বুধবার, ২৯ মার্চ, ২০২৩ ০০:০০ টা

সহনশীলতার বিকল্প নেই

মেজর জিল্লুর রহমান (অব.)

সহনশীলতার বিকল্প নেই

লিখতে বসে পত্রিকার কর্তাদের অলিখিত আগ্রহ-অনাগ্রহের অজুহাত মনে হলে লেখার উদ্যম বিঘিœত হয়। যখন লেখা শুরু করি খুঁটিনাটি রেডিমেড মনে থাকে না। অনেক সময় নিয়ে তথ্য সংগ্রহ, যাচাই-বাছাই, গবেষণা করে লেখার ফ্রেম দাঁড় করাতে হয়। ভেবেচিনতে খোঁজখবর নিয়ে তথ্য জোগাড় করে কষ্ট কসুর করে লেখা সাজাতে ভীষণ কষ্ট হয়। সে কষ্ট আরও বেড়ে যায় যখন মনের মধ্যে খোঁচা মারে লেখা নিয়ে সম্পাদক আপত্তি তুলবেন নতুবা পুনরায় মূল্যায়ন করে লিখতে বলবেন অথবা টেবিলের নিচে ওয়েস্ট পেপার বাস্কেটে ফেলে রাখবেন এমনটি ভেবে। ‘উচিত কথার ভাত নেই’ এমন বাণী চিরন্তনী ছোটবেলায় শুনতাম। এখন বুঝতে পারছি কথাটা নিছক কথার কথা নয়, নিশ্চয়ই পটভূমি কিছু আছে এ কথার উৎপত্তির।

অনেক লেখা এমন বস্তাবন্দি হয়ে ভাঙ্গুরার কাঁধে চড়ে চলে গেছে। বোঝা যায় ম্যানেজ করে কোথাও না কোথাও সমঝোতা করে কোনোরকমে দিন চালিয়ে যেতে হচ্ছে। উন্নয়নশীল দেশের সরকার শুধু প্রশংসা শুনতে চায়। এ চাটুকারী তোষামোদি মোসাহেবি কাজ শুধু চাটুকার মতলববাজরাই নিপুণভাবে করতে পারদর্শী। বিনিময়ে অযোগ্য হয়েও অনেক বড় পদপদবি সুযোগ-সুবিধা কুড়াচ্ছে। লাইব্রেরিতে যখন নির্জনে একা লিখতে বসি তখন মনে ভাবনার উদ্রেক করে কত দূর আর প্রাণ খুলে মতপ্রকাশের সেই রঙিন শুভলগ্ন।

আমাদের সরকার বাহাদুর বলে সমালোচনা করতে মানা থাকলে বা বাধা দিলে অগণিত চ্যানেলে সরকারের বিরুদ্ধে এত কথা কী করে বাকবাকুম বাকবাকুম বকত? বাধা নেই বলেই তো নিন্দা করতে পারছে এটাই বড় প্রমাণ। আমাদের দলই প্রথম টিভি চ্যানেল, মোবাইল অপারেটরের ব্যবসার দ্বার উন্মুক্ত করে দিয়েছে। ওপরমহলের আংশিক সহি এ কথা আর কাজের সঙ্গে অমিল বিস্তর। দলীয় চামচাদের চ্যানেলের অনুমতি দিলেই কি বাকস্বাধীনতা হয়ে যায়? টিভিতে কথা যারা বলে ভয়ে শঙ্কায় থেকে, যা বলতে চায় তা না বলে আমতা আমতা করে পিঠ বাঁচিয়ে কথা বলাকে স্বাধীন মতপ্রকাশ বলে না। ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের প্রয়োগ মতপ্রকাশের স্বাধীনতার পথে যে ব্যারিকেড খননের উদ্দেশ্যে প্রণীত সেই বার্তাই জানান দিচ্ছে।

সরকার সমালোচনা শুনলে তেলেবেগুনে জ্বলে ওঠে। গণতন্ত্র, সাম্য, ন্যায়বিচার, দুর্নীতি, অর্থ পাচার, বড় প্রকল্পে তুঘলকি কান্ড, আইনের শাসনের অভাব, দলীয়করণের বশীকরণ শুনলে ক্রোধে ফেটে পড়ে। বলতে থাকে মেট্রোরেল, পদ্মা সেতু, কর্ণফুলী টানেল, এক্সপ্রেসওয়ে ইত্যাদি তৈরির সাফল্য আড়াল করতেই ফালতু অভিযোগ তোলা হচ্ছে। তথ্য ও সম্প্রচারমন্ত্রী বলেন, এরা দেখে না বিরোধীরা সব অন্ধ। দ্রব্যমূল্যের অগ্নিতে মানুষ পুড়ে অঙ্গার হচ্ছে তা-ও বলা যাবে না, বলতে হবে আয়ের চেয়ে ব্যয় অনেক কম। পরিণতি না ভেবে আইএমএফ-প্রদত্ত প্রেসক্রিপশনে দাম বাড়াতে হয়েছে শুধু ঋণ পাওয়ার আশায় বুক বেঁধে। দফায় দফায় বিদ্যুৎ, গ্যাস ও তেলের দাম হাঁকিয়ে জনগণকে কষ্টে ফেলে সরকার যেনতেনভাবে গদিতে থাকার ধ্যানে মগ্ন থাকায় বুঝি এমন গোঁয়ার্তুমি।

পুরনো কথার বিরুদ্ধে কণ্ঠস্বরকে চুপ করাতে সরকারের দ্বিমুখী অস্ত্র ব্যবহার বহু চর্চিত। যে কোনো নিন্দা-প্রতিবাদ দাবি-আবদার দেশ-রাষ্ট্র বিরোধিতার মোড়কে পুরে প্রচার, দেশবিরোধী ষড়যন্ত্র বলে অভিযোগ করা হয়। শেষে অনৈতিক, আর্থিক বা আনুষঙ্গিক অভিযোগ তুলে হেনস্তা, হয়রানি, হাজতবাস করিয়ে ছাড়ে।

একের পর এক ব্যক্তি বা সংস্থার ওপর মামলা-মোকদ্দমা। সাংবাদিক, সমাজকর্মী, বিবেকবান, সুশীলসমাজ, মানবাধিকার কর্মীর বিরুদ্ধে পচা মামলা হচ্ছে যার জামিন নেই তো নেই। বিদেশিদের ক্ষেত্রেও কিছু পাতলা বাধা আছে। তলব করা-করি, প্রতিবাদলিপি, লবিস্ট নিয়োগ আছে। অপছন্দের কথা বলা, লেখা এমনভাবে ঘুরিয়ে পেঁচিয়ে উকিল-মোক্তার তরজমা করে সরল ব্যাখ্যা করে পেশ করা হয় আদালতে যাতে মনে হয় বক্তা-লেখক দেশের বিরুদ্ধে উঠেপড়ে লেগেছে। দেশ পরিচালনায় বিশ্বনেতাদের হস্তক্ষেপ কামনা করছেন যা কোনো সরকার বরদাশত করতে পারে না। স্বাধীন মতপ্রকাশের এই হলো দশা। যে কোনোভাবে যে কোনো মূল্যে যে কোনো অজুহাতে সরকারের সমালোচনাকে এনে ফেলতে হবে রাষ্ট্রবিরোধিতার আইনি ফরমেটে। সেজন্য ত্বরিত মামলা পয়দা করার প্রশিক্ষিত বাহিনী আছে। সহজ বিরোধী কথা দুই মাইল দূর থেকে ঘুরিয়ে পেঁচিয়ে গুরুতর অপরাধীর মস্তকের ফসল বলে আদালতে পেশ করতে আদালতপাড়ায় কালা কোট সাদা জামা পরা উকিল-মোক্তারও আছে। দুর্নীতি, স্বজনপ্রীতি, টাকা পাচার, ব্যাংক লুট, মানবাধিকার লঙ্ঘন এ নির্জলা অভিযোগকে বলতে হবে দেশের ওপর, সরকারের ওপর নিন্দা আরোপের ষড়যন্ত্র। পুলিশ সুপ্রিম কোর্টে ঢুকে বেধড়ক লাঠিচার্জ করেছে। সরকারি দলের উকিলদের বিজয় নিশ্চিত করার পারিপার্শ্বিক পরিস্থিতি কায়েম করেছে।

যাতে ব্যালট, ভোটবাক্স, সরকারি উকিলদের দল ইচ্ছামতো সমস্বরে জয়ধ্বনি দিতে পারে। আলামত দিনের বেলায় ঘটলেও তা দেখে বলতে হবে দুই দলের উকিল হাতাহাতি মারামারি করেছে। তাই মৃদু শক্তি প্রয়োগ করে হানাহানি ঠেকিয়েছে পুলিশ। সরকার গঠনের কোনো নির্বাচন না হলেও তাতেই এই লঙ্কাকান্ড। জাতীয় নির্বাচনে আর কী অলৌকিক মাজেজা অপেক্ষা করছে তার জন্য অপেক্ষায় থাকতেই হবে। জাতীয় নির্বাচনের আগাম পূর্বাভাস জানালে গোসসা করবে অনেক সুবোধ লোক।

গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া ব্যাহত করতে চায় যারা তাদের অন্য স্বার্থ আছে। হাতে রইল এক হাতে গণতন্ত্র বলে ঢাকঢোল পেটানো কাঠি, অন্য হাতে গণতান্ত্রিক সমালোচনাকে চোখ রাঙিয়ে ভীতসন্ত্রস্ত করে এক মস্তিষ্কের শাসন চালানো।

মতপ্রকাশের স্বাধীনতা, সংবাদপত্রের স্বাধীনতার ওপর বাধা আসার বিষয়টি বিশ্বের কারও যখন আর কিছু জানতে বাকি নেই, রাষ্ট্রবিরোধী ধুয়া তুলে শিয়ালের কুমিরছানা দেখানোর কল্পকাহিনিতে বিশ্বমত পক্ষে আনার প্রয়াস নিষ্ফল চেষ্টা হতে বাধ্য। বর্তমান দুনিয়ায় এহেন অন্ধ আত্মতুষ্টি চূড়ান্ত পরিণামে সরকারকে ভোগাবে। মুরুব্বি দেশের বিরক্তি না জাগিয়ে জনগণের কাছে গিয়ে শুনলে সামনে কী অপেক্ষা করছে বোঝা যাবে। তাতেই রোগ নিরাময়ের পথ্য আবিষ্কৃত হবে। ভিন্নমত প্রকাশের ক্ষেত্রে সরকারকে আরও সহনশীল হতে হবে।

 

লেখক : নিরাপত্তা বিশ্লেষক

[email protected]

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর