বুধবার, ১ ডিসেম্বর, ২০২১ ০০:০০ টা

শেখ হাসিনার হৃদয়ের জখম ও খালেদা জিয়ার বিদেশ চিকিৎসা

পীর হাবিবুর রহমান

শেখ হাসিনার হৃদয়ের জখম ও খালেদা জিয়ার বিদেশ চিকিৎসা

দেশজুড়ে এখন আলোচনা বিএনপি চেয়ারপারসন ও সাবেক প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়া লিভার সিরোসিসে আক্রান্ত। তাঁর উন্নত চিকিৎসার জন্য দেশের বাইরে দল ও পরিবার নিয়ে যেতে চান। এ নিয়ে আইনি মারপ্যাঁচের বাহাস চলছে। সংসদের পঞ্চদশ অধিবেশনেও এ নিয়ে আলোচনা হয়েছে। সরকার থেকে বলা হয়েছে রাষ্ট্রপতির কাছে দোষ স্বীকার করে ক্ষমা চাইলেই তিনি দেশের বাইরে যেতে পারবেন। এ ছাড়া সরকারের হাতে কোনো পথ নেই। চাইলে বিদেশ থেকে বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক আনতে পারেন। পর্যবেক্ষকরা মনে করছেন একসময়ের দাপুটে প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়া মৃত্যুপথযাত্রী এবং রাজনীতিতে তাঁর যুগের অবসান হতে চলেছে বা হয়ে গেছেই। তবু সরকারের হাত অনেক লম্বা এবং চাইলে তারা চিকিৎসার জন্য বিদেশ যাওয়ার অনুমতি দিতে পারে। আইনমন্ত্রী যতই আইনের বাধা সামনে আনুন না কেন সরকার চাইলে আইনের সংশোধনও করতে পারে। বেগম খালেদা জিয়া দীর্ঘদিন ধরে নানা অসুখে আক্রান্ত। দুর্নীতি মামলায় দন্ডিত হয়ে জেল খাটা কয়েদি ছিলেন তিনি। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কাছে তাঁর পরিবারের আবেদনে মুজিবকন্যার মানবিক ভূমিকায় খালেদা জিয়া যে দুই শর্তে মুক্ত তার অন্যতম তিনি বিদেশ যেতে পারবেন না এবং দেশেই চিকিৎসা করাবেন। মানুষের জীবন-মৃত্যু সর্বশক্তিমান আল্লাহর হাতে। তবু বলা যায় একজন লিভার সিরোসিস রোগীর যখন রক্তপাত শুরু হয় তখন তার জীবনের সময় ফুরিয়ে আসছে বলে শঙ্কা দেখা দেয়। নিয়তির কি বিধান দেড় দশক আগেও যিনি ছিলেন অসীম ক্ষমতাধর সেই খালেদা জিয়া আজ জীবনের পড়ন্ত বেলায় হাসপাতালের শয্যায় কত অসহায়, কত রিক্ত নিঃস্ব! আমরা কেউ জানি না আল্লাহ কাল কার ভাগ্যে কী রেখেছেন।

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সর্বশেষ সংবাদ সম্মেলনে এক প্রশ্নের জবাবে বলেছেন খালেদা জিয়াকে মুক্তি দিয়ে তাঁর বাসভবনে রাখার মানবিক ভূমিকার কথা। এবং সেই সঙ্গে তাঁর হৃদয়ের তপ্ত দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলেছেন বুকের গভীরে জমানো বেদনার কথা। তাঁর পরিবারের প্রতি তাঁর নিজের প্রতি বারবার যে বীভৎস প্রতিহিংসার হিংস্র আঘাত এসেছে তার যন্ত্রণা অনুভব করার শক্তি বোধহীন সমাজে সবার নেই। বিশেষ করে ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট কালরাতে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে পরিবার-পরিজনসহ জাতীয় ও আন্তর্জাতিক ষড়যন্ত্রে বিশ্বাসঘাতক মীরজাফর খন্দকার মোশতাক আহমদ আর একদল নৃশংস নির্দয় খুনি বিপথগামী সেনাসদস্য বর্বরোচিতভাবে হত্যা করে দেশে খুনিদের শাসন কায়েম করে। তারা বঙ্গবন্ধু হত্যার বিচার হবে না বলে অধ্যাদেশই শুধু জারি করেনি, খুনিদের সহায়তায় রীতিমতো অসাংবিধানিক সরকার কায়েম করে। সেদিন সেনাপ্রধান জেনারেল শফিউল্লাহ কাপুরুষোচিত ভূমিকা রাখেন। ডেপুটি চিফ জেনারেল জিয়াউর রহমানসহ শীর্ষ সেনা কর্মকর্তারাও বিশ্বাসঘাতকতা করেন। তারাসহ সব বাহিনীর প্রধানরা খুনিদের প্রতি নির্লজ্জ আনুগত্য প্রকাশ করেন। অন্যদিকে বঙ্গবন্ধু ও তাঁর পরিবারকে রক্ষা দূরে থাক তারা সেদিন ধানমন্ডির ৩২ নম্বর বাড়িতে অযত্ন অবহেলায় পড়ে থাকা দেশের রাষ্ট্রপতির রক্তাক্ত লাশের পাশেও যাননি। তার জানাজার আয়োজনও করেননি। খুনিদের প্রতিরোধ দূরে থাক তাদের কর্তৃত্বকেই তারা মেনেছেন। অপরাধের সহযোগী হয়েছেন। জেনারেল শফিউল্লাহকে সরিয়ে জেনারেল জিয়া সেনাপ্রধান হন। পরে জেনারেল খালেদ মোশাররফ রক্তপাতহীন অভ্যুত্থানে খুনি মোশতাক চক্রের শাসনের অবসান ঘটালে তাঁকে জীবন দিতে হয়। আর জেলখানায় নিহত হন জাতীয় চার নেতা। সেদিন জাসদের উগ্র হঠকারী রাজনীতির অনুসারী কর্নেল তাহেরের কাঁধে ভর করে অবৈধভাবে রাষ্ট্রক্ষমতা দখল করেন জেনারেল জিয়া। তার সামরিক শাসনকালে সংবিধান থেকে মহান মুক্তিযুদ্ধে অর্জিত বঙ্গবন্ধুর আদর্শ নির্বাসিত হয়। একাত্তরে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর দোসর নিষিদ্ধ সাম্প্রদায়িক শক্তিকে রাজনীতিতে পুনর্বাসিত করা হয়। বঙ্গবন্ধুর খুনিদের রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতায় বিভিন্ন দূতাবাসে কূটনৈতিক চাকরিতে বহাল করা হয়। একের পর এক ‘হ্যাঁ-না’ ভোট, রাষ্ট্রপতি নির্বাচন, জাতীয় সংসদ নির্বাচনের মাধ্যমে প্রহসনের নির্লজ্জ নির্বাচন চলতে থাকে। ’৭৯ সালের সংসদে ইনডেমনিটি আইন পাস করে বঙ্গবন্ধু হত্যার বিচারে অসাংবিধানিক বাধা দাঁড় করানো হয়। বঙ্গবন্ধু কেবল রাষ্ট্রপতিই ছিলেন না, আজীবন সংগ্রামী এক গণমুখী অমিতসাহসী জাতীয় নেতা হিসেবে জীবনের ১৩টি বছর জেল-জুলুম সয়ে, দুবার ফাঁসির মঞ্চে গিয়েও আপস না করে গোটা জাতিকে ঐক্যবদ্ধ করে গণরায় নিয়ে সুমহান মুক্তিযুদ্ধে তাঁর স্বপ্নের বাংলাদেশকে স্বাধীন করে জাতির পিতা হন।

সেই জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে পরিবার-পরিজনসহ যেভাবে হত্যা করা হয়েছিল তা বিশ্বরাজনীতির ইতিহাসে এক কলঙ্কিত অধ্যায়। মানবসভ্যতার ইতিহাসে সংঘটিত সবচেয়ে হৃদয়বিদারক ঘটনা। সেদিন দেশের বাইরে থাকায় অলৌকিকভাবে বঙ্গবন্ধুর দুই কন্যা শেখ হাসিনা ও শেখ রেহানা বেঁচে যান। আগস্ট হত্যাকান্ডের সময় বঙ্গবন্ধুর কন্যারা ব্রাসেলসে নিযুক্ত বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত সানাউল হক খানের বাসভবনে ছিলেন। বঙ্গবন্ধুর অনুকম্পায় রাষ্ট্রদূত হওয়া সানাউল হক খানের বাসভবন ছিল সেদিন উৎসবমুখর। একই সময় জার্মানির রাষ্ট্রদূত ছিলেন দক্ষিণ এশিয়া কাঁপানো কূটনীতিক হুমায়ুন রশীদ চৌধুরী। লন্ডন হাইকমিশনের কূটনীতিক ফারুক চৌধুরীর কাছ থেকে হুমায়ুন রশীদ চৌধুরী ঢাকার খবর পেয়েছিলেন। তখনো গোটা পরিবারের হত্যাকান্ডের খবর পৌঁছেনি। বঙ্গবন্ধু হত্যাকান্ডের খবর পেয়ে সানাউল হক খান পারলে তড়িঘড়ি করে মুজিবকন্যাদের বাড়ি থেকে বের করে দেন। হুমায়ুন রশীদ চৌধুরী জার্মান সীমান্ত পর্যন্ত তাদের পৌঁছে দেওয়ার অনুরোধ জানিয়ে সেখান থেকে এনে তাঁর বাসভবনে পরম আতিথেয়তায় আশ্রয় দেন। নিরাপত্তার কথা বিবেচনা করে তিনি ভারতের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী ও সুমহান মুক্তিযুদ্ধের সাহসী বন্ধু শ্রীমতী ইন্দিরা গান্ধীর সঙ্গে যোগাযোগ করেন। দিল্লিতে শেখ হাসিনা স্বামী-সন্তান নিয়ে নির্বাসিত জীবনে যান। যাওয়ার সময় হুমায়ুন রশীদ চৌধুরী বলেছিলেন, ‘মা, একদিন তুমি ইন্দিরা গান্ধী হবে’। একবার কি ঠান্ডা মাথায় আমরা কখনো চিন্তা করেছি যে, একটি পরিবারে পিতা-মাতা-ভাইসহ সবাইকে নৃশংসভাবে হত্যা করার পর খুনিদের পুরস্কৃত করা হয়েছে এবং সেই হত্যাকান্ডের বিচারের পথও রুদ্ধ করে রাখা হলে জীবিত সদস্যের হৃদয়ে কতটা জখম ও আর্তনাদ হয়? সেদিন বঙ্গবন্ধু-অন্তঃপ্রাণ লাখো নেতা-কর্মীর হৃদয়ে যেখানে আর্তনাদ উঠেছে সেখানে তাঁর কন্যা শেখ হাসিনা ও শেখ রেহানার হৃদয়ের জখম কতটা গভীর ও যন্ত্রণাবিদ্ধ ছিল? কতটা তীব্র ছিল কষ্ট, কান্না ও যন্ত্রণার আর্তনাদ? সেদিন বঙ্গবন্ধুর অনুসারীদের খুনি চক্র থেকে সেনাশাসক জিয়াউর রহমান পর্যন্ত নির্দয় অত্যাচার-নির্যাতন, জেল-জুলুম ও নির্বাসিত জীবন দিয়েছেন। সেদিন বঙ্গবন্ধুর নাম ইতিহাস থেকে মুছেই ফেলা হয়নি, রীতিমতো তাঁর সংগ্রামমুখর জীবন ও নামকে নিষিদ্ধ করে রাখা হয়েছিল। রাষ্ট্রীয়ভাবে জাতীয় দিবসগুলো পালনে ছিল নির্লজ্জ প্রহসনের মাত্রা। প্রতিহিংসা আর মিথ্যাচারের বীভৎস চিত্রপটে ঢাকা। আওয়ামী লীগ ও ছাত্রলীগ বঙ্গবন্ধুর মহান আদর্শের চেতনায় উজ্জীবিত হয়ে ঘুরে দাঁড়ালেও দলের ঐক্যের প্রতীক হিসেবে ’৮১ সালের ইডেন কাউন্সিলে সর্বসম্মতভাবে আওয়ামী লীগের সভানেত্রী নির্বাচিত করা হয় ইতিহাসের রাজকন্যা শেখ হাসিনাকে। সেই কাউন্সিলের রজনীতে বঙ্গভবনে সেনাশাসক জিয়াউর রহমান নির্ঘুম ছিলেন। আশা করেছিলেন আওয়ামী লীগের ভাঙন। ভোরবেলা যখন তুমুল করতালিতে শেখ হাসিনার ঐক্যবদ্ধ আওয়ামী লীগের সভানেত্রী নির্বাচিত হওয়ার খবর পেলেন তখন তার সামরিক সচিব জেনারেল সাদেক আহমেদ চৌধুরীকে ‘দেশটা ইন্ডিয়া হয়ে গেল’ বলে বঙ্গভবন ত্যাগ করলেন। গোটা পরিবারের রক্তের ওপরও স্বজন হারানোর বেদনা নিয়ে আওয়ামী লীগের হাল ধরে শেখ হাসিনা তাঁর বাবার স্বাধীন করা স্বদেশে ফিরে আসুন তা সেদিন সেনাশাসক জিয়াউর রহমান চাননি। দেশে ফেরার পর দোয়া মাহফিল করানোর জন্য আমাদের মহান স্বাধীনতার ঠিকানা ধানমন্ডির ৩২ নম্বর বাড়িটি খুলে দেওয়া হয়নি। বাইরেই তাঁকে দোয়া মাহফিল পড়াতে হয়েছে। সেদিন স্বজন হারানোর বেদনায় রিক্ত-নিঃস্ব শেখ হাসিনার অশ্রুজলের সঙ্গে প্রকৃতি একাত্ম হলেও সেই সেনাশাসকদের তলপিবাহকরা পৈশাচিক বিদ্রƒপ করেছে। তারা স্লোগান তুলেছিল, ‘দিল্লির হাসিনা বাংলা তোমায় চায় না’। বঙ্গবন্ধুর সরকারকে অশান্ত করে তোলা, উগ্র ও অতিবিপ্লবী, আরেকদিকে সাম্প্রদায়িক শক্তি চরম আওয়ামী লীগ ও মুজিববিদ্বেষীদের কুৎসিত বিকৃত অপপ্রচারও শেখ হাসিনাকে নীলকণ্ঠের মতো হজম করে গণতন্ত্রের সংগ্রামে কুপির বাতি নিয়ে জনগণের মাঝে নামতে হয়েছিল। পরের সংগ্রাম সবার জানা। জীবনের ৪১টি বছর তিনি এ দেশের রাজনীতিতে নিজেকে গণসম্পৃক্ত নেতৃত্বের উচ্চতায় প্রতিষ্ঠিতই করেননি, চারবার প্রধানমন্ত্রী হয়ে বিশ্ববরেণ্য রাজনীতিবিদদের মধ্যে একজন দাপুটে নেতা হিসেবে উদ্ভাসিত করেন। দেশকে তিনি উন্নয়নের মহাসড়কেই নিয়ে যাননি, দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নে মাইলফলক স্থাপন করে পশ্চিমা দুনিয়াকেও চমকে দেন। জীবনে বাইশবার তিনি মৃত্যুর দুয়ার থেকে ফিরে এসেছেন। তাই তিনি অবলীলায় সংবাদ সম্মেলনে বলেন, ‘রাখে আল্লাহ মারে কে আর মারে আল্লাহ রাখে কে?’ মৃত্যুভয় তুচ্ছ করে অপ্রতিরোধ্য গতিতে নিজস্ব নেতৃত্বের ক্যারিশমায় আজকের বাংলাদেশের রাজনীতিতে শেখ হাসিনার বিকল্প শেখ হাসিনাই- এ সত্যকে প্রতিষ্ঠিত করেছেন। তাঁর পরে আওয়ামী লীগের মতো বৃহৎ দলের নেতৃত্বের ভাগ্য কী হবে বা রাষ্ট্রনেতার শূন্যতা কীভাবে পূরণ হবে তা কেউ নিশ্চিত করে বলতে পারছেন না। সামরিক শাসন-উত্তর বাংলাদেশে গণতন্ত্রের নবযাত্রায় ’৯১ সালের নির্বাচনে সব হিসাব-নিকাশ পাল্টে দিয়ে জামায়াতের সমর্থন নিয়ে বিএনপি ক্ষমতায় আসে। গণতান্ত্রিক আন্দোলনের নেত্রী বেগম খালেদা জিয়া হন প্রধানমন্ত্রী। কিন্তু খালেদা জিয়া প্রধানমন্ত্রী হয়ে শেখ হাসিনার সঙ্গে মিলে দেশকে সংসদীয় শাসনব্যবস্থায় ফিরিয়ে নিলেও কথা দিয়েও ইনডেমনিটি নামের কলঙ্ক মুছে দেননি। বঙ্গবন্ধু হত্যার বিচার করেননি। এমনকি বঙ্গবন্ধুর খুনিদের পৃষ্ঠপোষকতাই নয় ’৯৬ সালের একতরফা ভোটারবিহীন ১৫ ফেব্রুয়ারির নির্বাচনে খুনিকে দুই সপ্তাহের সংসদে বিরোধী দলের আসনে বসান। শেখ হাসিনার জন্য হৃদয়ের জখম-যন্ত্রণা এটা কতটা বাড়িয়েছিল তিনি জানেন। কিন্তু ইতিহাসের জন্য এটি একটি অভিশপ্ত ঘটনা হিসেবে লেখা হয়ে আছে। সামরিক শাসকরা কর্নেল ফারুককে রাষ্ট্রপতি নির্বাচনে প্রার্থী হওয়ার সুযোগ শুধু দেয়নি, খুনিদের দল ফ্রীডম পার্টিকে সশস্ত্র রাজনীতি করার সুযোগ করে দিয়েছিল। কোনোটির পরিণতি যেমন শুভ হয়নি তেমনি রাজনীতির জন্য এ প্রতিহিংসা ও হিংস্রতা কল্যাণ বয়ে আনেনি। ’৯৬ সালের নির্বাচনে দীর্ঘ ২১ বছর পর মুজিবকন্যা শেখ হাসিনা আওয়ামী লীগকে ক্ষমতায় নিয়ে আসেন। বঙ্গবন্ধু হত্যার বিচার করেন ইনডেমনিটি নামের কালো আইন অপসারণ করে। কিন্তু ২০০১ সালে জামায়াতকে নিয়ে ক্ষমতায় আসা চারদলীয় জোটের খালেদা জিয়া সেই বিচার প্রক্রিয়া থামিয়ে দেন। এ জখমও শেখ হাসিনাকে বহন করতে হয়েছে। সেদিন বিএনপি শাসনামলে খালেদা জিয়ার সরকারের অপশাসনের পাশাপাশি তাঁর পুত্র তারেক রহমানের হাওয়া ভবনের প্যারালাল ক্ষমতার দাপট গণতান্ত্রিক রাজনীতিকে ক্ষতবিক্ষত করে দেয়। বিএনপির রাজনীতির জন্য যেমন কলঙ্কের সূচনা ঘটায় তেমনি বিরোধী দলের রাজনীতির জন্য রক্ত ঝরায়। একেকটি রাজনৈতিক হত্যাকান্ড গোটা দেশকে বেদনাবিধুর করে তোলে। জঙ্গিবাদ-সন্ত্রাসবাদের অভয়ারণ্য হিসেবে বাংলাদেশকে বিশ্বের সামনে উন্মোচিত করা হয়। একুশের ভয়াবহ গ্রেনেড হামলায় দিনদুপুরে শান্তি মিছিলের শুরুতে বঙ্গবন্ধু এভিনিউকে রক্তাক্ত করা হয়। শেখ হাসিনাকে উড়িয়ে দেওয়ার এ জঘন্য কাপুরুষোচিত হামলায় তিনি অলৌকিকভাবে বেঁচে গেলেও নারীনেত্রী আইভি রহমানসহ ২২টি তাজা প্রাণ মুহূর্তে ঝরে যায়। শত শত নেতা-কর্মী আর মানুষ পঙ্গুত্ববরণ করে। সেই বীভৎস হত্যাকান্ডের নির্মমতার জখম যন্ত্রণায় বেঁচে গিয়ে নির্বাক শেখ হাসিনা সেদিন উপলব্ধি করেছেন। গোটা দেশ স্তম্ভিত হয়েছে। বিএনপির মন্ত্রীরা অনেকেই কিংকর্তব্যবিমূঢ হয়ে পরদিন সচিবালয়ে যাননি। সেই নারকীয় ঘটনার দায় বিএনপি এড়াতে পারে না। লন্ডন নির্বাসিত তারেক রহমান এ মামলার একজন দন্ডিত ফেরারি অপরাধী। সেদিন বিএনপি তদন্ত ও বিচারের নামে নির্লজ্জ বেহায়াপনা করেছে রাজনীতিতে। সত্যকে হত্যা করে জজ মিয়া নাটকের মতো কী জঘন্য মিথ্যাচার মঞ্চস্থ করেছে। এ ধরনের একটি ভয়াবহ ঘটনা নিয়ে সংসদে শাসক দল বিএনপি বিরোধী দল আওয়ামী লীগকে সাধারণ আলোচনা করতে দেয়নি। কেবল এ ঘটনাই নয়, জাতির বেদনাবিধুর ১৫ আগস্ট জাতীয় শোক দিবসে বিএনপি নেত্রী বেগম খালেদা জিয়ার জন্মদিন পালনের বিকৃত বিশাল কেক কাটার নির্দয় উৎসব হয়েছে। রাজনীতিতে সামরিক শাসন-উত্তর গণতন্ত্রের নবযাত্রায় সমঝোতার রাজনীতির কফিনে শেষ পেরেকই ঠুকে দেয়নি, সেই রক্তাক্ত ১৫ আগস্টের ধারাবাহিকতায় বঙ্গবন্ধু-অন্তঃপ্রাণ মানুষের হৃদয়ে রক্তক্ষরণ ঘটিয়েছে। মুজিবকন্যা শেখ হাসিনার হৃদয়ের জখম যন্ত্রণা তীব্রতর করেছে। তবু শেখ হাসিনা বেগম খালেদা জিয়াকে তাঁর পরিবারের আবেদনে কারাগার থেকে মুক্তি দিয়েছেন।

মানবিক হৃদয়ে বঙ্গবন্ধুকন্যা হিসেবে তিনি বিদেশে চিকিৎসার জন্য যেতে দিলেও অবাক হওয়ার কিছু নেই। কিন্তু এ নির্মোহ সত্য অস্বীকার করার কোনো সুযোগ নেই যে, খুনি মোশতাক থেকে সেনাশাসক জিয়া হয়ে বেগম খালেদা জিয়া পর্যন্ত শাসন ক্ষমতার দম্ভে ও ভ্রান্ত নীতিতে প্রতিহিংসার আক্রোশে মুজিবকন্যা শেখ হাসিনার হৃদয়ের জখম যন্ত্রণা বাড়িয়েছেন কেবল, প্রশমিত করার উদ্যোগ নেননি কখনো। স্বাধীনতার ৫০ বছরে বঙ্গবন্ধুর স্বাধীন বাংলাদেশে জাতির সবচেয়ে বড় সর্বনাশটা ঘটেছিল বঙ্গবন্ধু হত্যাকান্ডের মাধ্যমে। আর মুজিবকন্যা শেখ হাসিনার নেতৃত্বে বড় অর্জন হচ্ছে বঙ্গবন্ধু হত্যার বিচার, একাত্তরের মানবতাবিরোধী অপরাধীদের বিচার ও দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়ন। বাকি আছে কেবল সুশসান, মুক্তিযুদ্ধের আকাক্সিক্ষত জবাবদিহিমূলক গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থা ও শোষণমুক্ত অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশ নির্মাণের লড়াই।

 

লেখক : নির্বাহী সম্পাদক, বাংলাদেশ প্রতিদিন।

সর্বশেষ খবর