ইউরোপ ও এশিয়ার মধ্যবর্তী এলাকা অর্থাৎ ককেশিয়া অঞ্চলের প্রাচীনতম ফল আনার। আমাদের দেশে ডালিম বা বেদানা নামেও পরিচিত। সাধারণত গ্রামের কোনো কোনো বাড়ির আঙিনায় দু-একটি ডালিম গাছ থাকে। সেখান থেকে কালে-ভদ্রে একটি-দুটি ডালিম পাওয়া যায়। ফলে আমরা যে কিনে ডালিম খাই সেগুলো মূলত দেশের বাইরে থেকেই আনা। আমাদের দেশে বাজারে যে ডালিম পাওয়া যায় তার অধিকাংশই ভারত থেকে আমদানিকৃত, যদিও বলা হয় ইরানের আনার। সবচেয়ে ভালো মানের আনার উৎপাদন হয় ইরানে। ফল আমদানিকারকদের সঙ্গে কথা বলে জেনেছি, প্রতি বছর দেশে প্রায় ১০ হাজার কোটি টাকার মতো ফল আমদানি করা হয়। যার মধ্যে আনার আমদানি হয় প্রায় ৭০০ কোটি টাকার। আমরা যখন আমদানিনির্ভরতা কমিয়ে আনতে চাচ্ছি, তখন ফলের চাষ বাড়িয়ে আমদানি কমিয়ে আনার চেষ্টা করাটাই শ্রেয়। আমাদের তরুণ কৃষক ও উদ্যোক্তাদের হাতে সম্প্রসারিত হচ্ছে ফলের চাষ।
গত এক যুগে দেশে ফলের উৎপাদন বেড়েছে ২২ শতাংশ। কম জমিতে বেশি মানুষের দেশ হিসেবে ফল উৎপাদনে বিশ্বের শীর্ষ দেশগুলোর তালিকায়ও এখন আমরা। আবার ফল চাষের জমি বৃদ্ধির দিক থেকেও বাংলাদেশ বিশ্বের শীর্ষস্থানে উঠে এসেছে। এ হিসাবে বছরে ফল চাষের জমি বাড়ছে ১০ শতাংশ হারে। শুধু ফলের উৎপাদন বৃদ্ধির দিক থেকে নয়, দেশের মানুষের মাথাপিছু ফল খাওয়ার পরিমাণও দ্বিগুণ হয়েছে গত এক যুগে। ২০০৬ সালের এক হিসাবে বাংলাদেশের মানুষ গড়ে দিনে প্রায় ৫৫ গ্রাম করে ফল খেত। বর্তমানের হিসাবে তা প্রায় ৮৫ গ্রামে উন্নীত হয়েছে; যা দেশের মানুষের জন্য নিরাপদ খাদ্য এবং পুষ্টি গ্রহণ অবস্থার উন্নয়নের একটি বার্তা। দুই দশক আগেও দেশের বিভিন্ন এলাকায় আম, জাম, কাঁঠাল, কলা, পেঁপে, লিচু ছাড়া উল্লেখযোগ্য কোনো ফল উৎপাদনের চিত্র দেখিনি। অথচ গত দুই দশকে নতুন নতুন ফলফসলে বদলে যাওয়া বহু এলাকার চিত্র দেখছি। কৃষক, উদ্যোক্তাদের মধ্যে মাল্টা, ড্রাগন, পেয়ারা, কুল, কমলা, লটকন ও অ্যাভোকাডোর মতো পুষ্টিকর ফল উৎপাদনে সফল হয়েছেন অনেকে। সম্প্রতি এ তালিকায় যুক্ত হয়েছে পারস্যের ফল আনার বা ডালিম। দেশের প্রথম আনারের বাণিজ্যিক বাগানটি গড়ে উঠেছে চুয়াডাঙ্গা সদরের রাঙ্গিয়ারপোতা গ্রামে।
গত সেপ্টেম্বরের প্রথম সপ্তাহে এক সকালে সেই বাগানে যাওয়ার সুযোগ হয়েছিল। বৃষ্টিহীন বর্ষা শেষে শরৎটাও যেন উত্তপ্ত রোদের। আকাশজুড়ে সাদা মেঘ ঘুরে বেড়ালেও সেপ্টেম্বরেও রোদের তেজ যথেষ্টই প্রখর মনে হচ্ছিল। তবে গাড়িতে যেতে যেতে রাস্তার দুই ধারের কৃষিজমিগুলোর দিকে তাকিয়ে মন ভরে উঠছিল। ধান-পাটের বাংলাদেশ এখন রকমারি ফলফসলে ভরে উঠেছে। নানারকম ফলফসল আর সবজির আবাদ। রাঙ্গিয়ারপোতা গ্রামে আমাকে অভ্যর্থনা জানালেন মোকাররম হোসেন। উচ্ছল এক তরুণ। মোকাররম হোসেন ও তার দুই বন্ধু মিলেই শুরু করেছেন আনারের বাণিজ্যিক চাষ।
বাগানে ঢুকেই গাছভর্তি রঙিন আনার দেখে চোখ জুড়িয়ে যায়। মনে হচ্ছিল আমি কোনো বিদেশি বাগানে দাঁড়িয়ে আছি। চারপাশে লাল হয়ে ঝুলে আছে পাকা পাকা আনার। মোকাররম হোসেন চার বছর আগে ৫ বিঘা জমিতে চাষ করেন এ বিদেশি ফলের। ইতোমধ্যে বাগান থেকে ফল বিক্রিও শুরু হয়েছে।
আনারের চাষ শুরু নিয়ে কথা বলি মোকাররমের সঙ্গে। তিনি জানান, প্রথমে ইউটিউবে আনার চাষ দেখে ফলটি চাষ করতে আগ্রহী হয়ে ওঠেন। যোগাযোগ করেন ভারতের কৃষিভিত্তিক প্রতিষ্ঠান সয়েল চার্জার টেকনোলজির সঙ্গে। সেখানকার সিনিয়র কনসালট্যান্ট কৃষিবিদ হারসাল মুখেকারের সঙ্গে সাক্ষাৎ করে আনার চাষ সম্পর্কে পরামর্শ নেন। পরে তাদের সঙ্গে যৌথ উদ্যোগে এ ফলের বাগান শুরু করেন তিনি। ৫ বিঘা জমিতে এসসিটি ভাগুয়া জাতের ৮০০ গাছ রোপণ করেন। প্রথম বছরে চারা কেনা, জমি তৈরি, পরিচর্যাসহ বিঘাপ্রতি খরচ হয়েছে প্রায় ১ লাখ টাকা। কিন্তু চার বছরে তার সর্বমোট বিনিয়োগ হয়েছে ১৫ লাখ টাকার মতো। চারা রোপণের দুই বছর পরই গাছে ফুল আসতে শুরু করে। ফুল থেকে ফল পরিপূর্ণ হতে চার মাস লাগে। মোকাররম বললেন, বছরে দু-তিন বার ফল সংগ্রহ করা যাবে প্রতিটি আনার গাছ থেকে। বর্তমানে বাগান থেকেই প্রতি কেজি আনার ২০০ থেকে ২৫০ টাকা দরে বিক্রি হচ্ছে। চার বছরে ৪০ লাখ টাকার মতো বিক্রি হয়েছে মোকাররমদের।
বাগান ঘুরে দেখলাম গাছে গাছে শোভা পাচ্ছে বিভিন্ন সাইজের আনার। এ আনারবাগান দেখতে প্রতিদিন দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে শত শত মানুষ ভিড় জমাচ্ছেন। মোকাররম হোসেন আনার চাষে সাফল্য পাওয়ায় চুয়াডাঙ্গা অঞ্চলে বাণিজ্যিকভাবে আনার চাষের সম্ভাবনা দেখা দিয়েছে। বছরে আনারের মৌসুম দুটি। চলতি মৌসুমটিও প্রায় শেষের পথে। বাগানের একাংশে ফল তোলা হয়ে গেছে। অর্ধেকাংশে এখনো বাকি রয়েছে ফল উত্তোলনের কাজ। আনারের এ বাগানে যা বিনিয়োগ করা হয়েছে তা ভালোমতোই ফিরে পেয়েছেন উদ্যোক্তারা। তবে টাকার থেকেও বেশি অর্জন করেছেন হাতে-কলমে আনার চাষের কৌশল ও প্রযুক্তিজ্ঞান; যা দিয়ে আগামীতে আরও কম খরচে বেশি লাভ করার কৌশল রপ্ত করেছেন তারা।
মোকাররম বললেন, বাগান শুরুর দিকে মাটির সর্বোচ্চ ব্যবহারের চেষ্টায় তারা আনারের মাঝে আবাদ করেছিলেন অন্য ফসলও। গাছগুলো বড় হওয়ার পর এখন আর সাথি ফসল চাষ করছেন না। আনারের সর্বোচ্চ ফলন পেতে আনারকেই প্রাধান্য দিচ্ছেন। পাশেই চলছে আনারের কলম তৈরির কাজ। ২০০ গাছে কলম বাঁধা হয়েছে। যেখানে দেখা হলো বাগানের আরেকজন উদ্যোক্তা ওবায়দুল হকের সঙ্গে। তিনি বললেন, তিন বন্ধু পড়াশোনা থেকে শুরু করে কর্মজীবনেও একসঙ্গে ছিলেন। তারই ধারাবাহিকতায় কৃষিচর্চায় যুক্ত রয়েছেন একসঙ্গেই। আনার চাষের এ কার্যক্রম নিয়ে যথেষ্ট আশাবাদী তারা।
আনারবাগানের পরিধি, ফলের প্রাচুর্য, সমৃদ্ধি সবকিছুতেই এক পরিবর্তিত কৃষির চেহারা ফুটে ওঠে। এটি হয়ে উঠেছে গোটা এলাকার কৃষিবৈচিত্র্যের উজ্জ্বল ক্ষেত্র। যেখান থেকে বহু মানুষ পাচ্ছে নতুন করে আনারবাগান গড়ার অনুপ্রেরণা। জানা গেল, এ বাগানের সূত্র ধরেই ছোটবড় ৭০টি নতুন আনারবাগান তৈরি হয়েছে চাঁপাইনবাবগঞ্জ, দিনাজপুর, ফটিকছড়িসহ নানা অঞ্চলে।
বাগানের পাশে ছোট ঘরে আনার বিপণনের কাজ চলছিল। আনারের আকার ও ওজন বুঝে ভিন্ন ভিন্ন দামে বাজারজাত করা হয়। তবে এ ক্ষেত্রে উদ্যোক্তাদের দাবি হচ্ছে, দেশি ফলের বাজার নিশ্চিতকল্পে দেশের ফল উৎপাদনের মৌসুমে আমদানিনির্ভরতা কমানো জরুরি। এজন্য আমদানিকৃত ফলের ওপর ট্যারিফ বাড়ানো দরকার মনে করেন তারা। সারা দেশের অসংখ্য কৃষক, তরুণ উদ্যোক্তার হাত দিয়েই রচিত হচ্ছে কৃষি খাতের নানারকম সফল ঘটনা। এসব সাফল্য যে শুধু বাণিজ্যের মোহে ঘটছে তা বলা যাবে না; বরং মাটি আর ফলফসলকে ভালোবেসেই তারা কৃষিতে যুক্ত হয়ে দৃষ্টান্ত গড়ছেন।
চুয়াডাঙ্গা সদরের রাঙ্গিয়ারপোতা গ্রামে কয়েকজন তরুণের হাত দিয়ে দেশের মাটিতে প্রথম যে আনারের বাণিজ্যিক বাগান সৃষ্টি হয়েছে তা থেকে অনেকেই হয়তো গড়ে তুলতে চাইবেন নতুন করে আনারবাগান। আমিও বিশ্বাস করি, এমন তরুণ উদ্যোক্তা কিংবা একেকজন উদ্যোগী কৃষকের সফল ঘটনাগুলোই বাংলাদেশে ফলের স্বয়ংসম্পূর্ণতা এনে দিতে পারে। ফলে কমে আসবে বিভিন্ন ফলের আমদানি। তবে যারা নতুন করে উদ্যোগ নেবেন তারা যেন অবশ্যই নতুন ফসল সম্পর্কে ভালোমতো জেনে-বুঝে এবং এর বাজার ব্যবস্থাপনা সম্পর্কে ধারণা নিয়ে এগোন। ফল চাষ সম্প্রসারণে বিশেষজ্ঞ ড. মেহেদী মাসুদের কাছে জানতে চেয়েছিলাম, আনার চাষের জন্য কতটা উপযোগী বাংলাদেশের মাটি। তিনি বললেন, ‘প্রযুক্তির ব্যবহারে বিভিন্ন দেশের ফলফসলই আমাদের দেশের মাটিতে ফলানো সম্ভব হচ্ছে। তবে যে-কোনো বাণিজ্যিক উদ্যোগের আগে যাচাই-বাছাই ও সম্ভাবনা পর্যালোচনা করে নেওয়া উচিত।’ আমি মনে করি কৃষকের সচেতনতার পাশাপাশি কৃষি বিভাগ যদি শুরু থেকেই নতুন ফসল চাষ সম্প্রসারণের উপযোগিতা বিচার করে দিকনির্দেশনা দেয় তবে কৃষক উপকার পাবে।
লেখক : মিডিয়া ব্যক্তিত্ব