শুক্রবার, ২ ডিসেম্বর, ২০২২ ০০:০০ টা

মায়ের দুধপান সম্পর্কে ইসলামের দৃষ্টিভঙ্গি

মুফতি রুহুল আমিন কাসেমী

মায়ের দুধপান সম্পর্কে ইসলামের দৃষ্টিভঙ্গি

প্রতিটি শিশুর জন্মের পরই আল্লাহ তার জন্য পবিত্র ও জান্নাতি রিজিকের ব্যবস্থা রেখেছেন। আর তা হলো শিশুর মায়ের ভালোবাসা ও পরম মমতায় মিশ্রিত, পবিত্রতা ও পুষ্টিগুণে সমৃদ্ধ বুকের দুধ। ইসলাম প্রতিটি শিশুকে মায়ের দুধ পান করানোর ব্যাপারে বিশেষ গুরুত্ব আরোপ করেছে। এ বিষয়ে কোরআন মাজিদে ইরশাদ হয়েছে, ‘মায়েরা তাদের সন্তানদের পূর্ণ দুই বছর দুধ পান করাবে’ (সুরা বাকারা, আয়াত ২৩৩) অন্যত্র ইরশাদ করেন, ‘আমি তো মানুষকে তার পিতা-মাতার প্রতি সদাচরণের নির্দেশ দিয়েছি। তার মা তাকে কষ্টের পর কষ্ট করে গর্ভে ধারণ করে। এরপর তার দুধ ছাড়ানো হয় দুই বছরে।’ (সুরা লোকমান, আয়াত ১৪) অন্য আয়াতে ইরশাদ হয়েছে, ‘আমি মুসার মায়ের অন্তরে ইঙ্গিতে নির্দেশ দিলাম তাকে দুধ পান করাও।’ (সুরা কাসাস, আয়াত ৭) আরও ইরশাদ হয়েছে, ‘তাকে গর্ভে ধারণ করতে ও দুধ ছাড়াতে লাগে ৩০ মাস।’ (সুরা আহকাফ, আয়াত ১৫) ওপরের আয়াতগুলো থেকে এ কথা স্পষ্টভাবে বোঝা যায় যে, মায়েরা তাদের শিশুকে পূর্ণ দুই বছর দুধ পান করাতে পারবে। প্রয়োজনে আরও ছয় মাস বাড়ানো যেতে পারে। সে সময় তাকে দুধ ছাড়ানোর বিশেষ পরিকল্পনা অনুযায়ী চেষ্টা চালিয়ে যেতে হবে। ৩০ মাস পর আর কোনোক্রমেই তাকে দুধ পান করানো যাবে না। চিকিৎসাবিজ্ঞানও এ বিষয়ে একমত, যে শিশুকে কমবেশি দুই বছর দুধ পান করানো উচিত। অনুরূপভাবে, মা বা শিশুর শারীরিক অসুস্থতার অবস্থায় বিশেষ বিশেষ ক্ষেত্রে চিকিৎসাবিজ্ঞানেও শিশুকে বুকের দুধ পান থেকে বিরত রাখার কথা বলা হয়েছে। যেমনটি পাওয়া যায় হাদিসে। প্রিয় নবী মুহাম্মাদ (সা.) ইরশাদ করেন, ‘তোমাদের সন্তানদের দেহপসারিণী ও পাগলিনীর দুধ পান করানো থেকে দূরে রাখো।’ আধুনিক চিকিৎসা-বিজ্ঞান থেকে জানা যায়, দেহপসারিণীর দুধপানে শিশু হেপাটাইটিস বি ভাইরাস, এমনকি এইডস ভাইরাসে আক্রান্ত হতে পারে। মাতৃদুগ্ধ পান করানোর প্রতি উৎসাহ প্রদান করে প্রিয় নবী (সা.) আরও ইরশাদ করেন, ‘আল্লাহ মুসাফিরের ওপর থেকে চার রাকাত -বিশিষ্ট নামাজের অর্ধেক রহিত করে দিয়েছেন। আর মুসাফির, স্তন্যদানকারী ও গর্ভবতী মায়েদের থেকে রমজানের ফরজ রোজা রাখার বাধ্যবাধকতাও উঠিয়ে দিয়েছেন।’ (তিরমিজি, আবু দাউদ) হজরত ওমর ফারুক (রা.)-এর শাসনামলে প্রথম দিকে যেহেতু মাতৃদুগ্ধ পানরত শিশুরা রাষ্ট্রীয় কোষাগার থেকে আর্থিক অনুদান পেত না, সেহেতু মায়েরা শিশুদের জন্য অনুদান পাওয়ার আশায় তাড়াতাড়ি বুকের দুধ খাওয়ানো ছাড়িয়ে দিতেন। এ অবস্থা লক্ষ করে হজরত ওমর শিশুদের বুকের দুধদানে মায়েদের উৎসাহিত করার উদ্দেশ্যে জন্মের পর থেকেই এই আর্থিক অনুদান চালু করেন। এ কথা নির্দ্বিধায় বলা চলে, আজকের চিকিৎসাবিজ্ঞান শিশুকে মাতৃদুগ্ধ দানের ব্যাপারে যে গুরুত্বের কথা বলছে, সেই গুরুত্বের কথা ইসলাম আজ থেকে ১৪০০ বছর আগেই ঘোষণা করেছে। আজকে বিশ্বব্যাপী মাতৃদুগ্ধ দানের ব্যাপারে যে আন্দোলন গড়ে উঠেছে, এমনকি বিশ্বজুড়ে প্রতি বছর ১ আগস্ট ‘বিশ্ব মাতৃদুগ্ধ দিবস’ পালিত হচ্ছে, তা ইসলামের দৃষ্টিভঙ্গিরই প্রতিফলন। প্রতিটি শিশুর জন্য মায়ের দুধের কোনো বিকল্প নেই। তাই শিশুর জন্য মায়ের দুধ পান করা অপরিহার্য। মায়ের বুকের দুধ হচ্ছে শিশুর জন্য প্রয়োজনীয় পুষ্টি উপাদানযুক্ত আল্লাহপ্রদত্ত এমন তৈরি খাবার, যা শিশু সহজেই হজম করতে পারে। শিশু স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করে এবং শিশুর দেহের পূর্ণাঙ্গ বৃদ্ধি ঘটিয়ে থাকে এবং সময়ের পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে শিশুর দেহের খাদ্য চাহিদার যে পরিবর্তন ঘটে, মায়ের বুকের দুধের উপাদানেও অনুরূপ পরিবর্তন প্রতিদিনই ঘটতে থাকে। যে তাপমাত্রায় বাচ্চার শরীর সহজেই এ দুধ গ্রহণ করে কাজে লাগাতে পারে, মায়ের বুকের দুধে ঠিক সে তাপমাত্রাই পাওয়া যায়। তাই শিশুর জন্য মায়ের দুধের বিকল্প নেই। মায়ের বুকের দুধে বেশকিছু রোগপ্রতিরোধক উপাদান থাকে যেমন আইজিএ, ল্যাকটোফেরিন, লাইসোজাইম ইত্যাদি। এ ছাড়া মায়ের দুধে প্রচুর শ্বেত রক্তকণিকা ও সংক্রামক রোগপ্রতিরোধক রয়েছে; যার ফলে শিশুর ডায়রিয়া, কান পাকা রোগ, শ্বাসনালির রোগ কম হয়। এ ছাড়া মাতৃদুগ্ধ পানে হৃৎপিণ্ডের রোগ, করোনারি হার্ট ডিজিজ, খাদ্যনালির রোগ ইত্যাদি প্রতিরোধ করে। মায়ের দুধপান শিশুর চেহারায় লাবণ্য সৃষ্টি করে, বাকশক্তি ও সাধারণ বুদ্ধি বিকাশে সাহায্য করে; যা শিশুর সুস্থসবল সুন্দর জীবনের জন্য অত্যন্ত প্রয়োজন। যে মায়েরা শিশুকে বুকের দুধ পান করান, তাদের জরায়ু দ্রুত গর্ভধারণের পূর্বাবস্থায় ফিরে আসে। তলপেটের থলথলে ভাব ক্রমান্বয়ে চলে যায়। গর্ভধারণের সময় শরীরে যে চর্বি জমা হয়, শিশুকে দুধ পান করালে তা নিঃশেষ হয়ে যায়। আর মায়ের শারীরিক সৌন্দর্য বাড়িয়ে তোলে। স্তন্যদানকারী মায়েদের প্রসব-পরবর্তী স্রাব তুলনামূলক অনেক কম হয়। যে মায়েরা শিশুকে বুকের দুধ পান করান, তাদের স্তন ক্যান্সারের হার তুলনামূলক অনেক কম হয়। এ ছাড়া মাতৃদুগ্ধদানের ভিতর দিয়ে মা ও শিশুর মাঝে এমন একটি শারীরিক, মানসিক, রক্ত ও দুগ্ধের, মায়া-মমতা ও ভালোবাসার বন্ধন রচিত হয়, যা পৃথিবীর বুকে সর্বোচ্চ শক্তিশালী ও চিরস্থায়ী বন্ধন; যা কেউ অস্বীকার করতে পারে না।

লেখক : ইমাম ও খতিব : কাওলারবাজার জামে মসজিদ, দক্ষিণখান, ঢাকা

সর্বশেষ খবর