রবিবার, ২৬ মে, ২০২৪ ০০:০০ টা

ঝড়ের সমুদ্র কীভাবে পাড়ি দেন শেখ হাসিনা

নঈম নিজাম

ঝড়ের সমুদ্র কীভাবে পাড়ি দেন শেখ হাসিনা

কুমিল্লার নাঙ্গলকোটে ১৯৮৭ সালের আন্দোলনে সরকারি দলের গুলিতে নিহত হয়েছিলেন যুবলীগ কর্মী আবদুল হামিদ। খবর শুনে শেখ হাসিনা ছুটে গেলেন নাঙ্গলকোট। হামিদের বাড়ি পর্যন্ত গাড়ি যেত না। অজপাড়ার ছনের জীর্ণশীর্ণ ঘরে থাকতেন হামিদ। ২ কিলোমিটার কোনোমতে একজন মানুষ চলতে পারে এমন গ্রামীণ ভাঙা কাঁচা রাস্তায় হেঁটে শেখ হাসিনা অসহায় হামিদের বাড়ি পৌঁছলেন। দাঁড়ালেন হামিদের পরিবারের পাশে। আওয়ামী লীগের তখন এত জৌলুস ছিল না। রোদে পুড়ে কষ্ট করে নেত্রীর এভাবে পথচলায় উশখুশ করছিলেন নিরাপত্তা টিমের সদস্য, বঙ্গবন্ধু পরিবারের আত্মীয় নজীব আহমেদ। তিনি স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতা সাবেক এমপি জয়নাল আবেদীন ভূইয়ার ওপর কিছুটা ক্ষোভ প্রকাশ করছিলেন। কারণ জয়নাল ভাই বারবার বলছিলেন, একটু সামনে গেলে হামিদের বাড়ি। আসলে পথ ২ কিলোমিটার। পর দিন ঢাকা ফিরে জয়নাল ভাই আমাকে বললেন, তুই একটু নজীবকে বুঝিয়ে বলিস আমার ওপর রাগ না রাখতে। নজীব ভাইয়ের সঙ্গে কথা বলার সময় তিনি হাসলেন। বললেন, নেত্রীর কষ্ট হচ্ছিল, তাই একটু মন খারাপ করেছিলাম। অন্য কিছু না। জয়নাল ভাই ঠিক ছিলেন। নেত্রীও খুশি হয়েছেন।

১৯৭৯ সালে আওয়ামী লীগের দুঃসময়ের এমপি ছিলেন জয়নাল ভাই। ’৮১ সালে দলের দায়িত্ব পেয়ে জয়নাল আবেদীনকে কুমিল্লার নিষ্ঠাবান কর্মী হিসেবে পেয়েছিলেন শেখ হাসিনা। নাঙ্গলকোটের হাসানপুরের কাছের পোছুইর গ্রামে হামিদের বাড়িতে পায়ে হাঁটিয়ে নেত্রীকে নিয়ে যান জয়নাল ভাই। চলার পথে বারবার বলেছিলেন, সামান্য একটু হাঁটলেই...। তখনকার নেতারা এমনই ছিলেন। নেত্রী সব বুঝেই তাদের নিয়ে ক্লান্তিহীনভাবে পথ চলতেন সারা দেশে। নাঙ্গলকোট সফরকালে আওয়ামী লীগ সভানেত্রী পুরো সময়টাতে আবেগপ্রবণ ছিলেন। তিনি কোনোভাবেই তাঁর একজন কর্মীকে নিষ্ঠুরভাবে হত্যার বিষয়টি মানতে পারছিলেন না। তিনি ক্ষুব্ধ -ব্যথিত ছিলেন স্বৈরাচারী সরকারের দোসর খুনিদের ওপর। হামিদ পরিবারের আহাজারিতে শেখ হাসিনা চোখের অশ্রু ধরে রাখতে পারেননি। তিনি নিজে সেদিন কেঁদেছেন। নেতা-কর্মীদেরও কাঁদিয়েছিলেন।

১৯৮১ সালে দেশে ফেরার পর এভাবেই সারা দেশে ঘুরতেন শেখ হাসিনা। দাঁড়াতেন কর্মীদের পাশে। এরশাদ জমানা ও ’৯১ সালের নির্বাচনকালীন থেকে শেখ হাসিনাকে কাছ থেকে দেখার সৌভাগ্যবানদের আমিও একজন। একজন সংবাদকর্মী হিসেবে তাঁর সঙ্গে দেশবিদেশ ঘুরেছি। কাছ থেকে দেখেছি, অনেক শক্ত মনোবলের অধিকারী তিনি। বাংলাদেশ শব্দের প্রশ্নে কোনো আপস করেন না। দেশের স্বার্থে কোনো কাজে তাঁর কোনো ক্লান্তি নেই। মাইলের পর মাইল হাঁটতে পারেন তিনি। ষড়যন্ত্র, মিথ্যা সমালোচনা চোখের পলকে মোকাবিলা করেন। মৃত্যুভয়... তাঁকে থামাতে পারে না। এমপি জ্যাকবের বাবা অধ্যক্ষ নজরুল ইসলাম ’৯১ সালে ভোলার চরফ্যাশন থেকে এমপি হয়েছিলেন। হঠাৎ তাঁর মৃত্যুর পর আসনটি শূন্য হয়, জ্যাকবের তখনো ভোট করার বয়স হয়নি। তাই উপনির্বাচনে জাফরউল্লাহ চৌধুরী নামে একজন স্থানীয় নেতা মনোনয়ন পেয়েছিলেন। ঢাকা থেকে সাগর লঞ্চে আমরা ভোলা গেলাম আওয়ামী লীগ সভানেত্রী, সংসদে বিরোধীদলীয় নেতার সঙ্গে। ঢাকা থেকে সিনিয়র নেতাদের সঙ্গে ছাত্রনেতা অসীম কুমার উকিল, জাহাঙ্গীর সাত্তার টিংকু নেত্রীর সফরসঙ্গী ছিলেন। ভোলা পৌঁছলে জননেতা তোফায়েল আহমেদ আমাদের রিসিভ করেন। জ্যাকবের সঙ্গে তখন পরিচয় হয়। স্থানীয় কলেজে ছাত্রলীগের নেতা। চরফ্যাশন থেকে চর কুকরি-মুকরিতে নেত্রী যাচ্ছিলেন ভোটের প্রচারে। আকাশ ছিল মেঘাচ্ছন্ন। সবাই নেত্রীকে বললেন ঝড়ের সময় উত্তাল মেঘনায় ইঞ্জিনচালিত নৌকায় না চড়তে। তিনি কারও কথা শুনলেন না।

বঙ্গবন্ধুকন্যা এমন কথা শুনবেন কেন? তিনি জন্ম নিয়েছেন ঝড়বাদল জয় করে মানুষের জন্য কাজ করতে। তিনি নৌকায় চড়ে বসলেন। সঙ্গে আমরা গুটিশুটি মেরে বসলাম। নৌকার মাঝিদের সঙ্গে গিয়ে বসলেন প্রার্থী জাফরউল্লাহ। আমরা সবাই নেত্রীর চারপাশে। সবার ভীত চোখ দেখে তিনি হাসলেন। পদ্মা-মেঘনার উত্তাল ঢেউতে ডিঙি নৌকা কীভাবে সামলে চলে তিনি সেসব গল্প শোনালেন। ছোটবেলায় টুঙ্গিপাড়া থেকে ঢাকা আসা-যাওয়ার গল্পও বললেন। তিনি আমাদের দিকে তাকিয়ে বললেন, এত ভীত হলে সাংবাদিকতা কীভাবে করবে? তিনি টিংকু ও অসীম কুমার উকিলকে সাহস জোগালেন। তোফায়েল ভাইয়ের দিকে তাকিয়ে বললেন, নদীর দেশের মানুষ হয়ে আপনিও ভয় পাচ্ছেন নাকি? শেখ হাসিনার সাহস দেখে স্বস্তি ফিরল ঝড়ের কবলে পড়া আমাদের নৌকায়। সবাই গল্পগুজবে মেতে উঠলাম নেত্রীর সঙ্গে। কেউ একজন ঝড়বাদল নিয়ে গানও করলেন। আড্ডায় আলাপে শেখ হাসিনা কাউকে বুঝতেই দিলেন না কখন ঝড় থেমেছে। কঠিন বিপদ অতিক্রম হয়েছে।

যুক্তরাষ্ট্রপ্রবাসী ডা. তৌহিদ শিবলি পরোপকারী মানুষ। বিপদে-আপদে চিকিৎসায় মানুষের পাশে দাঁড়ান। কোনো চাওয়াপাওয়ার হিসাব করেন না। ব্যক্তিগত জীবনে তিনি আওয়ামী লীগ করেন না। পারলে কঠোর বিরোধিতা করেন। সমালোচনাও করেন বিভিন্ন নেতিবাচক কাজের। ব্যক্তিগত সম্পর্ককে আলাদা করে গুরুত্ব দেন। নিজেই বলেন, তিনি অধ্যাপক ডা. সৈয়দ মোদাচ্ছের আলীর মুরিদ। এ সম্পর্কটা ঢাকা মেডিকেল কলেজ থেকে গড়ে ওঠা। এখন যোগাযোগ কম থাকলেও মোদাচ্ছের আলীকে সম্মান করেন। দীর্ঘদিন থেকে প্রবাসে আছেন। নিউইয়র্ক শহরে তাঁর রোগীর লাইন দীর্ঘ। প্রবাসীদের রোগবালাই, বিপদাপদ মানেই তৌহিদ শিবলি। অনেক দিন আগে তৌহিদ শিবলির কাছে শেখ হাসিনার কঠিন ঝড় মোকাবিলার আরেকটি সাহসী ঘটনা শুনেছিলাম। সময়টা ’৯১ সালের ঘূর্ণিঝড়ের। দুর্গত মানুষের পাশে দাঁড়াতে সন্দ্বীপ গিয়েছিলেন তখনকার বিরোধী দলের নেতা শেখ হাসিনা। সঙ্গে ডা. মোস্তফা জালাল মহিউদ্দিনের নেতৃত্বে একদল চিকিৎসক। তৌহিদ শিবলিও ছিলেন। সবকিছুর আয়োজক ছিলেন সন্দ্বীপের তখনকার এমপি মোস্তাফিজুর রহমান। তাঁর ছেলে মাহফুজুর রহমান মিতা বারবার বাবার আসন থেকে এখন নির্বাচিত হন।

সন্দ্বীপ যেতে উত্তাল সমুদ্র পার হতে হতো নৌকায়। সাগরের বেহাল রূপ দেখে অনেক নেতা কেটে পড়লেন। শেখ হাসিনাকে চট্টগ্রাম আওয়ামী লীগ নেতা অনুরোধ করলেন বিরূপ আবহাওয়ায় সন্দ্বীপ যাওয়ার কর্মসূচি বাদ দিতে। তিনি সবাইকে বললেন, যাওয়া বন্ধ করা যাবে না। যেতে হবে দুর্গত মানুষের পাশে। তারা জানে আমি ত্রাণ নিয়ে আসছি। না গেলে সবাই মন খারাপ করবে। গেলে খাবার, ওষুধ, কাপড়, চিকিৎসা পাবে। অনেক নেতা পেছন থেকে কেটে পড়লেন। মোস্তাফিজুর রহমানসহ কয়েকজন নেতাকে নিয়ে আওয়ামী লীগ সভানেত্রী নৌকায় উঠলেন। চিকিৎসক, সাংবাদিকরা নেত্রীর নৌকায়। সীতাকুণ্ড থেকে সন্দ্বীপের পথে নৌকা চলছে। বেপরোয়া আবহাওয়ায় গভীর সমুদ্রে সবাই ভীত হলেন। অনেকে বমি করলেন। ডা. তৌহিদ শিবলির চোখে-মুখে অন্ধকার। শেখ হাসিনা ভয়াবহ পরিস্থিতিতে গল্প জুড়ে দিলেন। সবাইকে বললেন, ভয়ের কিছু নেই। প্রতিদিন সন্দ্বীপের মানুষ এভাবে সমুদ্র পাড়ি দেয়। তারপর একজন ক্যামেরাম্যানকে বললেন, তরুণ ডাক্তারের ভীত চেহারার ছবি তোলো। ভবিষ্যতে গুরুত্বপূর্ণ অপারেশন টেবিলে সব মনে পড়বে। নানামুখী গল্পে তিনি সবাইকে মাতিয়ে রাখলেন পুরোটা সময়। একজন রিপোর্টার হিসেবে তখন আমি আওয়ামী লীগ সভানেত্রীর বিট কভার করলেও সেই সফরে ছিলাম না। ছিলেন আমার আরেক বন্ধু পীর হাবিবুর রহমান। প্রয়াত এই সাংবাদিকের লেখনীতে সন্দ্বীপ সফরে মাঝসমুদ্রের কথাগুলো আছে। পীর হাবিব আজ নেই। ডা. তৌহিদ শিবলি, ডা. মোস্তফা জালাল মহিউদ্দিন, দীন মোহাম্মদ এখনো সেই স্মৃতি রোমন্থন করেন।

শেখ হাসিনা একটি সাহসী নাম। ইতিহাসে শতবর্ষ পরেও তাঁর সাহসের প্রশংসা আসবে। বঙ্গবন্ধু বাংলাদেশ দিয়েছেন। শেখ হাসিনা দৃঢ়চেতা মনোভাবে বাংলাদেশকে এগিয়ে নিয়েছেন নতুন উচ্চতায়। কোনো মানুষই ফেরেশতা নয়। তার পরও শত্রুরা স্বীকার করতে বাধ্য বাংলাদেশের উন্নতি-সমৃদ্ধি। কোথায় ছিলাম, কোথায় আছি ভুলে গেলে হবে না। গ্রামে গেলে একটু পর পরই পাকা বাড়ি দেখি। বিদ্যুৎ, ইন্টারনেট, ডিশ-টিভি আছে। মানুষ ঘরের ফ্রিজে ঠান্ডা পানি খায়। প্রবাসীদের অনেক বাড়িতে আছে এয়ারকন্ডিশন। খুব দ্রুততম সময়ে যাওয়া যায় এক জেলা থেকে আরেক জেলায়। যোগাযোগব্যবস্থায় চোখ ধাঁধানো পরিবর্তন হয়েছে। বিমানবন্দর থেকে ফ্লাইওভারে ১৫ মিনিটে প্রবেশ করা যায় ধানমন্ডিতে। মেট্রোরেল, কর্ণফুলী টানেল, পারমাণবিক বিদ্যুৎ এখন আর স্বপ্ন নয়। সমালোচনা করলে সারা দিনই করা যাবে। বাস্তবতা এড়ানো যাবে না। আওয়ামী লীগের একজন কঠোর সমালোচক সেদিন বললেন, শেখ হাসিনার এখন চ্যালেঞ্জ দুর্নীতি বন্ধ, আর্থিক খাত ও ব্যাংকের শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনা। তারপর আসবে ২০২৮ সালে নিরপেক্ষ ভোটাধিকার। বিশ্বাস করি দুর্নীতি অবশ্যই কমবে। বাংলাদেশ ফিরবে সঠিক পথধারায়।

কঠিন বাস্তবতায় ছাড় মেলেনি সাবেক আইজিপি বেনজীর আহমেদের। ব্যক্তির ভুলের দায় শেখ হাসিনার সরকার নেয় না। আদালতের শক্ত অবস্থানে সরকার নাক গলায়নি। বেনজীর ও আজিজ থেকে শিক্ষা নেবেন আমাদের ব্যুরোক্রেসি। সততা-নিষ্ঠার আলাদা একটা মূল্যায়ন আছে। পুলিশের বর্তমান আইজির বিরুদ্ধে কেউ কিছু বলতে পারে না। তাঁর ভাই উপজেলা চেয়ারম্যান ছিলেন। সর্বশেষ সংসদ নির্বাচনে মনোনয়ন নিয়েছিলেন আওয়ামী লীগের। বাংলাদেশের মতো দেশে পুলিশপ্রধান চাইলে তাঁর ভাইকে বিজয়ী করতে পারতেন। তিনি পুলিশকে কাজে লাগাননি ভাইয়ের বিজয়ে। নিরপেক্ষ ভোটে হেরেছেন পুলিশের আইজির ভাই। জিতেছেন প্রয়াত নেতা সুরঞ্জিতের স্ত্রী জয়া সেন। ভোটের আগে আইজিপির ভাই আমার অফিসে এসেছিলেন। গল্প করে গেলেন। তাঁর ভিতরে কোনো অহমিকা দেখিনি। সাদামাটা একজন তরুণ রাজনীতিবিদ। আজকাল এমন পাওয়া যায় না। সবাই ক্ষমতার গরম দেখান। ক্ষমতাকালে অনিয়মে জড়িয়ে পড়েন। কেউ বুঝতে চান না ক্ষমতা দুই দিনের। অতীতেও অনেকে ক্ষমতার গরম দেখিয়েছিলেন। তারা টিকে থাকতে পারেননি।

প্রয়াত সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত বলেছেন, বাঘে ধরলে ছাড় পাওয়া যায়, শেখ হাসিনা একবার ধরলে আর ছাড়েন না। ক্যাসিনোকাণ্ডের সময় তিনি শক্ত হাতে সরকারি দলের লোকজনের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নিয়েছিলেন। এমনকি ছাড় দেননি আত্মীয়স্বজনকেও। তাদের অনেকের অপরাধের কোনো প্রমাণ মেলেনি। তার পরও ছাড় দেওয়া হয়নি। কিছুদিন আগে ভোটের ফলাফলে বাড়াবাড়ি করার কারণে ডিবি পুলিশ অভিযান চালিয়েছিল যুবলীগ চেয়ারম্যান শেখ পরশের বাড়িতে। ডিবি তাঁর স্ত্রী যুথিকে না পেলেও যুবলীগের কয়েকজন নেতাকে সেই বাড়ি থেকে আটক করে। তাদের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া হয়। আদালত অঙ্গনে বাড়াবাড়ির দায়ে জেলে যেতে হয়েছিল তাদের। শেখ হাসিনা ছাড় দেন না। সময়মতো ধরেন। বিশ্বাস করি, ব্যাংকিং খাতের অনিয়মের কঠোর শাস্তি হবে। আর্থিক খাত ক্ষতিগ্রস্তকারীদের বিচার হবে।

সমস্যা আছে, থাকবে। আমাদের সমস্যার মোকাবিলা আমাদেরই করতে হবে। পথ চলে সবাই, পথ দেখায় কেউ কেউ। বাংলাদেশের অর্থনীতি, রাজনীতি সম্পর্কে সচেতন সবাই ১০ বছর আগের সঙ্গে এখনকার পরিস্থিতি কি মেলাতে পারবেন? বাংলাদেশ একটা মর্যাদার আসনে আছে। সফলভাবে টানা রাষ্ট্র চালানো সহজ বিষয় নয়। এ দেশে কেউ কারও ভালো চায় না। রাষ্ট্রনায়কের দিনরাতের পরিশ্রম কারও ভালো লাগে না। ইতিহাসের পাতা নিষ্ঠুর হয়। অতীত ভুলে গেলে হবে না। ২০০১ সালে চারদলীয় জোট ক্ষমতায় আসার পর কী পরিবেশ তৈরি হয়েছিল? মুহূর্তে আইনশৃঙ্খলা নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে গিয়েছিল। সেনাবাহিনী নামিয়ে সবকিছুর নিয়ন্ত্রণ আনতে হয়েছিল তখনকার প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়াকে। সেনাবাহিনীর অপারেশন ক্লিনহার্টে বিএনপির অনেক কর্মীর মৃত্যু হয়েছিল। তারা আটকও হয়েছিলেন। সেনাবাহিনী ভয়াবহ অরাজক পরিস্থিতি মোকাবিলা করেছিল। তারা বন্ধ করেছিল পূর্ণিমাদের কান্না। অনেকের হয়তো সেসব কথা মনে নেই। ২০০৭ সালে বিএনপি একটি সফল ভোট করতে ব্যর্থ হয়েছিল। তত্ত্বাবধায়ক সরকারের কথা বিএনপি ও ইয়াজউদ্দিন মেনে নিলে হয়তো আজকের পরিস্থিতিতে পড়তে হতো না। ওয়ান-ইলেভেনের ঘটনা বিএনপি সমর্থক সেনা কর্মকর্তারাই ঘটিয়েছিলেন। খলনায়কদের বড় অংশই ছিলেন তখনকার প্রধানমন্ত্রীর আত্মীয়স্বজন। রাষ্ট্রপতি ছিলেন তাদের মনোনীত অধ্যাপক ইয়াজউদ্দিন আহমেদ। ১১ জন সিনিয়র অফিসারকে ডিঙিয়ে জেনারেল মইনকে সেনাপ্রধান করা হয়। কারণ ছিল তিনি ছিলেন বেগম খালেদা জিয়ার ভাই সাঈদ ইস্কান্দারের বন্ধু। খালেদা জিয়াকে একসময় আপা ডাকতেন। নবম পদাতিক ডিভিশনে ছিলেন সাঈদ ইস্কান্দারের ভায়রা মেজর জেনারেল মাসুদ উদ্দিন চৌধুরী। তখনকার ডিজিএফআইতে খালেদা জিয়ার বোনের ছেলেসহ তাঁর সমর্থক কর্মকর্তারাই ছিলেন। বারী-আমীন কার লোক ছিলেন?

আন্তর্জাতিক কমিউনিটি এখনো বিএনপিকে ক্ষমা করেনি। এর মূল কারণ রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতায় ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলার মতো বীভৎস ঘটনা। বিএনপি ক্ষমা পায়নি চট্টগ্রামের ১০ ট্রাক অস্ত্র প্রবেশের জন্য। রাষ্ট্রের একটি গোয়েন্দা সংস্থার তত্ত্বাবধানে সব হয়েছিল। বিচারিক আদালতের রায়ে সেই খলনায়করা এখন কারাগারে। রাষ্ট্রের সার্বভৌমত্ব ও স্বাভাবিক স্থিতির জন্য তাদের বিচার অপরিহার্য ছিল। গরমকালে শীতের চাদর আগুনে ছুড়ে বিএনপি এখন ভারতবিরোধিতার নাটক খেলছে। সবকিছুর একটা সময় থাকে। কঠিন বাস্তবতা মানতে হবে। ২০১২ সালে দিল্লি বিমানবন্দরে তখনকার বিরোধী দলের নেতা বেগম খালেদা জিয়াকে রেড কার্পেট সংবর্ধনা দিয়েছিল ভারত। বিশেষ ফ্লাইটে করে আজমিরে নিয়ে গিয়েছিল। রাষ্ট্রপতি প্রণব মুখার্জি সব দলের সিনিয়র নেতাদের আমন্ত্রণ করে ডিনার দিয়েছিলেন খালেদা জিয়াকে। তারপর ভারতের রাষ্ট্রপতি বাংলাদেশ সফরকালে পূর্বনির্ধারিত সাক্ষাৎ বাতিল করে জামায়াতকে দিয়ে হরতাল দিয়েছিল বিএনপি। সন্ধ্যায় রাষ্ট্রপতি প্রণবের সঙ্গে সাক্ষাতের কর্মসূচি বাতিল করেন বেগম জিয়া। বিদেশি রাষ্ট্রপতির সঙ্গে এটা কোন ধরনের কূটনৈতিক শিষ্টাচার ছিল? ২০১৩ সালে সিঙ্গাপুরে চিকিৎসার জন্য যাওয়া বেগম খালেদা জিয়ার সঙ্গে ভারতের সিনিয়র বিশেষ কূটনীতিক সাক্ষাৎ করেন। কী কথা হয়েছিল? বিএনপিকে বুঝতে হবে ভারত কেন দূরে। আমেরিকা কেন তাদের ক্ষমতায় বসানোর চিন্তা করে না। কৌশলে দূরে রাখে।

শেখ হাসিনা রাষ্ট্রক্ষমতায় শৃঙ্খলা ফিরিয়ে এনেছেন। ক্ষমতাসীন দলে অনেক ধরনের মানুষ থাকে। সব সময় সবাই সহিমতো কাজ করে তেমন নয়। ভুলত্রুটি হতেই পারে। তার পরও শেখ হাসিনা বাবার পথ ধরে মানুষের কল্যাণ থেকে সরেননি। তিনি জনগণের অধিকারের প্রশ্নে জীবনমৃত্যুর পরোয়া করেন না। তাঁকে ২১ বার হত্যার চেষ্টা করা হয়েছিল বিরোধী দলে থাকার বিভিন্ন সময়। তিনি টিকে আছেন নিজের ভিতরের মনোবল, গভীর সততা, দৃঢ়চেতা মনোভাব ও সাহস নিয়ে। মুক্তিযুদ্ধের চেতনার মানুষের শেষ ঠিকানা তিনি। তাঁকে নিয়ে ষড়যন্ত্র অতীতেও ছিল, এখনো আছে। তার পরও তিনি নানামুখী চক্রান্ত পাশ কাটিয়ে পথ চলছেন একটি সুন্দর বাংলাদেশ বিশ্বের কাছে উপহার দিতে।

লেখক : সম্পাদক, বাংলাদেশ প্রতিদিন

সর্বশেষ খবর