বৃহস্পতিবার, ২ ফেব্রুয়ারি, ২০২৩ ০০:০০ টা

রাষ্ট্র মেরামতের ঘোষণা বিলম্বে কেন?

মোশাররফ হোসেন মুসা

বর্তমান রাজনৈতিক অচলায়তনের পেছনে রয়েছে অগণতান্ত্রিক রাষ্ট্রব্যবস্থা। সেজন্য ‘রাষ্ট্র সংস্কার’ শব্দ দুটি সবার কাছে অতি প্রিয়। ২০২১ সালে সড়ক দুর্ঘটনায় কয়েকজন ছাত্র নিহত হলে ছাত্ররা রাস্তায় নামে। তাদের মুখে উচ্চারিত ‘রাষ্ট্র মেরামত’ শব্দটি ব্যাপক পরিচিতি পায়। তারা রাস্তায় ব্যারিকেড দিয়ে যানবাহনের কাগজপত্র পরীক্ষা শুরু করে এবং রাস্তায় সাইনবোর্ড টাঙিয়ে ঘোষণা দেয় ‘রাষ্ট্র মেরামতের কাজ চলছে’। সর্বশেষ বিএনপির মুখে রাষ্ট্র সংস্কারের কথা শোনা গেল।

প্রতিটি দেশেই একাধিকবার রাষ্ট্র গঠনের সুযোগ আসে। ১৯৭১ সালে মহান মুক্তিযুদ্ধের পর জনগণের মধ্যে জাতি ও রাষ্ট্র গঠনের একটি উন্মাদনা সৃষ্টি হয়েছিল। তখন জনগণ চাঁদা তুলে রাস্তা মেরামত, সাঁকো তৈরি, ক্লাব ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান নির্মাণসহ বিভিন্ন জনহিতৈষী কর্মকান্ড শুরু করে; কিন্তু সামন্তবাদী-আধাসামন্তবাদী মানসিকতার কারণে সে স্বপ্ন অধরাই থেকে যায়। দ্বিতীয়বার সুযোগ আসে স্বৈরাচারী এরশাদ সরকারের পতনের পর। সব দলের ঐক্যবদ্ধ আন্দোলনের ফলে এরশাদ সরকারের পতন হলেও ঐকমত্যের ভিত্তিতে সরকার কাঠামো গঠন করা সম্ভব হয়নি। ২০০৮ সালের ২৯ ডিসেম্বর নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। বিএনপি ৩০টি আসন লাভ করে। তারা ভোট কারচুপির অভিযোগ তুলে আন্দোলনের ডাক দেয়। তারা নিরপেক্ষ নির্বাচনের দাবিতে ২০১৪ সালের দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনও বর্জন করে এবং সরকারের পতন না হওয়া পর্যন্ত হরতাল-অবরোধের ঘোষণা দেয়। তারা আন্দোলনের নামে জ্বালাও-পাড়াও কর্র্মকান্ড শুরু করে। তাদের পেট্রোলবোমা, হাতে তৈরি বোমা ও অন্যান্য সহিংসতায় আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর ২০ সদস্যসহ ২০০ সাধারণ মানুষের প্রাণহানি ঘটে। অবরোধ কার্যকরের জন্য রাস্তার পাশে হাজারো গাছ কেটে ফেলা হয়। এ ছাড়া ছোটখাটো দোকান, সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠান ও বিদ্যুৎ কেন্দ্রগুলোয় আগুন দেওয়া হয়। আমাদের রাজনৈতিক দলের নেতারা ঘরোয়া আলোচনায় ভুলত্রুটি স্বীকার করলেও প্রকাশ্যে ঘোষণা দিতে ভয় পান। কারণ এতে তাদের পদ হারানোর আশঙ্কা থাকে। সে ক্ষেত্রে কৌশলগতভাবে এমন কার্যসূচির ঘোষণা দিতে হবে যেন পরোক্ষভাবে হলেও ভুল স্বীকারোক্তির প্রকাশ ঘটে। গত ১৯ ডিসেম্বর ঢাকা হোটেল ওয়েস্টিনে এক সংবাদ সম্মেলনে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ড. খন্দকার মোশাররফ হোসেন শরিক দলের নেতৃবৃন্দের উপস্থিতিতে ২৭ দফা দাবি উপস্থাপন করেন। দাবিগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো- ১. সংবিধান সংস্কার কমিশন গঠন; ২. নির্বাচন কমিশন নিয়োগ বাতিল; ৩. প্রশাসনিক সংস্কার কমিশন গঠন; ৪. সংবিধান মোতাবেক ন্যায়পাল নিয়োগ; ৫. অর্থনৈতিক সংস্কার কমিশন গঠন; ৬. রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রীর ক্ষমতার ভারসাম্য আনা; ৭. দ্বিকক্ষবিশিষ্ট আইনসভার প্রচলন; ৮. স্থানীয় নির্বাচনে দলীয় প্রতীক বাতিল; ৯. জাতীয় সমঝোতা কমিশন গঠন; ১০. বাংলাদেশে দেশি-বিদেশি সন্ত্রাসবাদের চর্চা বন্ধ করা প্রভৃতি। এমন যদি হতো ২০১০ সালেই বিএনপি উপরোক্ত ২৭ দফা দাবি উপস্থাপন করে ঘোষণা দিত যে, ‘সুষ্ঠু নির্বাচন না হওয়া, দুর্নীতি-সন্ত্রাস বন্ধ না হওয়া ইত্যাদির জন্য দায়ী অগণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থা। সেজন্য আমরা আজ থেকে একটি গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার আন্দোলন শুরু করলাম।’ তাহলে এতদিনে রাজনীতিতে একটি গুণগত পরিবর্তন ঘটত এবং বিভিন্ন রাজনৈতিক মহল থেকে রাষ্ট্র সংস্কারের দাবি উঠত। স্বৈরাচারী ও অনির্বাচিত সরকারগুলো ক্ষমতায় এসে চমক সৃষ্টিকারী কর্মসূচি ঘোষণা দিতে দেখা যায়। প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমানের ১৯ দফা ও এরশাদের ১৮ দফা উদাহরণ হতে পারে। তাদের এসব কর্মসূচিতে স্বাধীন নির্বাচন কমিশন, স্বাধীন বিচার বিভাগ, স্বাধীন দুর্নীতি দমন কমিশন, সর্বোপরি ক্ষমতার বিকেন্দ্রীকরণের কোনো ডিজাইন ছিল না। এ অবস্থায় ২৭ দফা বাস্তবায়ন বিষয়ে বিএনপি কতটুকু আন্তরিক হবে, তা প্রশ্নের দাবি রাখে। তাদের দাবিতে রাষ্ট্র সংস্কার, পার্লামেন্টে উচ্চকক্ষ সৃষ্টি, নিজ ভূমিতে দেশ-বিদেশের সন্ত্রাসবাদের চর্চা ইত্যাদি কীভাবে বাস্তবায়ন করবে- সে বিষয়ে কোনো সুস্পষ্ট দিকনির্দেশনা নেই। এ দেশে প্রাদেশিক সরকারব্যবস্থা নেই, সে ক্ষেত্রে উচ্চকক্ষের প্রতিনিধি কোথা থেকে আসবে তারও ব্যাখ্যা নেই। সেজন্য ‘সিডিএলজি’ দীর্ঘদিন যাবৎ বলে আসছে, দুই প্রকারের সরকারব্যবস্থাই সমাধান দিতে পারে। নগরায়ণমুখী বাংলাদেশ সামনে রেখে সরকারব্যবস্থা সাজাতে হবে। প্রতিটি স্থানীয় ইউনিটকে প্রজাতান্ত্রিক রূপ দিতে হবে। জেলা সরকার হবে গ্রামীণ স্থানীয় সরকার ও নগরীয় স্থানীয় সরকারের সর্বোচ্চ স্তর। জেলা সরকার থেকে প্রতিনিধি নিয়ে উচ্চকক্ষ সৃষ্টি করা যেতে পারে। প্রেসিডেন্ট পদটি সর্বদলীয় করার জন্য জাতীয় সংসদ সদস্য ও স্থানীয় সরকারের প্রতিনিধিদের ভোটে নির্বাচিত করার ব্যবস্থা করা যেতে পারে। বাংলাদেশের বড় পরিবর্তনের জন্য আমরা পেয়েছিলাম বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে; আর ভারত পেয়েছিল মহাত্মা গান্ধীকে। রাষ্ট্র সংস্কার যে কত গুরুত্বপূর্ণ বিষয়, তা তাঁরা জীবন দিয়ে প্রমাণ করে গেছেন। দেশবাসীর প্রতি বঙ্গবন্ধুর ভালোবাসা, সততা, সাধারণ জীবনযাপন, দীর্ঘকালের বাঙালি সংস্কৃতি ধারণ করা ইত্যাদির বিষয়ে কোনো বিতর্ক নেই। আর এসব কারণে ব্যক্তি মুজিবকে নিয়ে হাজার হাজার বছর ধরে কবিতা, গান, গল্প-উপন্যাস, সভা-সেমিনার চলতেই থাকবে। কিন্তু গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের জন্য রাষ্ট্রব্যবস্থা সংস্কার করার সময় বঙ্গবন্ধু পাননি এবং তা নিয়েও বিতর্ক চলতে থাকবে। একই উদাহরণ মহাত্মা গান্ধীর বেলায়ও ঘটে। তাঁর অহিংসবাদী নীতির কারণে তিনি সারা বিশ্বে সম্মানিত। সারা দেশে ধর্মীয় বিদ্বেষ, জাতপাত বজায় রেখে তথা সামন্তবাদী ব্যবস্থা বজায় রেখে অহিংসবাদ প্রচার বিবেকের রোলের মতো শোনায়। তার পরও ভারতবাসীর ভাগ্য ভালো পন্ডিত জওহরলাল নেহরুর মতো অভিজ্ঞ নেতাকে পেয়েছিল। তিনি দেশোপযোগী গণতান্ত্রিক ভারতের ডিজাইন দেন; সেই সঙ্গে মূল্যবোধসম্পন্ন কিছু মানুষকে বিভিন্ন সেক্টরে বসাতে সক্ষম হয়েছিলেন। বাংলাদেশের বড় রাজনৈতিক দলগুলোর অতীত এবং বর্তমানের কর্মকান্ড দেখে কেউই গণতন্ত্র ও গণতন্ত্রায়ণের বিষয়ে আশাবাদী হতে পারছে না।

                লেখক : গণতন্ত্রায়ণ ও গণতান্ত্রিক             স্থানীয় সরকারবিষয়ক গবেষক

সর্বশেষ খবর