রবিবার, ২১ আগস্ট, ২০২২ ০০:০০ টা

ইতিহাসের আরেকটি ভয়ংকর আগস্ট

ওয়ালিউর রহমান

ইতিহাসের আরেকটি ভয়ংকর আগস্ট

শোকের মাস আগস্ট। আমরা বঙ্গবন্ধু ও তাঁর পরিবারের সদস্যদের নৃশংস হত্যার সুষ্ঠু বিচার নিয়ে যখন উদ্বিগ্ন, যখন আমরা জাতির পিতাকে হারানোর পর শোকে কাতর, যখন আমরা তাঁর আত্মার শান্তির জন্য মসজিদ, মন্দির, গির্জায় প্রার্থনা করছি ঠিক তখনই ‘হাওয়া ভবনের’ কালো হাত বঙ্গবন্ধুকন্যা মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে হত্যার জন্য ২০০৪ সালের ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলার পূর্ণ পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করল। এ হামলার মূল লক্ষ্য ছিল স্বাধীনতা সার্বভৌমত্ব, গণতন্ত্র এবং মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ভূলুণ্ঠিত করা এবং আওয়ামী লীগ ও বাংলাদেশকে নেতৃত্বশূন্য করা। বর্বর এ হত্যাকান্ডে ঘটনা মনে হলে আজও গা শিউরে ওঠে। কোনো গণতান্ত্রিক, স্বাধীন ও সভ্য দেশে নিরাপত্তা বাহিনীর উপস্থিতিতে প্রকাশ্য দিবালোকে জনসভায় এমন বর্বরোচিত ঘটনা ঘটতে পারে, তা ভাবনারও অতীত।

বঙ্গবন্ধু এভিনিউতে আওয়ামী লীগ কার্যালয়ের সামনে আমাদের প্রধানমন্ত্রী যখন তাঁর বক্তব্য শেষ করে মঞ্চ থেকে নামবেন ঠিক সেই মুহূর্তে মাত্র দেড় মিনিটে ১৩টি গ্রেনেড হামলা হয়। দফায় দফায় বিস্ফোরণের বিকট শব্দে পুরো এলাকা কেঁপে ওঠে। তখন আমাদের সিনিয়র নেতারা তাঁকে ঘেরাও করে মানবঢাল তৈরি করেন, যাতে বঙ্গবন্ধুকন্যার গায়ে আঘাত না লাগে। কোনোরকমভাবে তাঁকে বুলেটপ্রুফ গাড়িতে উঠিয়ে দিয়ে, ধানমন্ডি ৫ নম্বর সুধাসদনে নিয়ে যাওয়া হয়। চারদিকে তখন আহাজারি। কারও হাত নেই, কারও পা নেই। সিনিয়র নেতা থেকে শুরু করে সবাই তখন রক্তে জর্জরিত। আমি তখন ছিলাম ১৫ আগস্টের হত্যাকান্ড- বিষয়ক এক আলোচনা সভায় শেরাটন হোটেলে, খবর পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে দ্রুতগতিতে চলে এলাম সুধাসদনে, এসে দেখি আমাদের নেত্রী শেখ হাসিনা ঘরের কোনার চেয়ারে বসে আছেন। আমাকে দেখে বললেন, ‘ওয়ালি ভাই, আপনি এসেছেন? ভালোই হলো। Now go and tell the whole world, This is the democracy of khaleda Zia..’ তাঁর সঙ্গে কিছুক্ষণ কথোপকথনের পর আমি বেরিয়ে পরি বঙ্গবন্ধু এভিনিউর উদ্দেশে। গিয়ে দেখি কী দুর্বিষহ অবস্থা। যেন নরকের এক প্রান্ত খোলা হয়েছে।

সভামঞ্চ ট্রাকের চারপাশে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকতে দেখা যায় রক্তাক্ত নিথর দেহ। লাশ আর রক্তে ভেসে যায় বঙ্গবন্ধু এভিনিউর সামনের পিচঢালা পথ। হতাহতদের জুতা-স্যান্ডেল ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়ে আছে। ভেসে আসে শত শত মানুষের গগনবিদারী আর্তচিৎকার। বেঁচে থাকার প্রাণপণ চেষ্টারত মুমূর্ষুদের কাতর-আর্তনাদসহ অবর্ণনীয় মর্মান্তিক সেই দৃশ্য। নেতা-কর্মীদের যে-কোনোভাবে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে হাসপাতালে। আর লাশগুলো রাখা হচ্ছে এক গাড়িতে। সে কী রোমহর্ষক দৃশ্য। আমি ওখান থেকে তাড়াতাড়ি চলে গেলাম হাসপাতালে। সাত থেকে আটটা হাসপাতালে ভর্তি ছিলেন ৩ শতাধিক অধিক মানুষ। ধানমন্ডির বাংলাদেশ মেডিকেলে গিয়ে দেখি আরও ভয়াবহ দৃশ্য। সেখানকার ডাক্তারের সঙ্গে কথা বললাম, তাঁরা আমাকে বললেন, এখনই কিছু ইনজেকশন কিনতে হবে। আমি ইনজেকশন কেনার ব্যবস্থা করলাম। ডিউটি ডাক্তারের সঙ্গে কথা বলে কিছু টাকা ও আমার সঙ্গে যোগাযোগব্যবস্থা তৈরি করলাম। ভয়াল সেই স্পিøন্টারের আঘাতে আমাদের নেতা-কর্মীরা দিনের পর দিন ভুগেছেন। তাঁর মধ্যে একজনের কথা না বললেই নয়। তিনি  মেয়র হানিফ। তাঁর মাথায় গ্রেনেডের আঘাত লেগেছিল। তা নিয়ে তিনি দীর্ঘদিন অসহনীয় যন্ত্রণা ভোগ করে ২০০৬ সালে ইন্তেকাল করেন। সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত সঙ্গে আমার দেখা হলেই স্পিøন্টারে তাঁর পায়ের আঘাত ও ব্যথা সম্পর্কে বলতেন। বন্ধু হওয়ায় আমাকে প্রায়ই এ নিয়ে কথা বলতেন। দিনের পর দিন তিনি কীভাবে এ ব্যথা সহ্য করে গেছেন তা আমি দেখেছি।

ওই ঘটনায় দলীয় নেতা-কর্মীরা মানববর্ম রচনা করে সভানেত্রী শেখ হাসিনাকে রক্ষা করলেও গ্রেনেডের আঘাতে আওয়ামী লীগের মহিলাবিষয়ক সম্পাদক, প্রয়াত রাষ্ট্রপতি জিল্লুর রহমানের স্ত্রী আইভি রহমানসহ মোট ২৩ জন নেতা-কর্মী প্রাণ হারান। ২১ আগস্টের গ্রেনেড হামলা ১৯৭৫-এর ১৫ আগস্টের কালরাতের বর্বরোচিত হত্যাকান্ডের ধারাবাহিকতার প্রতিফলন। এটা বঙ্গবন্ধুর উত্তরসূরি শেখ হাসিনাকে হত্যার উদ্দেশ্যে রক্তপিপাসু বিএনপি-জামায়াত অশুভ জোটের ঘৃণ্য ষড়যন্ত্র।

১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট থেকে ২০০৪ সালের ২১ আগস্ট কিন্তু বেশি ব্যবধান নয়। বিএনপি-জামায়াতের একটি মাত্র পরিকল্পনা- স্বাধীনতার পক্ষশক্তি বঙ্গবন্ধুর আদর্শের দল আওয়ামী লীগকে শেষ করে ফেলা। যার কারণে খালেদা জিয়া তাঁর ছেলেকে এ জঘন্যতম হামলায় সাহায্য করেন। তাঁর ছেলে তারেক রহমান, তৎকালীন স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী লুৎফুজ্জামান বাবর, খালেদা জিয়ার রাজনৈতিক সচিব হারিস চৌধুরী, জামায়াতে ইসলামীর মহাসচিব, তৎকালীন সমাজকল্যাণমন্ত্রী আলী আহসান মোহাম্মাদ মুজাহিদ তাঁদের সবাইকে নিয়ে গুলশানের হাওয়া ভবনে এ পরিকল্পনা করেন। তাঁরা পাকিস্তানিদের সাহায্য নিয়ে দিনের পর দিন দেশের ক্ষতি সাধন করে গেছেন। তথ্যমতে দেখা যায়, তাঁরা যে গ্রেনেড ব্যবহার করেছেন তা-ও পাকিস্তান থেকে এনেছেন। তাঁরা হুজির সাহায্যও নিয়েছিলেন এ হামলায়। কতটা স্বাধীনতাবিরোধী হলে মানুষ এমন কাজ করতে পারে! যে স্বাধীনতার জন্য আমরা নয় মাস যুদ্ধ করলাম, দেশ স্বাধীন করলাম, বঙ্গবন্ধুর সোনার বাংলাদেশ গড়ার জন্য দিনরাত পরিশ্রম করে যাচ্ছি, আর তাঁদেরই হাত ধরে তাঁরা এমন নৃশংস কাজ করলেন! যে দেশ স্বাধীন সে দেশে কীভাবে দুটি পক্ষ থাকে? কীভাবে স্বাধীনতার বিরোধিতা করে তারা এমন জঘন্য কাজ করতে পারে। আজকে তারাই আবার মুখে দেশপ্রেমের কথা বলে বেড়ায়।

ওই ভয়াবহ সহিংসতার পর দেশে-বিদেশে তীব্র প্রতিক্রিয়া দেখা গিয়েছিল। বিশেষ করে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় অর্থাৎ তখনকার বিশ্বনেতারা তীব্র নিন্দা জানিয়ে ঘটনার জন্য দায়ীদের বিচারের আওতায় আনতে তখনকার বিএনপি নেতৃত্বাধীন জোট সরকারের প্রতি বারবার আহ্বান জানিয়েছিলেন। আওয়ামী লীগ সভানেত্রীর সমাবেশের সেই ভয়ংকর ঘটনা পুরো বিশ্বকেই নাড়া দিয়েছিল।

খালেদা জিয়া প্রধানমন্ত্রী থাকা অবস্থায় গ্রেনেড হামলার বিচার যেন অনেকটা হাস্যরসভাবে চলছিল। তাঁর লোক দেখানো আসামি ও তাঁর নিজের তৈরি করা সিআইডি টিম সবকিছুই যেন এক নাটকীয় রূপ ছিল। দীর্ঘ ১৪ বছর পর ২০১৮ সালের ১০ অক্টোবর ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলা মামলার রায় ঘোষণা করা হয়। আদালত দুটি মামলার রায়ে জীবিত ৪৯ আসামির মধ্যে বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান, খালেদা জিয়ার রাজনৈতিক সচিব হারিস চৌধুরী, সাবেক সংসদ সদস্য কায়কোবাদসহ ১৯ জনের যাবজ্জীবন এবং সাবেক স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী লুৎফুজ্জামান বাবর, উপমন্ত্রী আবদুস সালাম পিন্টুসহ ১৯ জনকে মৃত্যুদন্ড দেন। বাকি ১১ জনকে বিভিন্ন মেয়াদে কারাদন্ড দিয়েছেন। এ রায়ের মধ্য দিয়ে আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা পেয়েছে, জাতি কলঙ্কমুক্ত হয়েছে।

২০০৯ সালে শেখ হাসিনার সরকার ক্ষমতায় আসার পর জঙ্গি দমনে নানা পদক্ষেপ ও পরিকল্পনা নেয়। সন্ত্রাস ও জঙ্গিবাদ দমনে ‘জিরো টলারেন্স’ নীতি অনুসরণ করে দেশে শান্তি ও গণতন্ত্র পুনঃপ্রতিষ্ঠিত হয়েছে। দেশের প্রতিটি সেক্টরে কাক্সিক্ষত অগ্রগতি অর্জিত হয়েছে। আর্থসামাজিক উন্নয়নে বাংলাদেশ এখন বিশ্বে ‘রোল মডেল’। আত্মমর্যাদাশীল দেশ হিসেবে আজ বিশ্বের বুকে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়েছে।

বঙ্গবন্ধুর সোনার বাংলায় যেন আর কোনো স্বাধীনতাবিরোধী শক্তি মাথা চাড়া দিয়ে উঠতে না পারে তার জন্য স্বাধীনতার পক্ষশক্তি গণতন্ত্রের সরকার মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এবং আমরা নিরলসভাবে কাজ করে যাচ্ছি। আমরা আর কোনো নৃশংস ভয়ংকর ১৫ আগস্ট, ২১ আগস্ট দেখতে চাই না। তার জন্য বাংলাদেশের জনগণ সদা জাগ্রত আছে।

                লেখক : ফরগোটেন ওয়ার : ফরগোটেন জেনোসাইড

সর্বশেষ খবর