শিরোনাম
রবিবার, ২২ জানুয়ারি, ২০২৩ ০০:০০ টা

তামাকের ক্ষতিকর দিক ও চিকিৎসকদের ভূমিকা

অধ্যাপক ডা. মোহা. শেখ শহীদ উল্লাহ

তামাকের ক্ষতিকর দিক ও চিকিৎসকদের ভূমিকা

তামাকজনিত বিভিন্ন রোগে দেশে প্রতিদিন কমপক্ষে ৪৫০ জন মারা যাচ্ছে। একই সঙ্গে এ-সংক্রান্ত রোগের চিকিৎসায় বছরে রাষ্ট্রের ব্যয় হচ্ছে প্রায় ৩০ হাজার ৫৬০ কোটি টাকা। এ ছাড়া প্রতি বছর বিশ্বব্যাপী প্রায় ৮০ লাখ মানুষের মৃত্যুর কারণ হিসেবে বিবেচিত তামাক। এসব পরিসংখ্যান শুরুতেই হাজির করার উদ্দেশ্য, চট করে তামাকের বিভিন্ন ক্ষতিকর দিক পাঠকের সামনে তুলে ধরা। একজন চিকিৎসক হিসেবে বলতে পারি, তামাক ব্যবহারের ফলে একজন ব্যক্তি মাথা থেকে পা পর্যন্ত বিভিন্ন রোগে আক্রান্ত হতে পারেন। এর মধ্যে ফুসফুসের ক্যান্সার অন্যতম। অধূমপায়ীদের চেয়ে ধূমপায়ীরা এ রোগে আক্রান্ত হয় বেশি। অধূমপায়ীদের তুলনায় ফুসফুসের ক্যান্সারে ধূমপায়ীর মৃত্যুর সংখ্যা ৮ থেকে ২৫ গুণ বেশি।

ক্রনিক ব্রঙ্কাইটিস নামক অসুখে মৃত্যুর সঙ্গে সিগারেট খাওয়ার সম্পর্ক রয়েছে। দৈনিক ২৫ শলাকা বা তার বেশি সিগারেট খায়, এমন লোকের ফুসফুসের ক্যান্সার হওয়ার ঝুঁকি অনেক বেশি। এদের মৃত্যুহার অধূমপায়ীর চেয়ে বেশি। আবার ন্যূনতম ধূমপানের কারণেও ফুসফুস ক্যান্সারের ঝুঁকি থেকে যায়। ধূমপানের কারণে ক্রনিক অবস্ট্রাকটিভ পালমোনারি ডিজিজ (সিওপিডি) হতে পারে। সিওপিডি একটি মরণব্যাধি হলেও সিগারেট খাওয়ার অভ্যাস পরিত্যাগ করলে এ রোগ প্রতিরোধ সম্ভব। সিগারেট খাওয়ার ফলে মস্তিষ্কের শিরায় রক্ত চলাচল বাধাগ্রস্ত হয়ে স্ট্রোক হতে পারে। স্ট্রোকে কারও কারও মৃত্যু হয়। কেউ কেউ পক্ষাঘাতগ্রস্ত (প্যারালাইসিস) হয়ে বেঁচে থাকে এবং কেউ কোমায় চলে যায়। সিগারেট খাওয়ার ফলে মস্তিষ্কে রক্তক্ষরণও হতে পারে।

সিগারেট খাওয়ার ফলে অন্ত্রের যে কোনো অংশে (ঠোঁট থেকে মলদ্বার পর্যন্ত) ক্যান্সার হতে পারে। ধূমপায়ীদের মুখগহ্বরে ক্যান্সার হওয়া কোনো অসাধারণ বিষয় নয়। খাদ্যনালির ক্যান্সারের সঙ্গে সিগারেট খাওয়ার সম্পর্ক রয়েছে। খাদ্যনালির ক্যান্সারে অধূমপায়ীদের চেয়ে ধূমপায়ীদের মৃত্যুহার কয়েক গুণ বেশি। ধূমপান পেপটিক আলসারেরও অন্যতম কারণ। ধূমপানের ফলে পেপটিক আলসার সারতে অনেক দেরি হয়। কখনো কখনো পাকস্থলী ছিদ্র হয়ে যেতে পারে। ধূমপানের ফলে মূত্রাশয়ে ক্যান্সার হতে পারে। একই সঙ্গে যৌনক্ষমতা কমে যায়। নর ও নারীর সন্তান উৎপাদন ক্ষমতাও কমে যায়। মহিলা ধূমপায়ীদের গর্ভাশয়ে ক্যান্সার হওয়ার প্রবণতা বৃদ্ধি পায়। অনেকের অকালে ঋতুস্রাব বন্ধ হয়ে যায়। ধূমপানের কারণে চোখের জ্যোতি কমে যেতে পারে এবং চোখে ছানি পড়তে পারে। এ ছাড়া হাড়ের ঘনত্ব হ্রাস পায় এবং শরীরে অকালবার্ধক্যের ছাপ পড়তে পারে।

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার এক প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে, বর্তমানে তামাকজাত পণ্য ব্যবহার করেন বিশ্বের ১৩০ কোটি মানুষ। ২০২০ সালে বিশ্বের জনসংখ্যার ২২ দশমিক ৩ শতাংশ তামাকজাত পণ্য ব্যবহার করেছে। শুধু তামাক ও তামাকজাত দ্রব্য ব্যবহারের কারণে প্রতি বছর বিশ্বে প্রায় ৮০ লাখের বেশি মানুষের মৃত্যু হয়। তাদের মধ্যে প্রায় ১২ লাখ মানুষ সরাসরি ধূমপান না করেও তামাকজাত দ্রব্যের কারণে মারা যাচ্ছে। তাই জনপরিসরে সচেতনতা তৈরির জন্য বিভিন্ন টিভি চ্যানেল, সংবাদমাধ্যম, সমাজমাধ্যম, বিলবোর্ড, ব্যানার, ফেস্টুন, হ্যান্ডবিলের মাধ্যমে সচেতনতার বার্তা প্রচার করা প্রয়োজন। গ্লোবাল অ্যাডাল্ট টোব্যাকোর সর্বশেষ জরিপ অনুযায়ী, দেশে ৩ কোটি ৭৮ লাখ তামাক ব্যবহারকারীর মধ্যে ২ কোটি ২০ লাখ মানুষ ধোঁয়াবিহীন তামাক ব্যবহার করে।

তামাকের সর্বগ্রাসী এসব ক্ষতিকর দিক উপলব্ধি করেই বঙ্গবন্ধুকন্যা মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ২০১৬ সালে ঘোষণা দেন, ২০৪০ সালের মধ্যে বাংলাদেশকে তামাকমুক্ত করা হবে। তামাকমুক্ত বাংলাদেশ গঠনে বিদ্যমান তামাক আইনকে আরও শক্তিশালীকরণের বিকল্প নেই। এ লক্ষ্যে কাজ করে যাচ্ছে স্বাস্থ্য ও পরিবারকল্যাণ মন্ত্রণালয়। তবে তামাক আইন সংশোধনের বিরোধিতায় নেমেছে তামাক কোম্পানিগুলো। তুলে ধরছে বিভিন্ন খোঁড়া যুক্তি। তাদের অপতৎপরতা থামিয়ে দিয়ে তামাকের ক্ষতিকর দিকগুলো জাতির সামনে তুলে ধরতে চিকিৎসকরা যুগান্তকারী ভূমিকা রাখতে পারেন। তামাকের স্বাস্থ্যগত ক্ষতিকর দিকগুলো রোগীদের সামনে উপস্থাপনের মাধ্যমে তামাক ব্যবহার বন্ধে তোদের সচেতন করতে পারেন। একই সঙ্গে রোগীদের সামনে আর্থিক ক্ষতির দিকগুলো তুলে ধরতে পারেন। স্বাস্থ্য খাতের ওপর চাপ কমাতে শক্তিশালী তামাক নিয়ন্ত্রণ আইনের বিকল্প নেই। তাই এ লক্ষ্যে কাজ করে যাচ্ছে বাংলাদেশ মেডিকেল অ্যাসোসিয়েশন (বিএমএ)। যতদিন শক্তিশালী তামাক নিয়ন্ত্রণ আইন পাস না হবে ততদিন সরকারের সঙ্গে কাজ করে যাবে চিকিৎসক সমাজ।

লেখক : দফতর সম্পাদক, কেন্দ্রীয় কমিটি বাংলাদেশ মেডিকেল অ্যাসোসিয়েশন

সর্বশেষ খবর