রবিবার, ২১ নভেম্বর, ২০২১ ০০:০০ টা

নির্বাচনী রাজনীতি ও ধর্ম

স্বদেশ রায়

নির্বাচনী রাজনীতি ও ধর্ম

এশিয়া ও আফ্রিকার অনেক দেশে এখন রাজনীতিতে ধর্মের প্রভাব অনেক বেশি। যত না মানুষের ব্যবহারিক ধর্মের প্রভাব তার থেকে ধর্ম ব্যবসায়ীদের ধর্মের প্রভাব অনেক বেশি। আফ্রিকার সুদান মাত্র ১০ বছর আগে ধর্মের নামে দুই ভাগ হলেও আফ্রিকার অন্য দেশগুলোয় ভোটের রাজনীতির থেকে ধর্মের প্রভাবে গোষ্ঠীগত সংঘাতের মতো সংঘাত এখনো নিয়মিত ঘটনা। অন্যদিকে এশিয়ায় এ মুহূর্তে জাপান ছাড়া যত দেশে ভোটের রাজনীতি আছে তার অধিকাংশ দেশেই ‘ব্যবসায়িক ধর্মের’ প্রভাব অনেক বেশি। ভোটের রাজনীতিতে এই ‘ধর্ম ব্যবসার রাজনীতি’র প্রভাব এ মুহূর্তে এশীয় দেশগুলোর মধ্যে বেশি ইন্দোনেশিয়া, মালয়েশিয়া, শ্রীলঙ্কা, ভারত, পাকিস্তান, মিয়ানমার ও বাংলাদেশে। এশিয়ার এই গণতান্ত্রিক দেশগুলোর মধ্যে সব থেকে বেশি দিন গণতন্ত্র চর্চা করার সুযোগ পেয়েছে ভারত। ভারতে নব্বইয়ের দশকের আগ অবধি ভোটের রাজনীতিতে ধর্ম ব্যবসা খুব বেশি সুযোগ পায়নি। নব্বইয়ের পরের থেকে ধীরে ধীরে এটা বড় বিষবৃক্ষ হচ্ছে। পাকিস্তানেও কায়েদে আজম মুহাম্মদ আলী জিন্নাহর মৃত্যুর পর থেকে দেশটিকে একেবারে একটি ধর্মীয় রাষ্ট্র বানানোর চেষ্টা চললেও সেখানেও ভোটের রাজনীতিতে বর্তমানে যতটা ধর্ম ঢুকেছে এতটা ধর্ম নব্বইয়ের দশকের আগে ঢোকানো যায়নি। সেখানে গণতন্ত্রের বিরুদ্ধে সামরিক শাসনই মূল শত্রু ছিল। ইন্দোনেশিয়ায়ও সেটাই ছিল। ইন্দোনেশিয়ায়ও বর্তমানে ভোটের রাজনীতিতে যেভাবে ধর্মীয় প্রভাব এটা নব্বইয়ের দশকে মেঘবতী সুকর্নপুত্রির আমলেও ছিল না। মালয়েশিয়ায় বাস্তবে রাজনীতি ও সমাজে ধর্মকে প্রাধান্য দেওয়ার কাজ শুরু হয়েছে মাহাথিরের একটানা ক্ষমতার আমলের শেষের দিকে। শ্রীলঙ্কায়ও এ শতাব্দীতে এসে তামিল গণহত্যার পর দেশব্যাপী ধর্মীয় জিঙ্গোইজম জাগানো হয়েছে। বুদ্ধিস্ট সাম্প্রদায়িকতাকে রাজনীতিতে নিয়ে আসা হয়েছে। সে দেশের মানুষ আগে যেখানে সিংহলি ও তামিলে চিহ্নিত ছিল সেখানে সিংহলি বুদ্ধিস্ট, তামিল হিন্দু এবং সিংহলি ও তামিল মুসলিম হিসেবে দেশের মানুষ ও ভোটকে ধর্মের নামে ভাগ করা হয়েছে। মিয়ানমারে আশির দশকে যখন রেঙ্গুন বিশ্ববিদ্যালয় ঘিরে ছাত্র -গণ অভ্যুত্থান হয় সে সময়ও সে দেশের রাজনীতি ও বিশেষ করে সু চির রাজনীতি ছিল পরিপূর্ণ আধুনিক রাজনীতি। মিয়ানমারে রাজনীতিতে ধর্মের প্রকাশ ঘটে এ শতাব্দীতে এসে যখন সামরিক শাসনের বিরুদ্ধে ছাত্রদের চেয়েও বড় বিদ্রোহী হিসেবে আত্মপ্রকাশ করল ধর্মীয় নেতা ও তাদের অনুসারীরা তখনই। সে সময় বোঝা গেল মিয়ানমারের রাজনীতি ও সমাজে পরিবর্তন এসে গেছে। বাংলাদেশের রাজনীতিতে ’৯১ সালেই ভোটের রাজনীতিতে ধর্ম ব্যবসা একটা বড় বিষয় হয়ে দাঁড়ায় এবং তার জয়ও দেখা গেল। একবিংশ শতাব্দীতে এসে বর্তমানের এই সময় দাঁড়িয়ে দেখা যাচ্ছে, পাকিস্তান ও ভারতের রাজনীতিতে এখন ধর্মই সব থেকে বড় ছড়ি ঘোরাচ্ছে। পাকিস্তানের ডন পত্রিকাও লিখছে, সে দেশের সরকার ধর্মীয় জিহাদিদের সঙ্গে আপস করে পাকিস্তানি তালেবানদের জেল থেকে মুক্তি দিয়েছে। যা শুধু অপরাধীদের মুক্তি দেওয়া নয়, দেশকে ধর্মীয় জঙ্গিবাদের দিকে ঠেলে দেওয়া। অথচ পাকিস্তানের এত বড় ভয়াবহ ঘটনা সে দেশের সরকার ঘটালেও প্রধান বিরোধী দলগুলো এর বিরুদ্ধে কোনো টুঁশব্দ করেনি। মিয়ানমারে সু চি এখন বন্দী। এ লেখা যে মুহূর্তে লিখছি ওই সময়ে সে দেশের ব্রেকিং নিউজ হলো, নির্বাচনে কারচুপি ও দুর্নীতির অভিযোগ দায়ের করে মামলা শুরু করেছে সে দেশের সরকার সু চির বিরুদ্ধে। এটা বাস্তবে একটি সামরিক সরকার ও নির্বাচিত জনপ্রতিনিধির সংঘাতের বিষয়। কিন্তু বিশ্ববাসী জানে যে নির্বাচন নিয়ে এ মামলা- ওই নির্বাচনটি সঠিক ও সুষ্ঠু হয়েছিল। কিন্তু ওই সুষ্ঠু ও সঠিক নির্বাচনটি ধর্মীয় রাজনীতির কাছে মাথা নত করেই হয়েছিল। নির্বাচনে কোনো দলই তাদের দেশের সব থেকে বড় ঘটনা- আরাকান গণহত্যা ও ১০ লাখ আরাকানবাসীকে বাংলাদেশে তাড়িয়ে দেওয়ার বিষয়টি নিয়ে টুঁশব্দ করেনি। কারণ ওই গণহত্যায় নিহত লাখ লাখ আরাকানবাসী ও শরণার্থী হয়ে বাংলাদেশে আশ্রয় নেওয়া ১০ লাখ আরাকানবাসী বা মিয়ানমারের ওই নাগরিকরা ধর্মে মুসলিম। তাই সেখানে বুদ্ধিস্ট সাম্প্রদায়িকতা বা বুদ্ধিস্ট ধর্মাশ্রয়ী রাজনৈতিক পরিবেশের বিপরীতে গিয়ে সু চিও তাঁর দেশের গণহত্যা ও ১০ লাখ নাগরিককে দেশান্তরিত করার মতো বিষয়কে রাজনীতিতে আনেননি। বরং বিপরীতে গিয়ে দাঁড়িয়েছিলেন। মিয়ানমারের পাশের বড় গণতান্ত্রিক দেশ ভারতেও এখন একই অবস্থা, সেখানেও গণতন্ত্র, উন্নয়ন সব থাকা সত্ত্বেও নির্বাচন এলে বা ভোটের স্বার্থে নরেন্দ্র মোদি থেকে শুরু করে রাহুল গান্ধী, মমতা ব্যানার্জি সবাই কখনো পাগড়ি পরছেন, কখনো হিজাব পরছেন। আবার জাতপাতের ঠেলায় পড়ে মায়াবতী, অখিলেশ কখনো দলিত সাজছেন, কখনো ঠাকুর হচ্ছেন। বাংলাদেশেও কেউ কম যাচ্ছে না। ভোটের রাজনীতিতে সব দলই যখন যে নাটমঞ্চে উঠছে তখন সেভাবেই নাটক করে যাচ্ছে। আর যখন যার হাতের সুতোর টান পড়ছে তখন তার মতো করেই নেচে যাচ্ছে। সবাই ধর্ম ব্যবসায়ীদের ভয়ে কুঁকড়ে গিয়ে এমনটি করছে।

অথচ একটু পেছন ফিরে তাকালে ইতিহাসের অন্য পাতা দেখা যায়। এ মুহূর্তে ভারত, পাকিস্তান, শ্রীলঙ্কা, মিয়ানমার ও বাংলাদেশে যে ধর্মীয় সাম্প্রদায়িকতা তার থেকে অনেক বেশি ধর্মীয় সাম্প্রদায়িকতা ছিল এ উপমহাদেশে ১৯৪৫, ’৪৬ ও ’৪৭-এ। ধর্মের নামে একটি আস্ত ভূখণ্ডকে কেটে দুই ভাগ করতে হয়েছিল। সাম্প্রদায়িক দাঙ্গায় সেদিন কোটি কোটি মানুষ নিজের বাস্তুভিটা ছেড়ে উদ্বাস্তু হয়েছিল। লাখ লাখ মানুষ সাম্প্রদায়িকতার ছুরি, তরবারি ও কৃপাণে নিহত হয়েছিল। ট্রেনের বগিভর্তি লাশ বিনিময় হয়েছিল সেদিন। তার পরও ভারতে ১৯৫২ সালে প্রথম যে নির্বাচন হয় তাতে কোনো দলকে কিন্তু ভোট পাওয়ার জন্য ধর্ম ব্যবসায়ীদের রাজনীতিকে কাজে লাগাতে হয়নি। এ ধারা আশির দশক অবধি ভারতে ঠিকভাবেই চলে। অন্যদিকে এই বাংলাদেশ অর্থাৎ তৎকালীন পূর্ববঙ্গসহ গোটা পাকিস্তানে প্রথম নির্বাচন হয়েছিল ১৯৫৪-তে। চুয়ান্নর ওই নির্বাচনে ভোটের রাজনীতিতে কাউকে ভীত হয়ে ধর্মকে ব্যবহার করতে হয়নি। ১৯৫৪-এর পূর্ববাংলার রাজনীতি সম্পর্কে সবাই জানেন, সে নির্বাচনে যে যুক্তফ্রন্ট জিতেছিল তার কিন্তু কোনো ধর্মের মঞ্চে উঠে নাচতে হয়নি। বরং ইতিহাসের পাতা জ্বলজ্বল করে এখনো ওই নির্বাচনের বিজয়ের মূল ভিত্তি একুশ দফাতে। বিশ নয়, বাইশ নয়- একুশ দফা করা হয়েছিল ভাষা আন্দোলনের একুশে ফেব্রুয়ারি স্মরণ করে। আর একুশ দফায় কোথাও ধর্মের সঙ্গে কোনো আপস ছিল না, বরং ছিল অর্থনৈতিক, সামাজিক, রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক মুক্তির কথা। অন্যদিকে ভারতের ১৯৫২-এর নির্বাচনের মূল নেতা ছিলেন জওহরলাল নেহরু, যাঁর গায়ে ভারত ভাগ করার দাগ ছিল, তার পরও তাঁকে কিন্তু নির্বাচনে জেতার জন্য ধর্মকে ব্যবহার করতে হয়নি। ১৯৭০-এর পাকিস্তানের নির্বাচনে বিপুল বিজয় পেতেও বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে একফোঁটা ধর্ম সাম্প্রদায়িকতা বা মৌলবাদিতার রাজনীতি ব্যবহার করতে হয়নি। কেন তাদের সেদিন ওই ধর্মের বিষের রক্তাক্ত সাগর পাড়ি দেওয়ার পরও নির্বাচনী রাজনীতিতে ধর্মকে ব্যবহার করতে হয়নি তার উত্তর ইতিহাসবিদ ও গবেষকরা সব থেকে ভালো দেবেন। তবে সাধারণ চোখে দেখা যায়, সেদিন তাঁরা কেউই কিন্তু রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠান ও রাজনৈতিক সংগঠন দুটোর কোনোটাই নষ্ট করেননি। ভারতে ১৯৫২ সালের ওই নির্বাচনে দেখা যায়, রাজনীতির সঙ্গে জড়িত রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠান ও রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠান দুটোই সঠিকভাবে বিকশিত হওয়ার পথে হাঁটতে শুরু করেছে। ঠিক একই ধারা দেখা যায়, ১৯৫৪ -এর নির্বাচনে। ওই নির্বাচনে ক্ষমতাসীন মুসলিম লীগের ভরাডুবি হয়েছিল এই পূর্ববাংলায়, কিন্তু নির্বাচনের সঙ্গে জড়িত কোনোরূপ কোনো রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানকে নূরুল আমিন সরকার নষ্ট করেনি। পাকিস্তানে ও বাংলাদেশে গণতন্ত্র সেই ধারাবাহিকতায় এগোতে পারেনি মূলত সামরিক শাসনের ফলে। কিন্তু ভারতে ১৯৭৫-এর জরুরি আইনের পূর্ব অবধি যে স্বাচ্ছন্দ্য গণতান্ত্রিক ধারা ছিল তা মূলত ওই রাষ্ট্রীয় ও রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠানগুলোকে সঠিকভাবে গড়ে ওঠার সুযোগ দেওয়ার ফলে।

তাই এখন এশীয় এ দেশগুলোর রাজনীতিতে কেন ধর্মের কাছে আত্মসমর্পণ? কেন মালয়েশিয়া, ইন্দোনেশিয়া থেকে শুরু করে ভারত, বাংলাদেশ ও মিয়ানমারের রাজনীতিবিদরা ভোটের রাজনীতির স্বার্থে এভাবে ধর্ম ব্যবসায়ীদের লালন করছেন? শুধু যে লালন করছেন তা নয়, নিজস্ব রাজনৈতিক সংগঠনে ও মগজে এই ধর্ম ব্যবসাকে ঢুকে পড়ার সুযোগ দিচ্ছেন। কেন নিজেকে এই অপচিন্তার সপক্ষ শক্তি হিসেবে দাঁড় করাচ্ছেন? এ বিষয়গুলোর সব উত্তর পেতে হলে অনেক গবেষণার দরকার। তবে সহজভাবে যেটুকু দেখা যায় তার মূলে হলো, রাজনৈতিক শক্তিগুলো তাদের রাজনৈতিক আদর্শভিত্তিক সংগঠনের কাঠামো হারিয়ে ফেলেছে। অন্যদিকে ধর্ম ব্যবসায়ীরা তাদের ধর্ম ব্যবসাভিত্তিক সাংগঠনিক কাঠামো অনেক বেশি শক্তিশালী করেছে। এ ছাড়া রাজনৈতিক শক্তিগুলো দুর্বল করে ফেলেছে তাদের রাষ্ট্রীয় সব কাঠামো। এ সাংগঠনিক ও রাষ্ট্রীয় কাঠামোর দুর্বলতাই আজকের এশীয় এ দেশগুলোর ধর্ম ব্যবসায়ীদের কাছে আত্মসমর্পণের অন্যতম কারণ। আর ওই দুর্বলতার কারণেই রাষ্ট্র ও রাজনীতি ধর্ম ব্যবসায়ীদের অনেক বেশি শক্তিশালী মনে করছে। বাস্তবে তারা শক্তিশালী নয়। একটা মিথ্যা অন্ধকারে পড়ে তাদের শক্তিশালী মনে করা হচ্ছে। তাদের কাছে আত্মসমর্পণ করা হচ্ছে। আসলে আদর্শ এবং মেরুদণ্ড দুটোই অন্ধকারে হারিয়ে গেলে সবকিছুতে নুয়ে পড়া ছাড়া কোনো উপায় থাকে না।

লেখক : সাংবাদিক।

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর