সোমবার, ২৬ ডিসেম্বর, ২০২২ ০০:০০ টা

ডিগ্রি পাস কোর্স নিয়ে কথা

বিমল সরকার

ডিগ্রি পাস কোর্স নিয়ে কথা

পাসকোর্স নিয়ে শিক্ষার্থী-শিক্ষক ও অভিভাবকসহ সচেতন মহলের ভাবনা-দুর্ভাবনার যেন শেষ নেই। জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীন ডিগ্রি  পাস ও সার্টিফিকেট কোর্স (কলা, সামাজিক বিজ্ঞান, ব্যবসায় শিক্ষা, বিজ্ঞান) এখন তিন বছর মেয়াদি। প্রতিবছর শিক্ষার্থীদের ৭০০ করে তিন বছরে মোট ২১০০ নম্বরের পরীক্ষায় অবতীর্ণ হতে হয়। এর মধ্যে রয়েছে ১০০ নম্বরের জাতীয় ভাষা বাংলা, ১০০ নম্বরের ইংরেজি ও ১০০ নম্বরের স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের ইতিহাস। উল্লিখিত তিনটি বিষয় বা কোর্স সব শাখার শিক্ষার্থীর জন্যই আবশ্যিক। এ ছাড়া প্রতিটি পত্র (পেপার) ১০০ নম্বর করে ৬ পত্রে ৬০০ নম্বর; এভাবে তিনটি ঐচ্ছিক বিষয়ে মোট ১৮০০ নম্বর। প্রথম বর্ষে প্রত্যেক নিয়মিত শিক্ষার্থীকে ১০০ নম্বরের স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের ইতিহাস এবং তিনটি ঐচ্ছিক বিষয়ের প্রত্যেকটির প্রথম ও দ্বিতীয় পত্র (প্রতিটি পত্র ১০০ নম্বর) মোট ৭০০ নম্বরের পরীক্ষা দিতে হয়। দ্বিতীয় বর্ষে প্রত্যেক নিয়মিত শিক্ষার্থীকে ১০০ নম্বরের বাংলা জাতীয় ভাষা এবং তিনটি ঐচ্ছিক বিষয়ের প্রত্যেকটির তৃতীয় ও চতুর্থ পত্র; (প্রতিটি পত্র ১০০ নম্বর) সর্বমোট ৭০০ নম্বরের পরীক্ষা দিতে হয়। আর তৃতীয় বা শেষ বর্ষে প্রত্যেক নিয়মিত শিক্ষার্থীকে ১০০ নম্বরের ইংরেজি এবং তিনটি ঐচ্ছিক বিষয়ের প্রত্যেকটির পঞ্চম ও ষষ্ঠ পত্র (প্রতিটি পত্র ১০০ নম্বর) সর্বমোট ৭০০ নম্বরের পরীক্ষা দিতে হয়। এভাবে তিন বছরে মোট ২১ নম্বরের পরীক্ষা। পাকিস্তান আমলে এবং স্বাধীনতার পর, এমনকি ১৯৯২ সালে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার আগ পর্যন্ত আমাদের দেশে ডিগ্রি স্তরের কলেজগুলো ঢাকা, রাজশাহী ও চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে ছিল। পাস কোর্সে কলা, বাণিজ্য ও বিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষার্থীদের প্রতিটি ১০০ নম্বরের তিন পত্রবিশিষ্ট তিনটি ঐচ্ছিক বিষয় পড়তে হয়েছে। এ সময় ঐচ্ছিক তিন বিষয়ে ৯০০ নম্বর ছাড়াও বাণিজ্য শাখার শিক্ষার্থীদের অতিরিক্ত ১০০ (কমার্শিয়াল ইংলিশ) এবং কলা শাখার শিক্ষার্থীদের ২০০ (বাংলা) জাতীয় ভাষা (আবশ্যিক) ১০০ এবং ইংরেজি (আবশ্যিক) ১০০) নম্বরের সিলেবাস পড়তে হয়েছে। ১৯৮৫ থেকে ১৯৯৫ সাল পর্যন্ত মোট ১০ বছর শাখা যার যাই হোক (কলা, সামাজিক বিজ্ঞান, ব্যবসায় শিক্ষা, বিজ্ঞান)) ডিগ্রি স্তরের শিক্ষার্থীদের ইংরেজি পড়তে হয়নি।

তার মানে পাকিস্তান আমল, এমনকি স্বাধীনতা লাভের পর আশি ও নব্বই দশকের প্রথমার্ধেও একজন শিক্ষার্থীকে ডিগ্রি পাসকোর্সে ৯০০, ১০০০ কিংবা বড়জোর ১১০০ নম্বরের সিলেবাসের মধ্যে থেকেই লেখাপড়া করতে হয়েছে। জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় ডিগ্রি কলেজগুলো অধিগ্রহণের তিন-চার বছর পর ১৯৯৬ সালে ডিগ্রি স্তরে কলা ও সামাজিক বিজ্ঞান শাখায় ১০০ নম্বরের ইংরেজি কোর্স আবার চালু করে। ক্রমে বিজ্ঞান ও ব্যবসায় শিক্ষা শাখায়ও বাংলা এবং ইংরেজি বাধ্যতামূলক করা হয়। অর্থাৎ প্রত্যেক শিক্ষার্থীর জন্য বাংলা-ইংরেজিসহ ১১০০ নম্বরের সিলেবাস। ২০০১ সালে বিষয়সমূহের কলেবর বাড়িয়ে ঐচ্ছিক তিনটি পত্রকে চারটি পত্রে বিন্যাস করা হয়। ফলে ডিগ্রি পাস কোর্সে চারটি করে পত্র এবং আবশ্যিক বাংলা ও ইংরেজি মিলে সিলেবাস হয় মোট ১৪০০ নম্বরের। তার মানে তৃতীয় বা শেষ বছরে একসঙ্গে ১৪০০ নম্বরের পরীক্ষা। অবশ্য শিক্ষার্থীদের অতিরিক্ত চাপের কথা বিবেচনা করে শিগগিরই তা তিন বছরে (প্রথম, দ্বিতীয় ও তৃতীয় বর্ষে) ভাগ করে নেওয়ার ব্যবস্থা হয়। ডিগ্রি স্তরে ১৪০০ নম্বরের কোর্স এবং বছর বছর পরীক্ষার ব্যবস্থা ২০১৩ সাল পর্যন্ত বহাল থাকে। এদিকে ঐচ্ছিক বিষয় যেমনই হোক বাংলা আবশ্যিক ও ইংরেজি আবশ্যিক বিষয়ের পরীক্ষা কোনটি শিক্ষাপর্বের কোন বছরে অনুষ্ঠিত হবে এ নিয়ে শিক্ষার্থীদের সঙ্গে বারবার করা হয়েছে এক ধরনের তামাশা। ইংরেজিকে একবার প্রথম বর্ষে, পরে দ্বিতীয় বর্ষে, তারও পরে তৃতীয় বর্ষে রাখা হয়। বাংলা বিষয়ের ক্ষেত্রেও এমনই; একবার দ্বিতীয় বর্ষে, পরে আবার প্রথম বর্ষে আনা হয়।

২০১৩-২০১৪ শিক্ষাবর্ষ থেকে পাসকোর্সে আনা হয় ব্যাপক পরিবর্তন। ২০০২ সাল থেকে চালু প্রতিটি ১০০ নম্বরের ৪ পত্রবিশিষ্ট ঐচ্ছিক বিষয়কে করা হয় ৬ পত্রবিশিষ্ট এবং আবশ্যিক হিসেবে ‘স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের ইতিহাস’ নামে ১০০ নম্বরের একটি নতুন কোর্স অন্তর্ভুক্ত করা হয়। এ কোর্সটি অবশ্য জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীন অনার্স শিক্ষার্থীদের বেলায়ও আবশ্যিক হিসেবেই চালু রয়েছে। এ ছাড়া একই শিক্ষাবর্ষ (২০১৩-২০১৪) থেকে চালু করা হয় ২০ নম্বরের ‘ইনকোর্স পরীক্ষা’ যা তত্ত্বাবধান করেন নিজ নিজ কলেজের বিষয়ভিত্তিক শিক্ষকরা। প্রতিটি বিষয়ভুক্ত পত্রের পরীক্ষার সময়সীমা প্রচলিত ৩ ঘণ্টার স্থলে করা হয় ৪ ঘণ্টা। পাসকোর্সে যুগ যুগ ধরে যেখানে ১০০ নম্বরের পরীক্ষার জন্য নির্ধারিত সময় ছিল ৩ ঘন্টা; ২০ নম্বর কমানোয় এখন মাত্র ৮০ নম্বরের জন্য পরীক্ষায় সময় রাখা হয় ৪ ঘণ্টা (অবশ্য কয়েক বছর এভাবে চলার পর তা সাড়ে ৩ ঘণ্টা করা হয়)।

বাংলা এবং ইংরেজি বিষয় নিয়ে টানাটানির ব্যাপারটিও শিক্ষার্থীদের অনেকবার ভোগান্তিতে ফেলেছে। এক সেশনে প্রথম বর্ষে তো পরের সেশনেই তৃতীয় বর্ষে। এভাবে বেশ কবার আকস্মিক রদবদল করায় শিক্ষার্থীদের বাংলা-ইংরেজির ‘গ্যাঁড়াকলে’ পড়তে হয়েছে। কয়েক বছর ধরে স্থির রয়েছে; প্রথম বর্ষে স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের ইতিহাস, দ্বিতীয় বর্ষে বাংলা এবং তৃতীয় বা শেষ বর্ষে ইংরেজি।

কয়েক বছর ধরেই শোনা যাচ্ছে, জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় ডিগ্রি পাসকোর্স তুলে দেবে। আবার এ কথাও শোনা যায় কলেজে; বিশেষ করে মফস্বল এলাকার কলেজগুলোতে চলমান অনার্স কার্যক্রম রাখা হবে না। বর্তমানে দেশে সরকারি-বেসরকারি মিলে ডিগ্রি স্তরে মোট আনুমানিক ২ হাজার ২৫০  কলেজ রয়েছে। কলেজগুলোর মধ্যে এক-তৃতীয়াংশের বেশি অর্থাৎ ৮৮১টিতে রয়েছে অনার্স পড়ার ব্যবস্থা-বন্দোবস্ত। এদিকে সার্বিক শিক্ষা কার্যক্রম এবং শিক্ষার মান নিয়ে রয়েছে নানান প্রশ্ন। অন্যদিকে কী এক রহস্য, নিয়মিত ক্লাস না হলেও শিক্ষার্থীরা পরীক্ষায় বলতে গেলে বরাবরই ভালো ফলাফল করছে।  অতএব, এসব নিয়ে যখন যা কিছুই করা হোক না কেন আগেভাগে গভীরভাবে চিন্তাভাবনা করে তবেই যেন করা হয়।

লেখক : অবসরপ্রাপ্ত কলেজ শিক্ষক

সর্বশেষ খবর