সোমবার, ২২ মে, ২০২৩ ০০:০০ টা

আল্লাহর দিকে বান্দা হাঁটলে আল্লাহ দৌড়ে আসেন

মাওলানা সেলিম হোসাইন আজাদী

আল্লাহর দিকে বান্দা হাঁটলে আল্লাহ দৌড়ে আসেন

রোজার আগের ঘটনা। সেদিন খুব গরম পড়েছিল। রমজানের শেষ দশকে বাইতুল্লাহ ইতিকাফের নিয়ত করেছি। হাতে সময় কম। জরুরি কাজগুলো গুছিয়ে আনছি। সেদিন একটু বেশিই ব্যস্ত ছিলাম। দম ফেলারও সময় ছিল না। জোহরের নামাজের প্রস্তুতি নিচ্ছি। এমন সময় হন্তদন্ত হয়ে এক যুবক প্রবেশ করল আমার রুমে। নাম-পরিচয় কিছু না বলেই আমার হাত ধরে ফেলল। অস্থির গলায় বলল, ‘হুজুর! আমাকে বাঁচান। আমি শেষ হয়ে যাচ্ছি। আমাকে বাঁচান।’ বলেই যুবক কেঁদে ফেলল। প্রথমে কিছুটা বিরক্ত হয়েছিলাম। কিন্তু যুবকের চোখের পানি দেখে মন নরম হয়ে গেল। জিজ্ঞেস করলাম, ‘ভাই তোমার নাম কী?’ কিছুটা দ্বিধার সঙ্গে বলল, ‘সবুজ (প্রকৃত নাম নয়)।’ ফাইলপত্র বন্ধ করে বললাম, ‘চলো একসঙ্গে নামাজ পড়ে নিই। তারপর খেতে খেতে কথা বলা যাবে।’ মেহমানের জন্য খাবার অর্ডার করে আমরা একসঙ্গে নামাজে দাঁড়ালাম। খাওয়ার সময় অপেক্ষা করছিলাম সবুজ নিজ থেকেই কথা শুরু করবে। কিন্তু সে পরম শান্তির সঙ্গে খেয়ে চলেছে। দেখে বোঝার উপায় নেই একটু আগে এই যুবকই আমার হাত ধরে কান্না করছিল। আমিও কিছু জিজ্ঞেস করলাম না। খাওয়া শেষে সবুজ বলল, ‘হুজুর! আজ তাহলে আসি। যা বলার জন্য এসেছিলাম তার সমাধান আমি পেয়ে গেছি। আজ আপনি অনেক ব্যস্ত। তাই আর বিরক্ত করব না।’ যুবকের অদ্ভুত আচরণে অবাক হলেও ব্যস্ততার চাপে অল্প সময়েই বিষয়টি মাথা থেকে উড়ে যায়। ওমরায় যাওয়ার আগের দিন যুবকের সঙ্গে আবার দেখা। তবে এখন আর তার চোখে-মুখে হতাশা বা বিষণ্ণতার কোনো ছাপ নেই। হালকা দাড়িও দেখা যাচ্ছে মুখে। শত ব্যস্ততা ভুলে মুচকি হাসি দিয়ে বললাম, ‘আজ বুঝি জীবনের গল্প শোনাতে এসেছো? কিন্তু আজ তো সময় দিতে পারব না বাবা।’ যুবক অবাক হয়ে বলল, ‘আমি জীবনের গল্প শোনাতে এসেছি আপনি কীভাবে বুঝলেন?

‘অনুমান করলাম।’

‘তাহলে আমাকে ১০ মিনিট সময় দিন, প্লিজ!’

‘ঠিক আছে। কাঁটায় কাঁটায় ১০ মিনিট।’

যুবক বলতে শুরু করেছে- ‘আমার অর্থবিত্তের কোনো অভাব নেই। নেই সঙ্গী-সাথীরও। ১০ বছর প্রেম শেষে মনের মানুষকেই বিয়ে করেছি। আমাদের কোলজুড়ে ফুটফুটে সন্তানও দিয়েছেন আল্লাহতায়ালা। কিন্তু অল্প বয়সে হোক আর যে কারণেই হোক অর্থ আমার জীবনে অনর্থের কারণ হয়ে দেখা দিয়েছে। এমন কোনো দিন নেই যে আমার মদ ছাড়া চলে। সন্ধ্যা নামলেই মাথা ঝিমঝিম করতে থাকে। সবকিছু ফেলে বারে ছুটি। এমনও রাত যায় এক বোতল পুরোটাই খেয়ে ফেলি। কিন্তু অন্তরে কোনো শান্তি পাই না। একদিন হঠাৎ আপনার একটি লেখা চোখে পড়ে- ‘মন নদীতে ঢেউ উঠেছে প্রভুর জিকির কর।’ লেখাটি পড়ে কী যে ভালো লেগেছে বলে বোঝাতে পারব না! এরপর থেকেই আপনার সঙ্গে দেখা করব করব করছি। কিন্তু করা হয়ে ওঠেনি। বারবার মনে তাগাদা আসছিল, আমাকে এ পাপের জগৎ ছাড়তেই হবে। অবশেষে সেদিন আপনার সঙ্গে দেখা করতে আসি। আপনি আমাকে নিয়ে জোহরের নামাজ পড়লেন। নামাজ শেষ হওয়ার পর মনে হলো জ্বলন্ত হৃদয়ে কে যেন শীতল বরফ ঢেলে দিয়েছে। এতটাই বিমোহিত ছিলাম যে, মুখ ফুটে কিছু বলতে পারিনি। সে থেকে শুরু হলো দীনের পথে চলা। আমার জন্য দোয়া করবেন আর যেন শয়তানের ধোঁকায় না পড়ি।’ সবুজের কথাগুলো শুনতে শুনতে নিজের অজান্তেই চোখ ভিজে গেল। আসলে আল্লাহ কখন কাকে কীভাবে হেদায়াত দেন বোঝা মুশকিল। মনে পড়ে গেল আল্লাহর সে আশার বাণী- ‘বান্দা! তুমি আমার দিকে এক বিঘত এগোলে আমি তোমার দিকে এক হাত এগোই। তুমি আমার দিকে হেঁটে এলে আমি তোমার দিকে দৌড়ে আসি। তুমি দৌড়ে এলে আমি তোমাকে বুকে জড়িয়ে নিই।’ সুবহানাল্লাহ।

প্রিয় পাঠক! বহু লেখায় বারবার বলেছি, সব থেকেও কেন মানুষের হৃদয়ে শান্তি থাকে না। কেন বেশির ভাগ ধনাঢ্য ব্যক্তি মদ-নারী আসক্তির পরও শান্তির ঘুম ঘুমাতে পারে না। এর কারণ হলো এরা টাকা-পয়সাকেই নিজের প্রভু বা রব বানিয়ে ফেলেছে। তারা মনে করে, টাকা হয়েছে মানেই দুনিয়ার সব শান্তির চাবিকাঠি তারা পেয়ে গেছে। কিন্তু এ চিন্তা পুরোপুরি ভুল। শান্তির চাবিকাঠি কেবল আল্লাহর জিকিরে। সুরা জুমারের ২২ নম্বর আয়াতে আল্লাহ বলেছেন, ‘যন্ত্রণাদায়ক জীবন তাদের জন্য যাদের হৃদয়ে আল্লাহর জিকির জারি নেই।’ সুরা জুখরুফের ৩৬ নম্বর আয়াতে আল্লাহ বলেন, ‘যার হৃদয়ে আল্লাহর জিকির নেই তার জন্য একটি শয়তানকে বন্ধু বানিয়ে দেওয়া হয়। সে শয়তান তাকে দুনিয়া ও আখেরাতে সঙ্গ দেয়।’ আল্লাহতায়ালা আমাদের সঠিক বুঝ দিন। আমিন।

♦ লেখক : চেয়ারম্যান, বাংলাদেশ মুফাসসির সোসাইটি পীরসাহেব, আউলিয়ানগর

সর্বশেষ খবর