মঙ্গলবার, ৩০ নভেম্বর, ২০২১ ০০:০০ টা

ভাঙা ঘরের শিশু : কোন পাপে শাস্তি পায়?

খায়রুল কবীর খোকন

ভাঙা ঘরের শিশু : কোন পাপে শাস্তি পায়?

বাংলা সংগীত জগতের কিংবদন্তি ড. ভূপেন হাজারিকার একটি গান ‘মানুষ মানুষের জন্য’ কোটি কোটি বার বাঙালি সংগীতপ্রেমীরা শুনেছেন, এখনো একান্ত মনোযোগের হৃদয় দিয়ে শোনেন, যেমন শোনেন তাঁর অন্য গানগুলো। কিন্তু সেই গানের ভিতরের বাণী (‘মানুষ মানুষের জন্য-একটু সহানুভূতি কি মানুষ পেতে পারে না!’) থেকে আমরা কি কিছু শিখতে পারলাম? না, কিছুই শিখতে পারিনি। আসলে কি কিছু শিখতে চেয়েছি কখনো? এক কান দিয়ে শুনে আরেক কান দিয়ে বের করে দিয়েছি শুধু। তাই তো বলতে পারি- এতটুকু মানবিকতা কি আমরা দেখাতে পারছি নিদারুণ অসুস্থ বেগম খালেদা জিয়ার জন্য? তাঁর চিকিৎসা পাওয়ার অধিকার কি নেই! যেখানে তাঁর সঠিক চিকিৎসা চলতে পারে সেই মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র বা ইউরোপে তাঁকে পাঠিয়ে দিলে বাংলাদেশ রাষ্ট্রের কী এমন ক্ষতি হবে? স্বৈরাচার এরশাদবিরোধী আন্দোলনের ও গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার আপসহীন নেতা, তিনবারের প্রধানমন্ত্রী, একজন শীর্ষ রাজনীতিক, বিরোধী দল বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়া কি এ দেশের মানুষের কাছে তাঁর জীবন রক্ষার শেষ সাহায্যটুকুও চাইতে পারেন না! তাহলে দেশবাসী সাধারণ মানুষ কেন নীরব? তিনি তো শুধু বিএনপি নেতা নন, বাংলাদেশের উন্নয়নের একজন রূপকারও। তিনি তো এ দেশের রাষ্ট্রনায়ক, উন্নয়নের রূপকার জিয়াউর রহমানের সহধর্মিণীও। আমরা দেখছি এই বাংলাদেশে মানুষের প্রতি মানুষের নিষ্ঠুরতা কত দূর যেতে পারে; আওয়ামী লীগ শীর্ষ নেতারা কত দূর মানবিক হতে পারেন, কতটুকু পারেন না।

সে তো গেল এক নিদারুণ কাহিনি। আরেক নির্মমতা দেখুন, শুনুন সেই করুণ কাহিনি। জাপানি মা এরিকো নাকানো আর বাংলাদেশি বাবা ইমরান শরীফের দুই কন্যাসন্তান নিয়ে যে যুদ্ধটা চলল তাকে কী বলবেন পাঠক? পত্রিকা পাঠক সবারই জানা, বাংলাদেশি নাগরিক ইমরান শরীফ আর জাপানি নাগরিক এরিকো নাকানো ভালোবেসে ২০০৮ সালের ১১ জুলাই জাপানে বিয়ে করেছিলেন। তাঁদের দাম্পত্য জীবনে একের পর এক কন্যাসন্তানের জন্ম হয়। এ তিন কন্যার বাবা-মার মধ্যে ভালোবাসা চলে গেল, এক যুগও লাগল না। তাই তাঁদের বিবাহবিচ্ছেদের পথে এগোতে হলো; সেটা এমনই জরুরি হয়ে পড়ল যে বিশ্বব্যাপী এ করোনা মহামারীর ভয়ংকর শোকাবহ এক পরিস্থিতিও তাঁদের শান্ত রাখতে পারল না। তাঁদের প্রথম মেয়েটির বয়স ১১, দ্বিতীয়টির ১০ আর তৃতীয়টির ছয় বছর (সম্ভবত)। জাপানি আদালতে ইমরান-এরিকো দম্পতির বিবাহবিচ্ছেদের আবেদন পেশের পর এ বছর ২১ ফেব্রুয়ারি ইমরান শরীফ তাঁদের বড় দুই মেয়েকে (প্রথম ও দ্বিতীয়) সুকৌশলে সঙ্গে নিয়ে বাংলাদেশে চলে এলেন। সন্তানবিচ্ছিন্ন মা এরিকো দিশাহারা হয়ে পড়লেন। এর মধ্যে করোনা পরিস্থিতির অবনতির কারণে আবার বিমান চলাচল বন্ধ হয়ে গেল। শেষে বিমান চলাচল শুরু হলেই এরিকো ছুটে এলেন ঢাকার পানে মেয়েদের সন্ধানে, জন্মদাত্রী মা বলে কথা! তাঁর দাবি তাঁকে না জানিয়ে তাঁর সাবেক স্বামী ইমরান তাঁদের বড় দুই মেয়েকে নিয়ে পালিয়ে বাংলাদেশে চলে এসেছেন। এরিকো জাপানে তাঁর মায়ের কাছে তাঁদের তৃতীয় মেয়েটিকে রেখে বাংলাদেশে আসেন ১৮ জুলাই বড় দুই মেয়েকে আইনি লড়াইয়ের মাধ্যমে পাওয়ার আশায়। তিনি এখানে এসেই বাংলাদেশের হাই কোর্টে বিচারপ্রার্থী হলেন। অন্যদিকে ইমরান শরীফ তাঁদের তৃতীয় মেয়েটিকেও নিজের কাছে নিয়ে আসার দাবিতে হাই কোর্টে রিট পিটিশন করলেন। চলল তিন সন্তানকে নিয়ে বাংলাদেশি যুবক ইমরান শরীফ আর জাপানি যুব-মহিলা এরিকো নাকানোর এক ভয়ানক যুদ্ধ। মাঝখানে তিন সন্তান তাদের বাবা-মায়ের এ লড়াইয়ে বিধ্বস্ত দশায়, নিদারুণ অসহায়, হৃদয় বিদীর্ণ করা আর্তনাদই যাদের একমাত্র ভরসা। আর দুই দেশের নাগরিকরা দেখলেন, বিশ্ববাসী সচেতন পত্রিকা পাঠকরা, টিভি মিডিয়ার দর্শকরা জানলেন দুই বাবা-মায়ের এক অপ্রয়োজনীয় যুদ্ধের বিভীষিকা, যে যুদ্ধে কোনো আগ্নেয়াস্ত্র লাগে না, জীবাণুযুদ্ধ লাগে না, পারমাণবিক অস্ত্র লাগে না। তবে ধ্বংসযজ্ঞ যা হয় তা তুলনাহীন। তাতে রক্তাক্ত হয় ওই তিনটি শিশু, আর অগণন বিশ্ব মানুষ যাদের প্রত্যেকের সজীব হৃদয় আছে; এবং শেষাবধি এই বাংলাদেশি যুবক ইমরান আর জাপানি যুব মহিলা এরিকো। আর শেষ কথা হলো- এ যুদ্ধে কখনো কেউ জিতবে না, হারবে মানবতাবোধ, হারবে অগণন বিশ্ববাসী- এই অসহায় তিনটি শিশুর জন্য কিছু করতে না পারার জন্য।  শেষাবধি যদিও দুই মাননীয় বিচারপতি (বিচারপতি এম ইনায়েতুর রহিম ও বিচারপতি মো. মোস্তাফিজুর রহমান) সমন্বয়ে গঠিত বাংলাদেশের হাই কোর্ট বেঞ্চ একটা সমাধানের ব্যবস্থা করে দিয়েছে। দুই মেয়ে থাকবে তাদের বাবা ইমরান শরীফের কাছে ঢাকায়, আর তাদের মা এরিকো নাকানোর কাছে থাকবে তৃতীয় মেয়েটি। এরিকোকে ইতিমধ্যে তাঁর খরচের ১০ লাখ টাকা দিতে হবে ইমরানকে আর বছরে (তিনবার/১০ দিন করে) মা এরিকোর ঢাকায় এসে দুই মেয়ের সঙ্গে সময় কাটানোর জন্য ১০ লাখ টাকা খরচ দেবেন ইমরান এবং এর বাইরে এরিকো নাকানো নিজ খরচে ঢাকায় এসে ইচ্ছামতো মেয়েদের সঙ্গে নিয়মমাফিক সময় কাটাতে পারবেন। (আদালত আরও কিছু নিয়ম বেঁধে দিয়েছে উভয় পক্ষের মেনে চলার জন্য)। আর তৃতীয় মেয়েটিকে ফিরে পাওয়ার জন্য বাবা ইমরানের দায়ের করা রিট হাই কোর্ট বেঞ্চ বাতিল করে দিয়েছে।

বাবা-মায়ের লড়াইয়ের মাঝখানে পড়ে শিশু সন্তানদের ‘বিনা দোষে শাস্তি পাওয়ার’ বিষয়ে সাবধান করেছিলেন এক ঘর ভাঙা সাংবাদিককে এক বিখ্যাত ব্যক্তিত্ব। তিনি নিজে সাংবাদিক এবং রাজনীতিক (এখন প্রয়াত), যিনি একটি প্রধান ছাত্র সংগঠনের সভাপতি হয়েছিলেন ষাটের দশকেই। তিনি বলেছিলেন, তাঁর অনুজপ্রতিম সেই সাংবাদিককে- ‘দেখ, তুমি যদি আজকে তোমার ছেলেমেয়েকে তাদের মায়ের কাছ থেকে কেড়ে আনতে চাও, হয়তো আইনের লড়াইয়ে সফল হলেও হতে পার, কিন্তু ভেবে দেখেছ কি যাদের তুমি তোমার কাছে আনবে বাবার ¯ন্ডেœহচ্ছায়ায় বড় করতে, মাতৃচ্ছায়া বঞ্চিত করে তাদের দেওয়া হবে একটা বড় শাস্তি। সেটা কি তুমি দিতে পার? কখনই না।’ (ঘটনাটি আমি নিজে জেনেছি আমার বড় ভাইতুল্য সেই ব্যক্তির কাছ থেকে; পারিবারিক ঘনিষ্ঠতার সূত্রে)।

সুহৃদ পাঠক! আপনারা যাঁরা এখন সত্তরোর্ধ্ব বা আশির এপারে-ওপারে, তাঁরা যাঁরা বিশ্ব চলচ্চিত্রের অনুরাগী তাঁদের জানা ঘটনাটি। ‘ক্র্যামার ভার্সেস ক্র্যামার’ অস্কার জেতা চলচ্চিত্র, সত্তরের দশকের শেষ ভাগে তৈরি হলিউডি সিনেমা। সমগ্র আমেরিকা ও ইউরোপ কাঁপিয়ে দিয়েছিল সেই ছায়াছবি (১৯৭৯ সালে মুক্তিপ্রাপ্ত)। বিশেষভাবে হৃদয়বান চলচ্চিত্রপ্রেমী মানুষের হৃদয়-মন ভেঙে চুরমার করে দিয়েছিল। অত্যন্ত সাদামাটা সাধারণ নাগরিক জীবনের গল্প, কিন্তু অসম্ভব হৃদয়স্পর্শী তার আবেদন। আমেরিকায় অল্প বয়সী এক বাবা আর কম বয়সী এক মায়ের দাম্পত্য কলহ লাগল। মাঝখানে ছয় বছর বয়সী শিশু সন্তান। আদালত অবধি গড়াল কার সঙ্গে থাকবে পুত্রসন্তানটি তার ফায়সালা নিয়ে। শ্রেষ্ঠ চলচ্চিত্র হয়েছে অস্কার পুরস্কারে, জিতেছে সেরা চিত্রনাট্য পুরস্কারও, নায়ক (ডাস্টিন হফম্যান) ও নায়িকা (মেরিল স্ট্র্রিপ) দুজনই শ্রেষ্ঠ অভিনেতা ও অভিনেত্রীর অস্কার জিতেছেন। কী আছে সেই ছায়াছবিতে? আছে মা-বাবার মধ্যে এক ভয়ানক যুদ্ধের মাঝে পড়ে নিরুপায় এক শিশু সন্তানের নিদারুণ অসহায়ত্ব; যে যুদ্ধে তার কোনো দায়দায়িত্ব নেই।

আমরা বিশ্বব্যাপী মা-বাবারা নিজেদের বেকুবপনায় দাম্পত্য কলহে জড়িয়ে পড়ে নিজেদের শিশু-কিশোর সন্তানদের নিদারুণ যুদ্ধশিকার বানাই, বিনা দোষে তাদের নিষ্ঠুর শাস্তি দিই, কিন্তু তারা তো কোনোভাবেই এ যুদ্ধের জন্য দায়ী নয়। আমরা যারা বাবা-মার যথার্থ দায়িত্ব পালনের বদলে নিজেদের সন্তানদের অবর্ণনীয় কষ্টের মধ্যে ছুড়ে ফেলে দিই তারা কি এক ধরনের ‘যুদ্ধাপরাধী’ নই? জাপানি নাগরিক এরিকো নাকানো একজন মা, তিনটি সন্তান জন্ম দিতে তাঁর যে কষ্ট ও বেদনা সহ্য করতে হয়েছে তাঁর প্রতি সহমর্মী হয়ে যদি ইমরান শরীফ শিশু তিনটিকে তাদের মায়ের কাছে থাকতে দিতেন কী এমন ক্ষতি হতো? তিনি তো জাপানে গিয়ে শিশু তিনটিকে দেখে আসতে পারতেন নিয়মমাফিক, জাপানি আদালতও তাঁকে সেই সুযোগ দিত। কিন্তু তিনি তা হতে দিলেন না, একেই কি বলে পুরুষতন্ত্র?

লেখক : বিএনপির যুগ্ম-মহাসচিব, সাবেক সংসদ সদস্য ও ডাকসু সাধারণ সম্পাদক।

সর্বশেষ খবর