বৃহস্পতিবার, ২৯ সেপ্টেম্বর, ২০২২ ০০:০০ টা

যেভাবে নবুয়ত পেলেন রসুল (সা.)

এম এ মান্নান

যেভাবে নবুয়ত পেলেন রসুল (সা.)

মহান আল্লাহ এ বিশ্বজগতের স্রষ্টা। মানুষকে তিনি সৃষ্টির সেরা জীব হিসেবে সৃষ্টি করেছেন। শেষ নবী হজরত মুহাম্মদ (সা.)-কে আল্লাহ পাঠিয়েছেন মানব জাতির আলোকবর্তিকা হিসেবে। মানব জাতির জন্য তিনি আল্লাহর রহমত হিসেবে অবতীর্ণ হয়েছেন। হজরত আদম (আ.) থেকে শুরু করে প্রায় ১ লাখ ২৪ হাজার নবী-রসুল বিভিন্ন সময় বিভিন্ন জাতি-গোষ্ঠী বা সম্প্রদায়ের জন্য আল্লাহ পাঠিয়েছেন। যেসব নবী-রসুলের কাছে যে কিতাব আল্লাহ নাজিল করেছেন তাতে শেষ নবী মুহাম্মদ (সা.)-এর আগমনের সুসংবাদ রয়েছে। ইতিহাসবিদ, সর্বস্তরের জ্ঞানীগুণী মহানবী (সা.)-কে সর্বসেরা মানব হিসেবে অভিহিত করেছেন। জগদ্বাসীর ওপর আর কোনো নবী-রসুল বা ধর্ম প্রচারক তাঁর মতো প্রভাব বিস্তার করতে পারেননি। মুহাম্মদ (সা.)-এর মাক্কি জীবনকে প্রধানত দুই ভাগে ভাগ করা যায়। নবুয়ত প্রাপ্তির আগের আর নবুয়ত প্রাপ্তির পরের। রসুলুল্লাহ (সা.) ৪০ বছর বয়সে নবুয়ত লাভ করেন। এর আগ পর্যন্ত তিনি গোটা আরব জাতির কাছে ছিলেন আস্থার প্রতীক। আরবরা তাঁকে ‘আল আমিন’ অভিধায় অভিহিত করেছিল। আরবরা তাদের বিভিন্ন অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্বের নিরসনে তাঁর ফয়সালার ওপর পূর্ণ আস্থা স্থাপন করত এবং সন্তুষ্টচিত্তে মেনে নিত। যখন মহানবীর বয়স ৩৫ বছর, তখন কুরাইশরা কাবাঘর সংস্কারের সিদ্ধান্ত নেয়। বায়তুল্লাহর নির্মাণকাজে অংশ গ্রহণ করতে পারাকে প্রত্যেকেই নিজের জন্য সৌভাগ্যের বিষয় মনে করত। আর কুরাইশ গোত্রগুলো কাবার খেদমতে কে বেশি অংশ নিতে পারে এটিকে সৌভাগ্য মনে করত। তাই সম্ভাব্য ঝগড়া এড়ানোর জন্য সংস্কারকাজ গোত্রগুলোর মধ্যে বণ্টন করে দেওয়া হলো। বিপত্তি বাধল ‘হাজরে আসওয়াদ’ সরানোর সময়। হাজরে আসওয়াদকে উঠিয়ে তার নির্দিষ্ট স্থানে স্থাপন করার ব্যাপারে তাদের মধ্যে চরম মতভেদ সৃষ্টি হলো। প্রতিটি গোত্র ও ব্যক্তির দাবি সে এ সৌভাগ্য লাভ করবে; এমনকি এজন্য প্রয়োজনে লড়াইয়ে নামার অঙ্গীকার নেওয়া আরম্ভ হলো। সংঘাত এড়াতে গুরুজনরা শলাপরামর্শের মাধ্যমে মীমাংসার পথ বের করার কথা ভাবলেন। এ উদ্দেশ্যে তাঁরা সমবেত হলেন। সিদ্ধান্ত হলো, আগামীকাল প্রত্যুষে যে ব্যক্তি সবার আগে নির্দিষ্ট দরজা দিয়ে কাবা চত্বরে প্রবেশ করবে সে-ই এ ব্যাপারে ফয়সালা দেবে এবং সবাই তা মেনে নেবে। মহান আল্লাহর কুদরত, সবার আগে মুহাম্মদ (সা.) ওই দরজা দিয়ে প্রবেশ করলেন। তাঁকে দেখে সবাই একবাক্যে বলে উঠলেন, ‘ইনি আল আমিন আমরা তাঁর সিদ্ধান্ত মানতে সম্মত আছি।’ নবীজি এগিয়ে এলেন এবং এমন প্রজ্ঞাপূর্ণ ফয়সালা দিলেন যাতে সবাই সন্তুষ্ট হয়ে গেলেন। তিনি একটি চাদর বিছালেন এবং নিজ হাতে হাজরে আসওয়াদটি তাতে রেখে দিলেন। তারপর নির্দেশ দিলেন প্রতি গোত্রের ব্যক্তিরা যেন চাদরের এক এক কোণ ধরে। যখন চাদরসহ হাজরে আসওয়াদ ভিত পর্যন্ত পৌঁছল তখন মুহাম্মদ (সা.) নিজ হাতে পাথরটি তুলে যথাস্থানে রেখে দিলেন। আরবদের এমন আস্থা ও ভালোবাসার মধ্যে রসুলুল্লাহ (সা.) তাঁর জীবনের ৪০টি বছর অতিবাহিত করেন। কিন্তু ৪০ বছর বয়সে নবুয়ত লাভের পর এ চিত্র পাল্টে যায়। মক্কাবাসীর তীব্র বিরোধিতার সম্মুখীন হন তিনি। মুহাম্মদ (স.)-এর বয়স যখন ৪০ একদিন আল্লাহ তাঁকে সমগ্র বিশ্বজাহানের জন্য করুণাস্বরূপ এবং মানব জাতির জন্য সুসংবাদদাতা করে পাঠালেন। রসুল (সা.)-এর নবুয়তপ্রাপ্ত হওয়ার প্রেক্ষাপট সম্পর্কে হজরত আয়েশা (রা.) বর্ণনা করেছেন এভাবে-

আল্লাহ যখন রসুল (সা.)-কে সম্মানিত করতে ও মানব জাতিকে তাঁর দ্বারা অনুগৃহীত করতে মনস্থ করলেন, তখন রসুল (সা.) নবুয়তের অংশ হিসেবে স্বপ্ন দেখতে থাকেন। তখন তিনি যে স্বপ্নই দেখতেন তা ভোরের সূর্যোদয়ের মতো বাস্তব হয়ে দেখা দিত। এ সময় আল্লাহ তাঁকে নির্জনে অবস্থান করার জন্য আগ্রহী করেন। একাকী অবস্থান তাঁর কাছে সর্বাধিক পছন্দনীয় হয়ে ওঠে। আবদুল মালেক ইবনে উবাইদুল্লাহ বলেন, আল্লাহ যখন নবুয়তের সূচনা করলেন, তখন তিনি কোনো প্রয়োজনে বাইরে বেরোলে লোকালয় ছেড়ে অনেক দূরে মক্কার পার্বত্য উপত্যকায় ও সমভূমিতে চলে যেতেন। তখন যে-কোনো পাথর বা গাছের পাশ দিয়েই যেতেন ওই পাথর বা গাছ বলে উঠত আসসালামু আলাইকুম ইয়া রসুলুল্লাহ। তখন রসুল (সা.) পাশে তাকিয়ে গাছ-পাথর ছাড়া কিছুই দেখতেন না। নবুয়ত প্রাপ্তির পর রসুলুল্লাহ (সা.) গোপনে তিন বছর দাওয়াতের কাজ পরিচালনা করেন। তিন বছর যাবৎ গোপন দাওয়াত দেওয়ার পর আল্লাহর হুকুম হলো প্রকাশ্যে দাওয়াত দেওয়ার। মহান আল্লাহ তাঁর প্রিয় হাবিবের মনমানসিকতা প্রস্তুত করে নেন সুরা শুয়ারা নাজিল করে। ২২৭ আয়াত-বিশিষ্ট এ সুরার শুরুতেই আল্লাহ তাঁর নবীকে বলেন, ‘লোকেরা ইমান আনছে না বলে হয়তো আপনি মর্মবেদনায় আত্মঘাতী হওয়ার উপক্রম করেছেন। জেনে রাখুন, যদি ইচ্ছা করি তাহলে আকাশ থেকে তাদের ওপর এমন নিদর্শন (গজব) অবতীর্ণ করতে পারি, যা দেখে এদের সবার গর্দান অবনত হয়ে যাবে।’ (আয়াত ৩-৪) এর দ্বারা বোঝানো হয়েছে, অহংকারী সমাজনেতাদের আচরণে বেদনাহত হয়ে তৌহিদের দাওয়াত থেকে পিছিয়ে আসা যাবে না। বরং আল্লাহর ওপর ভরসা রেখে বুকে বল নিয়ে সামনে এগিয়ে যেতে হবে।

                লেখক : সভাপতি, আমেনা খাতুন হাফেজিয়া কোরআন রিসার্চ অ্যান্ড  ক্যাডেট ইনস্টিটিউট, কাটিয়াদী, কিশোরগঞ্জ

সর্বশেষ খবর