বুধবার, ৬ অক্টোবর, ২০২১ ০০:০০ টা

মন দরিয়ায় ঢেউ উঠেছে প্রভুর জিকির কর

মাওলানা সেলিম হোসাইন আজাদী

মন দরিয়ায় ঢেউ উঠেছে প্রভুর জিকির কর

রঙিন দুনিয়া। রঙিলা মানুষ। চোখ ধাঁধানো আলো। দিন শেষে আঁধার নামিয়ে কালো রাত আসে। তখনো কিছু মানুষ জেগে থাকে বাহারি বাতির আলোর নিচে। এদের অনেকেই দিনে নিপাট ভদ্রলোকের অভিনয় করে বেড়ায়। ভদ্র পোশাকধারী এমনই একজন মানুষের নাম জামাল (ছদ্মনাম)। প্রচুর অর্থবিত্তের মালিক। একবার মাহফিল শেষে তার সঙ্গে দেখা। আমাকে বললেন, হুজুর একান্তে কথা বলতে চাই আপনার সঙ্গে। গভীর রাত। বললাম কোথায় যাবেন? বললেন, অমুক জায়গায়। গাড়িতে উঠুন। আমার উদ্দেশ্য গাড়িতে বসে তার কথা শুনব। ভদ্রলোক তার ড্রাইভারকে বললেন, তুমি পেছন পেছন আস। আমি হুজুরের গাড়িতে আসছি। নির্জন রাত। চাঁদহীন আকাশ। গাড়ি ছুটছে। অন্ধকার গাড়িতে জামাল সাহেব বললেন, আমি কি আপনার হাত ধরতে পারি? সম্মতির অপেক্ষা না করেই আমার হাত ধরে ফেললেন। মনে হলো এই বুঝি ডুকরে কেঁদে উঠবেন। তেমন কিছুই হলো না। উদাস গলায় আমার দিকে প্রশ্ন ছুড়ে দিলেন, সব থেকেও মানুষ কেন সুখী হয় না? কেন হঠাৎ হঠাৎ মনটা হাহাকার করে ওঠে, বলতে পারেন মাওলানা? জগতের অতিপ্রাচীন কিন্তু খুব দরকারি একটা প্রশ্ন করলেন জামাল ভাই। এমন কোনো মানুষ নেই যে তার বর্তমান জীবন নিয়ে সন্তুষ্ট। যার সব আছে সে-ও একসময় অতি সুখে আত্মহত্যা করে বসে। আবার যার কিছুই নেই তারও সময় সময় ইচ্ছা জাগে ট্রাকের নিচে মাথা দিয়ে জীবনটা শেষ করে দেওয়ার। আমরা ভাবী, যার অর্থবিত্ত-পরিবার-পরিজন আছে তার মতো সুখী কেউ নেই। আসলে কথাটা ঠিক নয়। যার সব আছে তার আসলে কিছুই নেই। যার অনেক কিছু নেই তার অল্প কিছু আছে। হঠাৎ হাতটা হালকা অনুভূত হলো। লোকটি এমনভাবে আমার হাত ছাড়লেন যেন রাজ্যের বিরক্তি ভর করেছে তার ওপর। যে আশা নিয়ে আমার কাছে এসেছেন তা জলে গেছে। আমার শুরুটা তিনি বুঝতে পারেননি। আশ্বস্ত করার জন্য বললাম জামাল ভাই, আপনি আমার কথাগুলো ধরতে পারেননি। একটু ব্যাখ্যা করলেই পরিষ্কার হয়ে যাবে। মাথা নেড়ে সম্মতি জানালেন। আমি বলতে শুরু করলাম। ‘এমন কোনো মানুষ নেই যে তার বর্তমান জীবন নিয়ে সন্তুষ্ট।’ আসলে জীবন নিয়ে সন্তুষ্ট হওয়া কখনই সম্ভব নয়। মাওলানা জালালুদ্দিন রুমির (রহ.) বিখ্যাত গ্রন্থ মসনভির প্রথম কবিতাটি উদ্ধৃত করলাম, বিশনু আজ যে হেকাইয়েত মিকুনাদ ওয়াজ জুদাই হা শেকায়েত মিকুনাদ। কান পেতে শোনো! বাঁশি কী বলে? বাঁশি তার বিচ্ছেদের কথাই বলে। যুগ যুগ ধরে বাঁশরি বাঁশি বাজায়। মায়াবী সুরে তন্ময় হয়ে শুনতে থাকে মানুষ। কী যেন আছে এ বাঁশির সুরে। হন্তদন্ত একজন মানুষকেও বাঁশির করুণ সুর থমকে দেয়। পুরোপুরি টাকার পাগল একজন মানুষও চমকে ওঠে বাঁশির সুর শুনে। বিরহী প্রেমিকের মনে জ্বলতে থাকা তুষের আগুনে ঘি ঢেলে দেয় বাঁশবাগানের ছোট্ট একটি বাঁশি।

কিন্তু কেন? কী আছে বাঁশির সুরে? এত তন্ময়তা সে কোথায় পেল? মাওলানা রুমি রহস্যের উত্তর খুঁজে পেয়েছেন। স্বয়ং বাঁশি তার সঙ্গে কথা বলেছে। বাঁশির সে কথা দিয়ে তিনি শুরু করেছেন মসনভি নামক বিখ্যাত কাব্যগ্রন্থটি। ‘বাঁশি তার বিচ্ছেদের কথাই বলে’। বাঁশবাগান থেকে বাঁশি কে কেটে এনেছে। জীবনভর বাঁশবাগানে ফিরে যাওয়ার বেদনায় বাঁশি কেঁদে বেড়ায়। এ কান্নাই বাঁশির শক্তি। তন্ময়তার রহস্য। মূলত মানুষের আত্মাও এসেছে মহান আল্লাহর কাছ থেকে। আবার তার কাছেই ফিরে যাবে। কোরআনের অসংখ্য আয়াতে আল্লাহ মানুষকে বলেছেন, ‘তোমরা এসেছ আমার থেকে, আবার আমার কাছেই তোমাদের ফিরে আসতে হবে।’

‘এমন কোনো মানুষ নেই যে তার বর্তমান জীবন নিয়ে সন্তুষ্ট।’ এবার বুঝতে পেরেছেন আমার এমনটি বলার রহস্য কী, জামাল সাহেব? মানবাত্মা নামক যে বাঁশিকে আল্লাহ থেকে জুদা করে দুনিয়ায় ছেড়ে দেওয়া হয়েছে, শত ঐশ্বর্যে কিংবা চরম ফকিরি যে হালতেই থাকুক না কেন সব সময় সে হাহাকার করতে থাকবে কখন বাঁশবাগানে গিয়ে মূল বাঁশের সঙ্গে সে মিলতে পারবে। ‘যার সব আছে তার আসলে কিছুই নেই।’ বিত্তশালী মানুষ এমনই হতভাগা যে অর্থের বিনিময়ে সে হৃদয়ের সুখ কিনতে চায়। হারিয়ে যায় নেশা-নারী-পাপের জগতে। ভাবে আমার চেয়ে সুখী বুঝি কেউ নেই। কিন্তু দিন শেষে রাত আসে। রাত শেষে ভোর। ঘুমহীন চোখে সে উপলব্ধি করে বয়সের সঙ্গে সঙ্গে হৃদয়ের যন্ত্রণা কেবল বেড়েই চলেছে। বেড়েই চলেছে। তখন কেউ ঘুমের ওষুধের মাত্রা বাড়িয়ে দেয়। কেউ নেশার ওপর নেশা করে। একসময় দুঃখ থেকে পালাতে আত্মহত্যার ভুল পথও বেছে নেয় কেউ কেউ। এর বিপরীতও আমি দেখতে পাই। অন্যদিকে বিত্তবৈভবহীন একজন মানুষ, যার অঢেল সম্পদের পাহাড় নেই। এমন ব্যক্তি হৃদয়ের শূন্যতা পূরণ করতে মসজিদে চলে যায়। দীর্ঘ শ্বাস ছেড়ে আল্লাহকে ডাকে। গরিব-দুঃখী, আত্মীয়স্বজনের পাশে থাকে। আর কোরআনে আল্লাহ বলেছেন, ‘আলা বিজিকরিল্লাহি তাতমাইন্নুল কুলুব। অবশ্যই হৃদয়ের শূন্যতা দূর হয় প্রেমময় প্রভুর স্মরণে।’ হাদিসে রসুল (সা.) বলেছেন, ‘বান্দাকে ভালোবাসলে আল্লাহর ভালোবাসা পাওয়া যায়।’ এই হলো ‘যার অনেক কিছু নেই, তার অল্প কিছু আছে’র মর্মার্থ। কথা শেষ হতেই হাতে গভীর চাপ অনুভব করলাম। শব্দ শুনে বুঝলাম ফুঁপিয়ে কাঁদছেন জামাল সাহেব। জড়ানো কণ্ঠে রাতের এই মেহমান বললেন, হুজুর! ভেবেছিলাম অনেক টাকার মালিক হলে সুখ ধরা দেবে। কিন্তু এখন বুঝতে পেরেছি মানুষ যত বড় লোক হয়, অন্তরের দিক থেকে ততই গরিব হতে থাকে। কথাটা পুরোপুরি ঠিক নয়। অধিকাংশ বিত্তশালী মানুষ অন্তরের দিক থেকে নোংরা হয় ঠিক তাই বলে সবাই না। যেমন হজরত ওসমান (রা.) ও আবদুর রহমান ইবনে আউফ (রা.)। তাঁরা দুজনই দোজাহানের সম্পদে ছিলেন ভরপুর। আসলে বিত্ত যদি প্রভুর প্রেম ভুলিয়ে না দেয় তাহলে সম্পদের পাহাড়ে ঘুমিয়ে থাকলেও প্রভুর স্পর্শ হৃদয়ে অনুভূত হয়। জামাল সাহেবের কান্না শেষ হলে বিষয়টি বুঝিয়ে বলতে হবে।

লেখক : চেয়ারম্যান, বাংলাদেশ মুফাসসির সোসাইটি, আউলিয়ানগর।

সর্বশেষ খবর