১৯৭২ সালের ৪ এপ্রিল সর্বপ্রথম বাংলাদেশে সংসদীয় পদ্ধতির সরকার যাত্রা করে। ১৯৭৫ সালের ২৫ জানুয়ারি মাত্র কয়েক মিনিটের মধ্যে সংসদে চতুর্থ সংশোধনের মাধ্যমে জনগণের দেওয়া রায় উপেক্ষা করে একদলীয় সরকার কায়েম হয়। গণতন্ত্রকে যারা পর্যদুস্ত করল আজ তাদের বক্তব্য হলো- গণতন্ত্র বিএনপির হাতে নিরাপদ নয়। ১৯৯১ সালের ১৮ সেপ্টেম্বর বেগম খালেদা জিয়ার নেতৃত্বে সংসদে ১২তম সংশোধনের মাধ্যমে বহু আকাক্সিক্ষত সংসদীয় পদ্ধতির সরকারব্যবস্থা চালু করে জনগণের নেতা নির্বাচনের ক্ষমতা জনগণের কাছে ফিরিয়ে দেওয়া হয়। স্থাপন করা হয় এক বিরল দৃষ্টান্ত। এমনকি বেগম খালেদা জিয়া রাষ্ট্রযন্ত্র ব্যবহার করে নিজের ক্ষমতা আঁকড়ে রাখার পরিবর্তে ১৯৯৬ সালের ২৮ মার্চ ১৩তম সংশোধনের মাধ্যমে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচনের ব্যবস্থা করেন। জনগণ যাতে প্রভাবমুক্ত পরিবেশে নিজের ভোট নিজে প্রয়োগ করতে পারে সেই আকাক্সিক্ষত পদ্ধতি চালু করে জনগণের নেতা নির্বাচনের ক্ষমতা জনগণের কাছে সমর্পণের এক বিরল দৃষ্টান্ত স্থাপন করেন।
জনগণ যাতে নির্বিকারভাবে ভোটাধিকার প্রয়োগ করতে পারে তিনি সেই ব্যবস্থা চালু করেন। ঐতিহাসিকভাবে এ কৃতিত্বের দায় বেগম খালেদা জিয়ার। এ দুটি সংশোধন সংবিধানে এনে জনগণের মৌলিক অধিকার সমুন্নত রাখার এক অনন্য দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন তিনি। তুমুল আন্দোলন করে স্বৈরাচারের পতন ঘটিয়েছিলেন এই সাহসী নেত্রী। তিনি কখনো কোনো স্বৈরাচারের সঙ্গে লং ড্রাইভে যাননি। ১-১১ সরকারের সঙ্গে তিনি সমঝোতা করে ক্ষমতা ভাগাভাগি করেননি। এগুলো হচ্ছে ধ্রুবসত্য। তাই জনগণ অকপটে বেগম খালেদা জিয়াকে ‘গণতন্ত্রের মা’ হিসেবে আখ্যায়িত করে। আর ২০১১ সালের ৩০ জুন একটি বিতর্কিত রায়ের আলোকে ১৫তম সংশোধনের মাধ্যমে নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকার পদ্ধতি বিলুপ্ত করা হয়। এর মাধ্যমে দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচন করার বিধান জারি করে জনগণের ভোটের অধিকার হরণের প্রক্রিয়া উৎসাহিত করা হয়। ১৫তম সংশোধনের অধীনে সংবিধানের ৫৩টি অনুচ্ছেদ চিরকালের জন্য সংশোধন- অযোগ্য করা হয়েছে। জাতীয় ইস্যুতে গণভোটের বিধান বিলুপ্ত করে ক্ষমতা কুক্ষিগত করে রাখার ব্যবস্থা পাকাপোক্ত করে নিশীথ রাতে ভোট প্রদানকে উৎসাহিত করা হয়েছে। এমনকি ১৫তম সংশোধনের মধ্য দিয়ে সাংবিধানিক স্বৈরাচার প্রতিষ্ঠায় উৎসাহ দেওয়া হয়। তা যে কত ভয়ানক তা বুঝতে কারও বাকি নেই। যার ফলে একদিকে যেভাবে এ সংশোধনের কোনো সর্বজনীনতা নেই, অন্যদিকে ক্ষমতায় গিয়ে নির্বিকারভাবে প্রধানমন্ত্রী ও মন্ত্রীরা তাঁদের উত্তরাধিকারী কার্যভার গ্রহণ না করা পর্যন্ত স্ব স্ব দায়িত্বে বহাল থাকার বিধান রেখে নিজেদের ক্ষমতা অপ্রতিরোধ্য করা হয়েছে। সুকৌশলে ধাপে ধাপে সংশোধনের মাধ্যমে গণতন্ত্রকে অবজ্ঞা করে নব্য স্বৈরশাসকের আবির্ভাব ঘটিয়েছে। ২০১৪ সালের ১৯ ডিসেম্বর বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা জাতিকে প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন, ৫ জানুয়ারির নির্বাচন শুধু নিয়ম রক্ষার জন্য। অথচ তিনি সেটা বেমালুম ভুলে গিয়ে পরবর্তীতে নিশিরাতের ভোটের ব্যবস্থা করে গণতন্ত্র প্রশ্নবিদ্ধ করেছেন। গণতন্ত্রের আদি শাশ্বত বাণী নীরবে নিভৃতে কেঁদে কেঁদে বলছে- ‘আমায় স্বৈরাচারের হাত থেকে রক্ষা কর। এদের হাতে গণতন্ত্র কোনো দিন নিরাপদ নয়। আর কার হাতে নিরাপদ ভবিষ্যৎ বলে দেবে।’ ২০১৪ সালের ১৪ নভেম্বর ঢাকায় অনুষ্ঠিত সাবেক ভারতীয় হাইকমিশনারদের বৈঠক শেষে সে দেশের একজন ঝানু কূটনীতিক পিনাকরঞ্জন চক্রবর্তী বলেছিলেন, বাংলাদেশে আদর্শ গণতান্ত্রিক পরিবেশ ফিরে আসুক।’ এ প্রত্যাশায় তিনি আরও বলেছিলেন. বাংলাদেশে একটি আদর্শ নির্বাচনব্যবস্থা, গণতান্ত্রিক পরিবেশ ও শক্তিশালী বিরোধী দল সবাই চায়। পৃথিবীর বৃহত্তম গণতান্ত্রিক দেশ হিসেবে ভারতও এটাই চায়। আমি রাজনৈতিক বিজ্ঞানের একজন ছাত্র হিসেবে দ্বিধাহীন চিত্তে বলতে চাই, Absolute power corrupts absolutely. কর্তৃত্ববাদিতা পরিহার করার উত্তম পথ হচ্ছে To ensure peaceful transfer of power. যা নির্বাচন পরিচালনার জন্য নির্বাচনকালীন নিরপেক্ষ নির্দলীয় সরকার অ্যাডহক ভিত্তিতে গঠনের ব্যবস্থা করা। যার মধ্য দিয়ে জনগণ ফিরে পাবে তাদের বহু আকাক্সিক্ষত ভোটের অধিকার। জাতি মুক্তি পাবে এক শ্বাসরুদ্ধকর ব্যবস্থা থেকে। পথহারা বাংলাদেশে ফিরে আসবে তার মৌলিক ভিত্তি গণতন্ত্র। চরম বিশৃঙ্খলা থেকে শৃঙ্খলা ফিরে পাবে জাতি। এখন বলুন তো, গণতন্ত্র কার হাতে নিরাপদ? স্বৈরশাসকদের সঙ্গে আপস করে যারা ক্ষমতায় আসে তাদের হাতে? না যিনি স্বৈরশাসকদের রক্তচক্ষু উপেক্ষা করে তাদের সঙ্গে আপস না করে নির্ভয়ে দ্বিধাহীনচিত্তে জনগণকে নিয়ে গণতন্ত্রের ঝান্ডা উড়িয়েছেন তার হাতে। এমন একজন নেত্রী যিনি আপসহীন নেত্রী হিসেবে ইতিহাসে স্থান করে নিয়েছেন তিনি হলেন বেগম খালেদা জিয়া। তিনি কারও সঙ্গে আপস করেননি।
সংবিধানে চতুর্থ সংশোধন আনার পরও শাসক দল ক্ষান্ত হয়নি। ১৯৭৩ সালের ২২ সেপ্টেম্বর সংবিধানের দ্বিতীয় সংশোধনের মাধ্যমে দেশে জরুরি অবস্থা ঘোষণার বিধান, বিবর্তনমূলক আটকসংক্রান্ত আইনের মধ্য দিয়ে জনগণের মৌলিক অধিকারে আঘাত হানা হয় সেই আদি বা মূল সংবিধানে বিভিন্ন সময় রাজনৈতিক নেতৃত্বের অধীনে ১৬টি সংশোধন আনা হয়। ১৯৭৫ সালের ২৫ জানুয়ারির সংশোধন গণতন্ত্র থেকে বিচ্যুতি ঘটায়। আর তার বিপরীতে ১৯৭৯ সালের ৬ এপ্রিল প্রথম সংশোধনের মাধ্যমে গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার পুনঃপ্রবর্তন করে বহুদলীয় গণতন্ত্র, সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিল গঠনের মধ্য দিয়ে বিচার বিভাগ তার স্বাধীনতা ফিরে পায়। প্রতিটি রাজনৈতিক দল তার দলীয় রাজনীতি করার অধিকার ফিরে পায়। জাতি একদলীয় শাসনের নাগপাশ থেকে মুক্তি পায়। এর বিপরীতে ২০১১ সালের ৩০ জুন একটি বিতর্কিত রায়ের মাধ্যমে, ১৫তম সংশোধনের মাধ্যমে নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকার বিলুপ্তকরণের মধ্য দিয়ে দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচন করার বিধান জারি করে জনগণের ভোটের অধিকার হরণের প্রক্রিয়া উৎসাহিত করা হয়। এ ১৫তম সংশোধনের অধীনে সংবিধানের ৫৩টি অনুচ্ছেদ চিরকালের জন্য সংশোধন-অযোগ্য করা হয়েছে। সংবিধানের ১৪২ অনুচ্ছেদের উপ-অনুচ্ছেদ-১-এর ‘খ’ গণভোটের বিধান বিলুপ্ত করে জনগণের মতামত উপেক্ষা করা হয়েছে। অথচ বর্তমানে বিশ্বের বিভিন্ন গণতান্ত্রিক দেশে গণভোটের পদ্ধতি প্রচলিত আছে। স্কটল্যান্ড যুক্তরাজ্যের সঙ্গে থাকবে কি থাকবে না এবং ব্রিটেন ইউরোপীয় ইউনিয়নে থাকবে কি থাকবে না তা-ও নির্ধারিত হয় গণভোটের মাধ্যমে। যা আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত গণতান্ত্রিক পদ্ধতি। তত্ত্বাবধায়ক সরকারের বিধান বাতিল করে এক ব্যক্তির কর্তৃত্ববাদী শাসনের ভিত তৈরি করা হয়েছে। ১৫তম সংশোধনের মধ্য দিয়ে সাংবিধানিক কর্তৃত্ববাদ যে কত ভয়ানক তা জনগণ হাড়ে হাড়ে বুঝতে পেরেছে। এ সংশোধনের কোনো সর্বজনীনতা নেই।
এ সংশোধনের ৭৫-এর ‘৩’ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী প্রধানমন্ত্রীর উত্তরাধিকারীর কার্যভার গ্রহণ না করা পর্যন্ত তিনি স্বপদে বহাল থাকবেন। এ সংশোধনের ৫৬-এর ‘৪’ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী সংসদ ভেঙে যাওয়ার অব্যবহিত পূর্বে যারা সংসদ সদস্য ছিলেন তারা সদস্যরূপে বহাল রয়েছেন বলে গণ্য হবেন। এমনকি সংবিধানের এ সংশোধনের ৫৮-এর ‘৪’ ও ‘৫’ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী প্রধানমন্ত্রী ও মন্ত্রীরা তাদের উত্তরাধিকারীগণ কার্যভার গ্রহণ না করা পর্যন্ত স্ব স্ব পদে বহাল থাকবেন। এ ধরনের ১৬টি সংশোধন এনে আদি/মূল সংবিধানে রক্ষিত জনগণের অধিকার তথা স্বাধীনতার মূলমন্ত্র থেকে শাসন পদ্ধতিকে বিচ্যুত ঘটায় আওয়ামী লীগ। এসব সংশোধন এনে জনগণের মৌলিক অধিকার লঙ্ঘন করে জাতিকে এক অনিশ্চয়তার দিকে ঠেলে দেওয়া হয়েছে। এ অবস্থায় কর্তৃত্ববাদীদের ক্ষমতায় থাকা বা আসার পথ খুলে দেওয়া হয়েছে। যেখানে শান্তিপূর্ণভাবে ক্ষমতা হস্তান্তরের পদ্ধতি সংবিধানের ছিল সেখানে আজ জনগণের ভোটের অধিকার নিয়ে জাতি এক সাংঘর্ষিক অবস্থার মুখোমুখি।
এ থেকে উত্তরণের একমাত্র পথ- সংবিধানে বেগম খালেদা জিয়ার নেতৃত্বে ১৯৯১ সালের ১৮ সেপ্টেম্বর সংসদে ১২তম সংশোধনের মাধ্যমে দলীয় সরকারের প্রভাবমুক্ত জনগণের ভোটের অধিকার নিশ্চিত করার লক্ষ্যে নির্দলীয় নিরপেক্ষ তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচন দিলে জাতি এ ভয়ানক পরিস্থিতি থেকে মুক্তি পাবে এবং গণতান্ত্রিক অধিকার পুনঃপ্রতিষ্ঠা হবে। গণতন্ত্র কার হাতে নিরাপদ তা ঐতিহাসিকভাবে সত্য যে, জনগণ কর্তৃক নির্বাচিত সরকারের হাতে গণতন্ত্র সবচেয়ে বেশি নিরাপদ। কোনো কর্তৃত্ববাদী শাসক গণতন্ত্রের লেবাসে ক্ষমতায় থাকলে তাদের হাতে গণতন্ত্র নিরাপদ নয়। জাতিকে অনিশ্চিত অবস্থা থেকে রক্ষার একমাত্র পথ হচ্ছে নেতা নির্বাচনের ক্ষমতা জনগণের হাতে ফিরিয়ে দেওয়া। যারা এ কাজটি করবেন তাদের নাম জাতির ইতিহাসে স্বর্ণাক্ষরে লেখা থাকবে। তথাকথিত নেতাদের হুমকি-ধমকি অসারে পরিণত হবে।
লেখক : সাবেক রাষ্ট্রদূত, মেয়র, মন্ত্রী
সহসভাপতি, বিএনপি