শুক্রবার, ২৭ মে, ২০২২ ০০:০০ টা

কিশোর গ্যাং, ভার্চুয়াল গেম বনাম আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী

জহিরুল হক শামীম

কিশোর গ্যাং, ভার্চুয়াল গেম বনাম আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী

আমাদেরও শৈশব, কৈশোর ছিল। কবি সুফিয়া কামাল সেসব দিনের বর্ণনা দিয়েছেন তাঁর কবিতায়, এভাবে : ‘আমাদের যুগে আমরা যখন খেলেছি পুতুল খেলা/তোমরা এ যুগে সেই বয়সেই লেখাপড়া কর মেলা/ আমরা যখন আকাশের তলে ওড়ায়েছি শুধু ঘুড়ি/তোমরা এখন কলের জাহাজ চালাও গগন জুড়ি।’ মানছি, এ যুগের কিশোর-কিশোরীরা পুতুল নিয়ে খেলা করে না। আকাশের তলে ঘুড়ি ওড়ানোর অফুরন্ত অবসর পায় না। আমরা তাদের খেলার মাঠ, খোলা আকাশ দিতে পারিনি। প্রজাপতির পিছু ছুটে হারায়নি ওরা কোনো বিকাল। বর্ষার পানিতে শোল মাছের পোনার ঝাঁক বা রংবেরঙের ‘বইচা’ মাছের বাসা খুঁজে গড়ায়নি দুপুর। পাখির ছানার খোঁজে গাছের মগডালে চড়ার কথা ওরা ভাবতেই পারে না। খালে-বিলের পানিতে গোসল করার নামে ডুবসাঁতার কেটে চোখ লাল করে বাড়ি ফেরেনি কোনো বিকালে। রাতের আঁধারে জোনাক পোকার পিছু ছুটে পথ হারায়নি। দলবেঁধে ফজরের আগে বকুলতলায় ছুটে যাওয়ার অনাবিল আনন্দের খোঁজ পায়নি ওরা। ঝড়ের দিনে আম কুড়ানোর সুখ তো ওদের কাছে গল্পের মতো। নারকেলের পাতা দিয়ে হাতঘড়ি বা চশমা বানানোর নির্মল আনন্দ থেকে ওরা বঞ্চিত। সোনালু বা হিজলের হাতছানি, ছিটকির বা পুঁইয়ের গোটায় পায়ে আলতা দেওয়ার কথা ওদের কাছে রূপকথা। ওরা খেলেনি গোল্লাছুট, দাড়িয়াবান্ধা, হা-ডু-ডু, কানামাছি ভোঁ ভোঁ, বৌছি, ডাংগুলি, মারবেল বা (বিরিং) রশিটানাটানি, ইচিং বিচিং, ওপেন টু বাইস্কোপ, এলাটিং বেলাটিং ইত্যাদি। ওরা দেখেনি গাঁও-গেরামে ষাঁড়ের বা মোরগের লড়াই। কাটাকাটি খেলতে গিয়ে ঘুড়ি হারিয়ে নাটাই হাতে কাঁদেনি কোনো বিকেলে। শোনেনি দূর আকাশের পানে ছুটে যাওয়া ঢাউস ঘুড়ির ভোঁ ভোঁ শব্দ। এককালে জনপ্রিয় এসব খেলা নতুন প্রজন্মের কাছে একেবারেই অজানা। এসব খেলার বদলে এখন ওদের মন-মগজে জায়গা করে নিয়েছে ভার্চুয়াল গেম। খেলার মাঠ বা খোলা প্রান্তরের বদলে ওদের হাতে রয়েছে মোবাইল, ল্যাপটপ। দেশীয় কালচারের বদলে ওরা অভ্যস্ত হয়ে উঠছে ভার্চুয়াল কালচারে। গোল্লাছুট, বৌছি, কানামাছি আর ডাংগুলির জায়গা দখল করেছে পাবজি, ব্লু-হোয়েল, ফ্রি ফায়ার, মাইন ক্রাস্ট, রোব্লক্স, এমোংআস, ফল গাইস, কল অব ডিউটি, ফর্টনাইট, অ্যানিমেল ক্রসিং, ওভার ওয়াচ ইত্যাদি। অনলাইন গেমে শিশুদের একাংশ এতটাই আসক্ত হয়ে পড়েছে যে, মোবাইল গেম খেলতে বাধা দেওয়ায় আত্মহত্যার মতো ঘটনাও ঘটছে। বিশেষজ্ঞদের অভিমত, মোবাইল গেম এখন আসক্তির পর্যায়ে চলে গেছে। ইলেকট্রনিক্স ডিভাইসে অতিরিক্ত গেম আসক্তিতে শিশুদের দৃষ্টিশক্তি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। অনলাইন গেমিং আসক্তিকে মানসিক সমস্যা হিসেবে চিহ্নিত করেছে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা। মোবাইল গেমের কারণে শিশুরা লেখাপড়া-বিমুখ হয়ে পড়ছে। অপরদিকে আর একদল টিকটক, লাইকি ইত্যাদি ধরনের অ্যাপস ব্যবহার করে শিশু-কিশোরদের উপযোগী শিক্ষা বা স্বাস্থ্য সচেতনতামূলক অথবা নির্মল বিনোদনের কনটেন্ট না বানিয়ে বিকৃত সব কনটেন্ট বানিয়ে ‘লাইক’ পাওয়ার প্রতিযোগিতায় নেমেছে। পাশাপাশি উঠতি বয়সী কিশোর-কিশোরীদের ‘স্টার’ বানানোর লোভ দেখিয়ে- তাদের জ্ঞাতে বা অজ্ঞাতে স্পর্শকাতর ভিডিও তৈরি করে হাজারো কিশোরীর সর্বনাশ করছে। সম্প্রতি রাজধানীর মগবাজারের টিকটক হৃদয় বাবুর ভারতে গ্রেফতার হওয়ায় বেরিয়ে এসেছে নানা রোমহর্ষক ঘটনা। একজন নারীর ওপর ভয়াবহ যৌন নির্যাতনের ভিডিও ভাইরাল হওয়ার পর টনক নড়ে সবার। ওই মেয়েটিকে টিকটকে অভিনয়ের কথা বলে নিয়ে যাওয়া হয় ভারতে। শুধু এই মেয়েটি নয় আরও অনেক নারী এখন নানাভাবে প্রতারণা ও পাচারের শিকার হচ্ছে। কতজন পাচার হয়েছে হিসাব নেই। এ সংক্রান্তে একটি জাতীয় দৈনিকের রিপোর্টে বলা হয়েছে, ‘দেশের ৪২ জেলায় সাত শতাধিক কিশোর গ্যাংয়ের আওতায় ২০ সহস্রাধিক কিশোর ‘উঠতি অপরাধীতে’ পরিণত হতে চলেছে’ এর মধ্যে শুধু রাজধানীতেই রয়েছে প্রায় দেড়শ গ্যাংয়ের দুর্বৃত্ত কিশোর। গত পাঁচ মাসে সারা দেশে তিন শতাধিক হত্যাকান্ডের সঙ্গে কিশোর গ্যাং বা গ্যাং সদস্যদের সম্পৃক্ততা পাওয়া গেছে।’ সম্প্রতি পুলিশ সদর দফতরের নির্দেশে র‌্যাব ও পুলিশ সদস্যরা কয়েকটি স্থানে অভিযান চালিয়ে কিশোর গ্যাংয়ের শতাধিক সদস্যকে গ্রেফতার করে। কিন্তু তারপরও কিছুতেই থামছে না গ্যাং কালচার ও কিশোর অপরাধের ভয়াবহতা। আমাদের শৈশব বা কৈশোরকালে অপরাধের (!) ঘটনা একবারেই ঘটেনি এমন দাবি আমি করছি না। উদ্দাম সাহসিকতায় এই গাছের ডাব, ওই গাছের আম-কাঁঠাল ইত্যাদি ‘চুরি’ (!) করে খেয়ে অপরাধবোধে ভোগার মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল আমাদের বীরত্ব। বন্ধুদের মধ্যে ফুটবল, হা-ডু-ডু বা অন্য কোনো খেলা নিয়ে বিরোধের জেরে অভিভাবকদের কাছে নালিশ বা নিজেদের মধ্যে বড় জোর হালকা মারপিটের মধ্যেই ছিল সীমাবদ্ধ। এসব ঘটনা নিয়ে কখনো শালিস-দরবার হয়নি। থানা-পুলিশের কথা তো প্রশ্নই ওঠে না। কিন্তু এখন কিশোর গ্যাং নিয়ে দেশের আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে মাথা ঘামাতে হচ্ছে। অভিভাবকদের রাতের ঘুম হারাম হচ্ছে। উল্লেখ্য, ড. বেনজীর আহমেদ বিপিএম (বার) ইতোমধ্যে একাধিকবার এ বিষয়ে অভিভাবকদের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছেন। আমরা ওদের শৈশবকে নিরাপত্তার নামে ফ্ল্যাটে অথবা স্কুলের চার দেয়ালের খুপরিতে আটকে মহানন্দে আছি। দাদা-দাদি, নানা-নানির কোলের বদলে ওদের ডে-কেয়ার সেন্টারে পাঠাচ্ছি। বিস্তীর্ণ খেলার মাঠ আর খোলা আকাশের বদলে ওদের হাতে মোবাইল, ল্যাপটপ তুলে দিয়ে দায়িত্ব পালন করার মহাগৌরবে আত্মতৃপ্তির ঢেকুর তুলছি। যার বিষময় ফল ফলতে শুরু করেছে।

সম্প্রতি মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ‘জাতীয় ক্রীড়া পুরস্কার ২০১৩-২০২১’ প্রদান অনুষ্ঠানে উদ্বেগ প্রকাশ করে বলেন, ‘আমাদের বেশির ভাগ শিশু প্রায় সময় ফ্ল্যাটে মোবাইল, ল্যাপটপ এবং আইপ্যাড নিয়ে সময় কাটাচ্ছে। যা তাদের শারীরিক ও মানসিক স্বাস্থ্যের জন্য খুবই অমঙ্গলজনক।’ এ বিষয়ে অভিভাবকদের দৃষ্টি আকর্ষণ করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘আমি সব অভিভাবকের প্রতি অনুরোধ জানাচ্ছি, আপনারা আপনাদের শিশুদের লেখাপড়ার পাশাপাশি খেলাধুলার প্রতিও মনোযোগী হবেন। তাহলে শিশুরা আর ভুল পথে যাবে না।’ মূলত অভিভাবকদের সক্রিয় তদারকি ছাড়া শিশু-কিশোরদের মোবাইল আসক্তি বা গ্যাং কালচার থেকে নিবৃত করা একা আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর পক্ষে সম্ভব নয়। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী সেই কথাটি সবাইকে স্মরণ করিয়ে দিয়েছেন।

                লেখক : সাংবাদিক।

সর্বশেষ খবর