বৃহস্পতিবার, ৩০ সেপ্টেম্বর, ২০২১ ০০:০০ টা

মত প্রকাশ

তসলিমা নাসরিন

মত প্রকাশ

১. চারদিকে খবর অভিনেত্রী মাহিয়া মাহীকে নিয়ে, তাঁর দ্বিতীয় বিয়ে নিয়ে। এবং ফেসবুকে তাঁর একটি কবিতা পোস্ট নিয়ে। কবিতাটি আমার লেখা। কবিতাটি তিনি কেন পোস্ট করেছেন, প্রেম নিয়ে কী ভাবছেন তিনি, জানতে আমি আগ্রহী নই। আমি জানতে আগ্রহী আমার কবিতার সঠিক বানান কে বা কারা বেঠিক করেছে। শুধু মাহীর পোস্টে নয়, এই কবিতাটি বেঠিক বানানে অনেকদিন ধরেই ফেসবুকে ঘুরছে। শুদ্ধ কবিতাটি এরকম।

‘যদি আমাকে কাজল পরতে হয় তোমার জন্য,

চুলে মুখে রং মাখতে হয়, গায়ে সুগন্ধী ছিটোতে হয়,

সবচেয়ে ভালো শাড়িটা যদি পরতে হয়,

শুধু তুমি দেখবে বলে মালাটা চুড়িটা পরে সাজতে হয়,

যদি তলপেটের মেদ, যদি গলার বা চোখের কিনারের ভাঁজ কায়দা করে লুকোতে হয়,

তবে তোমার সঙ্গে অন্য কিছু, প্রেম নয় আমার।

প্রেম হলে আমার যা কিছু এলোমেলো,

যা কিছু খুঁত, যা কিছুই ভুলভাল অসুন্দর থাক,

সামনে দাঁড়াবো, তুমি ভালোবাসবে।

কে বলেছে প্রেম খুব সহজ, চাইলেই হয়!

এত যে পুরুষ দেখি চারিদিকে, কই প্রেমিক তো দেখি না!’

বেঠিক কোথায় করেছে? শাড়ি পরা, চুড়ি পরার বদলে শাড়ি পড়া, চুড়ি পড়া করাই বানান বেঠিক করা। পড়া আর পরা’র পার্থক্য যে না বোঝে, সে বাংলা ভাষার অনেকটাই বোঝে না। বাংলাদেশের পত্র পত্রিকার নিজস্ব বানানরীতিতে ভুল বানান যথেষ্ট আছে। একটি পত্রিকা তো সম্মানীয় কারও জন্যও তাঁর ওঁর তাঁকে যাঁকে শব্দগুলো ব্যবহার করে না, চন্দ্রবিন্দুতে বড় অনীহা তাঁদের। সম্পাদক বলেন, কারও মৃত্যু হলেই চন্দ্রবিন্দুর ব্যবহার চলবে, তার আগে নয়। সম্মান পেতে আমাদের মৃত্যু পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হবে, আর কোনও উপায় নেই।

শুদ্ধ উচ্চারণ শেখাটা খুব জরুরি। আঞ্চলিক ভাষায় কথা বলা কোনও অন্যায় নয়। বরং এতে নানা বর্ণে ভাষাটি বর্ণময় হয়ে ওঠে। কিন্তু শুদ্ধ উচ্চারণ শিখে রাখলে কবিতা আবৃত্তি করা, নাটকের সংলাপ বলা, গান করা, খবর পড়া- এসবে কাজে লাগে।

একটি ভাষাকে বাঁচিয়ে রাখতে হলে ভাষাটির নানা আঞ্চলিকতা বাঁচিয়ে রাখলেই হয় না, শুদ্ধ বানান এবং শুদ্ধ উচ্চারণও বাঁচিয়ে রাখতে হয়। তা না হলে কালের স্রোতে শুদ্ধ অবয়বটি বিলুপ্ত হয়ে গিয়ে অপভ্রংশই বেঁচে থাকবে। ভাষা ভেসে যায় জানি, ভাষার মৃত্যু হয় জানি, কিন্তু এত বিপুল জনসংখ্যার ভাষাটির শুদ্ধ অবয়ব যদি বেঁচে না থাকে, সেই দোষ প্রকৃতির নয়, সেই দোষ মানুষের।

২. আফগানিস্তান এখন এক খন্ড মধ্যযুগ। অপহরণ করার অভিযোগ এনে চারজন আফগান লোককে সিরাত শহরে খুন করেছে তালেবান গোষ্ঠী। তারপর চারটে মৃতদেহ ঝুলিয়ে দিয়েছে এমন জায়গায় যেন জনগণ দেখতে পায়। বলেছে তারা চুরির শাস্তি দেবে হাত কেটে। অপহরণ এবং এই ধরনের অপরাধের শাস্তি দেবে ফাঁসিতে ঝুলিয়ে। মেয়েদের পাথর ছুড়ে হত্যাও ফিরে আসছে। তারা ধর্মের নামে নারকীয় হত্যাযজ্ঞ চালাচ্ছে এবং চালাবে। কার কী বলার আছে? ছেলেদের ইস্কুল খুলে গেছে, মেয়েদের ইস্কুল খোলেনি। কার কী বলার আছে? মুখ খুলবে তো চাবুক।

৩. কত কিছুর দিবস যে পালিত হচ্ছে। সবে গেল ‘কন্যা দিবস’। জানি না পুত্র দিবস বলে কোনও দিবস আছে কিনা। আসলে পুত্র দিবস তো প্রায় প্রতিদিনই পালিত হয়। কন্যা যেহেতু অনেক সংসারেই অবহেলিত, তাই কন্যাকে মূল্য দেওয়ার জন্য, আমার ধারণা, একটি দিবস তৈরি করা হয়েছে। আমার কন্যাও নেই, পুত্রও নেই। যৌবনে অনেক ভুল সিদ্ধান্ত নিলেও সন্তান না জন্ম দেওয়ার সিদ্ধান্তটি আমার সঠিক ছিল। ৭৮০ কোটি লোকে পৃথিবী উপচে পড়ছে, এই দুঃসময়ে জনসংখ্যা বাড়ানোর কোনও প্রয়োজন নেই। যারা জন্মেছে তারা কি সবাই খেতে পরতে পাচ্ছে, শিক্ষা স্বাস্থ্য পাচ্ছে?

ইতর প্রাণীর মধ্যে বংশ বিস্তারের ইচ্ছেটা কিলবিল করে, এই কিলবিল ব্যাপারটি নিয়ন্ত্রণ করতে তারা পারে না। মানুষের মধ্যেও এই ইচ্ছেটি আছে, তবে এটি আরোপিত। আরোপিত বলেই এটি নিয়ন্ত্রণ সম্ভব। অনেকে সন্তান জন্ম দেওয়ার ইচ্ছে নেই বলে সন্তান জন্ম দেয় না। কিছু মানুষ, আমার অবাক লাগে, মনে করে সন্তান জন্ম না দিলে তাদের জীবনই ব্যর্থ, অর্থহীন। তারা সন্তানের জন্য ইতর প্রাণীদের মতো কিলবিল করা ইচ্ছের আমদানি করে। আমার এক বোন উচ্চশিক্ষিতা, নামি কলেজের অধ্যাপিকা, কিন্তু সন্তান নেই বলে এমনই দুঃখে-কষ্টে ডুবে থাকে যে তার জীবনটিই সে উপভোগ করে না। তার এমন অর্থপূর্ণ জীবনটিকে সে যে অর্থহীন মনে করছে, এ দোষ কার বা কাদের? তার কানের কাছে যারা শৈশব থেকে গুনগুন করেছে সন্তান না জন্মালে জীবনের কোনও মানে নেই, দোষ নিশ্চয়ই তাদের অনেকটা, বাকি দোষ তাদেরও যারা যুক্তি-বুদ্ধি দিয়ে নারীবিদ্বেষী রীতিগুলোকে ভাঙার কোনও চেষ্টা করে না।

প্রজাতিকে বাঁচিয়ে রাখার জন্য যদি প্রজননের প্রয়োজন পড়তো, কথা ছিল। এখন তো দেখা যাচ্ছে মানুষের আধিক্য একটা ভয়াবহ পরিস্থিতি তৈরি করেছে। লক্ষ কোটি অরণ্য-নির্ভর প্রাণীর আবাসস্থল উড়িয়ে দিয়ে মানুষের জন্য শহর নগর বানাতে হয়েছে। পৃথিবীর কত প্রজাতি যে আমাদের মানুষ-প্রজাতির হিংস্রতা আর বোধবুদ্ধিহীনতার কারণে বিলুপ্ত হয়ে গেছে। এই গ্রহে আমাদের যতটা অধিকার, ততটা অধিকার তো তাদেরও। অস্ত্রের জোরে কী অরাজকতাই না আমরা চালিয়েছি! আমরা পৃথিবীর বন জঙ্গল ধ্বংস করেছি, নদী সমুদ্র আকাশ বাতাস দূষিত করেছি আমাদের স্বার্থান্ধ জীবনযাপন এবং আমাদের অর্থহীন জনসংখ্যা দিয়ে। অনেকে মনে করেন, জ্ঞানীগুণীদের সন্তান জন্ম দেওয়া উচিত। কিন্তু বারবার প্রমাণিত হয়েছে, জ্ঞানীগুণীদের সন্তান জ্ঞানীগুণী হয় না। আর কত প্রমাণ দরকার! মৃত্যুতেই জীবনের চিরকালীন সমাপ্তি। বংশ রয়ে গিয়ে, রক্তের ছিটেফোঁটা রয়ে গিয়ে কারও কোনও লাভ হয় না।

আজ এতকাল পরও নিজেকে আরেকবার ধন্যবাদ দিই, না পুত্র না কন্যা কিছুই জন্ম না দিয়ে আমি একটি স্বাধীন এবং অর্থপূর্ণ জীবনযাপন করেছি বলে। তুমি সন্তান জন্ম দিয়ে জীবনকে অর্থপূর্ণ করার চেষ্টা কোরো না। তুমি তোমার কাজ দিয়ে জীবনকে অর্থপূর্ণ করো। তুমি কে, তুমি কী সেটাই বড়। সন্তান যে কেউ জন্ম দিতে পারে, যে কোনও গ-মূর্খই, এ কোনও উল্লেখযোগ্য ব্যাপার নয়।

৪. বিদ্যাসাগরের জন্মদিন পার হলো দু’দিন আগে। বিদ্যাসাগরের মতো হিন্দু ধর্মের আরও কোনও সংস্কারক গত দুশ বছরে জন্মেছেন কি? কারও কথা তো জানি না।

বিধবারা তো এখনও হবিষ্যি খান। একেবারে হবিষ্যি না হলেও মাছ মাংস বাদ দিয়ে খান। শাড়িও পরেন সাদা। একেবারে সাদা না পরলেও লাল রং এড়িয়ে চলেন। কপালে লাল টিপও পরেন না। এরকম আমি শিক্ষিত বাড়িতেই দেখেছি। বিধবার বিয়ে? হাজারে কটা হয় কে জানে?

মেয়েদের শিক্ষাটা বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই শিক্ষালয়গুলোতে দুপুরের খাবার বা ‘মিড ডে মিল’ জুটবে বলে, বা বিয়ের পাত্র জুটবে বলে। মেয়েরা পড়াশুনো করে বড় হবে, নিজের পায়ে দাঁড়াবে, স্বনির্ভর হবে, নিজের জীবন নিজেই পরিচালনা করবে- এমন মহৎ উদ্দেশ্যে নয়। ধর্মীয় কুসংস্কারে বিদ্যাসাগরের সময়ে সমাজ যতটা আচ্ছন্ন ছিল, তার চেয়ে তো এখন কিছু কম আচ্ছন্ন নয়।

জাত পাতের বিরুদ্ধেও তো লড়েছিলেন বিদ্যাসাগর। জাত পাত ওপরে ওপরে আজ নেই হয়তো, ভিতরে ভিতরে ঠিকই কিন্তু আছে।

বিদ্যাসাগরের বাংলা বর্ণ পরিচয়? কজন পড়ে আজকাল! বাচ্চারা তো অ আ ক খ নয়, এ বি সি ডি পড়ে। বাংলা শিখে নাকি কোনও লাভ নেই, তাই পড়ে না।

৫. বড় কিছু বাঙালি লেখক সম্পর্কে খুব গর্ব করে বলা হয় তাঁদের কোনও শত্রু নেই। শুনে আঁতকে উঠি আমি। শত্রু নেই, তাহলে কেমন লেখক তাঁরা, কী লেখেন যে শত্রু তৈরি হয়নি? তাঁরা এমন লেখা লেখেন, যে লেখা পড়ে সবাই খুশি থাকে। বামপন্থি ডানপন্থি কট্টরপন্থি নরমপন্থি সকলেই খুশি, ধনী গরিব নারীবিদ্বেষী নারীবাদী সকলেই খুশি, কেউ লেখার কোনও বিষয়ে আপত্তি করে না, মন খারাপ করে না, রুখে ওঠে না। কারণ আপত্তি করার, মন খারাপ করার বা রুখে ওঠার কিছু থাকে না তাঁদের লেখায়।

আমার ভয় হয় এমন লেখকের নাম শুনলেই। এই লেখকেরা এক নষ্ট সমাজে বাস করছেন, কিন্তু নষ্ট সমাজের নিন্দে করেন না, করলে নষ্ট সমাজের হর্তাকর্তারা তাঁদের পছন্দ করবেন না তাই। এই লেখকেরা বৈষম্যের মধ্যে বাস করেন, কিন্তু বৈষম্যের প্রতিবাদ করেন না, প্রতিবাদ করলে শত্রু তৈরি হবে, বৈষম্যে বিশ্বাস করা মানুষ তাঁদের ঘৃণা করবে এই ভয়ে। এই লেখকেরা বিস্তর জাতীয় পুরস্কার পান, বড় বড় সাহিত্য সভায় সভাপতিত্ব করেন, পুরু পুরু ফুলের মালা পরেন গলায়, উদ্বোধনের ফিতে কাটেন, প্রকাশকেরা এই লেখকদের রচনাবলী প্রকাশ করেন। এই লেখকেরা নিষিদ্ধ হন না, বরং বিক্রি হন ভালো।

৬. অনেকে বলে ‘তসলিমার সব মতের সঙ্গে আমি একমত নই’, বলা মাত্র উপস্থিত শ্রোতাদের কাছে তারা খুব জ্ঞানী এবং গুরুত্বপূর্ণ মানুষ হিসেবে বিবেচিত হয়। তসলিমার কোন কোন মতের সঙ্গে তারা একমত নয়, তা অবশ্য উল্লেখ করে না কেউ। করলেও তসলিমা যা বলেনি, বা লেখেনি, হলুদ সাংবাদিকতা থেকে প্রাপ্ত এমন কিছু রটনারই উল্লেখ করে। নারীবাদ, মানববাদ, মত প্রকাশের অধিকার, মানবাধিকার, বৈষম্যহীন সমাজ, সমতা, সততা, সমানাধিকার ইত্যাদি নিয়ে তসলিমার গত তিন দশকের বেশি সময় ধরে ভাবনা এবং লেখালেখির কোনটির সঙ্গে তারা একমত নয়- তা আমারও বড় জানতে ইচ্ছে করে।

                লেখক : নির্বাসিত লেখিকা।

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর