মঙ্গলবার, ১৪ জুন, ২০২২ ০০:০০ টা

রাজধানীর ফুসফুস রমনা পার্ক

তপন কুমার ঘোষ

রাজধানীর ফুসফুস রমনা পার্ক

রাজধানী ঢাকার রমনা পার্ক মহানগরীর ‘ফুসফুস’ বলে খ্যাত। প্রকৃতি অপরূপ সাজে সাজিয়েছে এ উদ্যানকে। জ্যৈষ্ঠ মাসেও রমনা পার্কে কোকিলের ডাক শোনা যায়। বসন্তের রেশ যেন এখনো রয়ে গেছে। কৃষ্ণচূড়া, কাঠগোলাপ, রঙ্গন, নাগেশ্বর, টগর, বেলিসহ বাহারি সব ফুল ফুটে আছে রমনা পার্কে। সবুজ পাতার ফাঁকে ফাঁকে লাল-নীল-হলুদ আর সাদা রং ছড়াচ্ছে। বর্ষার কদম ফুল ফুটতে শুরু করেছে। বিশাল এলাকাজুড়ে শাখা-প্রশাখা প্রসারিত করে দাঁড়িয়ে আছে বেশ কিছু শতবর্ষী বৃক্ষ। যেন আকাশ ছুঁতে চায়। গাছে গাছে মিষ্টি ঘ্রাণ ছড়াচ্ছে আম-জাম-কাঁঠাল। এ বছর কাঁঠালের ফলন খুব ভালো হয়েছে। গাছের গোড়া থেকে মগডাল পর্যন্ত ঝুলছে অসংখ্য কাঁঠাল। এ সময় কাঠবিড়ালিদের দুরন্তপনা বেড়ে গেছে। পাখিরা মহাখুশি। ফুল-ফলের এ মৌসুমে আহার্য নিয়ে কোনো দুশ্চিন্তা নেই। মনের সুখে আপন মনে গান গেয়ে চলেছে। নিশাচর বাদুড়ের দল রাতের ওড়াউড়ি শেষ করে গাছের উঁচু ডালে ঝুলে বিশ্রাম নিচ্ছে। রাতজাগা কুকুরগুলো ক্লান্ত হয়ে পথের মাঝখানে ঘুমিয়ে পড়েছে।

সময় এখন এই রোদ এই বৃষ্টির। সকাল থেকে আকাশজুড়ে চলে মেঘের খেলা। একসময় ঘনকালো হয়ে আসে আকাশ। কখনো অঝোর ধারায় আবার কখনো বা ঝিরিঝিরি বৃষ্টি নামে। রমনা হাতছানি দেয়। ঝড়-বাদল কিছুই ঘরে আটকে রাখতে পারে না কিছু মানুষকে। এ এক অন্য রকম আকর্ষণ! এ যেন এক নেশা। ছাতা নিয়ে বের হন অনেকে। এ সময় ঘরেও মন টেকে না। কোনো কাজে মন বসে না। সকালটা বিষণ্ণতায় কাটে। এর চেয়ে ভালো এক পাক ঘুরে আসা। বৃষ্টিস্নাত রমনা পার্ক। শান্ত-স্নিগ্ধ। গাছের সবুজ পাতাগুলো আরও উজ্জ্বল হয়ে উঠেছে। গাছের পাতায় আর ফুলের পাপড়িতে জমে থাকা স্বচ্ছ জলের ফোঁটা যেন মুক্তা ছড়াচ্ছে। মাঠের সবুজ ঘন ঘাস আরও সবুজ আর সতেজ হয়ে উঠেছে। লেকের জলের উচ্চতা বেড়েছে। রাজহাঁসের দল দিব্যি মনের আনন্দে ভেসে বেড়াচ্ছে। যেদিকে মন চায় সেদিকে ছুটছে। ঘাটে বাঁধা অর্ধনিমজ্জিত কাঠের নৌকা। লেকের স্বচ্ছজলে সুউচ্চ বৃক্ষের প্রতিবিম্ব এসে পড়েছে। অনেকে মুগ্ধ হয়ে সেদিকে তাকিয়ে আছেন। সব মিলিয়ে গ্রামীণ আবহ। এমন পরিবেশে মনটা ভালো না হয়ে পারে না। প্রতিদিন চেনা-অচেনা অনেক মানুষের সঙ্গে দেখা হয় রমনায়। পরিচিতদের সঙ্গে কুশল বিনিময় হয়। অনেক মানুষের সঙ্গে বন্ধুত্ব গড়ে ওঠে। সব বয়সেই মানুষের বন্ধু দরকার হয়। আলফা ইয়োগা সোসাইটির সদস্যরা নিয়মিত যোগব্যায়াম করেন উন্মুক্ত স্থানে। শতায়ু অঙ্গন, মহিলা অঙ্গন, রমনা প্রভাতি, ঊষা, কিছুক্ষণ, ব্যাংকার্স চত্বর, শকুন্তলা, উজ্জীবন, উৎস, রমনা প্লাসের সদস্যরা সকাল থেকেই ব্যস্ত থাকেন শরীরচর্চা নিয়ে। এ ছাড়াও আছে বেশ কয়েকটি সংঘ।

নিসর্গবিদ ও বিশিষ্ট লেখক দ্বিজেন শর্মা একসময় সকালে পার্কে আসতেন। কাঁধে কাপড়ের ব্যাগ ঝুলিয়ে একমনে হাঁটতেন। কৌতূহলী অনেকেই এগিয়ে যেতেন তাঁর কাছে। আগ্রহভরে ছাত্রদের গাছ চেনাতেন তিনি। বছর পাঁচেক হতে চলল তিনি প্রয়াত হয়েছেন।

সবার জন্য উন্মুক্ত রমনা পার্ক। সবার প্রবেশাধিকার আছে রমনায়। শুধু হকার ও ভিক্ষুকদের পার্কে ঢুকতে মানা। বহুজনের খাবার নিয়ে প্রবেশ নিষেধ। পার্কে ধূমপান নিষিদ্ধ। জনপ্রতিনিধি থেকে শুরু করে বিচারপতি, সচিব, পদস্থ আমলা, ব্যাংকার, ব্যবসায়ী, শিল্পী, গৃহবধূ, সাধারণ মানুষ সবাই এক কাতারে হেঁটে চলেছেন রমনার বৃত্তাকার পথ ধরে। এমন নয় যে শুধু অবসরপ্রাপ্ত বা প্রবীণদের পদচারণে মুখরিত রমনা। সাবেক ও বর্তমান সবার পদচারণ এখানে। কোনো শ্রেণিবিভাজন নেই। সব বয়সী মানুষের জন্য রমনা পার্ক। সাপ্তাহিক ছুটির দিন ছোট ছোট ছেলেমেয়েরা সাদা পোশাকে পার্কে আসে কারাতে প্রশিক্ষণ নিতে। সকালের পবিত্রতা রক্ষায় সজাগ নিরাপত্তাকর্মীরা। সাকল্যে ৩৫ জন নিরাপত্তাপ্রহরী পালাক্রমে ২৪ ঘণ্টা নিরাপত্তার দায়িত্ব পালন করে চলেছেন। করোনাকালে বেশ কয়েক মাস বন্ধ ছিল রমনা পার্ক। ওই সময়ই পার্কের সৌন্দর্যবর্ধনের কাজ হাতে নেওয়া হয়। এখন প্রায় শেষ পর্যায়ে। ভিতরের রাস্তাগুলো উঁচু ও প্রশস্ত করা হয়েছে। রাস্তার ওপর লাল ইট বিছিয়ে দেওয়া হয়েছে। লেকের ওপর পুরনো দুটি ব্রিজ ভেঙে নতুন করে নির্মিত হয়েছে। গণশৌচাগারগুলো পুনর্র্নির্মিত হয়েছে। লেকের পাড়ঘেঁষে গোল পিলারের ওপর নান্দনিক ওয়াকওয়ে নির্মাণ করা হয়েছে। এখন চলছে ‘শিশুপ্রাঙ্গণ’-এর উন্নয়নকাজ। পার্ক এখন জঞ্জালমুক্ত। বিভিন্ন পয়েন্টে ক্লোজ সার্কিট ক্যামেরা বসানো হয়েছে। বিশেষ ধরনের নতুন বাতির আলোয় রাতের রমনা হয়ে ওঠে মোহময়, রহস্যময়ী।

ঘনবসতির এ রাজধানীতে মানুষের বিনোদনের জন্য পাবলিক স্পেস বা গণপরিসর খুবই কম। নগর জীবনের একঘেয়েমি কাটাতে খোলামেলা উন্মুক্ত স্থান দরকার। বর্ষায় অপরূপ সাজে সেজেছে রমনা পার্ক।

নবরূপে সজ্জিত রমনা পার্কে যাওয়ার সময়-সুযোগ যাদের এখনো হয়নি তাঁরা সময় করে অন্তত একবার ঘুরে আসতে পারেন প্রাণের রমনা পার্কে। সকালে বা শেষ বিকালে সময়টা দারুণ কাটবে আপনার। সপ্তাহের সাত দিনই খোলা থাকে রমনা পার্ক। কোনো প্রবেশমূল্য লাগে না।

                লেখক : প্রাতর্ভ্রমণকারী।

সর্বশেষ খবর