মঙ্গলবার, ৩১ জানুয়ারি, ২০২৩ ০০:০০ টা

বিশ্ব ইজতেমার জন্য নতুন স্থানের প্রস্তাব

আলম রায়হান

বিশ্ব ইজতেমার জন্য নতুন স্থানের প্রস্তাব

দুই দফা আখেরি মোনাজাতের মধ্য দিয়ে দুই পর্বের বিশ্ব ইজতেমা সমাপ্ত হয়েছে। প্রথম পর্ব ছিল ১৩ থেকে ১৫ জানুয়ারি এবং দ্বিতীয় পর্ব অনুষ্ঠিত হয়েছে ২০ থেকে ২২ জানুয়ারি। দুই দফায় ছয় দিনের আনুষ্ঠানিকতা থাকলেও তা আসলে ছিল আট দিনের। এবার বিশেষভাবে লক্ষণীয় বিষয় হচ্ছে, এবারের ইজতেমায় রেকর্ডসংখ্যক মুসল্লির সমাগম হয়েছে তুরাগ নদ নামের নর্দমাসম তুরাগ তীরে। এ সময় টক অব দ্য কান্ট্রি হয়েছে, ট্রাফিক ব্যবস্থা ভেঙে পড়া, রাজধানীতে ১০ কিলোমিটারজুড়ে যানজট, অনেকের ফ্লাইট মিস হওয়া, রাজধানীজুড়ে গণপরিবহনের সংকট, ঢাকা-ময়মনসিংহ রোড বন্ধ হয়ে যাওয়াসহ আরও কিছু ঘটনা। এসব বিরূপ পরিস্থিতি সামলানো যায়নি। যা চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছে, টঙ্গীর নির্ধারিত স্থানে ইজতেমায় আগত মুসল্লিদের স্থান সংকুলান কেবল কঠিন নয়, অসম্ভব হয়ে পড়েছে।

শত বছরের দোরগোড়ায় পৌঁছেছে বিশ্ব ইজতেমা। পাশাপাশি তীব্র হচ্ছে স্থান সংকুলানের সংকট। ১৯২৭ খ্রিস্টাব্দে ভারতের উত্তরপ্রদেশের সাহরানপুর এলাকায় ইসলামী দাওয়াত তথা তাবলিগের প্রবর্তন করেন মাওলানা ইলিয়াস (রহ.)। বাংলাদেশে ১৯৫০-এর দশকে তাবলিগ জামাতের প্রচলন করেন মাওলানা আবদুল আজিজ। প্রতি বছর বাংলাদেশের প্রত্যন্ত গ্রাম-শহর-বন্দর থেকে লাখ লাখ ধর্মপ্রাণ মুসলমান এবং বিশ্বের অর্ধ শতাধিক দেশ থেকে তাবলিগি দিনদার মুসলমান জামাতসহ লাখ লাখ মুসল্লি বিশ্ব ইজতেমায় অংশ নেন। কারও বুঝতেই অসুবিধা হওয়ার কথা নয়, তুরাগ তীরে ইজতেমায় আগত মুসল্লিদের স্থান সংকুলান সংকট আগামীতে আরও কঠিন হয়ে পড়বে। তাবলিগ জামাতের দুটি গ্রুপ আলাদাভাবে টঙ্গীর তুরাগ নদের পাড়ে বিশ্ব ইজতেমার আয়োজন করেছে, যার প্রথম পর্বটি ১৩ জানুয়ারি শুরু হয়ে শেষ হয়েছে ১৫ জানুয়ারি। প্রথম পর্বের ইজতেমার আয়োজন করে মাওলানা জুবায়ের আহমদের নেতৃত্বাধীন অংশ। আর ২০ থেকে ২২ জানুয়ারি ইজতেমার আয়োজক মাওলানা ওয়াসিফুল ইসলামের নেতৃত্বাধীন অংশ। যারা ভারতের মাওলানা মোহাম্মদ সাদ কান্দলভির অনুসারী হিসেবে পরিচিত। এদিকে মাওলানা জুবায়ের আহমদের অংশটিকে প্রকাশ্যে সমর্থন দিয়ে মাওলানা সাদের বিরোধিতায় লিপ্ত হয়েছে হেফাজতে ইসলাম।

দুই দফায় আয়োজন করেও স্থান সংকুলান কঠিন হয়ে পড়েছে। যা এবার আরও প্রকট হয়ে উঠেছে বলে মনে করা হচ্ছে। দুই গ্রুপের বিরোধ এবং মুসল্লির সংখ্যা বৃদ্ধি পাওয়ায় দুই দফায় বিশ্ব ইজতেমা আয়োজনের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে আশা করা হয়েছিল, স্থান সংকুলানের সংকট কাটবে। কিন্তু তা যে কাটেনি তা হাড়ে হাড়ে টের পাওয়া গেল এবারের ইজতেমার প্রথম পর্বেই। শুধু তাই নয়, ইজতেমা শুরুর আগের দিন ১২ জানুয়ারি ইজতেমাকেন্দ্রিক যানজট পুরো রাজধানীকে স্থবির করে দিয়েছিল। এটি বুঝতে কারও অসুবিধা হওয়ার কথা নয়, বিশ্ব ইজতেমায় মুসল্লিদের অংশগ্রহণের হার যেভাবে বাড়ছে তাতে টঙ্গীতে স্থান সংকুলান সম্ভব হচ্ছে না। সঙ্গে বাড়ছে পানি-বিদ্যুৎসহ নানান সংকট। এমনকি ওজুর পানিরও সংকট দেখা দিয়েছে। মলমূত্র ত্যাগ নিয়ে সংকটের প্রসঙ্গ না হয় নাই-বা তুললাম। সামগ্রিক অবস্থার বিবেচনায় অনেকে মনে করেন, ইজতেমার জন্য নতুন স্থান নির্ধারণ বিষয়টি বিবেচনায় নেওয়া খুবই জরুরি হয়ে পড়েছে।

দীর্ঘ পথপরিক্রমায় ইজতেমার কলেবর ও গুরুত্ব বেড়েছে। এর আগে তাবলিগের সাথী সংখ্যা বৃদ্ধির কারণে ১৯৬৬ সাল থেকে টঙ্গীতে আয়োজন শুরু হয় ইজতেমার। ১৯৪৬ সালে ঢাকার রমনা পার্কসংলগ্ন কাকরাইল মসজিদ থেকে যাত্রা শুরু হয়। মাওলানা আবদুল আজিজ (রহ.) বাংলাদেশে ইজতেমার হাল ধরেন। তখন থেকেই বাংলাদেশে তাবলিগ জামাতের প্রধান কেন্দ্র কাকরাইল মসজিদ থেকে এই সমাবেশ কেন্দ্রীয়ভাবে পরিচালনা শুরু হয়। ১৯৪৬ সালে ঢাকার রমনা পার্কসংলগ্ন কাকরাইল মসজিদে প্রথমবারের মতো তাবলিগ জামাতের বার্ষিক সম্মেলন বা ইজতেমা অনুষ্ঠিত হয়। দুই বছর পর ১৯৪৮ সালে চট্টগ্রামে তৎকালীন হাজি ক্যাম্পে দ্বিতীয়বারের মতো তাবলিগের সম্মেলন বা ইজতেমার আয়োজন করা হয়। তার ১০ বছর পর ১৯৫৮ সালে নারায়ণগঞ্জের সিদ্ধিরগঞ্জে ইজতেমা অনুষ্ঠিত হয়। তখন তাবলিগের এ সম্মেলন শুধু ইজতেমা নামেই পরিচিত ছিল।

দ্রুত তাবলিগের প্রচার-প্রচারণা দিন দিন প্রসারিত হতে থাকে। বাড়তে থাকে তাবলিগের সাথী ও শুভাকাক্সক্ষীর সংখ্যা। এ কারণে আট বছর পর ১৯৬৬ সালে টঙ্গীর পাগার গ্রামের খোলা মাঠে ইজতেমার আয়োজন করা হয়। সে বছর স্বাগতিক বাংলাদেশ ছাড়াও বিশ্বের বিভিন্ন দেশ থেকে তাবলিগের এই ইজতেমায় ধর্মপ্রাণ মুসলমান ও তাবলিগের সাথীরা অংশগ্রহণ করেন। আর সে বছর থেকেই এ ইজতেমাকে বিশ্ব ইজতেমা হিসেবে আখ্যায়িত করা হয়। আর বিশ্বব্যাপী ‘বিশ্ব ইজতেমা’ হিসেবে পরিচিতি লাভ করতে থাকে এ ইজতেমা। ১৯৬৬ সালের পর থেকে প্রতি বছরই টঙ্গীর তুরাগ নদের উত্তর-পূর্ব তীরসংলগ্ন ডোবা-নালা, উঁচু-নিচু জমি মিলিয়ে রাজউকের হুকুমদখলকৃত ১৬০ একর জায়গার বিশাল মাঠে অনুষ্ঠিত হয় এ ইজতেমা। যা বিশ্ব ইজতেমা নামে বর্তমানে বিশ্বব্যাপী পরিচিত। এ বিশাল এক আয়োজন। অংশগ্রহণকারীর সংখ্যা বাড়তে বাড়তে এবার প্রথম দফায়ই পৌঁছে ৪০ লাখে। দ্বিতীয় পর্বে এ সংখ্যা ৩০ লাখের কম নয় বলে মনে করা হচ্ছে। ইজতেমায় অংশগ্রহণকারী মুসল্লিদের সংখ্যা বৃদ্ধিও এই ধারা বিশেষভাবে লক্ষণীয়। গণমাধ্যমে প্রকাশিত খবর অনুসারে এবার বিশ্ব ইজতেমার প্রথম পর্বে স্মরণকালের সমাগম ঘটেছে। এর মধ্যে ৬১ দেশের প্রায় ৫ হাজার বিদেশি মেহমান ছিলেন। বোধগম্য কারণেই আগামীতে বিশ্ব ইজতেমায় মুসল্লির সংখ্যা বাড়বে। তখন পরিস্থিতি কী দাঁড়াবে? এই বাস্তবতায় অনেকেই বলছেন, নতুন স্থান নির্ধারণসহ ইজতেমার নানান দিক নিয়ে গভীরভাবে চিন্তা করা খুবই জরুরি।

ইসলাম ধর্মের আলোর ইজতেমার এই দিক ছাপিয়ে ২০১৮ সালে দেখা দেয় অন্ধকার। টঙ্গীতে তাবলিগ জামাতের বিবদমান দুই পক্ষের মধ্যে দিনভর রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষ হয়। ইজতেমা ময়দান ও এর আশপাশের এলাকায় ছড়িয়ে পড়া এ সংঘর্ষে এক মুসল্লি নিহত হওয়াসহ উভয় পক্ষের দুই শতাধিক মুসল্লি আহত হন। জোড় ইজতেমাকে কেন্দ্র করে তাবলিগ জামাতের দিল্লির নিজামউদ্দিন মারকাজের মাওলানা সাদ গ্রুপ এবং দেওবন্দের কওমিপন্থি মাদরাসার অনুসারী ঢাকার কাকরাইল মারকাজের মুরব্বি মাওলানা জুবায়ের গ্রুপের মধ্যে এ সংঘর্ষ চলে। সারা দিন এ সংঘর্ষের পর সরকারের পক্ষ থেকে ৩০ ডিসেম্বরের জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে ইজতেমা আয়োজন বন্ধ রাখার সিদ্ধান্ত দেওয়া হয়। মাওলানা সাদ তাবলিগ জামাতে কিছু সংস্কার করার পক্ষে। এ সংস্কার ভাবনা নিয়ে ২০১৭ সালেই ভারতে তাবলিগের শীর্ষ নেতাদের মধ্যে বিভক্তির শুরু হয়। মাওলানা সাদ বলেছিলেন ‘ধর্মীয় শিক্ষা বা ধর্মীয় প্রচারণা অর্থের বিনিময়ে করা উচিত নয়’। অনেকে মনে করেন, এই বক্তব্যের মাধ্যমে মিলাদ বা ওয়াজ মাহফিলের মতো কর্মকান্ড পরিচালনার বিনিময়ে অর্থ নেওয়ার বিপক্ষে বলা হয়েছে।

সাদ কান্দলভি আরও বলেছিলেন, ‘মাদরাসাগুলোর শিক্ষকদের মাদরাসার ভেতরে নামাজ না পড়ে মসজিদে এসে নামাজ পড়া উচিত, যাতে মানুষের সঙ্গে যোগাযোগ বাড়ে।’ মাওলানা সাদের এসব বক্তব্য ভারতে তাবলিগ জামাতের একাংশকে ক্ষুব্ধ করে তোলে। বিশেষ করে ভারতের দারুল উলুম দেওবন্দ তার বক্তব্যের তীব্র সমালোচনা করে। দারুল উলুম দেওবন্দ-এর সাদবিরোধী অবস্থান প্রকাশ্য হওয়ার প্রভাব বাংলাদেশেও পড়ে। বিভক্ত হয়ে পড়েন বাংলাদেশের তাবলিগ জামাতের শীর্ষ নেতারা। তবে উভয় পক্ষ যেভাবে অনড় অবস্থানে রয়েছে তাতে এই বিরোধের মীমাংসা সহজে হবে বলে মনে হচ্ছে না। কারণ, উভয় পক্ষই দাবি করে এর মধ্যে রাজনীতি ঢুকে পড়েছে। এ জন্য তারা পরস্পরকে দায়ী করছে।

করোনাভাইরাস মহামারির কারণে দুই বছর বিরতির পর এবার বিশ্ব ইজতেমায় মুসল্লির সংখ্যা বেড়েছে। এদিকে বেড়েছে তাবলিগ জামাতের মধ্যে বিভক্তিও। এই বিভক্তি দূর হওয়ার কোনো লক্ষণও দেখা যাচ্ছে না। তাবলিগ জামাতের দুটি অংশের এই বিরোধের অবসানের জন্য গত বছর স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান উভয় পক্ষের সঙ্গে বৈঠক করে সমঝোতার চেষ্টা করেন। কিন্তু কোনো ফলোদয় হয়নি। এ অবস্থায় দুটি অংশ আলাদাভাবে আয়োজন করার কারণে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির দৃষ্টিভঙ্গিতে বিশ্ব ইজতেমা বেশ স্পর্শকাতর বিষয় হয়ে উঠেছে। মাওলানা জুবায়ের অনুসারীদের বক্তব্য হচ্ছে-মাওলানা সাদ তার কিছু বক্তব্যের মাধ্যমে কোরআন ও হাদিসের অপব্যাখ্যা দিয়েছেন। সুতরাং তার সঙ্গে সমঝোতা সম্ভব নয় বলে অনেকে মনে করেন। মোহাম্মদ সাদ কান্দলভি নিজ থেকে এর সমাধান না করলে তাবলিগ জামাতের বিভক্তির অবসান হবে না বলে মনে করেন মাওলানা জুবায়েরপন্থিরা। মাওলানা জুবায়ের অনুসারীরা এখন নিজেদের তাবলিগ জামাতের মূলধারা হিসেবে দাবি করছেন। জাকারিয়া নোমানের বক্তব্য, মাওলানা সাদপন্থিরা ধীরে ধীরে দৃশ্যপট থেকে হারিয়ে যাবে। এদিকে মাওলানা সাদের সমর্থকরা বলছেন, তারা একত্রিত হওয়ার জন্য চেষ্টা করছেন। মাওলানা সাদ তার বক্তব্যের বিষয়ে ইতোমধ্যে ভারতের দেওবন্দের কাছে ব্যাখ্যাও দিয়েছেন বলে তারা উল্লেখ করেন।

পর্যবেক্ষক মহল মনে করেন, বিশ্ব ইজতেমায় অংশগ্রহণকারীদের সংখ্যা যে হারে বাড়ছে তাতে টঙ্গীর বর্তমান স্থানে সংকুলান কেবল কঠিন নয়, অসম্ভব। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাওয়ার আগেই নতুন স্থান চিহ্নিত করার বিষয়টি বিবেচনায় নেওয়া খুবই জরুরি। সেই স্থান হতে পারে বাংলাদেশে অথবা অন্য কোনো দেশে। আর সবচেয়ে জরুরি হচ্ছে, তাবলিগ জামাতের দুই গ্রুপের মধ্যে বিরোধের অবসান। এটা করা না গেলে আবারও রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষের আশঙ্কা কিন্তু রয়েই গেছে। শুধু তাই নয়, এই বিরোধ প্রকারান্তরে তাবলিগের মূল উদ্দেশ্য ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার আশঙ্কাও থেকে যায়। এই আশঙ্কা থেকে উঠে আসার বিষয়টি নিয়ে গভীরে দিয়ে ভাবা প্রয়োজন। স্মরণ করা যায়, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান দুই গ্রুপের মধ্যে বিরোধ মেটানোর চেষ্টা করে ইতোমধ্যে বিফল হয়েছেন। তবে এই ব্যর্থতার অভিমান নিয়ে হাত-পা গুটিয়ে থাকা উচিত হবে না। কারণ তাবলিগের দুই গ্রুপের মধ্যে দিনভর রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষে হতাহতের উদাহরণ লজ্জার উদাহরণ হয়েই আছে।

লেখক : জ্যেষ্ঠ সাংবাদিক

সর্বশেষ খবর