এ বছর রাষ্ট্রীয় উদ্যোগে উদযাপিত হচ্ছে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের বিশ্বখ্যাত জুলিও কুরি শান্তিপদক প্রাপ্তির ৫০ বছর। ২৩ মে, ২০২৩ সেই কাক্সিক্ষত দিন। নানা বিবেচনায় এ লগ্নটি বাঙালি জাতির জন্য এক বড় ঘটনা। বিশেষ করে ইউক্রেন যুদ্ধ আর মধ্যপ্রাচ্যের রক্তক্ষরণ যে সময়ে পুরো বিশ্বকে ক্ষতবিক্ষত করছে, বিশ্ব অর্থনীতির চাকা থমকে দিচ্ছে। তখন শান্তির সংগ্রামে অনন্য অবদানের জন্য বঙ্গবন্ধুকে এ পদক প্রদানের ইতিহাস অনেক বেশি প্রাসঙ্গিক এবং বিস্তারিত আলোচনার দাবি রাখে।
একটি রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের মধ্য দিয়ে লাখো শহীদের আত্মদান এবং অসংখ্য মা-বোনের সম্ভ্রমের বিনিময়ে বাংলাদেশ নামক একটি স্বাধীন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠায় মূল নেতৃত্বদানের জন্য, যুদ্ধ-পরবর্তী শান্তি প্রতিষ্ঠার অসামান্য প্রচেষ্টা এবং বিশ্বের বিভিন্ন দেশের সাম্রাজ্যবাদবিরোধী সংগ্রামে সংহতি জ্ঞাপনের জন্য ১৯৭৩ সালের ২৩ মে বিশ্ব শান্তি পরিষদ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে বিশ্বখ্যাত জুলিও কুরি শান্তিপদকে ভূষিত করে। বঙ্গবন্ধুর এ পদক প্রাপ্তি ছিল তাঁর সুবিশাল সংগ্রামের প্রথম আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি। তৎকালীন বিশ্বরাজনীতি এবং আন্তর্জাতিক মর্যাদার বিবেচনায় এ পদক প্রাপ্তির বিষয়টি শুধু ব্যক্তি বঙ্গবন্ধুই নয়, গোটা বাঙালি জাতির জন্য ছিল এক বিশাল গৌরবের।
১৯৭২ সালের ১০ অক্টোবর বিশ্ব শান্তি পরিষদের প্রেসিডেনশিয়াল কমিটির সভায় বিশ্ব শান্তির সপক্ষে বঙ্গবন্ধুর অবদানের স্বীকৃতিস্বরূপ জুলিও কুরি শান্তিপদক প্রদানের জন্য শান্তি পরিষদের সাধারণ সম্পাদক রমেশচন্দ্র প্রস্তাব উপস্থাপন করেন। বিশ্বের ১৪০ দেশের শান্তি পরিষদের ২০০ প্রতিনিধির উপস্থিতিতে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধুকে ‘জুলিও কুরি’ শান্তিপদক প্রদানের সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়। সভায় উপস্থিত সবাই একমত হয়েছিলেন সারা জীবনের রাজনীতি আর বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সর্বাধিনায়কত্বের বিবেচনায় বঙ্গবন্ধুকে জুলিও কুরি শান্তিপদক প্রদান করার। সে বিবেচনায় বিশ্বশান্তি পরিষদ ১৯৭২ সালের ১০ অক্টোবর পদক প্রাপক হিসেবে বঙ্গবন্ধুর নাম ঘোষণা করে।
জুলিও কুরি হচ্ছে বিশ্ব শান্তি পরিষদের একটি সম্মানজনক পদক। ফরাসি পদার্থবিজ্ঞানী জঁ ফ্রেডরিক জুলিও কুরি ১৯৫৮ সালে মৃত্যুবরণ করেন। তাঁর স্ত্রীর নাম ইরেন কুরি। তাঁরা দুজনেই নোবেল বিজয়ী বিজ্ঞানী। ইরেনের মা-বাবাও নোবেল বিজয়ী বিজ্ঞানী দম্পতি পিয়েরে কুরি ও মাদাম কুরি। পরে বিশ্ব শান্তি পরিষদ তাদের শান্তিপদকের নাম ১৯৫৯ সালে রাখে ‘জুলিও কুরি’।
বিশ্বের শান্তির জন্য সর্বোচ্চ পদক হলো ‘জুলিও কুরি’। বিশ্বের বরেণ্য ব্যক্তিরাই এ পুরস্কার পেয়েছেন। বঙ্গবন্ধু ছাড়াও এ বিরল সম্মান অর্জন করেছেন ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামের নেতা প্রথম প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহরু, কিউবার ফিদেল কাস্ত্রো, চিলির সালভেদর আলেন্দে, ফিলিস্তিনের ইয়াসির আরাফাত, ভিয়েতনামের হো চি মিন, দক্ষিণ আফ্রিকার নেলসন ম্যান্ডেলা, ভারতের সাবেক প্রধানমন্ত্রী শ্রীমতী ইন্দিরা গান্ধী, কবি ও রাজনীতিবিদ পাবলো নেরুদা, মার্টিন লুথার কিং। ১৯৭৩ সালের ২৩ মে ঢাকায় বাংলাদেশ জাতীয় সংসদের দক্ষিণ প্লাজায় এশীয় শান্তি সম্মেলনের এক আড়ম্বরপূর্ণ অনুষ্ঠানে সেই পদক বঙ্গবন্ধুকে পরিয়ে দেন পরিষদের তৎকালীন সাধারণ সম্পাদক মি. রমেশচন্দ্র। সে অনুষ্ঠানে বিশ্ব শান্তি পরিষদের সাধারণ সম্পাদক রমেশচন্দ্র বলেছিলেন, ‘বঙ্গবন্ধু শুধু বাংলার নন, তিনি বিশ্বের এবং তিনি বিশ্ববন্ধু’। এ অনুষ্ঠানেরই একটি সংক্ষিপ্ত ভিডিও ক্লিপ এখন সরকারি-বেসরকারি বিভিন্ন অনুষ্ঠানে প্রদর্শন করা হয়। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের এ বিরল সম্মাননা অনুষ্ঠান আয়োজনের অগ্রণী সংগঠন বাংলাদেশ শান্তি পরিষদ। সে সময় এ সংগঠনের সাধারণ সম্পাদক ছিলেন বিশিষ্ট সাংবাদিক ও কমিউনিস্ট নেতা কমরেড আলী আকসাদ। মূলত বিশ্ব শান্তি পরিষদের সদস্য সংগঠন হিসেবেই বাংলাদেশ শান্তি পরিষদ ১৯৭৩ সালের ২৩ মে ঢাকায় এশীয় শান্তি সম্মেলনের আয়োজন করে। স্বাধীন বাংলাদেশে অনুষ্ঠিত এই এশীয় শান্তি সম্মেলনে অনেক গণ্যমান্য রাজনৈতিক নেতা, দেশবিদেশের সম্মানিত অতিথি, কূটনীতিক ও সর্বস্তরের মানুষ অংশগ্রহণ করেন। ঐতিহাসিক এ শান্তি সম্মেলন ছিল এশিয়ার তৎকালীন রাজনীতির জন্য বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা। কারণ সময়টা ছিল পুঁজিবাদী মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও সমাজতান্ত্রিক সোভিয়েত ইউনিয়নের ঠান্ডাযুদ্ধের কালপর্বের। যখন এ দুই পরাশক্তি এক ভয়ানক সংঘাতের মুখোমুখি। যখন এশিয়া, আফ্রিকা এবং লাতিন আমেরিকায় দেশে দেশে জাতীয় মুক্তিসংগ্রাম চলমান। সেসব মুক্তি আন্দোলনের নেতারা দুই পরাশক্তির অস্ত্র প্রতিযোগিতা বন্ধ এবং নিরস্ত্রীকরণের দাবি জোরের সঙ্গে তুলে ধরছেন। যখন ইন্দোনেশিয়ার বান্দুং সম্মেলন থেকে জন্ম নেওয়া চেতনার আলোকে ১৯৬১ সালে বেলগ্রেড শহরে জন্ম নেওয়া জোটনিরপেক্ষ আন্দোলনের ধারণা সারা বিশ্বে তুমুল জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে। এই জোটনিরপেক্ষ আন্দোলনের শীর্ষে যাঁরা ছিলেন তাঁদের মধ্যে ছিলেন তৎকালীন যুগোস্লাভিয়ার নেতা মার্শাল টিটো, ইন্দোনেশিয়ার সুকর্ন, মিসরের গামাল আবদেল নাসের, ভারতের জওহরলাল নেহরু, জাম্বিয়ার কেনেথ কাউন্ডা, ঘানার নক্রুমা, কিউবার ফিদেল কাস্ত্রো, আলজেরিয়ার হুয়েরি বুমেদিনে প্রমুখ। শান্তির জন্য গড়ে ওঠা এই জোটনিরপেক্ষ আন্দোলনের সামনের সারিতে ছিলেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। ফলে শান্তি আন্দোলনে বঙ্গবন্ধুর অবদান ছিল আন্তর্জাতিক পর্যায়ে।
লেখক : বাংলাদেশ শান্তি পরিষদের সম্পাদকমন্ডলীর সদস্য এবং সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী