২০২৪-এর জুলাইয়ে ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশে শুধু রাষ্ট্রক্ষমতা থেকে যে স্বৈরাচারেরই পতন হয়েছে তাই নয়, একই ধারাবাহিকতায় রাষ্ট্র ও সমাজের অন্যসব গুরুত্বপূর্ণ ক্ষেত্রেও অভিনব পরিবর্তনের সূচনা হয়েছে। অনেক বছর পরে মানুষ মন খুলে কথা বলতে পারছে। নিজেদের আশা-আকাক্সক্ষা নিয়ে স্বাধীনভাবে চিন্তা ও আলাপ করতে পারছে। নিজেদের এবং চারপাশের অন্যদের নিয়ে সুন্দর ও সুস্থ ভবিষ্যৎ গড়ার স্বপ্ন দেখতে পারছে। দেশে এবং বিদেশের যেখানেই বাংলাদেশিরা আছে, সবার মধ্যেই একটা খুশির আমেজ বিরাজ করছে। অনেকটা ঈদের আনন্দের মতো। সত্যি বলতে কী, স্বৈরাচারের পতনের ঠিক পরের সপ্তাহে কানাডার মন্ট্রিল আর আমেরিকার নিউইয়র্ক শহরে গিয়ে পরিচিত এবং অপরিচিত বাংলাদেশিদের সঙ্গে সাক্ষাৎ হয়েছে, তাদের অনেকেই আমাকে ঈদ মোবারক বলেছে। আর আমার নিজের বর্তমান আবাস কাতারেও একইভাবে আমরা ঈদ মোবারক বলে নিজেদের অন্যদের সঙ্গে আনন্দ প্রকাশ ও ভাগাভাগি করে নিচ্ছি।
গতকাল দেশের প্রধান বিশ্ববিদ্যালয় ও আমার আলমা-ম্যাটার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য এবং দুজন উপ-উপাচার্যের মনোনয়ন প্রকাশ হলো জাতীয় গণমাধ্যমে, যা আমাদের আনন্দকে আরও বাড়িয়ে দিয়েছে। উপাচার্য পদে অধ্যাপক নিয়াজ আহমেদ খান, উপ-উপাচার্য পদে অধ্যাপক সায়মা হক বিদিশা আর অধ্যাপক ইসমাইল হোসেন। তারা প্রত্যেকেই নিজ নিজ বিষয়ে বিদেশের সুখ্যাত বিশ্ববিদ্যালয় থেকে সর্বোচ্চ ডিগ্রি, উচ্চতর গবেষণা এবং প্রকাশনার মধ্য দিয়ে সর্বোচ্চ মেধাবী হিসেবে স্বীকৃত।
রাষ্ট্র পুনর্গঠনের প্রক্রিয়ায় উচ্চ শিক্ষাক্ষেত্রের অগ্রযাত্রার পথে শুভ সূচনা হলো ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এই নেতৃত্ব মনোনয়নের মধ্য দিয়ে। কারণ, এই মনোনয়নে সুস্পষ্টভাবেই মেধাকে প্রধান মাপকাঠি হিসেবে নেওয়া হয়েছে। নব্বইয়ের দশকের মধ্যভাগে নিজের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রজীবন থেকে নিয়ে আজ পর্যন্ত কখনো মেধাকে প্রধান্য দিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য ও উপাচার্যের পদে মনোনীত হতে দেখি নাই। বিগত সাড়ে তিন দশকে অধ্যাপক এমাজউদ্দীন থেকে শুরু করে যে সাতজন উপাচার্যকে দেখেছিলাম, এদের মধ্যে মাত্র একজনকে মেধাবী হিসেবে খানিকটা বিবেচনা করা যায় তার গবেষণা, একাডেমিক লেখালেখি ও প্রকাশনার জন্য। এ ছাড়া বাকি সবাই ছিলেন ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক দলের মনোনীত উপাচার্য এবং উপ-উপাচার্য। ফলে যা হওয়ার তাই হতো, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় পরিচালিত হতো রাষ্ট্র ক্ষমতায় আসীন সরকারের রাজনৈতিক ইচ্ছা-আকাক্সক্ষা-নীতি অনুযায়ী। সম্প্রতি বিগত ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগ ক্রমাগতভাবে স্বৈরাচারের দিকে যাওয়ার পথে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের নেতৃত্বও এই প্রতিষ্ঠানকে ক্রমশ একটা দলীয় প্রতিষ্ঠানেই রূপান্তর করেছিল যা বহিঃপ্রকাশ দেখেছি এই জুলাই-অভ্যুত্থানে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশাসনের নানান পর্যায়ে নেতৃত্বে থাকা শিক্ষকসহ ছাত্রলীগকে ছাত্র-জনতার বিরুদ্ধে প্রকাশ্য অবস্থান নেওয়ার মধ্যে। এদের নেতৃত্বে ছাত্র-ছাত্রীদের আবাসিক হলগুলো এবং বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাস হয়ে উঠেছিল আওয়ামী সন্ত্রাসের অভয়ারণ্যে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের নতুন উপাচার্য এবং তার সহযোগী দুই উপ-উপাচার্যের কেউই সক্রিয়ভাবে কোনো রাজনৈতিক দলের সঙ্গে জড়িত না এবং কোনো রাজনৈতিক দলের দ্বারাই মনোনীত না। ফলে স্বভাবতই সুদীর্ঘ দিনের প্রচলিত প্রথা ভেঙে যাওয়ায় জনপরিসরে সুপরিচিত নানান রাজনৈতিক দল ও মতের অনুসারী অধ্যাপক ও বুদ্ধিজীবীদের মধ্যে একটা অনিশ্চয়তা লক্ষণীয়, যা তারা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে প্রকাশ করছেন। এই নতুন নেতৃত্ব ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়কে কোন রাজনৈতিক মতাদর্শের দিকে নিয়ে যাবেন, তা নিয়ে নানান সম্ভাবনা ও আশঙ্কা প্রকাশ করছেন। যা এরা বলেন না, বা আমলে আনছেন না, সেটাই আসলে আমাকে আনন্দিত ও আশাবাদী করছে। আর সেটা হলো- মেধাভিত্তিক উচ্চশিক্ষার পথে যাত্রা। নতুন এই নেতৃত্ব নিজেরা মেধার মাপকাঠিতে নিজ নিজ বিষয়ে সমগ্র দেশেই সর্বোচ্চ মানের। বিশ্বব্যাপী সুপ্রসিদ্ধ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে সর্বোচ্চ ডিগ্রি, বিশ্বমানের গবেষণা ও প্রকাশনায় অগ্রবর্তী এই নেতৃত্ব। সেই সঙ্গে আন্তর্জাতিক গবেষণা সংস্থা ও বিশ্ববিদ্যালয়ে বিশেষ করে উপাচার্য অধ্যাপক নিয়াজ আহমেদ খানের সফলভাবে নেতৃত্ব দেওয়ার অভিজ্ঞতা, অধ্যাপক সায়মা হক বিদিশার অর্থনীতিবিষয়ক থিংকট্যাংকে জাতীয় অর্থনীতির নানান গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে পলিসি নির্ধারণী ভূমিকা তাদের নেতৃত্বে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে উচ্চশিক্ষার নতুন দিগন্তের সূচনা করবে বলেই আমি আশাবাদী।
বিগত আওয়ামী শাসনামলে অভাবনীয় মাত্রায় দুর্নীতি ও রাজনীতিকরণের মাধ্যমে সমস্ত প্রতিষ্ঠানের মতোই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়কেও চরমভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করা হয়েছে। দলীয় লেজুড়বৃত্তিকে তৈরি করা হয়েছে শিক্ষক ও বিসিএসের মতো সর্বোচ্চ প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষাগুলোতে সাফল্যের মাপকাঠিতে। আবাসিক হলে থাকা ও বিশ্ববিদ্যালয়ের আর সব কর্মকাণ্ডে অংশগ্রহণকে করা হয়েছে আওয়ামী লীগের প্রতি আনুগত্যের শর্তাধীন। ফলে, মুক্ত জ্ঞানচর্চা ও মুক্তচিন্তার বিকাশের বদলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়কে পরিণত করা হয়েছে ফ্যাসিজমের সূতিকাগারে। এ অবস্থা থেকে উত্তরণের জন্য সব থেকে বেশি জরুরি ছিল মেধার সর্বোচ্চ স্তর থেকে ব্যক্তিগতভাবে স্বাধীনচেতা, উচ্চশিক্ষা ও পেশাগত পর্যায়ে নেতৃত্বের অভিজ্ঞতাসম্পন্ন প্রার্থী, যে মাপকাঠিতে মনোনীত উপাচার্য ও উপ-উপাচার্যগণ খুবই উপযুক্ত। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এই নেতৃত্ব কীভাবে উচ্চশিক্ষায় নতুন দিগন্তের পথে চলবে?
প্রথমত, কোনো বিশেষ রাজনৈতিক দলের মনোনয়নে এসব পদে যেতে হয়নি বলে এবং নিজেরা সক্রিয়ভাবে কোনো দলের সঙ্গে জড়িত নয় বলে উপাচার্য এবং উপাচার্য দলীয় রাজনৈতিক প্রভাবমুক্ত থেকে বিশ্ববিদ্যালয়কে পরিচালনা করার একটা সুবর্ণ সুযোগ পেয়েছেন। তারা এই সুযোগের সদ্ব্যবহার করে দীর্ঘদিনের রাজনৈতিক প্রভাবে প্রতিষ্ঠানের মধ্যে গড়ে ওঠা নানারকম অনিয়ম ও অব্যবস্থা দূর করতে প্রয়োজনীয় প্রাতিষ্ঠানিক সংস্কারের উদ্যোগ নেবেন। এ ক্ষেত্রে আমি সর্বপ্রথম জোর দেব মেধাকে সর্বস্তরে প্রধান মানদণ্ড হিসেবে প্রতিষ্ঠা করতে। শিক্ষক নিয়োগ, শ্রেণিকক্ষে পাঠদান ও ছাত্র-ছাত্রীদের মূল্যায়ন পদ্ধতি, ক্যাম্পাস এবং আবাসিক হলগুলোতে পড়াশোনার পরিবেশ ফিরিয়ে আনা। এই তিনটি ক্ষেত্রে মেধাভিত্তিক অংশগ্রহণ ও মেধার পরিচর্যার জন্য প্রয়োজনীয় কাঠামোগত পরিবর্তন করতে পারলেই অন্যসব সমস্যার সমাধানের পথও খুলে যাবে।
এসব সংস্কার প্রাতিষ্ঠানিক সংস্কারের পথে সর্বপ্রথম এবং প্রধান বাধা আসতে পারে আওয়ামী স্বৈরাচারের আমলে শিক্ষকতা আর প্রশাসনিক নানান পদে নিয়োগপ্রাপ্ত দলীয় লেজুড়দের কাছ থেকে। পাশাপাশি ছাত্র-জনতার সফল অভ্যুত্থানের ফলে গঠিত অন্তর্র্বর্তী অরাজনৈতিক সরকারের প্রশাসনিক দুর্বলতার সুযোগ নিয়ে অন্য রাজনৈতিক দল, পেশাজীবী সংগঠন বা বিশেষ স্বার্থগোষ্ঠীও নিজেদের দাবি-দাওয়া আদায়ের জন্য চাপ প্রয়োগ করতে পারে। যা বিশ্ববিদ্যালয়কে মেধাভিত্তিক প্রতিষ্ঠানে পরিণত করার প্রচেষ্টাকে ব্যাহত করবে। এ সমস্যা থেকে উত্তরণের কী উপায়?
সাম্প্রতিক বন্যা এবং নানান রাজনৈতিক বিশৃঙ্খলা থেকে আমরা একটা সম্ভাব্য কার্যকরী উপায় দেখতে পারি। আর তা হলো ছাত্র-জনতাকে সঙ্গে নিয়ে সম্মিলিতভাবে প্রতিরোধ গড়ে তোলা। স্বৈরাচারের পতনের পর সারা দেশে পুলিশের অনুপস্থিতি ও প্রশাসনিক স্থবিরতার সুযোগে রাস্তাঘাটে বিশৃঙ্খলা, হিন্দু সম্পদায়ের উপাসনালয়ে হামলা এবং ছিনতাই-রাহাজানি শুরু হওয়ার আশঙ্কা দেখা দিয়েছিল। ছাত্র-জনতা সম্মিলিতভাবে নিরাপত্তা নিশ্চিত করে সেই আশঙ্কা দূর করেছে। আনসার বাহিনীর কিছু আন্দোলনকারী সদস্য সচিবালয় ঘেরাও কর্মসূচি নিলে সেখানেও ছাত্র-জনতা তাদের সফলভাবে প্রতিহত করেছে।
নতুন উপাচার্য ও উপ-উপাচার্যরা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়কে মেধাভিত্তিক প্রতিষ্ঠানে পরিবর্তন করার প্রক্রিয়ায় ছাত্র-জনতার সমর্থন পাবেন এ কথা নিশ্চিত বলা যায়। অতএব, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রয়োজনীয় প্রাতিষ্ঠানিক সংস্কারের খাতগুলো চিহ্নিত করে অগ্রাধিকার ভিত্তিতে সেগুলোকে পরিবর্তন শুরু করা দরকার। সংস্কার একটা দীর্ঘ প্রক্রিয়া। আর কয়েক দশক ধরে চলা দলীয় লেজুড়বৃত্তির রাজনীতি আর দুর্নীতির ফলে অনিয়মই অনেকটা নিয়মে পরিণত হয়েছে। ফলে নতুন নেতৃত্বের জন্য দরকারি সংস্কারগুলো সফলভাবে সম্পন্ন করাটাও স্বভাবতই সময়সাপেক্ষ হবে। কিন্তু ছাত্র-জনতার মাঝে বর্তমানে বিদ্যমান সংহতি দীর্ঘস্থায়ী না-হওয়ারই কথা। এ জন্য ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে একটা কাঠামোগত সংস্কারের মাধ্যমে রাজনৈতিক দলসমূহের প্রভাবমুক্ত থেকেও সাধারণ ছাত্র-ছাত্রীদের মধ্যে সংহতি বজায় রাখা এবং বিশ্ববিদ্যালয়ের নেতৃত্বকে প্রয়োজনের সময় সহায়তা করার সুযোগ তৈরি করতে হবে। আশার কথা হলো, এরকম একটা মেকানিজম বিশ্ববিদ্যালয়ের কাঠামোতেই বিদ্যমান আছে। আর তা হলো, ছাত্র সংসদ, যা ডাকসু নামে সুপরিচিত। স্বৈরাচারের অনুপস্থিতি আর অন্যান্য রাজনৈতিক দলের প্রভাবমুক্ত এই ক্রান্তিকালেই সম্ভব জাতীয় রাজনীতি থেকে সম্পূর্ণ স্বাতন্ত্র্য থেকে শুধু ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাধারণ ছাত্রছাত্রীদের নিয়ে একটা অবাধ ও নিরপেক্ষ নির্বাচনের মাধ্যমে শক্তিশালী ডাকসু কমিটি গঠন করা এবং এর মাধ্যমে সমস্ত ছাত্র-ছাত্রীকে বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিচালনায় সংযুক্ত করা। এর ফলে তারা যেমন প্রশাসনে নিজেদের মতামতের প্রতিফলন দেখতে পাবে, ঠিকই একই সঙ্গে নিজেদের মাঝে নেতৃত্বের গুণাবলি বিকাশেরও সুযোগ পাবে, যা থেকে তারা বিশ্ববিদ্যালয় পাস করে পাশাপাশি তাদের নিজ নিজ পেশাগত ক্ষেত্রেও নেতৃত্ব দিয়ে দেশ ও সমাজকে উন্নতির পথে এগিয়ে নেবে।
লেখক : সহকারী অধ্যাপক, নর্থওয়েস্টার্ন বিশ্ববিদ্যালয় (কাতার ক্যাম্পাস) পিএইচডি গবেষক, ক্যালিফোর্নিয়া বিশ্ববিদ্যালয়, লস অ্যাঞ্জেলস