সোমবার, ২০ ফেব্রুয়ারি, ২০২৩ ০০:০০ টা

মাতৃভাষা চর্চায় আলেমদের অংশগ্রহণ বাড়াতে হবে

মাওলানা সেলিম হোসাইন আজাদী

মাতৃভাষা চর্চায় আলেমদের অংশগ্রহণ বাড়াতে হবে

ভাষা মানুষের অন্যতম প্রধান বৈশিষ্ট্য। অন্যান্য প্রাণীর ওপর মানুষের শ্রেষ্ঠত্বের অন্যতম কারণ এ ভাষা। পৃথিবীতে ঠিক কতগুলো ভাষা আছে তার সঠিক পরিসংখ্যান পাওয়া কঠিন। তবে অনুমান প্রায় ৩ থেকে ৪ হাজার ভাষা পৃথিবীতে রয়েছে। উইকিপিডিয়ার তথ্য মতে পৃথিবীতে এ পর্যন্ত ৭ হাজার ৩৩০টি ভাষার সন্ধান পাওয়া গেছে। তবে এতগুলো ভাষার মধ্যে প্রত্যেক জাতির কাছেই নিজ মাতৃভাষা অতুলনীয়। মাতৃভাষায় মানুষ যেভাবে মনের ভাব প্রকাশ করতে পারে অন্য ভাষায় তা হয় না। শিশুর প্রতি মা জননীর অতুলনীয় স্নেহ, মায়ের প্রতি শিশুর অফুরন্ত ভালোবাসা প্রকাশ হয় এ মাতৃভাষায়। পৃথিবীর প্রত্যেক জাতির লোক তার মাতৃভাষাকে ভালোবাসে মায়ের মতোই।

মহানবী হজরত মুহাম্মদ (সা.) বলেছেন, ‘তিন কারণে তোমরা আরবিকে ভালোবেসো- যেহেতু আমি আরবি ভাষায় কথা বলি, কোরআন আরবি ভাষায় নাজিল হয়েছে এবং জান্নাতের ভাষাও হবে আরবি।’ (বুখারি)। কিন্তু আরবি পরকালের ভাষা হওয়া সত্ত্বেও সব নবী-রসুল আরবি ভাষাভাষী ছিলেন না; এমনকি সব আসমানি কিতাবও আরবি ভাষায় নাজিল হয়নি। আল্লাহতায়ালা মানুষকে অন্ধকার থেকে আলোর পথে নিয়ে আসার জন্য যুগে যুগে অসংখ্য নবী-রসুল দুনিয়ায় প্রেরণ করেছেন। তাঁরা নিজ জাতির ভাষায় ধর্ম প্রচার করতেন। আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘আমি সব রসুলকে তাদের নিজ জাতির ভাষাভাষী করে পাঠিয়েছি, যাতে তারা উম্মতকে পরিষ্কার করে বুঝাতে পারে।’ (সুরা ইবরাহিম, আয়াত ৪) হজরত মুসা (আ.)-এর সম্প্রদায়ের ভাষা ছিল ইবরানি। তাই তাওরাত নাজিল হয়েছে ইবরানি ভাষায়। হজরত দাউদ (আ.)-এর কওমের ভাষা ছিল ইউনানি। তাই জাবুর কিতাব নাজিল হয়েছে ইউনানি ভাষায়। হজরত ঈসা (আ.)-এর গোত্রের ভাষা ছিল সুরিয়ানি। তাই এ ভাষায় ইনজিল কিতাব নাজিল হয়। প্রিয় নবী হজরত মুহাম্মদ (সা.)-এর উম্মতের ভাষা ছিল আরবি। তাই আরবি ভাষায় কোরআন নাজিল হয়েছে। আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘আমি একে আরবি ভাষায় কোরআনরূপে নাজিল করেছি, যাতে তোমরা সহজে বুঝতে পার।’ (সুরা ইউসুফ, আয়াত ২)।

ইসলাম সব ভাষাকে সম্মান করতে শেখায়। সব ভাষাই আল্লাহর দান ও তার কুদরতের নিদর্শন। আল্লাহ বলেন, ‘তাঁর মহিমার নিদর্শন হচ্ছে মহাকাশ ও পৃথিবীর সৃষ্টি এবং তোমাদের ভাষা ও বর্ণের বৈচিত্র্য। এতে অবশ্যই জ্ঞানীদের জন্য শিক্ষণীয় নিদর্শন রয়েছে।’ (সুরা রুম, আয়াত ২২) বিশুদ্ধভাবে মাতৃভাষায় কথা বলা নবীজির সুন্নত। প্রসিদ্ধ হাদিস গ্রন্থ ‘মুসান্নাফে ইবনে আবি শায়বা’য় শিষ্টাচার অধ্যায়ের একটি শিরোনাম হলো- ‘মান কানা ইউয়াল্লিমুহুম ওয়াদরিবহুম আলাল লাহনি’ অর্থাৎ সন্তনকে ভাষা শিক্ষা দেওয়া এবং ভুল হলে শাসন করা প্রসঙ্গ। এ পরিচ্ছেদে হজরত আবদুল্লাহ ইবনে উমর (রা.) থেকে বর্ণিত আছে, ‘তিনি ভাষাগত ভুল হলে সন্তানদের শাসন করতেন।’ একদিন এক সাহাবি রসুল (সা.)-এর দরজার বাইরে থেকে সালাম দিয়ে বললেন, ‘আ-আলিজু?’ প্রবেশ করার অর্থে এ শব্দটির ব্যবহার আরবিতে আছে। কিন্তু প্রমিত ও সাহিত্যপূর্ণ শব্দ হলো, ‘আ-আদখুলু?’ রসুল (সা.) তাঁকে শেষোক্ত শব্দটি প্রয়োগ করতে বলেছেন।

মাতৃভাষা গৌরবের বিষয়। নিজ মাতৃভাষা সম্পর্কে উচ্ছ্বসিত কণ্ঠে মহানবী (সা.) বলতেন, ‘আরবদের মধ্যে আমার ভাষা সর্বাধিক সুললিত। তোমাদের চেয়েও আমার ভাষা অধিকতর মার্জিত ও সুললিত।’ (আল-মুজাম, হাদিস নম্বর ২৩৪৫)

এর কারণ তিনি নিজেই ব্যাখ্যা করেছেন এভাবে- ‘আরবের সবচেয়ে মার্জিত ভাষার অধিকারী সাদিয়া গোত্রে আমি মানুষ হয়েছি। তাঁদেরই কোলে আমার মুখ ফুটেছে। তাই আমি সর্বাধিক সুললিত ভাষা আত্মস্থ করেছি।’ (আল-বদরুল মুনির ফি তাখরিজিল আহাদিস : ৮ম খ, পৃ. ২৮১ পৃষ্ঠা) সাহিত্যিক সৈয়দ আবুল হাসান আলী নদভী (রহ.) বাংলাদেশ সফরে এসে আলেমদের উদ্দেশে বলেন, বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের নেতৃত্ব নিজেদের হাতে নিতে হবে এবং এর নেতৃত্ব ছিনিয়ে আনতে হবে। তিনি আরও বলেন, দীর্ঘ জীবনের লব্ধ অভিজ্ঞতা থেকে বলা যায়, বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের প্রতি উদাসীনতা প্রদর্শন কিংবা বিমাতাসুলভ আচরণ এ দেশের আলেম সমাজের জন্য জাতি হত্যারই নামান্তর। তিনি আরও বলেন, প্রতিটি মাদরাসায় বাধ্যতামূলক সাহিত্য-সাংবাদিকতার ওপর পাঠদান এখন সময়ের দাবি। অনেকে বাংলা ভাষাকে অবহেলা করেন। কোনো কোনো ভাই মনে করেন এ ভাষায় কোনো নূর নেই। আসলে আরবি ভাষা তো ছিল আবু জাহেল, উতবা ও শায়বাদের। ফারসি ভাষা ছিল অগ্নিপূজকদের। তাই বলে কি সে দেশের মুসলমানরা তাদের মাতৃভাষা আরবি-ফারসি বর্জন করেছেন? না, করেননি। বরং তারা কোরআনের নূর দিয়ে নিজেদের ভাষা-সাহিত্যকে আরও সমৃদ্ধ করেছেন। এদিকেই তাগিদ দিয়েছেন সৈয়দ আবুল হাসান আলী নদভী (রহ.)। তা ছাড়া বাংলা ভাষা কোনো একক ধর্মীয় গোষ্ঠীর পৈতৃক সম্পত্তি নয়। পাশাপাশি এটাও সত্য, বাংলা ভাষা মুসলিম শাসকদের দ্বারাই সমৃদ্ধ লাভ করেছে। বিশেষ করে সুলতান ইলিয়াস শাহর শাসনকালে। এ জন্য তাকে বঙ্গীয় উপাধিতে ভূষিত করা হয়েছিল। মহান আল্লাহ আমাদের মাতৃভাষা বাংলাকে কেয়ামত পর্যন্ত স্থায়ী রাখুন এবং উত্তরোত্তর এর শ্রীবৃদ্ধি করুন। বিশুদ্ধ মাতৃভাষায় সত্য ও ন্যায়ের প্রতি দাওয়াত দেওয়ার তৌফিক আল্লাহ আমাদের দিন। আমিন।

লেখক : চেয়ারম্যান, বাংলাদেশ মুফাসসির সোসাইটি, পীর সাহেব, আউলিয়ানগর।

সর্বশেষ খবর