বৃহস্পতিবার, ৭ অক্টোবর, ২০২১ ০০:০০ টা

পিতৃতন্ত্র বনাম সমানাধিকার

তসলিমা নাসরিন

পিতৃতন্ত্র বনাম সমানাধিকার

১. স্ত্রী-সন্তানকে হত্যা করার পর গৃহকর্তার আত্মহত্যা। এমন ঘটনা সেই কতকাল থেকে ঘটছে। এই তো সেদিন পশ্চিমবঙ্গের হাওড়ায় অভিজিৎ দাস নামের এক গ্যাসের ব্যবসায়ী তাঁর স্ত্রী দেবযানী আর কন্যা সম্রাজ্ঞীকে হাতুড়ি দিয়ে মাথায় আঘাত করে খুন করেছেন, তারপর নিজে গলায় দড়ি দিয়ে আত্মহত্যা করেছেন। কারণ, গ্যাসের ব্যবসায় মন্দা, অর্থনৈতিক অবস্থা দ্রুত খারাপ হওয়া, ধার দেনা বেড়ে যাওয়া। গৃহকর্তারা অভাবের কারণে শোকে এমন মুহ্যমান থাকেন যে দুশ্চিন্তা, হতাশা, অবসাদ তাঁদের গ্রাস করে ফেলে। তারপরই এমন হত্যা এবং আত্মহত্যার ভয়ঙ্কর সিদ্ধান্ত নেন।

প্রচুর লোক এভাবেই পরিবারের ঘনিষ্ঠদের হত্যা করে নিজে আত্মহত্যা করেন। আত্মহত্যা মহামারীর আকার নিয়েছে কৃষকদের মধ্যে। ৩৫ বছর আগে প্রথম এক কৃষক  আত্মহত্যা করেন। পরিবারের সবাইকে কীটনাশক খাইয়ে হত্যা করার পর নিজে সেই বিষ খেয়ে আত্মহত্যা করেছিলেন। তারপর থেকে প্রতি বছর কৃষকরা আত্মহত্যা করছেন। দশ হাজার কৃষক এবং তাঁদের পরিবারের সদস্য প্রতি বছর আত্মহত্যা করেন ভারতবর্ষে। এর কারণ খরা বৃষ্টিতে ফসল না হওয়া, ফলে অভাব-অনটন এবং ধারদেনা।

এখন প্রশ্ন হলো, কেন পুরুষেরা তাঁদের ওপর অর্থনৈতিকভাবে নির্ভরশীল মানুষকে খুন করেন? এর কারণ পুরুষতন্ত্র। পুরুষতন্ত্র বলে পুরুষ সবল, পুরুষ নির্ভীক, পুরুষ উপার্জন করবে, স্ত্রী সন্তান থাকবে পুরুষের অর্থাৎ গৃহকর্তার অধীন, স্ত্রী সন্তানের ভরণপোষণের দায়িত্ব পুরুষের। এ দায়িত্বটি সঠিকভাবে সম্পন্ন না করতে পারলে পুরুষেরা হীনমন্যতায় ভোগেন, হীনমন্যতায় ভুগতে ভুগতে তাঁদের অর্থের ওপর নির্ভরশীল মানুষদের যেহেতু তাঁরা পুরুষতান্ত্রিক সংজ্ঞা অনুযায়ী নিজস্ব সম্পত্তি বলে মনে করেন, সেহেতু তাদের জীবননাশ করতে তাঁরা দ্বিধা করেন না এবং নিজের অক্ষমতা, অপারগতা, অসাফল্য, অকৃতকার্যতা, অকৃতিত্ব এবং ব্যর্থতা পুরুষ হিসেবে মেনে নিতে পারেন না, সমাজের সামনে পরাজিত পুরুষ হিসেবে দাঁড়াবার শক্তি তাঁদের থাকে না বলেই নিজের জীবনের সমাপ্তি টানেন।

পুরুষতন্ত্রের বোঝা তাঁদের কাঁধে এমন চেপে না বসলে, পুরুষতন্ত্র দ্বারা মগজধোলাই না হলে তাঁরা এভাবে দলে দলে আত্মহত্যা করতেন না। তাঁদের পরিবারের সবাইকে খুন হতেও হতো না। সে কারণেই পুরুষতন্ত্রের কঠোর রীতিনীতি ভেঙে ফেলতে হবে। একা পুরুষের ওপর নয়, সংসারের অর্থনৈতিক দায়িত্ব নারীকেও নিতে হবে। অর্থনৈতিক অবস্থা মন্দ হওয়ার সব দায়ভার পুরুষের ওপর যেন না পড়ে। পুরুষকে যেন সফল হওয়ার প্রমাণ দেখিয়ে সমাজে টিকে থাকতে না হয়। ব্যর্থ হলেও যেন পুরুষেরা আত্মসম্মান নিয়ে বাঁচতে পারে। পুরুষতন্ত্র বিদেয় হলেই পুরুষ যে পরাজিত হতে পারে, অসফল হতে পারে, পুরুষ যে শোকে কাঁদতে পারে-তা স্বাভাবিক হয়ে উঠবে। ব্যর্থ হওয়ার কারণে পুরুষকে লজ্জা এবং গ্লানি ভোগ করতে হবে না, হত্যা এবং আত্মহত্যার সিদ্ধান্ত নিতে হবে না। পুরুষজন্মের সার্থকতা শুধু অর্থনৈতিক সাফল্যে নয়। পুরুষ এবং নারী যদি নারী-পুরুষের সমানাধিকারে এবং সাম্যে বিশ্বাস করে, যদি তারই চর্চা করে, তাহলেই বিদেয় হবে পুরুষতন্ত্র, প্রতিষ্ঠিত হবে সমতার সমাজ। পুরুষকে সুপারহিরো হিসেবে নয়, মানবিক গুণাবলিসম্পন্ন মানুষ হিসেবে সমাজে বাস করতে হবে। সুখ-দুঃখ, আনন্দ-বেদনা, সাফল্য এবং ব্যর্থতা সবকিছুই, ধরে নিতে হবে, পুরুষের এবং নারীর জীবনে স্বাভাবিক। পুরুষকে এও মনে রাখতে হবে, স্ত্রী সন্তান তাঁর সম্পত্তি নয়, তাদের হত্যা করার অধিকার তাঁর নেই। সমতার সমাজে প্রত্যেক ব্যক্তিরই বাঁচার স্বাধীনতা এবং অধিকার সমান।

পুরুষতন্ত্রের শিকার শুধু নারী নয়, পুরুষও। সে কারণেই শুধু নারীকে পুরুষতন্ত্রের বিরুদ্ধে সংগ্রাম করলে চলবে না, পুরুষকেও করতে হবে।

২. মনীষা বাল্মিকীর কথা মনে আছে? এক গরিব মেয়ে মনীষাকে চারটে বীরপুরুষ ধর্ষণই শুধু করেনি, মনীষার মেরুদন্ড ভেঙে দিয়েছে, জিভও কেটে নিয়েছে। কেন করেছে ওরা এই নির্যাতন? কারণ মনীষা মেয়ে। অন্যদের মতো আমি বলবো না কারণ মনীষা নীচু জাত। কেন, উঁচু জাত বুঝি ধর্ষণের শিকার হয় না? হয়। ভারতে এই জাতপাত আইনত নিষিদ্ধ হলেও এটি সকলে মেনে চলে। ওপরে ওপরে না মানলেও ভেতরে ভেতরে মানে। আমার কত প্রগতিশীল বন্ধুর শার্টের ফাঁক দিয়ে দেখেছি উঁকি দিচ্ছে সাদা পৈতে। জাত গোত্র হাবিজাবি সব দেখে তবে এরা বিয়ে করে। পুরুষতন্ত্রের বিচারে মেয়েদের একটাই জাত, সেটা হলো নীচু জাত। সুতরাং মেয়েদের উঁচু নিচু সব জাতের পুরুষই ধর্ষণ করতে, হত্যা করতে দ্বিধা করে না।

মনীষা শেষ পর্যন্ত বাঁচতে পারেনি। গরিবের মৃত্যুতে কারও কিছু যায় আসে না। কিন্তু যেহেতু মনীষার হাল অনেকটা নির্ভয়ার মতো, গণধর্ষণের পর মৃত্যু ... তাই পুরনো প্রতিবাদ মনে পড়েছে লোকের। চেঁচিয়ে কিচ্ছু হবে না। চেঁচিয়ে, ধর্ষকদের ফাঁসি দিয়ে কিচ্ছু হয়নি, ধর্ষণ বন্ধ করা যায়নি। ফাঁসির চেয়েও যেটি ভয়াবহ, সেটির নাম পুরুষতন্ত্র। পুরুষেরা ফাঁসির ভয় ভুলে যায়, পুরুষতন্ত্রের শিক্ষা ভোলে না।

যতদিন নবজাতকের পুরুষাঙ্গ দেখে পরিবারের লোকেরা আনন্দে আত্মহারা হবে, যতদিন মেয়ে-জন্ম অনাকাক্সিক্ষত থাকবে, যতদিন পণপ্রথা টিকে থাকবে, যতদিন মেয়েরা যৌনবস্তু হিসেবে চিহ্নিত হবে, যতদিন মেয়েরা বিয়ের পর শ্বশুরবাড়ি থাকতে যাবে, যতদিন সিঁদুর শাঁখা হিজাব বোরখা পরতে হবে, যতদিন স্বামীর নামে পরিচিত হবে, যতদিন পুরুষ প্রভু নারী দাসীর কাঠামো রয়ে যাবে, যতদিন বেশ্যাপ্রথার অস্তিত্ব থাকবে, যতদিন পিতৃতন্ত্র বা পুরুষতন্ত্র বজায় থাকবে, ততদিন ধর্ষণ চলবে। কারণ ধর্ষণ ব্যাপারটা আগাগোড়া পুরুষতান্ত্রিক, আগাগোড়াই নারী-বিদ্বেষ। ধর্ষণ যারা করে তারা জন্মের পর থেকেই পুরুষতন্ত্র দ্বারা মগজধোলাই হওয়া, তারা মনেপ্রাণে বিশ্বাস করে নারীকে ভোগ করা, নির্যাতন করা, নারীকে মেরে ফেলা, কেটে ফেলার একশ’ভাগ অধিকার তাদের আছে।

৩. সতীদাহ বন্ধ হয়েছে, কিন্তু নারীবিরোধী অনেক প্রথাই বেশ বহাল তবিয়তে বেঁচে আছে ভারতীয় উপমহাদেশে। এ সব দূর করার কোনও উদ্যোগ তো নেওয়া হচ্ছেই না, বরং আরও ঘটা করে পালন করার ব্যবস্থা হচ্ছে, আরও জাঁকালো উৎসব হচ্ছে এসবের। কিছু দিন আগেই বাঙালি বিবাহিত মেয়েদের ‘সিঁদুর খেলা’ হলো। দুর্গা প্রতিমা বিসর্জনের দিন পরস্পরের মাথায় মুখে গালে কপালে চিবুকে নাকে কানে সিঁদুর মাখামাখি চলল। সিঁদুর খেলার একটিই উদ্দেশ্য, স্বামীর দীর্ঘায়ু। বিধবা আর অবিবাহিতদের জন্য সিঁদুর খেলা বারণ। বারণ, কারণ তাদের স্বামী নেই! মাথায় তাদের সিঁদুর ওঠেনি, অথবা সিঁদুর মুছে ফেলা হয়েছে।

দুজন প্রাপ্তবয়স্ক মানুষ বিয়ে করার পর একজনের শরীরে শাঁখা সিঁদুর পলা লোহার উপদ্রব চাপানো হয়, আর একজনের শরীর আক্ষরিক অর্থে রয়ে যায় যেমন ছিল তেমন। কেউ কি এই প্রশ্নটি করে : যে কারণে বিবাহিত মেয়েরা শাঁখা সিঁদুর পলা লোহা পরছে, সেই একই কারণে কেন বিবাহিত পুরুষেরা শাঁখা সিঁদুর লোহা পরছে না? অথবা যে কারণে বিবাহিত পুরুষেরা শাঁখা সিঁদুর পলা লোহা পরছে না, সেই একই কারণে কেন বিবাহিত মেয়েরা ওসব পরা থেকে বিরত থাকছে না?

সাফ কথা হলো, পুরুষ বিশ্বাস করে এবং নারীকেও বিশ্বাস করতে বাধ্য করে যে এই বিশ্বব্রহ্মান্ডে সব চেয়ে মূল্যবান বস্তুটি- মানুষ প্রজাতির মধ্যে পুরুষ নামক যে প্রাণীটি আছে, তার ঊরুসন্ধিতে- সেটি। সেটি যাদের আছে, তাদের গায়ে কোনও উপদ্রব চাপাতে হয় না! তাদের জীবনসঙ্গী বা স্ত্রীটির সুস্থ থাকার জন্য, তার পরমায়ুর জন্য, তার ধনদৌলত লাভের জন্য ভগবানের কাছে প্রার্থনা করার কোনও আচার-অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণ করতে হয় না, স্ত্রীর মঙ্গলকামনায় তাদের দিনভর উপোস করতে হয় না, সিঁদুর খেলতে হয় না! পুরুষতান্ত্রিক সমাজে প্রতি দিন সকাল সন্ধে যে পুজোটি চলে, সে পুংলিঙ্গ পুজো। পুরুষেরা সমাজের ঈশ্বর, মহাশক্তিমান, মহাক্ষমতাবান, পুরুষেরা নারীর প্রভু, অভিভাবক, কর্তা, দেবতা। পুরুষের আরও ক্ষমতা, আরও প্রভাব, প্রতাপ এবং প্রাচুর্য বৃদ্ধির জন্য, পুরুষের দীর্ঘজীবন এবং অমরত্বের জন্য, নারীদের, দুর্বলদের, দুর্ভাগাদের, দলিতদের, নির্যাতিত, নিপীড়িতদের উপোস করতে হয়, প্রার্থনা করতে হয়। পুরুষের মঙ্গলকামনায় ভাইফোঁটা, শিবরাত্রি, রাখি, শ্রাবণ সোমবার কত কিছুই সারা বছর পালন করছে নারীরা!

নারী শিক্ষিত হচ্ছে, এমনকী স্বনির্ভর হচ্ছে, স্বামীর ওপর অর্থনৈতিক নির্ভরতা অনেকের প্রায় নেই বললেই চলে, স্বামী ছাড়া চলবে না- এমন কোনও ব্যাপারই নেই, এমন নারীও পুরুষতান্ত্রিক বিধিব্যবস্থাগুলো দিব্যি মাথা পেতে মেনে নিচ্ছে! কেউ প্রশ্ন করছে না, বিয়ের পর কেন নারীর পদবি পালটাতে হবে, পুরুষের নয়? কেন নারীকে শ্বশুরবাড়িতে বাস করতে হবে, কেন স্ত্রীর মতো পুরুষের কর্তব্য নয় শ্বশুরবাড়িতে বাস করা আর শ্বশুর-শাশুড়ির সেবা করা? পণের নিয়ম যদি মানতেই হয়, শুধু স্ত্রী কেন স্বামীকে দেয়, স্বামী কেন স্ত্রীকে পণ দেয় না?

ভারতবর্ষের বেশ কিছু রাজ্যের বিবাহিত মেয়েরা ‘করবা চৌথ’ পালন করে। এই উৎসবটা মূলত- স্বামী দীর্ঘজীবী হোক, অনন্তকাল বেঁচে থাকুক, স্বামীর অসুখ-বিসুখ না হোক, দুর্ঘটনা না ঘটুক, আমাদের যা-ইচ্ছে-তাই হোক, আমাদের সুস্থতা গোল্লায় যাক, আমাদের দীর্ঘজীবনের বারোটা বাজুক-এর উৎসব। সূর্যোদয় থেকে চন্দ্রোদয় অবধি স্বামীর সুস্বাস্থ্যের জন্য উপোস। চাঁদ দেখবে তবে জলস্পর্শ করবে লক্ষ লক্ষ পতিব্রতা স্ত্রী। এটিও ওই পুংপুজো। এই সব আচার-অনুষ্ঠানের একটিই সার কথা : সংসারে স্ত্রীর নয়, স্বামীর জীবনটি মূল্যবান।

লক্ষ করার, দরিদ্র অশিক্ষিত পরনির্ভর মেয়েরা নয়, পুরুষতান্ত্রিক আচার-অনুষ্ঠানগুলো বেশির ভাগই পালন করছে উচ্চবিত্ত-মধ্যবিত্ত শ্রেণির শিক্ষিত স্বনির্ভর মেয়েরা। এই মেয়েরাই কিন্তু আজকাল ধর্ষণ এবং অন্যান্য নারী নির্যাতনের বিরুদ্ধে খুব সরব, কিন্তু সিঁদুর খেলা বা করবা চৌথ পালন করছে রীতিমতো উৎসব করে। ধর্ষণ, নারী নির্যাতন, করবা চৌথ, সিঁদুর খেলা- সবই পুরুষতন্ত্রের নারীবিরোধী উপসর্গ।

নারীবিরোধী এসব অনুষ্ঠান নিয়ে তুমুল বাণিজ্যও হচ্ছে। করবা চৌথ-এর চোখধাঁধানো উৎসব এখন সিনেমায়, থিয়েটারে, টিভি সিরিয়ালে। বিজ্ঞাপনে পুরুষতান্ত্রিক আচারাদিতে অলংকৃত লাস্যময়ী নারীদের ঝলমলে দৃশ্য। যে মেয়েরা দূর থেকে দেখে এসব, দুঃখ-দুর্দশার জীবন যাদের, তাদের ইচ্ছে হয় ওই সাজগোজ করা ফর্সা ফর্সা সুখী সুখী মেয়েদের মতো উৎসব করতে। তারাও এক সময় ফাঁদে পা দেয়, বাণিজ্যের ফাঁদে। শাড়ি গয়না কেনার ফাঁদ। এমনিতেই এই সমাজ মেয়েদের পণ্য বলে ভাবে। পুংপুজোর আচারে অংশ নিয়ে মেয়েরা নিজেদের আরও বড় পণ্য করে তোলে। এসব করে যত বেশি পুরুষকে মূল্যবান করে মেয়েরা, তত বেশি নিজেদের মূল্যহীন করে। পুরুষতান্ত্রিক অসভ্যতাকে, অসাম্যকে, লিঙ্গবৈষম্যকে, নারী-বিদ্বেষকে, নোংরামোকে কেবল সহনীয় নয়, আদরণীয় আর আকর্ষণীয় করার পাঁয়তারা চলছে চারদিকে। যে সব রাজ্যে করবা চৌথ পালন করা হতো না, এখন সে সব রাজ্যেও পালন হয়। পুরুষতন্ত্র বড্ড সংক্রামক।

পুং-রা যে সমাজে প্রতি দিন বধূহত্যা করছে, বধূনির্যাতন করছে, ধর্ষণ করছে, গণধর্ষণ করছে, কন্যাশিশু হত্যা করছে, সেই সমাজে আড়ম্বর করে মেয়েরাই পুংপুজো করছে। এমন চলতে থাকলে, পুং-দের বোধোদয় কি আদৌ ঘটবে কোনও দিন? পুং-আধিপত্যবাদের কৌশল শিখে বেড়ে ওঠা পুরুষেরা কি মাথা থেকে ঝেড়ে ফেলতে পারবে যা শিখেছে সব?

এই সমাজে সমানাধিকারের কোনও চর্চাই নেই নারী পুরুষের সম্পর্কে। পুরুষ মনে করে তার পুরুষত্ব খানিকটা খসে গেলে বুঝি অপমান হবে তার, নারী মনে করছে তার নারীত্ব কিছুটা কমে গেলে রক্ষে নেই। এক-একজন প্রাণপণে বজায় রাখতে চায় পুরুষ আর নারীর জন্য সমাজের বানানো চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য। যদি ধরেই নিই পুরুষের ভেতর তথাকথিত এই পুরুষত্ব আর নারীর ভেতর তথাকথিত এই নারীত্ব আছে, তবে নিশ্চয় করে বলতে পারি, পুরুষের ভেতর যা আছে তার একশ’ভাগই পুরুষত্ব, নারীর ভেতর যা আছে তার একশ’ভাগই নারীত্ব- এ সম্পূর্ণ ভুল ধারণা। সমাজ চোখ রাঙায় বলে পুরুষ প্রকাশ করতে চাইছে না তার ভেতরে যেটুকু নারীত্ব আছে সেটুকু। নারীকে প্রকাশ করতে বাধা দেওয়া হয় তার ভেতরের পুরুষত্বটুকু। যদি সমাজের বাধা না থাকত, যদি সবাই সত্যি সত্যি খুলে মেলে ধরতে পারত নিজেদের সত্যিকার চরিত্র, তা হলে সমতা আসত সম্পর্কে। পুরুষও কাঁদত, শিশু পালন করত, ভালোবাসার মানুষকে রেঁধে খাওয়াত। কিন্তু পুরুষতান্ত্রিক সমাজ যে মাথার ওপর বসে খবরদারি করছে। পুরুষকে শুধু নৃশংসতা করে যেতে হবে, নারীকে শুধু সর্বংসহার মতো সয়ে যেতে হবে। যতই যা হোক, নারী কিন্তু প্রমাণ করেছে পুরুষ যা পারে নারীও তা পারে। নারী পুরুষের মতো পাহাড়ের চূড়োয় উঠতে পারে, সাত সমুদ্র তেরো নদী পেরিয়ে বাণিজ্য করতে যেতে পারে। পুরুষ কিন্তু আজও প্রমাণ করতে পারছে না নারী যা পারে, তা পুরুষও পারে। ঘরদোর সাফ করা, ঘরের রান্নাবান্না করা, শিশুর লালন পালন- এ সব এখনও করছে না পুরুষেরা। যত দিন না করবে, তত দিন এ কথা বলার উপায় নেই যে সংসারে বৈষম্য নেই।

যত দিন সমাজে পুরুষতন্ত্র টিকে আছে, তত দিন এই সমাজ কাউকে সমতার আর সমানাধিকারের দিকে হাত বাড়াতে দেবে না। একের অধীনতা ও অন্যের আধিপত্য ঘোচাতে হলে যেমন আধিপত্য তন্ত্রটাকেই নির্মূল করতে হয়, নারী ও পুরুষের বৈষম্য ঘোচাতে হলে পুরুষতন্ত্রকেও নির্মূল করা প্রয়োজন। ‘পণপ্রথা বন্ধ করো’, ‘ধর্ষণ বন্ধ করো’ বলে সারা বছর চেঁচালেও এসব উপসর্গ কখনও উবে যাবে না। যত দিন রোগটা আছে, উপসর্গগুলো ঘাপটি মেরে থেকেই যাবে। রোগটা সারাতে হবে।

লেখক : নির্বাসিত লেখিকা।

সর্বশেষ খবর