মঙ্গলবার, ২০ ডিসেম্বর, ২০২২ ০০:০০ টা

মহাগৌরবের ডিসেম্বর

বঙ্গবীর কাদের সিদ্দিকী বীরউত্তম

মহাগৌরবের ডিসেম্বর

বাঙালি জাতির পরম গৌরব ও মর্যাদার মাস ডিসেম্বর শেষ হতে চলল। ’৭১-এর ডিসেম্বরে যেমন অনেক ঘটনা ঘটেছে। একটা জালেম গোষ্ঠীর হাত থেকে জাতি মুক্ত হয়েছে। সেই ডিসেম্বর আস্তে আস্তে শেষের পথে। তবে এই অতি সম্প্রতি রাজনীতির আকাশে সামান্য এক শুভ বাতাস লক্ষ করা যাচ্ছে। সেটা হলো ২৪ ডিসেম্বর আওয়ামী লীগ আহূত জাতীয় সম্মেলনের দিন প্রধান বিরোধী দল বিএনপির ঘোষিত কর্মসূচি পিছিয়ে নেওয়া হয়েছে। রাজনীতিতে বা সামাজিকভাবে একে অন্যের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হলে দেশ অনেকদূর এগিয়ে যেত এবং মানুষের জীবন অনেক বেশি নিরাপদ ও স্বাচ্ছন্দ্য হতো। গত দুই মাস বিএনপি সারা দেশে বিভাগীয় জমায়েত করেছে। জমায়েত যাতে না হয়, লোকজন যাতে না আসে এসবের জন্য সর্বত্র রাস্তাঘাট, গাড়িঘোড়া সরকার এবং সরকারি দল বন্ধ করে দিয়েছে। যে কারণে ৩-৪ ঘণ্টার সমাবেশগুলো ৪০-৫০ ঘণ্টার হয়েছে। উপরন্তু নির্বিঘ্নে সমাবেশগুলো হলে হলফ করে বলা যায়, এ কটি সমাবেশে কম করে ২৫-৩০ জন বিরোধী কর্মী নিজেরা নিজেরা মারামারি করে নিহত হতো, তিন-চার শ আহত হতো। কার আগে কে বসবে, কে আগে কে পরে বক্তৃতা করবে, মঞ্চের কোন চেয়ারটা কার দখলে থাকবে এসব নিয়ে মারামারি করে ২-৪ হাজার চেয়ার ভেঙে বরবাদ করত। সরকারি চাপাচাপিতে ভোজবাজির মতো দলীয় অন্তঃকলহ অনেকাংশেই আপনাআপনি স্তিমিত হয়ে গেছে। এতে বলা যায়, এসব করে সরকার বরং বিএনপির উপকারই করেছে। সবসময় বিরোধী দলে দু-চার জন সরকারি লোক থাকে। ছোট কর্মী যেমন থাকে তেমনি বড় নেতাও থাকে। অনেকে বহাল তবিয়তে থাকে, কেউ কেউ আবার ধরা পড়ে। এই পুরো ডিসেম্বরে সরকার ও সরকারি দল অনেক প্রোগ্রাম করছে। অনেক জায়গায় মাঠ ভরে গেছে, কোনো কোনো জায়গায় আবার খালি থাকছে। ১১ ডিসেম্বর টাঙ্গাইল স্বাধীন হয়েছিল। আওয়ামী লীগ এবং সরকারি কর্মকর্তারা নানাভাবে ১৬ ডিসেম্বর পালন করছে। কখনো লোক হচ্ছে, কোনো কোনো জায়গায় হচ্ছে না। মানুষের ভিতর যে উদ্দীপনা-জাগরণ থাকার কথা কী করে যেন তা স্তিমিত হয়ে গেছে। এবারের ১৬ ডিসেম্বরে সারা দেশে কয়টা জাতীয় পতাকা উঠেছে বলতে পারব না। অথচ পাকিস্তানের শেষ সময়ে ’৭১-এর ২৩ মার্চ সারা দেশে যে পতাকা উঠেছিল সে এক বিস্ময়। আমার আজও মনে আছে, ২৩ মার্চ বিন্দুবাসিনী স্কুলমাঠে টাঙ্গাইল জেলা ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের পক্ষ থেকে পতাকা দিবস পালন করা হয়েছিল। অগণিত লোক এসেছিল সে সভায়। আমরা বাংলাদেশের পতাকা উড়িয়ে শপথ নিয়েছিলাম। সেই সভায় সভাপতিত্ব করেছিলেন ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের যুগ্ম আহ্বায়ক আলমগীর খান মেনু। আমি সভা পরিচালনা করেছিলাম। শপথ করিয়েছিলেন আমাদের নেতা লতিফ সিদ্দিকী এমপি। লতিফ ভাইয়ের কখন কী মনে হয় সেটা তাঁর ব্যাপার। কিন্তু আমার মনে হয় বড় ভাই লতিফ সিদ্দিকীর জীবনের শ্রেষ্ঠ সফলতা ’৭১-এর ২৩ মার্চ পাকিস্তান দিবসে বাংলাদেশের জন্য শপথবাক্য পাঠ করানো। হাজার পঞ্চাশেক সাধারণ মানুষ হৃদয় দিয়ে লতিফ সিদ্দিকীর উচ্চারিত প্রতিটি শব্দ বুকে ধারণ করেছিলেন। লতিফ সিদ্দিকী আরও একটি শপথ করিয়েছিলেন টাঙ্গাইল সার্কিট হাউস প্রাঙ্গণে। ২ নম্বর বেঙ্গল রেজিমেন্টের বি কোম্পানি যখন আমাদের সঙ্গে একাত্মতা ঘোষণা করে তখন। একজন মানুষ যদি তার জীবনে একটা দেশের জন্য, স্বাধীনতার জন্য দুবার এমনি শপথবাক্য পাঠ করানোর গৌরব অর্জন করেন একজন রাজনৈতিক ব্যক্তির, একজন দেশপ্রেমিক মানুষের আর কোনো চাহিদা থাকার কথা না। একজন রাজনৈতিক মানুষের জীবনের এ এক শ্রেষ্ঠ প্রাপ্তি যা অনেক মানুষের ভাগ্যে জোটে না।

আমি একজন অতি সাধারণ মানুষ। ছাত্রজীবনে লেখাপড়ার প্রতি তেমন আকর্ষণ ছিল না। দু-চারটা গল্পের বই টানতে পারলেও আকর্ষণ করলেও স্কুল-কলেজের কোনো বই-ই আমাকে সেভাবে টানতে পারেনি। তাই খুব বেশি নিবিষ্টমনে লেখাপড়া করা হয়নি। ’৭৫-এর ১৫ আগস্ট নেতা ও পিতা ঘাতকের হাতে নির্মমভাবে নিহত হলে তার প্রতিবাদে এক কাপড়ে ঘর ছেড়েছিলাম। সীমান্তে সীমান্তে প্রতিরোধ গড়ে তুলেছিলাম। হাজার হাজার মুজিবভক্ত পাশে দাঁড়িয়ে ছিল। সেই কঠিন সময় বড় কঠিনভাবে পার করেছি। ভারতের মাটিতে এক যুগের বেশি কাটিয়েছি। জীবনে অনেক কিছু দেখেছি। একটা জাতির স্বাধীনতার সাক্ষী হওয়ার সৌভাগ্য খুব বেশি মানুষের হয় না। পৃথিবীর ৭০০ কোটি মানুষের মধ্যে ২-১ কোটি মানুষও সেই সৌভাগ্য অর্জন করে না। আর বাংলাদেশের মতো এত রক্ত ঢেলে খুব কম দেশই স্বাধীন হয়েছে। তাই সে স্বাধীনতা নিয়ে কেউ কেউ যখন বাড়াবাড়ি করে দম্ভ দেখায় তখন খুব একটা ভালো লাগে না। যে যা-ই বলুন, লতিফ সিদ্দিকীর জন্ম না হলে আমি আজকের অবস্থানে থাকতাম না। তাঁকে অবলম্বন করেই রাজনীতিতে এসেছিলাম, রাজনীতিতে এসে বঙ্গবন্ধুকে পেয়েছিলাম। তাই আজ আমি এখানে। কষ্ট হোক দুঃখ হোক একটা দেশকে স্বাধীন করেছি। কোনো দেশ স্বাধীন করার সুযোগ খুব বেশি মানুষ পায় না। কিন্তু আমি আমরা স্বাধীনতা অর্জনে একজন ভাগ্যবান যোদ্ধা। নির্বাসিত জীবনে ভারতের মহান নেতা অটল বিহারি বাজপেয়ি যখন প্রধানমন্ত্রী তখন তাঁর এমপি হিসেবে পাওয়া যন্তরমন্তর রোডের বাড়ির বৈঠকখানার দেয়ালে বিশাল ছবি দেখে বিস্মিত হয়েছিলাম। সেখানে যেমন মহাত্মা গান্ধীর সঙ্গে অটল বিহারি বাজপেয়ির বাবার ছবি ছিল তেমনি পাকিস্তানের পিতা মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ, লিয়াকত আলী খান, বল্লভ ভাই প্যাটেল, রাম মনোহর লহিয়া আরও অনেকের ছবি। কেন যেন আনমনে ছবির পরিচিতি পড়ছিলাম। পড়তে পড়তে এক জায়গায় হঠাৎই চোখ পড়ে আলাউদ্দিন সিদ্দিকী অব বেঙ্গল। বিস্মিত হয়ে যাই আমার দাদার ছবি এখানে! এত বড় বড় ভারতীয় নেতার মাঝে আমার দাদা আলাউদ্দিন সিদ্দিকী? তখন মোবাইল ছিল না, ক্যামেরায় ছবি তুলতে হতো। কেন যে সে সময় সেই ছবিটি তুলিনি বলতে পারব না। মার কাছে শুনেছি বড় ভাই লতিফ সিদ্দিকীর জন্মের ৪০ দিন পর দাদু মারা যান। সেদিন ১৭ ডিসেম্বর আলাউদ্দিন সিদ্দিকী মহাবিদ্যালয়ের সুবর্ণজয়ন্তীর অনুষ্ঠানে ছোট বোন রহিমা তার বক্তৃতায় বলল, ২২ দিন পর মারা গেছেন। ঠিক সেই সময় লতিফ ভাই বললেন সাত দিন। তা যে কদিনই হোক আমরা আমাদের দাদু আলাউদ্দিন সিদ্দিকীকে দেখিনি। বাবা মৌলভী মুহাম্মদ আবদুল আলী সিদ্দিকীর বয়স ছিল তখন ২৪-২৫ বছর। জমিজমা-ঘরবাড়ি থাকতেও সংসার চালানো না জানায় যথেষ্ট কষ্ট করতে হয়েছে। দাদু মরে যাওয়ায় ছন্নছাড়া সিদ্দিকী পরিবার বড় ভাই লতিফ সিদ্দিকীর কল্যাণে আবার মাজা সোজা করে মাথা তুলে দাঁড়ায়। বাবা আমাদের গ্রামের বাড়ি ছাতিহাটি থেকে টাঙ্গাইল নিয়ে আসেন। ’৫৮ সালে আইয়ুব খানের মার্শাল লর পুরো চাপটাই যায় আমাদের ওপর দিয়ে, আমাদের পরিবারের ওপর দিয়ে।

বাবা জেলে, লতিফ ভাই জেলে আমাদের পরিবারটা খ-বিখ-, একেবারে তছনছ। কত কষ্ট করে মা আমাদের ধরে রেখেছিলেন তা আল্লাহ ছাড়া কেউ জানে না। ’৬৯-এর মহানায়ক তোফায়েল আহমেদের নেতৃত্বে তীব্র আন্দোলনের মধ্য দিয়ে বঙ্গবন্ধু আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা থেকে মুক্ত হয়ে বেরিয়ে আসেন। টুঙ্গিপাড়ার শেখ লুৎফর রহমানের ছেলে শেখ মুজিবুর রহমান হন আপামর বাঙালির প্রিয় নেতা বঙ্গবন্ধু। এরপর বেশি সময় লাগেনি। ’৬৯-এর ফেব্রুয়ারি থেকে ’৭১-এর মার্চ মাত্র দুই বছর। আইয়ুব খানের বদলে ইয়াহিয়া খান এসে প্রকাশ্য রাজনীতি বন্ধ করলেও ’৭০-এর পয়লা জানুয়ারি পর্যন্ত ঘরোয়া রাজনীতি অবাধে চলতে থাকে। ’৭০ চলে যায় দেখতে দেখতে। ’৭১ আরও তাড়াতাড়ি যেতে থাকে। ৩ মার্চ ঢাকায় জাতীয় পরিষদের অধিবেশন বসার কথা ছিল। কিন্তু হঠাৎ করেই পয়লা মার্চ ইয়াহিয়া খান জাতীয় পরিষদের অধিবেশন স্থগিত ঘোষণা করেন। ইয়াহিয়া খানের সিদ্ধান্ত কেউ মেনে নেয়নি। বাঙালি রুখে দাঁড়ায়। বঙ্গবন্ধু ৭ মার্চ তাঁর সিদ্ধান্ত জানিয়ে দেন। সাড়ে ৭ কোটি বাঙালি স্বাধীনতার আকাক্সক্ষায় উদ্বেল হয়ে ওঠে। ইয়াহিয়া খান তার সেনাবাহিনীকে সাধারণ মানুষের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়তে নির্দেশ দেন। লাখ লাখ বাঙালির প্রাণ যায়, মা-বোনের ইজ্জত যায়। লাখো ঘরবাড়ি পুড়ে ছারখার করে দেয়। নেতারা ভারতে আশ্রয় নিলেও সাধারণ মানুষ, আমরা ছোটরা পাকিস্তানিদের উদ্ধত হাত চেপে ধরার চেষ্টা করি। অনেক প্রতিবাদী নিহত হয়, শহীদ হয়। কিন্তু সাধারণ মানুষের স্বতঃস্ফূর্ত সহযোগিতায় আস্তে আস্তে আমি দাঁড়িয়ে যাই এবং এক বিশাল বাহিনী গড়ে ওঠে। আস্তে আস্তে আপনাআপনি সে বাহিনীর নাম হয়ে যায় কাদেরিয়া বাহিনী। কাদেরিয়া বাহিনী গঠনে আমার তেমন কোনো ভূমিকা নেই। বরং কিছু সময় কাদেরিয়া বাহিনী যাতে না হয় তার জন্য ভূমিকা আছে। কিন্তু প্রতিদিন এখানে সেখানে যুদ্ধ, পাকিস্তানিদের ঘন ঘন পরাজয় এসব কে করেছে কার সঙ্গে যুদ্ধ হয়েছে এগুলো বলাবলি করতে করতেই কাদেরিয়া বাহিনী হয়ে যায়। আগস্টের পর আর কোনোভাবেই সাধারণ মানুষের কাছে কাদেরিয়া বাহিনীর নাম চেপে রাখা সম্ভব হয়নি। হানাদাররা যেমন যুদ্ধে পারেনি, তেমনি কাদেরিয়া বাহিনী বলতে আমরা সাধারণ মানুষের মুখ আটকাতে পারিনি।

১৬ ডিসেম্বর পাকিস্তান হানাদার বাহিনী আত্মসমর্পণ করলে বাঙালি জাতি স্বাধীনতার আনন্দে উদ্বেল হয়ে ওঠে। দিকে দিকে জয়ধ্বনি। কিন্তু যাকে ঘিরে স্বাধীনতা সেই বঙ্গবন্ধু তখনো পাকিস্তানের কারাগারে বন্দি থাকায় আমরা আনন্দের মাঝেও নিরানন্দিত ছিলাম। বেশি সময় অপেক্ষা করতে হয়নি। ১৬ ডিসেম্বর থেকে ৮ জানুয়ারি আমাদের নেতা-পিতা পাকিস্তানের কারাগার থেকে মুক্ত হয়ে লন্ডন-দিল্লি হয়ে স্বাধীন স্বদেশে ফিরে আসেন। চলতে থাকে আরেক সংগ্রাম- দেশ গড়ার সংগ্রাম। এর মাঝে সখিপুর পাহাড়ের উজ্জ্বল নক্ষত্র হামিদুল হক বীরপ্রতীক, খোরশেদ আলম আরও, সালাম ফকির, শওকত মোমেন শাজাহান আরও কয়েকজনের প্রচন্ড পীড়াপীড়িতে সখিপুরে একটি কলেজ স্থাপনের সিদ্ধান্ত হয়। নাম করা হয় ‘কাদেরনগর মুজিব কলেজ’। বেশকিছু মানুষের অক্লান্ত পরিশ্রমে কলেজের অবকাঠামো গড়ে ওঠে। পাঠদানের স্বীকৃতি চাইলে দেখা যায় স্বীকৃতি বা অনুমতি লটকে আছে। অধ্যাপক ইউসুফ আলী তখন শিক্ষামন্ত্রী। তাঁর কাছে জিজ্ঞাসা করলে তিনি বলেন, ‘এটা আমাদের কাছে নয়, সবই তোমার নেতার কাছে।’ ছুটে যাই বঙ্গবন্ধুর কাছে। তিনি বলেন, ‘কাদের, আমার নামে কোথাও স্কুল-কলেজ হোক এটা আমি চাই না।’ দেশবাসী সবাই জানে চাটু মারা, পোঁ ধরা আমার ধাতে সয় না। তাই বঙ্গবন্ধুর সামনে কোনো কিছু বলতে আমার ঠোঁটে বাধত না। বলেছিলাম, আপনার নামে কে কলেজ করছে। আপনি শেখ লুৎফর রহমানের ছেলে হতে পারেন। আমরা তো আমাদের নেতা শেখ মুজিবুর রহমানের নামে মুজিব কলেজ করছি। তিনি আর কথা বাড়াননি। আবেদনে লিখেছিলেন, ‘সখিপুরের এই কাদেরনগর মুজিব কলেজ ছাড়া আমার নামে আর কোনো কলেজ স্বীকৃতি বা অনুমোদন পাবে না।’ খাতাপত্র খুঁজলে এখনো বঙ্গবন্ধুর হাতের লেখা পাওয়া যাবে। সেই সখিপুর মুজিব কলেজেরও ৫০ বছর বা সুবর্ণজয়ন্তী। কিন্তু জানি তারা সবাই ঘুমিয়ে আছে। আউলিয়াবাদ আলাউদ্দিন সিদ্দিকী মহাবিদ্যালয়ের শত শত ছাত্র প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। সুবর্ণজয়ন্তীর দিনের অনুষ্ঠানে গাড়িঘোড়ার সমারোহ দেখে বিস্মিত আশ্চর্যান্বিত হয়েছি। মুক্তিযুদ্ধের প্রাণকেন্দ্র কাদেরনগর মুজিব কলেজের এবারের ফলাফল ভালো নয়। এসব ভাবলে বড় কষ্ট হয়। দাদা আলাউদ্দিন সিদ্দিকীর নামে আউলিয়াবাদ আলাউদ্দিন সিদ্দিকী মহাবিদ্যালয়ের সুবর্ণজয়ন্তীতে খুব ভালো লেগেছে। বিশেষ করে ফুল দিয়ে সাজানো চার চাকার ঘোড়ার গাড়িতে আউলিয়াবাদ থেকে দাদার কবর জিয়ারতে ছাতিহাটি আসা এ এক দুর্লভ ঘটনা। আমি জীবনে কখনো চার চাকার ঘোড়ার গাড়িতে উঠিনি। ৬৫-৭০ বছর আগে দু-চার বার দুই চাকার ঘোড়ার গাড়িতে উঠেছি যখন মা ছাতিহাটি থেকে টাঙ্গাইল যেতেন অথবা টাঙ্গাইল থেকে ছাতিহাটি আসতেন। তাই চার চাকার ঘোড়ার গাড়িতে জীবনে প্রথম চড়া শেষ বয়সে যেমন একটা অপার আনন্দ পেয়েছি তেমনি অস্বস্তিও লেগেছে। লতিফ ভাই আর আমি পাশাপাশি, ভাবি বসেছিলেন উল্টোমুখী হয়ে সামনে। ফেরার পথে সাজানো ঘোড়ার গাড়িতে আর উঠিনি। এসেছিলাম তিন চাকার ভ্যান গাড়িতে। সামনে ছিল দারুণ সাজগোছ করা কুলো হাতে ১০-১২টি মেয়ে। তবে শিক্ষক-কর্মচারী সবার মধ্যেই একটা অপূর্ণতা লক্ষ করেছি। শুধু খারাপ লেগেছে লতিফ সিদ্দিকীর মতো একজন জননেতার প্রতিষ্ঠিত মহাবিদ্যালয়ে সাধারণ মানুষের জন্য দরজা বন্ধ। কলেজের সাবেক এবং বর্তমান শিক্ষার্থীদের নিয়ে অনুষ্ঠান এবং তাদের জন্য আলাদা খাবার ব্যবস্থা। ব্যাপারটা দরজা খোলা রেখে করা যেত। কিন্তু বলতে গেলে সব দিক থেকে হিসাব করলে সামান্য ত্রুটিবিচ্যুতি থাকলেও মফস্বল শহরে একটি চমৎকার শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের জন্য এ এক অসাধারণ সুবর্ণজয়ন্তী উদযাপন। একসময় কৃষ্টি-সভ্যতায় বাঙালি ছিল সবার আগে। এখন আর অনেক সাংস্কৃতিক কর্মকান্ডই গ্রামেগঞ্জে তেমন মাথা তুলে দাঁড়ায় না। কেমন যেন নেশায় বুঁদ হয়ে আছে।

বিজ্ঞানের অগ্রগতি ইন্টারনেটের ব্যাপক ব্যবহার আমাদের অন্ধ করে ফেলেছে। আফিমের নেশার চাইতেও ইন্টারনেটের নেশা বেশি। আমরা যারা ফেসবুকের নেশায় এখনো মত্ত নই, মোবাইলের অত বেশি বোতাম টিপতে জানি না তারা অনেকেই বুঝি না বাহ্যিক অনেক নেশার চাইতে ইয়াবা-হেরোইন-চরস-গাঁজা সবকিছু পিছে ফেলে দিয়েছে ইন্টারনেট। ফেসবুকের ফেস সে যে কত বড় সর্বগ্রাসী একটু নিবিড়ভাবে ভাবলেই বোঝা যাবে। তাই মনে পড়ে লোকমান হোসেন ফকিরের সেই কালজয়ী গান-

‘আবার জমবে মেলা বটতলা হাটখোলা অঘ্রানে নবান্নে উৎসবে,

সোনার বাংলা ভরে উঠবে সোনায়- বিশ্ব অবাক চেয়ে রবে।’

কবে যে আমরা আবার আমাদের প্রাণের কৃষ্টি-সভ্যতা খুঁজে পাব সেই অপেক্ষায় আছি।

লেখক : রাজনীতিক

www.ksjleague.com

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর