শনিবার, ১৫ অক্টোবর, ২০২২ ০০:০০ টা

অসাম্প্রদায়িকতা ও ইসলাম : হাদিস পর্ব

সৈয়দ শাহাদাত হুসাইন

অসাম্প্রদায়িকতা ও ইসলাম : হাদিস পর্ব

বিদায় হজের ঐতিহাসিক ভাষণে অসাম্প্রদায়িকতার চেতনা সুস্পষ্ট। রসুলুল্লাহ (সা.) বলেন, ‘হে মানবমণ্ডলী!  তোমাদের আল্লাহ এক ও অদ্বিতীয় এবং তোমাদের আদি পিতাও এক। একজন আরব একজন অনারব থেকে কোনো মতেই শ্রেষ্ঠ নয়। তেমনি একজন আরবের ওপরে একজন অনারবেরও কোনো শ্রেষ্ঠত্ব নেই। একজন সাদা চামড়ার মানুষ একজন কালো চামড়ার মানুষের চেয়ে শ্রেষ্ঠ নয়, আবার কালোও সাদার চেয়ে শ্রেষ্ঠ নয়। শ্রেষ্ঠত্বের মূল্যায়নে বিচার্য হবে, কে তাকওয়াবান তথা আল্লাহ ও বান্দার হক কতদূর আদায় করল। এর মাধ্যমে আল্লাহর কাছে তোমাদের সর্বোচ্চ সম্মানের অধিকারী সেই ব্যক্তি, যিনি সর্বাপেক্ষা বেশি ধর্মভীরু’ (সূত্র : বায়হাকি)। সাম্প্রদায়িকতা কী? এ বিষয়ে হজরত মুহাম্মদ (সা.) কী বলেছেন? রসুল (সা.) বলেন : তুমি তোমার কওমকে অত্যাচার করার জন্য সহযোগিতা করলে তা হচ্ছে আসাবিয়্যাত বা গোত্রবাদ। সূত্র : সুনান আবু দাউদ, হাদিস # ৫১১৯। ন্যায় ও কল্যাণের বিষয়ে নিজ কওমকে সাহায্য করা অন্যায় সম্প্রদায়প্রীতি নয়, বরং জুলুম ও অন্যায় কাজে কওমকে সহযোগিতা করাই হচ্ছে নিষিদ্ধ সাম্প্রদায়িকতা। এক কথায় অন্যায়ের ক্ষেত্রে পক্ষপাতই হলো সাম্প্রদায়িকতা, যা ইসলামে কঠিনভাবে নিষিদ্ধ। যারা সাম্প্রদায়িকতার ক্ষেত্রে যুদ্ধ করে তাদের রসুল নিজের উম্মত হিসাবে অস্বীকার করেছেন : রসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন : যে ব্যক্তি লোকদের গোত্রবাদের দিকে আহ্বান করে অথবা গোত্রবাদে উন্মত্ত হয়ে ভ্রষ্টতার পতাকাতলে যুদ্ধ করে নিহত হলে সে জাহিলিয়াতের মৃত্যুবরণ করল। সূত্র : সুনান ইবনে মাজাহ হাদিস # ৩৯৪৮, মুসলিম ১৮৪৮, নাসায়ী ৪১১৪, সুনান আবু দাউদ, হাদিস # ৫১২১ হাদিসের মান : সহিহ। নিজ গোত্রকে ভালোবাসা সাম্প্রদায়িকতা নয়। রসুলুল্লাহ (সা.)-এর নিকট জিজ্ঞাসা করা হলো, হে আল্লাহর রসুল! নিজ গোত্রের প্রতি ভালোবাসা কি গোত্রেবাদের অন্তর্ভুক্ত? তিনি বলেন : না। তবে নিজ গোত্রকে অন্যের ওপর অত্যাচারে সহায়তা করা গোত্রবাদের অন্তর্ভুক্ত। সুনান ইবনে মাজাহ হাদিস # ৩৯৪৯ আবু দাউদ ৫১১৯। রসুল (সা.) পারস্পারিক সহমর্মিতা, সহানুভূতি ও সহযোগিতার নির্দেশ দিয়েছেন : রসুল (সা.) বলেন : যে ব্যক্তি দয়া করে না, সে দয়া পায় না। যে ব্যক্তি ক্ষমা করে না, সে ক্ষমা পায় না। যে ব্যক্তি উদারতা প্রদর্শন করে না, সে উদারতা পায় না। যে ব্যক্তি অন্যকে রক্ষার জন্য সচেষ্ট হয় না সে রক্ষা পায় না। সূত্র আল আদাবুল মুফরাদ হাদিস # ৩৭২ হাদিসের মান : হাসান। অন্য হাদিসে নবী (সা.) বলেছেন : যে (সৃষ্টির প্রতি) দয়া করে না, (আল্লাহর পক্ষ থেকে) তার প্রতি দয়া করা হয় না সূত্র : সহিহ বুখারি; হাদিস # ৬০১৩ হাদিসের মান : সহিহ। অন্য হাদিসে রসুলুল্লাহ (সা.)-কে আমি বলতে শুনেছি : শুধু হৃদয়হীন, নিষ্ঠুর ও দুর্ভাগা মানুষের কাছ থেকেই রহমত ছিনিয়ে নেওয়া হয়। সূত্র : জামে আত তিরমিজি হাদিস # ১৯২৩ রসুলুল্লাহ (সা.) বলেন,  সাবধান! যে জিম্মি (অমুসলিম যুদ্ধবন্দি) ব্যক্তির চুক্তিবদ্ধ সম্প্রদায়ের কোনো ব্যক্তির ওপর জুলুম করবে বা তার প্রাপ্য কম দিবে কিংবা তাকে তার সামর্থ্যরে বাইরে কিছু করতে বাধ্য করবে অথবা তার সন্তুষ্টিমূলক সম্মতি ছাড়া তার কাছ থেকে কিছু গ্রহণ করবে, কিয়ামাতের দিন আমি (ঐ মুসলমানের) তার বিপক্ষে বাদী হব। সূত্র : সুনান আবু দাউদ হাদিস # ৩০৫২ হাদিসের মান : সহিহ। অন্য হাদিসে নবী (সা.) বলেন, ‘যে ব্যক্তি কোনো অমুসলিমকে কতল করে, সে জান্নাতের ঘ্রাণও পাবে না। যদিও জান্নাতের ঘ্রাণ চল্লিশ বছরের দূরত্ব হতে পাওয়া যায়। সূত্র : সহিহ বুখারি হাদিস # ৩১৬৬ হাদিসের মান : সহিহ। অন্য হাদিসে রসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন : যে ব্যক্তি কোনো জিম্মিকে (অমুসলিম যুদ্ধবন্দি) অন্যায়ভাবে হত্যা করবে, আল্লাহতায়ালা তার জন্য জান্নাত হারাম করে দেবেন। সূত্র : সুনান নাসায়ি হাদিস # ৪৭৪৭ হাদিসের মান : সহিহ। নবী করিম (সা.) অন্য ধর্মের মানুষের প্রতি নির্যাতন তো দূরের কথা, তাদের প্রতি মৌখিক অভিযোগও উত্থাপন করেননি। বরং কোনো বিরোধী যখন অসুস্থ হতো, তখন হজরত রসুলুল্লাহ (সা.) তাকে দেখতে যেতেন। রসুলুল্লাহ (সা.) ও খোলাফায়ে রাশেদিনের চিরাচরিত নিয়ম ছিল, যখন কোনো সেনাবাহিনী প্রেরণ করার প্রয়োজন হতো, তখন যুদ্ধ সম্পর্কিত বিভিন্ন নসিহত, দিক-নির্দেশনার পাশাপাশি এ কথা অবশ্যই বলে দিতেন যে, ‘যুদ্ধকালীন বা যুদ্ধের পর কোনো মন্দির-গির্জা-উপাসনালয় ভেঙে ফেলবে না। সূত্র : মুসান্নাফ আবি শায়বা : ৩৩৮০৪। সুফিদের নেতা সুফি মাওলানা রুমি ছিলেন প্রেম, সম্প্রীতি ও প্রজ্ঞার কবি ও মানবতাবাদী দার্শনিক। সুফি সাধকগণ তাদের লেখনীর মাধ্যমে অসাম্প্রদায়িক, মানবিক ও নৈতিক মূল্যবোধ জাগ্রত করতে যে অনন্য অবদান রেখেছেন, তা বিশ্ববাসীর কাছে আজও সমাদৃত। মুক্তিযুদ্ধ ধর্মীয় চেতনা থেকে হয়নি, মুক্তিযুদ্ধ হয়েছিল মানবিক চেতনা থেকে, সমগ্র জাতিকে ঐক্যবদ্ধ করা হয়েছিল অসাম্প্রদায়িক চেতনায়। মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে যে অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশ গঠনের জন্য এ দেশের মানুষ জীবন দিয়েছিল, সাম্প্রদায়িকতাকে আশ্রয় করে সেই চেতনায় ফাটল ধরানোর চেষ্টা করা হচ্ছে। স্বাধীনতার স্থপতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের অসাম্প্রদায়িক চেতনায় স্বাধীন দেশে সাম্প্রদায়িকতা মোটেও কাম্য নয়। মানবতার কবি, অসাম্প্রদায়িক কবি কাজী নজরুল ইসলাম লিখেছেন- ‘মানুষের চেয়ে বড় কিছু নাই নহে কিছু মহীয়ান/নাই দেশ-কাল-পাত্রের ভেদ, অভেদ ধর্ম জাতি,/ সব দেশে, সব কালে, ঘরে ঘরে তিনি মানুষের জ্ঞাতি।

লেখক :  চেয়ারম্যান, তাসাউফ ফাউন্ডেশন

সর্বশেষ খবর