছিল তখন অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল পাকিস্তানের বিরুদ্ধে টুঁ শব্দ করেছিল কিনা তার সন্ধানে আমি অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল নামের এনজিওর সব দলিল তন্ন তন্ন করে খুঁজে খুব হতাশ হয়েছি। ১৯৭১ সালে পাকিস্তানের নিষ্ঠুর নির্মমতার বিরুদ্ধে এ ব্রিটিশ এনজিও কোথাও কোনো প্রতিবাদ করেছে এমন কোনো দলিল খুঁজে পেলাম না। অথচ ১৯৭০ সালে অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল বিশ্বব্যাপী বিনা বিচারে আটক বন্দীদের ওপর নির্যাতন বন্ধ করার জন্য জোরালো আন্দোলন করছিল। ১৯৭০ সালে শুরু করা তাদের ‘স্বচ্ছ বিচার’ আন্দোলন বেশ কয়েক বছর চলমান ছিল এবং এ আন্দোলন চালিয়ে যাওয়ার জন্য তারা বিপুল অঙ্কের তহবিলও গড়ে তুলেছিল। ১৯৭১ সালে পাকিস্তান তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানে কত মানুষকে নির্বিচারে হত্যা করেছে, কত নারীকে বন্দী করে তাদের ওপর পাশবিক নির্যাতন চালিয়েছে সে সম্পর্কে অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনালের কোনো দলিলে তার বিন্দুমাত্র উল্লেখ পেলাম না। অথচ মানবাধিকার রক্ষার জন্য দুনিয়াব্যাপী আন্দোলন গড়ে তোলার পুরস্কার হিসেবে ১৯৭৭ সালে অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল নোবেল শান্তি পুরস্কার জিতেছিল। নোবেল শান্তি পুরস্কার বিজয়ী ব্রিটিশ এনজিও অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল মানবাধিকার শব্দটি কোন তরিকায় সংজ্ঞায়িত করে সেটি নোবেল শান্তি পুরস্কার যারা বিলিবণ্টন করেন তাঁরাই ভালো বলতে পারবেন। তবে ১৯৭১ সালে বাংলাদেশে পাকিস্তানি নিষ্ঠুরতার ব্যাপারে তারা যেভাবে মুখে কুলুপ এঁটে ছিল তাতে মনে হয় অ্যামনেস্টির মানবাধিকার চেতনা অতিমাত্রায় রাজনীতিঘেঁষা, যে জন্য তারা আমাদের ওপর ঘটে যাওয়া পাকিস্তানি বর্বরতা দেখতে পায়নি।

অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনালের মানবাধিকার চেতনা কতটা রাজনীতি নিয়ন্ত্রিত তার আরও প্রমাণ ইতিহাসের পাতায় পাওয়া যায়। ইরাকে আমেরিকান আগ্রাসনকে অনেক বিবেকবান আমেরিকান সমর্থন করেননি। কিন্তু তাতে কী? অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল ইরাকে নরহত্যা চালানোর জন্য আমেরিকাকে রীতিমতো উসকানি দিয়েছে এটি ঐতিহাসিক সত্য। আপনাদের নিশ্চয়ই মনে আছে ১৯৯০ সালে ইরাক কুয়েত আক্রমণ করেছিল। আমেরিকা তখন দাবি করেছিল যে ইরাক কুয়েত দখল করে সেখানে হত্যাযজ্ঞ চালিয়েছে। সে সময় নাইরা নামের একজন কুয়েতি নারী আমেরিকার কংগ্রেসে সাক্ষী দিতে গিয়ে বলেছিল যে, ইরাক কুয়েত আক্রমণ করার সময় সে কুয়েতে একটি হাসপাতালে স্বেচ্ছাসেবকের দায়িত্ব পালন করছিল। ইরাকিরা সেই হাসপাতাল আক্রমণ করে সেখান থেকে ৩০০ ইনকিউবেটর বাচ্চাসহ সরিয়ে নিয়ে যায় এবং ৩০০ বাচ্চাকে ইনকিউবেটরের ভিতর বন্ধ রেখে ঠান্ডয় জমিয়ে হত্যা করে। অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল এ বর্ণনা শুনে আহাবিহা করার পাশাপাশি চটজলদি নাইরার বর্ণনার সত্যতা যাচাইয়ের তাগিদ বোধ করল। সঙ্গে সঙ্গে সরেজমিনে ‘নিরপেক্ষ তদন্ত’ চালানোর জন্য অ্যামনেস্টির মানবাধিকার কর্মীরা গিয়ে কুয়েতে হাজির। পুঙ্খানুপুঙ্খ ‘নিরপেক্ষ তদন্ত’ চালিয়ে অ্যামনেস্টি দেখল, কুয়েতি স্বেচ্ছাসেবক নাইরার দেওয়া জবানবন্দি শতভাগ সত্য। ইরাকিরা কুয়েতের হাসপাতালে ৩০০ শিশুকে ইনকিউবেটরসহ অপহরণ করে পরে সেই শিশুদের ঠান্ডায় জমিয়ে হত্যা করেছে। শিশু হত্যার বর্ণনাকে নিখাদ সত্য বলে দাবি করে অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল ইরাকে আমেরিকান আক্রমণকে উসকে দিয়েছিল। অথচ পরবর্তী সময়ে কুয়েতে একটি নিরপেক্ষ তদন্ত দল কুয়েতি নারী নাইরার দেওয়া জবানবন্দির সত্যতা যাচাই করতে গিয়েছিল। সেই তদন্তকারী দল সবকিছু যাচাই করে দেখে কুয়েতে যে হাসপাতালে ৩০০ ইনকিউবেটরে শিশু হত্যার কথা বলা হয়েছে আসলে সেই হাসপাতালে এত ইনকিউবেটর ছিল না। এমনকি কুয়েতের সেই শহরের সব হাসপাতাল মিলিয়ে সে সময় ৩০০ ইনকিউবেটর ছিল না। অথচ অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল তাদের মতো ‘সত্য’ আবিষ্কার করে আমেরিকার ইরাক আক্রমণের ইন্ধন জুগিয়েছিল। ১৯৮০-এর দশকে অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনালের মনগড়া সত্য সাজানোর শঠতা সম্পর্কে দুনিয়ার অনেক দেশ নড়েচড়ে বসতে শুরু করে। সে সময় সোভিয়েত ইউনিয়ন তাদের বিরুদ্ধে গোয়েন্দাবৃত্তির অভিযোগ তোলে। মরক্কো সরকার বলেছিল, অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল আইন ভঙ্গকারীদের রক্ষক। এ এনজিও সম্পর্কে কথাটি উড়িয়ে দেওয়ার কোনো সুযোগ নেই, কারণ ১৯৭১ সালে অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশে পাকিস্তানিদের নিষ্ঠুর নির্যাতনের বিরুদ্ধে কোনো বক্তৃতা বিবৃতি দিয়েছে এমন কোনো প্রমাণ পাওয়া যায় না, বরং যুদ্ধাপরাধীদের শাস্তির হাত থেকে বাঁচানোর জন্য তাদের চেষ্টার কোনো কমতি ছিল না। অ্যামনেস্টির ১৯৭১-১৯৭২ সালের বার্ষিক রিপোর্ট মন দিয়ে পড়ে দেখলাম। পুরো রিপোর্ট খুঁটিয়ে পড়ে অ্যামনেস্টির যে স্বরূপ পেলাম তাতে তাদের মানবাধিকারের পক্ষের সংগঠন বলে মানতে আমি দ্বিধান্বিত। ১৯৭১ সালের ১ জুন থেকে ৩১ মে ১৯৭২ সময়কালের রিপোর্টে ৩১ পৃষ্ঠার দুটি প্যারাগ্রাফে পাকিস্তান এবং বাংলাদেশ প্রসঙ্গ উল্লেখ করা হয়েছে। বলা হয়েছে- পূর্ব পাকিস্তানের নির্বাচিত নেতা শেখ মুজিবুর রহমান এবং ড. কামাল হোসেন পাকিস্তানের কারাগারে বন্দী আছেন যাদের বিচার মিলিটারি কোর্টে না হয়ে সিভিল কোর্টে হওয়া উচিত। ব্যস! পূর্ব পাকিস্তানের মানবাধিকার পরিস্থিতি নিয়ে এটুকু কথাই অ্যামনেস্টির বলার ছিল। বার্ষিক রিপোর্টের ৩১ পৃষ্ঠার দ্বিতীয় প্যারাগ্রাফ পড়লে অ্যামনেস্টির মানবাধিকার মূল্যবোধের নমুনা আপনারা সবাই টের পাবেন। অ্যামনেস্টির সে সময়ের সেক্রেটারি জেনারেল মার্টিন এনালস ১৯৭২ সালের জানুয়ারি মাসে স্বাধীন বাংলাদেশের মানবাধিকার পরিস্থিতি নিয়ে রীতিমতো উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন। উদ্বেগের বিষয়টি কী চমৎকার একবার ভেবে দেখুন। অ্যামনেস্টি বলছে, বাংলাদেশে কিছু মানুষকে পাকিস্তানি সৈন্যদের সহযোগিতা করার অপরাধে দালাল আইনে গ্রেফতার করা হচ্ছে। পাকিস্তানের দালালরা বাংলাদেশে নিশ্চয়ই ন্যায় বিচার পাবে না এটি অনুমান করে অ্যামনেস্টি উদ্বিগ্ন হয়ে পড়েছিল। তাদের উদ্বেগের বিষয় বর্ণনা করে তারা বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীকে একটি পত্র পাঠিয়েছিল বলে রিপোর্টে উল্লেখ করা হয়েছে। বহু বছর পরে ২০০৯ সালে বাংলাদেশে যখন যুদ্ধাপরাধীদের বিচার শুরু হলো তখন এ এনজিও যুদ্ধাপরাধীদের পক্ষ নিয়ে কত নাকি কান্নাই না কাঁদল। ২০১৪ সালে যখন জামায়াত নেতা নিজামির ফাঁসির দন্ড হলো তখন অ্যামনেস্টি তাদের প্রকাশনায় নিজামির পরিচয় তুলে ধরতে গিয়ে বলছে, ‘নেতৃস্থানীয় বিরোধীদলীয় নেতা জনাব নিজামিকে মৃত্যুদন্ডে দন্ডিত করা হয়েছে।’ নিজামিকে যুদ্ধাপরাধী নামে না ডেকে নেতৃস্থানীয় বিরোধীদলীয় নেতা বলার অর্থ সরকারবিরোধী মত দমন করার জন্য নিজামিকে হত্যা করেছে। শব্দের মারপ্যাঁচে সত্যের অপলাপ করা অ্যামনেস্টির অত্যন্ত বাজে অভ্যাস।

অ্যামনেস্টি দুনিয়ার সব মানুষকে সৎ, সত্যবাদী, স্বচ্ছ হওয়ার সবক দিয়ে বেড়ায়, অথচ দেখুন তারা নিজেরা কী চর্চা করে সে খবর তার দলিল খুঁজলেই দেখতে পাবেন। ২০০৯-১০ অর্থবছরে অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনালের বেতন কেলেঙ্কারি নিয়ে ইংল্যান্ডে বেশ তোলপাড় হয়েছিল। সে সময় বাংলাদেশি আইনজীবী আইরিন খান অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনালের সেক্রেটারি জেনারেল ছিলেন। উনার বেতন কেলেঙ্কারির ঘটনা ঘটেছিল ২০০৯ সালে যার সূত্র ধরে তিনি পদত্যাগ করেছিলেন। কাগজ-কলমে আইরিন খানের বার্ষিক বেতন ছিল ১ লাখ ৩২ হাজার ৪৯০ পাউন্ড। অথচ বার্ষিক অডিটে ধরা পড়ল তিনি অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল নামের স্বেচ্ছাসেবী প্রতিষ্ঠান থেকে আসলে বেতন নিয়েছেন ৫ লাখ ৩৩ হাজার ১০৩ পাউন্ড! আইরিন খানের বেতন কেলেঙ্কারি পত্রপত্রিকায় ছাপা হওয়ার পরে ইংল্যান্ডের পার্লামেন্ট সদস্য ফিলিপ ডেভিস ডেইলি এক্সপ্রেসকে বলেছিলেন, ‘আমার বিশ্বাস, জনগণ অ্যামনেস্টিকে দান করে কারণ তারা বিশ্বাস করে অ্যামনেস্টি তাদের দানের টাকায় দারিদ্র্য দূর করার জন্য কাজ করবে। জনগণের দানের টাকা এমন মোটা বিড়াল (ফ্যাট ক্যাট) পোষার কাজে ব্যয় হতে পারে এটি অবিশ্বাস্য। অ্যামনেস্টিকে যারা দান করে এ ঘটনার সূত্র ধরে তাদের মোহভঙ্গ হবে।’

ইংল্যান্ডের সংসদ সদস্য ফিলিপ ডেভিসের কথায় অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনালের দাতাদের মোহভঙ্গ হলেও হতে পারে কিন্তু আমাদের দেশের বুদ্ধি-পেশাজীবীদের আনুগত্যের মোহ কাটবে কবে!

লেখক : কথাসাহিত্যিক।

সর্বশেষ খবর