বুধবার, ৫ এপ্রিল, ২০২৩ ০০:০০ টা

সড়ক হোক নিরাপদ

প্রিন্সিপাল এম এইচ খান মঞ্জু

সড়ক হোক নিরাপদ

প্রতিদিনই দেশের কোথাও কোথাও ঘটছে সড়ক দুর্ঘটনা। দীর্ঘতর হচ্ছে মৃত্যুর মিছিল। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার হিসাব মতে, বাংলাদেশে সড়ক দুর্ঘটনায় বার্ষিক মৃত্যুহার উচ্চ আয়ের দেশগুলোর দ্বিগুণ এবং বিশ্বের সর্বোচ্চ নৈপুণ্য দেখানো অর্থনীতিগুলোর চেয়ে পাঁচ গুণের অধিক।  গত দুই দশকে সড়কভিত্তিক যোগাযোগব্যবস্থায় বিপুল বিনিয়োগ হয়েছে। রাষ্ট্রীয় প্রচেষ্টায় বিস্তৃত হয়েছে সড়ক-মহাসড়ক। তবে থামছে না দুর্ঘটনা। প্রতিদিনই প্রাণ ঝরছে সড়কে। ড্রাইভিং লাইসেন্সের জন্য একটি নির্দিষ্ট বয়সসীমা ও শিক্ষাগত যোগ্যতা বেঁধে দিলেও সেটি অনেক ক্ষেত্রে মানা হচ্ছে না। অদক্ষ ও ভুয়া লাইসেন্সপ্রাপ্ত চালক গাড়ি নিয়ে নামছেন সড়কে। বেপরোয়া গতিতে চালাচ্ছেন গাড়ি। ত্রুটিপূর্ণ যানবাহনও অনেক সময় উঠে আসছে সড়কে। উচ্চগতির যানবাহনের সঙ্গে চলছে ধীরগতির যানবাহন। সেগুলোও অনেক সময় দুর্ঘটনার কারণ হচ্ছে।

দেশে সড়ক নিরাপত্তা উন্নয়নে সরকারের সদিচ্ছার ঘাটতি নেই। খোদ প্রধানমন্ত্রীও সড়ক দুর্ঘটনা রোধে নানা নির্দেশনা দিয়েছেন। এ ছাড়া বিশেষজ্ঞরা বিভিন্ন সময়ে সুপারিশ দিয়েছেন। মহাসড়কগুলোয় ফিডার রোড দিয়ে কম গতির গাড়ি, মোটরবিহীন যানবাহন চলাচল বন্ধ করা দরকার, যাতে দুর্ঘটনা হ্রাস পায়। আর মহাসড়কের পাশে থাকা বাজার, মানুষজন রাস্তা পারাপার হয়- এমন স্থানগুলোয় বিশেষ ব্যবস্থা নেওয়ার বিষয়টি এখন সময়ের দাবি।

সম্প্রতি দেশের সবচেয়ে ব্যয়বহুল, দৃষ্টিনন্দন, সবচেয়ে ভালো মহাসড়ক ঢাকা-ভাঙ্গা একপ্রেসওয়েতে এক সড়ক দুর্ঘটনায় ২০ জনের মর্মান্তিক মৃত্যু হয়েছে। আহত হয়েছে অন্তত ২০ জন। রাজধানী ও পদ্মা সেতুর মধ্যে সংযোগ স্থাপনকারী এই মহাসড়কের শিবচরের কুতুবপুরে একটি বাস নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে খাদে পড়ে গেলে হতাহতের এ ঘটনা ঘটে। চালকের বিষয়ে জানা গেছে, ঘুম ঘুম চোখে সে গাড়ি চালাচ্ছিল। খবরে বলা হয়েছে, ৪৮ ঘণ্টার মধ্যে ৩০ ঘণ্টা বাস চালিয়ে চালক ক্লান্ত ছিল। দুর্ঘটনায় তারও মৃত্যু হয়েছে। বাসের বিষয়ে জানা গেছে, বাসটির রেজিস্ট্রেশন ছিল না, চলাচলের অনুমোদন ছিল না। রুট পারমিট ও রেজিস্ট্রেশন গত নভেম্বরে স্থগিত করা হয়। বাসটি ওই মাসে এক দুর্ঘটনায় পতিত হয়, যাতে তিনজন নিহত হয়। বাসের ফিটনেস সার্টিফিকেট ছিল না; অনেক আগেই তার মেয়াদোত্তীর্ণ হয়েছে। বাসে ধারণক্ষমতার অতিরিক্ত যাত্রী ছিল। দেখা যাচ্ছে, এ ধরনের দুর্ঘটনা ঘটার জন্য বর্ণিত একটি কারণই যথেষ্ট।

গত ফেব্রুয়ারিতে ৩০৮টি সড়ক দুর্ঘটনায় মৃত্যু হয়েছে ৩০৩ জনের এবং আহত হয়েছে ৪১৬ জন। গত বছর দুর্ঘটনায় মৃত্যু হয়েছে ৭ হাজার ৭১০ জনের।

সড়ক দুর্ঘটনা নিয়ে কাজ করা সংগঠন রোড সেফটি ফাউন্ডেশনের তথ্য অনুযায়ী, গত বছর সড়কে ১ হাজার ২৩৭ জন শিক্ষার্থীর মৃত্যু হয়েছে। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি ১৪২ শিক্ষার্থীর মৃত্যু হয়েছে ডিসেম্বরে। আর সংখ্যার দিক থেকে তুলনামূলক কম মৃত্যুর ঘটনা এপ্রিলে-৬৩ জন। বিদায়ী ২০২২ সালের মে, জুলাই, অক্টোবর ও ডিসেম্বর- এই চার মাসের প্রতি মাসেই শতাধিক শিক্ষার্থীর মৃত্যু হয়েছে সড়কে। এর মধ্যে মে মাসে ১০৭ জন, জুলাইতে ১০৪ জন এবং অক্টোবরে ১২৩ শিক্ষার্থী সড়ক দুর্ঘটনায় প্রাণ হারান। আর গত বছর দেশে সড়ক দুর্ঘটনায় মারা গেছেন ৭ হাজার ৭১৩ জন। অর্থাৎ মোট নিহতের ১৬ শতাংশের বেশি ছিল শিক্ষার্থী। এদের বড় অংশের মৃত্যু হয়েছে মোটরসাইকেল দুর্ঘটনায়।

কয়েক বছর ধরেই দেশে মোটরসাইকেল দুর্ঘটনা ধারাবাহিকভাবে বাড়ছে। ২০২১ সালের তুলনায় ২০২২ সালে মোটরসাইকেল দুর্ঘটনা বেড়েছে ৪৩ শতাংশের বেশি। ট্রাক, কাভার্ড ভ্যান, পিকআপ ও বাসের ধাক্কা, চাপা এবং মুখোমুখি সংঘর্ষে মোটরসাইকেল দুর্ঘটনা বেশি ঘটছে। প্রায় ৪০ শতাংশ ক্ষেত্রে দুর্ঘটনার জন্য মোটরসাইকেল চালক এককভাবে দায়ী ছিল বলে সড়ক নিরাপত্তা নিয়ে কাজ করা তিনটি সংগঠনের ২০২২ সালের প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে।

শুধু ঢাকা-ভাঙ্গা এক্সপ্রেসওয়ে নয়, দেশের কোনো সড়ক-মহাসড়কই দুর্ঘটনামুক্ত নয়। ঢাকা-চট্টগ্রাম, ঢাকা-আরিচা, ঢাকা-টাঙ্গাইল প্রভৃতি মহাসড়কে ছোটখাটো দুর্ঘটনা তো আছেই, কখনো কখনো বড় ধরনের দুর্ঘটনাও ঘটতে দেখা যায়। দক্ষ ও প্রশিক্ষিত চালক যানবাহন চালালে, যানবাহনের কাগজপত্র ও কন্ডিশন ঠিক থাকলে, ট্রাফিকবিধি মেনে যানবাহন চলাচল করলে এবং যান চলাচল নিয়ন্ত্রণ ও তত্ত্বাবধানে ট্রাফিক ও হাইওয়ে পুলিশ দায়িত্বশীল হলে দুর্ঘটনা ও প্রাণহানি অনিবার্যভাবেই কমতে বাধ্য। স্বীকার করতে হবে, রাস্তা ব্যবস্থাপনা ও যানবাহন ব্যবস্থাপনা বলতে যা বোঝায়, আমাদের দেশে তার অভাব বা ঘাটতি আছে। এ কারণে দুর্ঘটনা ও প্রাণহানির দিক থেকে আমাদের দেশ এখনো বিশ্বে শীর্ষে অবস্থান করছে।

নিরাপদ সড়কের দাবিতে দীর্ঘদিন আন্দোলন হচ্ছে। অথচ, সড়ক নিরাপদ হচ্ছে না। বরং দিন দিন আরও অনিরাপদ হয়ে পড়ছে। দুর্ঘটনা বন্ধ বা কম হলেই সড়ক নিরাপদ বলে সাব্যস্ত হবে না। নিরাপদ সড়ক মানে সড়কে সব ধরনের উপদ্রব বন্ধ হওয়া।  চুরি, ডাকাতি, ছিনতাই, রাহাজানি, মালামাল লোপাট- এসব বন্ধ হলে সড়কে নির্ভয় পরিবেশ প্রতিষ্ঠিত হবে। ঢাকা-ভাঙ্গা এক্সপ্রেসওয়েসহ সব সড়ক-মহাসড়ক নিরাপদ করতে সড়ক-সেতু কর্তৃপক্ষ, পুলিশ, জনপ্রতিনিধি ইত্যাদি স্টেকহোল্ডারকে একসঙ্গে বসে সিদ্ধান্ত ও যৌথ কার্যব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। সড়ক-দুর্ঘটনা, প্রাণহানি ও বহু মানুষের রোনাজারি বন্ধ  হোক, আমরা এই কামনা করি।

লেখক : সাবেক সংসদ সদস্য ও প্রাক্তন প্রিন্সিপাল এম এইচ খান ডিগ্রি কলেজ, গোপালগঞ্জ

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর