শনিবার, ২৪ ডিসেম্বর, ২০২২ ০০:০০ টা

রাষ্ট্র মেরামতের কে কারিগর, কে ঠিকাদার

সৈয়দ বোরহান কবীর

রাষ্ট্র মেরামতের কে কারিগর, কে ঠিকাদার

উদয়ন, নবারুণ, সোভিয়েত নারী- এসব ছিল কিশোর বয়সের উত্তেজনার কিছু নাম। কিছু আবেগ আর ভালোবাসার নাম। অসাধারণ ছাপা। পরিপাটি পরিচ্ছন্ন কিছু ম্যাগাজিন। এই ম্যাগাজিনগুলো আসত সুদূর সোভিয়েত ইউনিয়ন (বর্তমানে রাশিয়া) থেকে। ছোটবেলায় বিস্ময়ে অবাক হতাম। প্রতিটি ম্যাগাজিনে শিক্ষণীয় অনেক বিষয় থাকত। ম্যাগাজিনগুলোর অঙ্গসৌষ্ঠব এতই পরিপাটি ছিল যে, কেউ এসব ম্যাগাজিন উপেক্ষা করতে পারত না। সে সময় ‘উদয়ন’-এর প্রতিটি সংখ্যায় রুশ উপকথা প্রকাশ পেত। প্রতিটি উপকথার মধ্যে শিক্ষণীয় বক্তব্য থাকত। এরকমই একটি রুশ উপকথা আজ মনে পড়ে গেল। এক ব্যক্তি ঠিক করলেন তার জীর্ণ বাড়িটা মেরামত করবেন। বাড়ি মেরামতের জন্য তিনি একজন কারিগরের (মিস্ত্রি) সঙ্গে কথা বললেন। কারিগর বাড়িটি সরেজমিন দেখলেন। চালটা ফুটো। ওই ফুটো দিয়ে বরফ ঢুকে ঘরের মেঝে জমাট হয়ে যায়। দেয়ালে চির, জানালা ভাঙা। এসব দিয়ে হিমশীতল বাতাস আসে। কারিগর সব দেখেশুনে ঘর মেরামতের একটা হিসাব দিলেন। এই হিসাব দেখে তো বাড়ির মালিক রীতিমতো আঁতকে উঠলেন। এত রুবল (রুশ মুদ্রা) তিনি কোথায় পাবেন? কারিগর পরামর্শ দিলেন, মহাজনের কাছে যাও। ঋণ নাও। তারপর আস্তে আস্তে শোধ করবে। বাড়িওয়ালা দেখলেন পরামর্শ মন্দ না। গেলেন মহাজনের কাছে। মহাজন বললেন, ঋণ তো আমি দিতেই পারি। কিন্তু ঋণের গ্যারান্টি দিতে হবে। মহাজন বললেন, তোমার বাড়ির দলিল আমাকে দাও। ঋণ শোধ হয়ে গেলে নিয়ে যেও। বাড়িওয়ালা রাজি হলেন। জমির দলিল দিয়ে ঋণ নিলেন। কারিগরকে দিয়ে বাড়ি মেরামতের কাজ শুরু করলেন। এর মধ্যে কারিগরের খরচের ফর্দ বাড়ে। নতুন নতুন খরচ যুক্ত হয়। বাড়িওয়ালাও মহাজনের কাছ থেকে আরও ঋণ নেন। একপর্যায়ে বাড়ি মেরামতের কাজ শেষ হলো। মহাজনও এসে হাজির হলেন। ঋণ শোধ কর। বাড়িওয়ালা বললেন, আমি এখন কীভাবে ঋণ শোধ করব। আমি তো আস্তে আস্তে ঋণ পরিশোধের কথা বলেছি। মহাজন নাছোড়বান্দা। একপর্যায়ে জোর করে বাড়িওয়ালাকে উচ্ছেদ করলেন। মেরামত করা বাড়ি দখল করলেন মহাজন। আর বাড়ির মালিক হলেন উদ্বাস্তু। সর্বহারা। এই গল্পের শিক্ষা হলো, তোমার সাধ্যের বাইরে গিয়ে কিছু করতে যেও না। সব হারাবে। বহু বছর পর বিএনপির রাষ্ট্র মেরামতের রূপরেখা পড়ে রুশ ওই উপকথা মনে পড়ে গেল। বাংলাদেশ রাষ্ট্র মেরামতের জন্য বিএনপি কোন মহাজনের কাছে হাত পাতবে? কে হবে এই রাষ্ট্র মেরামতের কারিগর? বিএনপির রাষ্ট্র মেরামতের রূপরেখার ২৭ দফার দুটি দিক রয়েছে। একটি হলো- এই ২৭ দফাকে কীভাবে বাস্তবায়ন করবে। অন্যটি হলো- ২৭ দফায় কী আছে। ‘রাষ্ট্র মেরামত’ মূলত একটি উপনিবেশিক ধারণা। যুক্তরাজ্য, ফ্রান্স, পর্তুগাল পৃথিবীর বিভিন্ন দেশ অন্যায়ভাবে দখল করেছিল। লুণ্ঠন করেছিল। সভ্যতা এবং মানবতার চরম অবমাননা করেছিল। আর তাদের এই অপরাধের বৈধতা দেওয়ার জন্য তারা ‘রাষ্ট্র মেরামত’ তত্ত্ব হাজির করেছিল। বর্বর নিপীড়ন এবং নির্যাতনের মাধ্যমে ব্রিটিশরা এই উপমহাদেশে ‘সভ্যতা’ শিখিয়েছিল। দক্ষিণ আফ্রিকায় ভয়ংকর হিংস্রতার পর রাষ্ট্র মেরামতের জন্য ডাক দিয়েছিল। একালেও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র আফগানিস্তান, ইরাক আক্রমণ করে তছনছ করেছিল। সেই ক্ষত সারানোর জন্য ‘রাষ্ট্র মেরামত’ তত্ত্ব হাজির করেছিল যুক্তরাষ্ট্র। আফগানিস্তানে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ‘রাষ্ট্র কাঠামো উন্নয়নে কৌশলগত সহায়তা প্রকল্পে’ ১২০ বিলিয়ন ডলার খরচ হয়েছে। যা মূলত লুণ্ঠন হয়েছে। হামিদ কারজাইয়ের মতো সুশীল থেকে ভাড়াটে রাজনীতিবিদরা শত শত কোটি ডলার আত্মসাৎ করেছেন। আফগানিস্তানে ‘রাষ্ট্র মেরামত’ তত্ত্ব বুমেরাং হয়েছে। দেশটি থেকে রাষ্ট্র মেরামতের ঠিকাদার যুক্তরাষ্ট্র রীতিমতো পালিয়ে বেঁচেছে। ২০০১ সালের ডিসেম্বরে আফগানিস্তানে হামিদ কারজাইয়ের নেতৃত্বে ‘অন্তর্বর্তীকালীন সরকার’ গঠিত হয়। এ সময় মার্কিন পৃষ্ঠপোষকতায় হামিদ কারজাই যে ‘স্ট্রাকচারাল রিফর্ম’ কার্যক্রম শুরু করে সেটিই বিএনপির ‘রাষ্ট্র মেরামত’ কর্মসূচি। মার্কিন ফর্মুলায় এ রাষ্ট্র মেরামত কর্মসূচির মাধ্যমে ২০০৪ সালে আফগানিস্তানে একটি নতুন সংবিধান প্রণীত হয়েছিল। ২০১৪ সালে আরেক সুশীল রাজনীতিবিদ আশরাফ ঘানি রাষ্ট্রপতি নির্বাচিত হয়েছিলেন। কিন্তু শেষ পর্যন্ত আফগানিস্তানে মার্কিন ‘রাষ্ট্র মেরামত’ ব্যর্থ হয়। আফগানিস্তানে কট্টর মৌলবাদীদের হাতে ক্ষমতা তুলে দেয় যুক্তরাষ্ট্র। ইরাক, লিবিয়াতেও মার্কিন আগ্রাসনের পর ‘রাষ্ট্র মেরামত’ কর্মসূচি বা ‘ডেমোক্রেটিক স্ট্রাকচারাল রিফর্ম’ সামনে আসে। এসব প্রেসক্রিপশন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র উদ্ভাবিত। এসব ‘উদ্ভাবন’ নিরীক্ষার জন্য বিভিন্ন দেশকে যুক্তরাষ্ট্র গিনিপিগ হিসেবে ব্যবহার করে। ১৯ ডিসেম্বর বিএনপির ২৭ দফা রাষ্ট্র মেরামত কর্মসূচি দেখার পর অনেক অমীমাংসিত প্রশ্নের উত্তর মিলে যায়। ৭ ডিসেম্বর নয়াপল্টনে বিএনপি কার্যালয়ের সামনে ঘটনার পর কেন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র থেকে তিনটি ভিন্ন ভিন্ন বিবৃতি দেওয়া হলো। ১০ ডিসেম্বরে গোলাপবাগের সাদামাটা সমাবেশের পর ১৪ ডিসেম্বর শহীদ বুদ্ধিজীবী দিবসের দিন কেন পিটার ডি হাস শাহীনবাগে ছুটে গেলেন? কেন তিনি নিরাপত্তা নিয়ে গোস্সা করে পররাষ্ট্রমন্ত্রীর সঙ্গে সাক্ষাৎ করলেন। এরপর বিএনপির রাষ্ট্র মেরামতের ঘোষণা। সেই পুরনো খেলায় কি ফিরে গেছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র? আফগানিস্তানে যা করতে পারেনি, তা কি এখন বাংলাদেশে করতে চায়? এ জন্য বিএনপিকে ব্যবহার করছে? সাজেদুল নিখোঁজ ১০ বছর ধরে। তিনি গুম হয়েছেন না স্বেচ্ছায় নিখোঁজ তা তদন্তাধীন বিষয়। গত ১০ বছরে বাংলাদেশে যুক্তরাষ্ট্রের আরও তিনজন রাষ্ট্রদূত দায়িত্ব পালন করেছিলেন। এর মধ্যে ড্যান মজিনার (নভেম্বর ২৪, ২০১১ থেকে জানুয়ারি, ১২, ২০১৫) সময়েই সাজেদুল নিখোঁজ হন। কিন্তু মজিনা শাহীনবাগে যাননি। সাজেদুলের নিখোঁজ হওয়া নিয়ে কোনো কথা বলেননি ড্যান মজিনা। মজিনার পর বাংলাদেশে যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রদূত হয়েছিলেন মার্শা বার্নিকাট। বার্নিকাট খুবই সামাজিক ছিলেন। বিভিন্ন কর্মসূচিতে তার সরব উপস্থিতি ছিল লক্ষণীয়। বিদায়ের আগে তিনি সুজন সম্পাদক বদিউল আলম মজুমদারের বাসায় নৈশভোজে আমন্ত্রিত হয়েছিলেন। সেখানে অনভিপ্রেত ঘটনা ঘটেছিল। পরে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী দ্রুত ব্যবস্থা নেয়। ২০১৮ সালের নভেম্বরে বিদায়ের আগে বার্নিকাট প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন। এ সময়ও ওই ঘটনায় তিনি এতটুকু উদ্বেগ এবং অস্থিরতা দেখাননি। ২০১৫ থেকে ২০১৮ সাল পর্যন্ত বাংলাদেশে দায়িত্ব পালন করেন বার্নিকাট। তিনি একবারের জন্যও শাহীনবাগে যাননি। বার্নিকাটের পর ২০১৮-এর ২৯ নভেম্বর বাংলাদেশে রাষ্ট্রদূত হিসেবে দায়িত্ব নেন আর্ল মিলার। মিলার তিন বছরের বেশি সময় বাংলাদেশে দায়িত্ব পালন করেন। এ সময় তিনিও ‘মায়ের ডাকে’ সাড়া দেননি। হঠাৎ কী এমন ঘটল যে, মার্কিন রাষ্ট্রদূতকে সকালে শাহীনবাগে ছুটে যেতে হলো। গোলাপবাগের মিশন কাক্সিক্ষত ফলাফল আনতে পারেনি, এ জন্যই কি শাহীনবাগের নাটক সাজানো হয়েছিল। যে কোনো নিখোঁজ উদ্বেগের। নিখোঁজ ব্যক্তিকে নিয়ে যে কী উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা তৈরি হয় তা ভুক্তভোগী পরিবারই বলতে পারে। প্রতিবছর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ‘ডিপার্টমেন্ট অব জাস্টিস’ সে দেশে নিখোঁজ এবং গুম হওয়া মানুষের তালিকা তৈরি করে। ২০২২ সালেও হারিয়ে যাওয়া অজ্ঞাত ব্যক্তিদের ডাটাবেজ প্রকাশিত হয়েছে। এ তালিকায় দেখা যায়, যুক্তরাষ্ট্রে প্রতিবছর ৬ লাখের বেশি মানুষ নিখোঁজ হয়। প্রতিবছর প্রায় ৪ হাজার ৪০০ অজ্ঞাত পরিচয় লাশ উদ্ধার করা হয়। যুক্তরাষ্ট্রে প্রতি লাখে ছয়জনের বেশি মানুষ বছরে নিখোঁজ হন। যুক্তরাষ্ট্রে ২০২১ সালে নিখোঁজ সংক্রান্ত মামলা নথিভুক্ত হয়েছে ৫ লাখ ২১ হাজার ৭০৫টি। এর মধ্যে ৪ লাখ ৮৫ হাজার নিখোঁজ ঘটনার সুরাহা হয়েছে। প্রায় ৩৬ হাজার নিখোঁজ (গুম) হওয়া ব্যক্তির কোনো হদিস পাওয়া যায়নি। আমি জানি না, যুক্তরাষ্ট্রের এই দীর্ঘ গুমের তালিকায় রাষ্ট্রদূতের কোনো স্বজন আছেন কি না। সে জন্যই গুম নিয়ে আবেগপ্রবণ হয়ে তিনি শাহীনবাগে ছুটে গেছেন কি না। কিন্তু বাংলাদেশে ‘গুম’ রীতিমতো লুকোচুরি গল্পের মতো। দীর্ঘদিন শুনলাম হারিছ চৌধুরী গুম হয়েছেন। বিএনপি নেতারা এ নিয়ে কঠোর বিবৃতিও দিলেন। কিন্তু তার স্বাভাবিক মৃত্যুর পর আবিষ্কার হলো নাম বদলে তিনি বাংলাদেশেই ছিলেন। হারিছ চৌধুরী মরে প্রমাণ করলেন তিনি গুম হননি। ইতালির নাগরিক তাভেলা সিজার হত্যাকান্ডের অন্যতম আসামি সাবেক ওয়ার্ড কমিশনার এবং বিএনপি নেতা কাইয়ুম। তাভেলা সিজার হত্যাকান্ডের পর তিনি দেশ থেকে পালিয়ে গেলেন। বলা হলো, সাবেক এই ওয়ার্ড কমিশনার গুম হয়েছেন। বাড্ডায় তার কর্মীরা সমাবেশ করল। ওমা, এখন দেখি তিনি লন্ডন, মালয়েশিয়া, সিঙ্গাপুরে ঘুরছেন। তারেক জিয়ার ক্যাশিয়ার হিসেবে তিনি এই দেশ থেকে ওই দেশে ঘুরছেন বলে কেউ কেউ বলেন। বিএনপির আরেক নেতা সালাউদ্দিন আহমেদকে নিয়েও কী লঙ্কাকান্ডই না হলো। তারপর তিনি ভারতে ‘আবিষ্কৃত’ হলেন। ফরহাদ মজহার তো গুম নাটকের প্রধান চরিত্র হতে গিয়ে বুড়ো বয়সে জাতির সামনে তার ‘পরকীয়া’ উন্মোচন করলেন। এভাবেই গুমের তালিকা ছোট হচ্ছে। ১৩৬ থেকে ৭৬। এখন তা ১৭ জনে এসে দাঁড়িয়েছে। এ নিয়ে যেভাবে এখন মাতম তোলা হচ্ছে তার পেছনে অবশ্যই রাজনৈতিক দুরভিসন্ধি রয়েছে। ‘মায়ের ডাক’ সংগঠনটি বিতর্কিত। দুটি রাজনৈতিক দলের মদদে এবং পৃষ্ঠপোষকতায় এই সংগঠনটি গড়ে উঠেছে। গুম অনাকাক্সিক্ষত। একটি স্বাধীন রাষ্ট্রে একজন ব্যক্তিরও গুম হওয়া কাম্য নয়। একজন মানুষেরও বিচারবহির্ভূত হত্যাকান্ড দুর্ভাগ্যজনক। আবার গুমের নাটক সাজিয়ে রাজনৈতিক ফায়দা হাসিলের চেষ্টা তার চেয়েও গর্হিত কাজ। ‘মায়ের ডাক’ কথিত গুমের ঘটনার সস্তা রাজনীতিকরণ করছে। এটি এখন বিএনপি এবং জামায়াতের অঙ্গ ও সহযোগী সংগঠনে পরিণত হয়েছে। এরকম একটি রাজনৈতিক পক্ষপাতপূর্ণ সংগঠনের আমন্ত্রণে শাহীনবাগে গিয়ে পিটার হাস কূটনৈতিক রীতিনীতি ও শিষ্টাচার লঙ্ঘন করেছেন কি না, তা তিনি নিশ্চয়ই একান্তে ভেবে দেখবেন। তবে বিএনপির রাষ্ট্র মেরামত রূপরেখার পর শাহীনবাগে অভিযানের আসল কারণ আমরা সহজেই বুঝতে পেরেছি। তাহলে কি যুক্তরাষ্ট্র এ দেশের সুশীল নামধারী হামিদ কারজাইদের শাসন কায়েম করতে চায়? এ জন্য কি এ দেশে গণতন্ত্র, মানবাধিকার নিয়ে এত আর্তনাদ। ১৯৭৫ সালে এগোনি বুস্টার বাংলাদেশে মার্কিন রাষ্ট্রদূত ছিলেন। ১৫ আগস্টের জঘন্যতম হত্যাকান্ডের ঘটনায় তিনি কী করেছেন, তা লরেন্স লিফশুলৎস-এর ‘বাংলাদেশ : দি আনফিনিশড রেভল্যুশন’ এবং অ্যান্থনি ম্যাসকারনহাসের ‘এ লেগেসি অব ব্লাড’ বই দুটোতে ভালোভাবেই আছে। তাই ‘মানবাধিকার’ যুক্তরাষ্ট্রের কাছে একেক দেশে, বিভিন্ন সময়ে ভিন্ন রূপে আবির্ভূত হয়। এর পেছনে তাদের উদ্দেশ্য থাকে। বাংলাদেশের রাষ্ট্র মেরামত নিরীক্ষা করতে চায় যুক্তরাষ্ট্র। এ কারণেই তাদের ইদানীং এত মানবাধিকার চর্চা। তবে হাস্যকর বিষয় হলো, সুশীল এবং পশ্চিমা দেশগুলো প্রণীত এই রাষ্ট্র মেরামত ফর্মুলা এমন একটি রাজনৈতিক দলকে দিয়ে করানোর চেষ্টা হচ্ছে, যে তা বাস্তবায়ন করতে গেলে বিএনপিকেই বিলুপ্ত করতে হবে। কীভাবে? আসুন পাঠক ২৭ দফা এবং বিএনপির অতীত কর্মকান্ড একটু পাশাপাশি মিলিয়ে দেখি। বিএনপির ২৭ দফার প্রথম দফায় সংবিধান সংস্কার কমিশন গঠনের কথা বলা হয়েছে। এতে বলা হয়েছে ‘সকল অযৌক্তিক, বিতর্কিত ও অগণতান্ত্রিক সাংবিধানিক সংশোধনী ও পরিবর্তনগুলো পর্যালোচনা করে এসব রহিত বা সংশোধন করা হবে।’ হায় সেলুকাস। কী বিচিত্র। যাদের হাতে ’৭২-এর সংবিধান ধর্ষিত হয়েছিল, তারাই করবে ‘সংবিধান কমিশন’! জিয়া ক্ষমতায় এসে সংবিধান থেকে ধর্মনিরপেক্ষতা, সমাজতন্ত্র উৎপাটন করেছিলেন। এই স্বৈরাচারী একনায়ক ধর্মভিত্তিক রাজনীতি নিষিদ্ধকরণের বিধান বাতিল করেছিলেন। দিয়েছিলেন একাত্তরের পরাজিত শক্তিকে রাজনীতিতে পুনর্বাসনের সুযোগ। এই বিএনপি সংবিধানের পঞ্চম সংশোধনীর মাধ্যমে বাংলাদেশ রাষ্ট্রের মূল চেতনা ধ্বংস করেছিল। আজ তারা সংবিধানের অগণতান্ত্রিক বিধান বাতিলের কথা বলে! ২০০১ সালে বিএনপি-জামায়াত জোট ক্ষমতায় এসে এক ব্যক্তিকে তত্ত্বাবধায়ক সরকারপ্রধান করার জন্য সংবিধান সংশোধন করেছিল। ১৯৮১ সালে বিচারপতি সাত্তারকে রাষ্ট্রপতি পদে প্রার্থী করতে সংবিধানের ষষ্ঠ সংশোধনী করেছিল। তাদের মুখেই আজ সংবিধানের জন্য আর্তনাদ। কী হাস্যকর! বিএনপির ২৭ দফার দ্বিতীয় হলো- ‘রেইনবো নেশন’ প্রতিষ্ঠা। এতে বলা হয়েছে ‘প্রতিহিংসা’ ও ‘প্রতিশোধ’-এর রাজনীতির বিপরীতে বাংলাদেশি জাতীয়তাবাদের ভিত্তিতে অন্তর্ভুক্তিমূলক রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা। বিএনপি তাহলে কর্নেল তাহের হত্যাকান্ডের জন্য জাতির কাছে ক্ষমা চাইবে? ক্ষমতায় থাকার জন্য জিয়া যে হাজার হাজার সেনা কর্মকর্তা ও সৈনিক হত্যা করেছিলেন, তার জন্য দুঃখ প্রকাশ করবে? বেগম জিয়া ও তারেক জিয়ার নেতৃত্বে ২০০৪ সালের ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলা প্রতিহিংসার রাজনীতির সবচেয়ে বীভৎস উদাহরণ। রেইনবো নেশনের আগে এ জন্য বিএনপি কি জাতির সামনে কান ধরে দাঁড়াবে? একবার বলবে ভুল করেছি, আর কখনো করব না? ২০০১ সালের ১ অক্টোবর নির্বাচনের রাতে রাজনৈতিক প্রতিপক্ষকে নির্মূল করতে যে সন্ত্রাস সহিংসতা, তারই বা কী ব্যাখ্যা দেবে বিএনপি? বিএনপির রাষ্ট্র মেরামত রূপরেখার তৃতীয় বিষয় হলো- তত্ত্বাবধায়ক সরকার প্রতিষ্ঠা। তাহলে তো জাতির সামনে বিএনপিকে অবশ্যই ব্যাখ্যা দিতে হবে- কে এম হাসানকে তত্ত্বাবধায়ক সরকারপ্রধান করতে কেন এমন নির্লজ্জ চেষ্টা করেছিল। কেন তারা রাষ্ট্রপতি থাকা সত্ত্বেও ড. ইয়াজউদ্দিনকে তত্ত্বাবধায়ক সরকারপ্রধান করে পুরো ব্যবস্থাকে ধ্বংস করেছিল। ২৭ দফার চতুর্থ দফায় রাষ্ট্রপতি এবং প্রধানমন্ত্রীর ক্ষমতার ভারসাম্য প্রতিষ্ঠার কথা বলা হয়েছে। ’৯১ সালে দেশ যখন সংসদীয় গণতন্ত্রে ফেরে তখন বিএনপি ছিল ক্ষমতায়। তারা কেন প্রধানমন্ত্রী এবং রাষ্ট্রপতির ক্ষমতার ভারসাম্য করেনি? বিএনপি নেতারা কেন একজন মফস্বলের রাজাকারকে রাষ্ট্রপতি বানিয়ে সর্বোচ্চ এই সাংবিধানিক পদের মর্যাদা নষ্ট করেছিল? রাষ্ট্রপতি হওয়ার পর ডা. বদরুদ্দোজা চৌধুরীর সঙ্গে যে আচরণ বিএনপি করেছিল, তাতে কি ‘রাষ্ট্রপতি’ পদকেই অসম্মান করা হয়নি? রাষ্ট্র মেরামত রূপরেখায় বিএনপি দুবারের বেশি কেউ রাষ্ট্রপতি এবং প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করতে পারবে না বলে ঘোষণা করেছে। বাংলাদেশে কেউ পর পর দুবারের বেশি রাষ্ট্রপতি হতে পারেন না। প্রধানমন্ত্রী হন সংসদে সংখ্যাগরিষ্ঠ দলের নেতা। ভারত এমনকি যুক্তরাজ্যেও দুবারের বেশি কেউ প্রধানমন্ত্রী হতে পারবেন না, এরকম বিধান নেই। কারণ এটি সংসদীয় চেতনার সঙ্গে সাংঘর্ষিক। বাংলাদেশে এই ফর্মুলা প্রথম আবিষ্কার হয় ২০০৭ সালে এক-এগারোর সময়। আওয়ামী লীগ সভানেত্রী শেখ হাসিনা এবং বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়াকে রাজনীতি থেকে মাইনাস করার জন্যই এই তত্ত্ব হাজির করা হয়েছিল। বিএনপির তৎকালীন মহাসচিব প্রয়াত আবদুল মান্নান ভূঁইয়া আনুষ্ঠানিক সংবাদ সম্মেলন করে ওই সংস্কার প্রস্তাব উপস্থাপন করেছিলেন। এর প্রতিবাদ করে একটি চমৎকার বিবৃতি দিয়েছিলেন এখনকার বিএনপির সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী। তিনি বলেছিলেন, ‘বিরাজনীতিকরণ এবং মাইনাস ফর্মুলা বাস্তবায়নের জন্য এরকম উদ্ভট সংস্কার প্রস্তাব। যারা এই প্রস্তাব দিয়েছে তারা অগণতান্ত্রিক সরকারের উচ্ছিষ্ট ভোগী, কুলাঙ্গার।’

বিএনপি নেতারা কি মান্নান ভূঁইয়ার ফর্মুলা গ্রহণ করল? এই রূপরেখা ঘোষণার মাধ্যমে তারা কি আসলে বেগম জিয়াকে রাজনীতি থেকে বহিষ্কার করল? কারণ এই রূপরেখা বাস্তবায়িত হলে বেগম জিয়া আর কোনো দিন প্রধানমন্ত্রী হতে পারবেন না। রূপরেখার ৬ থেকে ২৭ পর্যন্ত দফাগুলো কোনোটাই বিএনপির নয়। বিএনপির ঘোষণাপত্র, প্রতিষ্ঠাকালে প্রণীত ১৯ দফার সঙ্গে এর অনেক ধারা সাংঘর্ষিক। যেমন বিএনপির ঘোষণাপত্রে ইসলামী মূল্যবোধ প্রতিষ্ঠার কথা বলা হয়েছে। অথচ রূপরেখার ১৬তম দফায় ‘ধর্ম যার যার রাষ্ট্র সবার’ এই ধর্মনিরপেক্ষ নীতির কথা বলা হয়েছে। বিএনপির কোনো দলিলে আজ পর্যন্ত ‘ধর্মনিরপেক্ষতা’কে রাষ্ট্রীয় মূলনীতি হিসেবে স্বীকার করা হয়নি। ১৯তম দফায় বলা হয়েছে ‘বাংলাদেশের ভূখন্ডের মধ্যে কোনো রকম সন্ত্রাসী তৎপরতা বরদাস্ত করা হবে না।’ স্পষ্টতই ভারতকে খুশি করতে এমন বক্তব্য আমদানি করা হয়েছে। কিন্তু এরকম বক্তব্য গ্রহণযোগ্য হতো যদি না দশ ট্রাক অস্ত্রের ব্যাপারে বিএনপি একটি যুক্তিসংগত ব্যাখ্যা দিত। বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের সময় ওই অস্ত্র ভারতীয় বিচ্ছিন্নতাবাদীদের জন্যই আনা হয়েছিল। এভাবে রূপরেখার দফাওয়ারি পোস্টমর্টেম করা যায়। করলেই দেখা যাবে, বিএনপি সুশীল এবং পশ্চিমাদের দেওয়া এক ‘ব্যবস্থাপত্র’ না দেখেই ঘোষণা করেছে। রাষ্ট্র মেরামতের ফর্মুলা তাই বিএনপির নয়। মেরামতের কারিগরও বিএনপি হবে না-এটা নিশ্চিত।

সোভিয়েত ইউনিয়নকে আফগানিস্তান থেকে হটাতে যুক্তরাষ্ট্র উগ্র মৌলবাদী তালেবানদের পৃষ্ঠপোষকতা করেছিল। তাদের অস্ত্র দিয়েছিল।  অর্থ দিয়েছিল। আবার সেই তালেবানদেরই সন্ত্রাসী বলে তাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করেছে। এখন বাংলাদেশে দক্ষিণপন্থি আধা মৌলবাদী জামায়াত নিয়ন্ত্রিত বিএনপি দিয়ে আওয়ামী লীগকে যারা হটাতে চায়, তারা আসলে বাংলাদেশকে তালেবান রাষ্ট্র বানাতে চায়।  বাংলাদেশকে বানাতে চায় আফগানিস্তান। রাষ্ট্র মেরামতের রূপরেখা সেই খায়েশের এক বার্তা।

 

লেখক : নির্বাহী পরিচালক, পরিপ্রেক্ষিত

[email protected]

সর্বশেষ খবর