শিরোনাম
বৃহস্পতিবার, ১৩ এপ্রিল, ২০২৩ ০০:০০ টা

মহিউদ্দীন আহমেদ : জাতীয় ইতিহাসের এক কিংবদন্তি

জিল্লুর রহিম

মহিউদ্দীন আহমেদ : জাতীয় ইতিহাসের এক কিংবদন্তি

বরিশালের মহিউদ্দীন আহমেদ- শেষ পর্যন্ত সমগ্র বাংলার গণমানুষের মহিউদ্দীন আহমেদ হয়ে উঠেছিলেন। গণমানুষের শোষণ মুক্তির সংগ্রামে তিনি ছিলেন সর্বসমন্বয়ক সংগঠক, সর্বত্যাগী কর্মযোগী। মহিউদ্দীন কৈশোরকাল থেকে আমৃত্যু সাধারণ মানুষের অবস্থার উন্নয়নে যুদ্ধ করেছেন এবং এ যুদ্ধ ছিল তুলনাবিহীন। গণআন্দোলনের গভীরতা গণমানুষের কাছে তিনি তুলে ধরতে পেরেছিলেন। সমাজতন্ত্রের ধ্যান-ধারণায় প্রতিজ্ঞাবদ্ধ মহিউদ্দীন আহমেদ অতি সাধারণ মনের কোনো রাজনৈতিক কর্মী ছিলেন না, তিনি কখনো সস্তা-জনপ্রিয়তা প্রত্যাশী সংগঠক ছিলেন না। সারা জীবন তিনি গুরুতর চিন্তাভাবনার মাধ্যমে, গভীর জীবনবোধে উদ্বুদ্ধ হয়ে প্রতিটি অনাচারের বিরুদ্ধে রাজনৈতিক, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক, রাষ্ট্রিক আন্দোলনে অংশগ্রহণ করেছেন এবং প্রতিটি ক্ষেত্রে চূড়ান্ত সাফল্য অর্জন অবধি জেল-জুলুম, মামলা-হামলা সবকিছু সহ্য করে গেছেন। পুরো প্রক্রিয়াটা চলেছে আপসহীন পন্থায়। বিশ্বমানবতার মুক্তিসংগ্রামের ইতিহাস ও বিশ্লেষণসমূহ তিনি অধ্যয়ন করেছেন ব্যাপকভাবে মেধাবী শিক্ষার্থীর কায়দায়। তিরিশের দশক থেকে ১৯৯০ দশক অবধি পুরো ছয় দশক মহিউদ্দীন আহমেদের গণআন্দোলনের যে ভূমিকা তা একেবারেই পৃথক দুরূহ একটি কাজ। তাকে সবসময়ই বিরামহীন থাকতে হয়েছে। আর এ থাকাটাই ছিল তার চরিত্রের প্রকৃত ভিত্তি।

রাজনীতিক মহিউদ্দীন আহমেদের নিজ জীবনদর্শন ছিল অত্যন্ত উঁচু স্তরের। তার বাবা আজহার উদ্দীন আহমেদ ছিলেন ১৯২০ ও ১৯২৩ সালের বঙ্গীয় আইনসভার সদস্য। এখনকার ছয়টি উপজেলার সমান এলাকা ছিল একেকটি সংসদীয় এলাকা। আজহার উদ্দীন সাহেবের বড় ছেলে শিবপুর ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজে লেখাপড়া করে গ্র্যাজুয়েট ইঞ্জিনিয়ার হয়েছিলেন। পরবর্তীতে তিনি সরকারের প্রধান প্রকৌশলী হয়েছিলেন। আজহার উদ্দীন সাহেবের দ্বিতীয় পুত্র প্রখ্যাত শিক্ষাবিদ প্রফেসর এম ইউ আহমেদ যিনি বিভিন্ন সরকারি কলেজে অধ্যাপনা শেষে শেষাবধি ঢাকা কলেজের প্রিন্সিপাল হিসেবে অবসরে যান। প্রফেসর এম ইউ আহমেদ ভারত উপমহাদেশের একজন মনোরোগ চিকিৎসক ও একজন উল্লেখযোগ্য ব্যক্তিত্ব। পারিবারিক কারণে মহিউদ্দীন আহমেদ যে বিশাল পরিবেশ পেয়েছিলেন সেটা রাজনৈতিক ও মানবসেবার ব্রতে নতুন মাত্রা যোগ করেছিল। যে কারণে মানবতা এবং দেশপ্রেমে মহিউদ্দীন আহমেদের অবস্থান ছিল অটল।

জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এবং মহিউদ্দীন আহমেদ প্রায় সমবয়সী। রাজনীতিতে দুজনই সমসাময়িক। আদর্শগতভাবেও তারা উভয়ই কাছাকাছি অবস্থানে ছিলেন। কৈশোরে ও তারুণ্যে একই মুসলিম ছাত্রলীগ করেছেন। কলেজজীবন উত্তীর্ণ হওয়ার পর দুজনই ‘ব্রিটিশ খেদাও’ আন্দোলন থেকে পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার সংগ্রাম অবধি এমনকি তারপরেও ১৯৪৯ সালের ২৩ জুন অবধি তারা উভয়েই মুসলিম লীগ করেছেন। তারপরে কিছুকাল তারা পৃথক অবস্থানে ছিলেন কিন্তু আদর্শগতভাবে উভয়েই পাকিস্তান মুসলিম লীগের ‘কুচক্রী’ অংশের বিরোধী ছিলেন। ১৯৫২ সালের কারাবন্দি দশায় তরুণ নেতা আওয়ামী মুসলিম লীগ যুগ্ম সম্পাদক শেখ মুজিবুর রহমান এবং মুসলিম লীগ পরিত্যাগকারী তরুণ নেতা মহিউদ্দীন আহমেদ অন্যতম রাষ্ট্রভাষা বাংলা ভাষা প্রতিষ্ঠার দাবিতে এবং মুসলিম লীগ সরকারের অনাচারের বিরুদ্ধে ও অবিলম্বে নিঃশর্ত মুক্তির দাবিতে কারাগারে অনশন শুরু করেন। তখন তাদের দুজনকেই ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগার থেকে ফরিদপুর কারাগারে স্থানান্তরিত করা হয়। স্বৈরতন্ত্রী মুসলিম লীগ সরকারের ক্ষমতার ভিত নড়বড়ে করে দিল শেখ মুজিবুর রহমান ও মহিউদ্দীন আহমেদের যৌথ অনশন ধর্মঘট। একদিকে কারাগারের বাইরে ভাষা আন্দোলনের তুমুল উত্তাপ সমগ্র পাকিস্তান কাঁপানো রাজপথ, তার পাশাপাশি কারাগারে শেখ মুজিব ও মহিউদ্দীন আহমেদ আমরণ অনশন ধর্মঘট দুই- আন্দোলন মিলেমিশে ষড়যন্ত্রনির্ভর সরকারের দাঁত ভাঙার জবাব দিল।

১৯৩০ দশকের শুরুতেই স্কুল শিক্ষার জীবনকাল আরম্ভ; সেই থেকে তার ব্রিটিশ রাজত্বের উপনিবেশবাদী দখলদারদের বিরুদ্ধে উচ্ছেদ সংগ্রামের লড়াকু-জীবনের শুরু, তারপরে প্রায় টানা ছয় দশক ধরে চলছে তার অক্লান্ত শ্রান্তিহীন সংগ্রামমুখর জীবন। ব্রিটিশ উপনিবেশবাদী শাসন-শোষণ থেকে মুক্তির লক্ষ্যে যে স্বাধীনতার সংগ্রাম, মহিউদ্দীন আহমদের কৈশোর আর তরুণের সেই রাজপথ কাঁপানো লড়াই ছিল একটা অনন্য সাধারণ ঘটনা। বরিশালের দক্ষিণাঞ্চলের গ্রামীণ পরিবেশে বেড়ে ওঠা সাদামাটা মানবিক জীবনের কিশোর তার তারুণ্যের পানে বেড়ে চলা জীবনের পথে সে পেয়ে গেল বাংলার তথা ভারতবর্ষের নিপীড়িত মানুষের ‘ব্রিটিশ উপনিবেশবাদী শাসক খেদাও’ আন্দোলনের মহামিছিল। তিনি সেই মিছিলের অগ্রভাগের সংগঠক হলেন, নিজের প্রাণ বিসর্জন সংগ্রামের একটি অপরিহার্য পথ খুঁজে নিলেন। অবিভক্ত বাংলার নদীয়া এলাকায়, কলকাতা মহানগরীতে, সেই সঙ্গে বরিশাল জেলা শহর এলাকায় এবং একই সঙ্গে বরিশালের দক্ষিণাঞ্চলের পিরোজপুর, মঠবাড়িয়া, ভান্ডারিয়া, পাথরঘাটা, বামনা, বরগুনা, পটুয়াখালী এ অঞ্চলে তিনি ‘ব্রিটিশ খেদাও’ সংগ্রামে বড় সংগঠক হলেন। ‘ব্রিটিশ খেদাও’ আন্দোলনে তরুণ মহিউদ্দীনের মিছিলে-সভা সমাবেশে দৃপ্ত পদচারণ ছিল জীবনের উল্লেখযোগ্য অধ্যায়। সে সময় তার নেতা ছিলেন শেরবাংলা আবুল কাশেম ফজলুল হক, হাশেম আলী খান এবং আরও উল্লেখযোগ্য ব্যক্তিত্ব। স্কুল ও কলেজজীবনে নদীয়া ও বরিশালে, কলকাতায়, রাজনৈতিক কর্মকান্ডে সমগ্র ভারত উপমহাদেশে চষে বেড়িয়েছেন মহিউদ্দীন আহমেদ। ১৯৪০ সালে মাত্র ১৮ বছর বয়সেই তিনি বড় সংগঠক হয়ে উঠেছিলেন। পীড়িত ভারতীয় জনতার মুক্তি সংগ্রামের অগ্রসেনা গোষ্ঠীর এ গণনায়ক।

মহাত্মা গান্ধী ভারতের জাতির পিতার অবস্থানে গেলেও মূল সংগ্রামের প্রকৃত নেতা হয়ে ওঠেন নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসু। তার অতুলনীয় দেশপ্রেম, অপরিমেয় সাহস, বিশ্বমানের জননেতার সব গুণাবলি ধারণ করে এক অসামান্য ব্যক্তিত্বে পরিণত হয়েছিলেন। মহিউদ্দীন আহমেদ সেই তিরিশ- চল্লিশের দশকে নেতাজি সুভাষ বসুর একনিষ্ঠ অনুসারী। বিপ্লবী সুভাষ বসুর কথায়- আদর্শে তিনি তখন প্রাণ উৎসর্গ করতে প্রস্তুত।

সেই স্বাধীনতার যুদ্ধ চলতে চলতে যখন ভারতবর্ষের জনগণ চরমভাবে নির্যাতিত তখন ব্রিটিশরা উপমহাদেশ ছেড়ে যাওয়ার সময় দেশকে ভাগ করে সাম্প্রদায়িকতার বিষবাষ্পে ধ্বংস করে দিয়ে গেল। সেই সময় ‘পাকিস্তান’ নামক নয়া-উপনিবেশবাদী নয়া-শোষক রাষ্ট্রের জাঁতাকলে পড়ল বাঙালি জাতি। এবার পাকিস্তানি উপনিবেশবাদী দুর্গের বন্দিদশা থেকে মুক্তির লড়াই এবং সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধ সংগঠিত করার সাংগঠনিক প্রক্রিয়ায় বিশাল যুদ্ধ-যুদ্ধের শেষে বাংলাদেশের স্বাধীনতা লাভের পরে নতুন জাতির সামগ্রিক পুনর্গঠনে নেতৃত্ব দেওয়ার এক অবিরাম লড়াই, দেশি-বিদেশি গণশত্রুদের নির্মূলের সংগ্রাম, নিজস্ব শক্তিতে জাতির আত্ম প্রতিষ্ঠার সংগ্রামকে প্রচ- শক্তিময়তার ভিতের ওপর দাঁড় করানোর কাজে মহিউদ্দীন আহমেদ অবিচলিতভাবে এগিয়ে এলেন।

মহিউদ্দীন আহমেদ তার রাজনৈতিক ও সামাজিক আন্দোলনের বিশাল সময়কার যে পটভূমি প্রত্যক্ষভাবে পূর্ণ করতে পেরেছেন-তার নেপথ্যে তারই পিতার অবদান খুবই গুরুত্বপূর্ণ। মহিউদ্দীন আহমেদকে তার পিতা পান্না নামেও ডাকতেন। মহিউদ্দীন আহমেদ ১৯২২ সালে বৃহত্তর বরিশাল জেলার পিরোজপুরে জন্মগ্রহণ করেছিলেন। তিনি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের সমকালীন এবং ঘনিষ্ঠতম রাজনীতিবিদ। বাঙালির শাসন-শোষণের বিরুদ্ধে অটল এক সংগ্রামী ব্যক্তিত্ব। স্বৈরাচারের বাহিনী তার ওপরে অসংখ্যবার হামলা চালিয়েছে, তার শরীর রক্তাক্ত হয়েছে। বারবার কারাবন্দি হয়েছেন, প্রাণ হারানোর ঝুঁকি নিয়ে কারাগারে অনশন করেছেন; কিন্তু কাপুরুষের মতো নত হননি। গণমানুষের মুক্তির সংগ্রামে তার দৃঢ় মনোবল এক অফুরন্ত অঙ্গীকারে উদ্দীপ্ত ছিল। মহিউদ্দীন আহমেদের পর্যবেক্ষণ শক্তি ছিল তীব্র। জিন্নাহকে দেখে তিনি বর্ণনা দিয়েছিলেন- জিন্নাহর চোখ দুটি ছিল তীক্ষœধার, ভয়ংকর ও নিষ্ঠুর প্রকৃতির। এবং আইয়ুব খানের দোসর মোনেম খানের বর্ণনা দিয়েছেন- ‘মোনেম খানের চোখ ছিল ভাবলেশহীন, কেউ সে চোখের ভাষা সহজে পড়তে পারত না।

মহিউদ্দীন আহমেদ ১৯৩৬ সালে মাত্র ১১ বছর বয়সে রাজনীতিতে হাতেখড়ি নেন। ১৯৪০ সালে মুসলিম লীগ সম্মেলনে যোগ দিয়েছেন। ১৯৪২ থেকে ১৯৪৭ সাল পর্যন্ত রাজনীতিতে ঘটেছিল তার ঝটিকা উত্তরণ। ১৯৪৩ সালে তিনি সর্বভারতীয় ছাত্রনেতার দুর্লভ মর্যাদা পেয়েছিলেন। ১৯৪৪ সালে তিনি ছিলেন বরিশাল ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক এবং ১৯৪৬ সালে হয়েছিলেন বরিশাল জেলা মুসলিম লীগের সাধারণ সম্পাদক। ১৯৫২ সালে ভাষা আন্দোলন যখন তুঙ্গে তখন তিনি ও বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ছিলেন ফরিদপুর জেলে আটক। দুজনই তখন কারাগারে অনশনরত ছিলেন। ১৯৫৪ সালের সাধারণ নির্বাচনে যুক্তফ্রন্টের প্রার্থী হিসেবে প্রচুর ভোটে নির্বাচিত হন। ১৯৬২ সালের ছাত্র আন্দোলন থেকে শুরু করে ১৯৬৬ সালের ছয় দফা আন্দোলন এবং ৬৯-এর গণআন্দোলনে মহিউদ্দীন আহমেদ ছিলেন প্রথম সারির নেতা। ১৯৭১ সালের যে যৌথ নেতৃত্ব স¦াধীনতা যুদ্ধ পরিচালনা করে, তিনি ছিলেন তারই একজন, ১৯৭৩ সালে আওয়ামী লীগের সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। এবং আওয়ামী লীগের সিনিয়র ভাইস প্রেসিডেন্টের দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৭৩ সালে বাকশালের পলিটব্যুরোর সদস্য হিসেবে মনোনীত হন। বঙ্গবন্ধুর নির্মম হত্যাকান্ডের পর ১৯৭৯ সালের ভারপ্রাপ্ত সভাপতি হিসেবে আবার আওয়ামী লীগ পুনর্গঠিত করেন। ১৯৭৯ সালে বিরোধী দলের উপনেতার দায়িত্ব পান এবং একই সঙ্গে জেনারেল জিয়াবিরোধী আন্দোলনে প্রচ- শক্তি সঞ্চার করেন। অনুরূপ জেনারেল এরশাদের নির্বাচন বর্জন করে তার পতনকে ত্বরান্বিত করেন। মহিউদ্দীন আহমেদের জীবন আমাদের জাতীয় ইতিহাসের গুরুত্বপূর্ণ একটি বিশদ বিবরণ। মহিউদ্দীন আহমেদের সহধর্মিণী রেবেকা মহিউদ্দীন প্রসঙ্গক্রমে বলেছিলেন, সারাজীবন তিনি মেহনতি মানুষের স্বার্থে রাজনীতি করেছেন। নিজের কিংবা পরিবার নিয়ে ভাবার সময়ই ছিল না। প্রকৃতপক্ষে বিদ্রোহী বাঙালি জাতির সহস্র বছরের সংগ্রামে মহিউদ্দীন আহমেদ বাঙালি জাতির অস্তিত্বের সঙ্গে প্রবহমান থাকবেন। আমাদের চেতনায় তিনি চিরকাল দীপ্তি ছড়াবেন।

                লেখক : সম্পাদক ওয়াসিংটন নিউজ 24.com

সর্বশেষ খবর