আওয়ামী লীগ ও সব সহযোগী সংগঠনের নেতা-পাতি নেতারা এবং সদ্য পতিত কর্তৃত্ববাদী সরকারের মোসাহেব-চাটুকার বুদ্ধিজীবীরা জিয়াউর রহমানকে খাটো করার জন্য নানারকম অপপ্রচার চালিয়ে আসছে প্রায় সাড়ে চার দশকব্যাপী। মুক্তিযুদ্ধের সেক্টর কমান্ডার এবং পরবর্তীকালে রাষ্ট্রনায়ক জিয়ার কোনো অবদানই তারা স্বীকার করতে চান না। ঈর্ষাকাতর ব্যক্তিদের জিয়া-বিরোধিতার কারণগুলো তো সুস্পষ্ট।
একাত্তরের মার্চে দখলদার পাকিস্তানি বাহিনী গণহত্যা শুরুর সঙ্গে সঙ্গে চট্টগ্রামে মেজর জিয়া তাঁর সঙ্গী বাঙালি অফিসার ও প্রায় ৩০০ বাঙালি সৈন্য নিয়ে পাকিস্তানের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করে স্বাধীনতাযুদ্ধ শুরু করেন, চট্টগ্রামের সংগ্রামী জনতা তাঁকে সমর্থন জানান। তখনকার সিনিয়র বাঙালি সামরিক অফিসারদের অন্যতম ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টাল সেন্টারের কমান্ডার মেজর জিয়া প্রতিরোধযুদ্ধ চালাতে চালাতে একপর্যায়ে ২৭ মার্চ সন্ধ্যায় চট্টগ্রামের কালুরঘাট স্বাধীন বাংলা বিপ্লবী বেতার কেন্দ্র থেকে প্রথম স্বাধীনতার ঘোষণা দেন। সেই ঘোষণাটি সারা দেশের স্বাধীনতা-সংগ্রামী মানুষ তথা সমগ্র বাঙালি জাতির আশা-ভরসার স্থল হয়ে দাঁড়ায়। একাত্তরের অস্থায়ী সরকারের প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ ঘটনাটি প্রশংসার সঙ্গে স্বীকার করলেও অন্য সব আওয়ামী লীগাররা তাদের হীনমন্যতা অতিক্রমে ব্যর্থ।
জিয়াউর রহমানের ব্যাপারে তাদের গাত্রদাহের পরের কারণটি ব্যাখ্যা করে বলতে চাই। আড়াই দশকের বেশি রাজনীতি করে জেল-জুলুম নিপীড়ন সহ্য করেও জাতীয় নেতা শেখ মুজিবুর রহমানের ১৯৭২-১৯৭৫ সালের শাসনামলে দেশবাসী চরম আর্থিক সংকটে পড়ে। দেশ পতিত হয় দুর্ভিক্ষাবস্থার মধ্যে। শেষাবধি সবকিছুতে ব্যর্থ হয়ে গণতন্ত্রকে এক পাশে সরিয়ে চালু করলেন একদলীয় বাকশাল শাসনব্যবস্থা- মানুষের মৌলিক অধিকার, মানবাধিকার, সংবাদপত্রে মতপ্রকাশের স্বাধীনতা সবই বরবাদ। চারটি সরকারি দৈনিক পত্রিকা রেখে বাকি সব পত্র-পত্রিকা সাময়িকী নিষিদ্ধ। এমতাবস্থায় সামরিক বাহিনীর একটি ব্যাটালিয়ন ৬ মেজরসহ ১৭ জুনিয়র অফিসারের নেতৃত্বে সৈন্যরা (প্রায় ৭৩০ জন) বিদ্রোহ করে এবং তারা রাষ্ট্রপতি শেখ মুজিবুর রহমানকে সপরিবারে হত্যা করে বাকশাল ব্যবস্থার অবসান ঘটায়। তারপরে পঁচাত্তরের ৭ নভেম্বর সিপাহি-জনতার অভ্যুত্থানে জিয়া হন নতুন সরকারের দ্বিতীয় প্রধান ব্যক্তি; পরে তিনি জনগণের ভোটে নির্বাচিত হন রাষ্ট্রপতি। প্রায় সাড়ে পাঁচ বছর ধরে বিরামহীন পরিশ্রমে, মেধা ও দক্ষতা দিয়ে বাংলাদেশে ব্যাপক উন্নয়ন কর্মকান্ড চালান, যা দেশে-বিদেশে প্রশংসিত হয়। এই যে জিয়ার প্রশংসা এবং সাফল্য, এটাই আওয়ামী লীগ নেতা-কর্মী ও তাদের মোসাহেবদের গাত্রদাহের বড় কারণ। শেখ মুজিবকন্যা শেখ হাসিনা অগণতান্ত্রিক কায়দায় ১৯৮১ সাল থেকে টানা ২০২৪ সালের আগস্ট/৫ অবধি আওয়ামী লীগ সভাপতির পদ দখলে রেখে এবং সাড়ে পনেরো বছর ফ্যাসিবাদী স্টাইলে প্রধানমন্ত্রীর পদটি কবজায় রেখে চরম কর্তৃত্ববাদী শাসন চালিয়েছেন। এর ফলে ঘটেছে বারবার নির্বাচন জালিয়াতি, নানা অনাচার, অপরিসীম অপরাধ, সীমাহীন দুর্নীতি, নাগরিক নির্যাতন ইত্যাদি। শেষাবধি শিক্ষার্থী-গণমানুষের অভ্যুত্থানের মুখে তিনি ৫ আগস্ট পদত্যাগ করে দেশ ছেড়ে ভারতে আশ্রয় নিতে বাধ্য হন।
জিয়াউর রহমান বা বেগম খালেদা জিয়াকে কিন্তু এরকম ভাগ্যবরণ করতে হয়নি। রাষ্ট্রপতি জিয়া জেনারেল এরশাদ ও অন্য ষড়যন্ত্রকারীদের চক্রান্তে নিহত হলেও তাঁর জানাজায় অংশ নেন লাখ লাখ মানুষ। তাঁর ছিল অপরিসীম জনপ্রিয়তা। বেগম খালেদা জিয়া গণ আন্দোলনের প্রতি শ্রদ্ধাবশত তত্ত্বাবধায়ক সরকার পদ্ধতি মেনে নিয়েছিলেন। চালু করেছিলেন ওয়েস্টমিনিস্টার ধাঁচের সংসদীয় গণতন্ত্র। পাঁচ বছর পর আবার সসম্মানে ফিরে এসেছিলেন ক্ষমতায়।
জিয়াউর রহমান দেশের রাজনীতি, তথা রাষ্ট্র ব্যবস্থাপনায় পুরোপুরি গণতন্ত্র ও সুশাসন কায়েম করতে সক্ষম হয়েছিলেন, দেশকে প্রকৃত উন্নয়নের পথে পরিচালিত করতে পেরেছিলেন। তাঁর উদ্ভাবিত বাংলাদেশি জাতীয়তাবাদের ভিত্তিতে ১৯৭৮ সালের ১ সেপ্টেম্বর প্রতিষ্ঠা করেন বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল-বিএনপি। প্রতিষ্ঠাকালীন ঘোষণাপত্রের শুরুতেই বলা হয়েছিল- ‘স্বাধীন ও সার্বভৌম বাংলাদেশের অতন্দ্র প্রহরী হচ্ছে-
১. বাংলাদেশি জাতীয়তাবাদের ভিত্তিতে অনুপ্রাণিত ও সংহত ইস্পাতকঠিন গণঐক্য। ২. জনগণভিত্তিক গণতন্ত্র ও রাজনীতি। ৩. ঐক্যবদ্ধ ও সুসংগঠিত জনগণের অক্লান্ত প্রয়াসের ফলে লব্ধ জাতীয় অর্থনৈতিক মুক্তি, আত্মনির্ভরশীলতা ও প্রগতি।
জিয়াউর রহমানের দূরদর্শী এবং রাষ্ট্রনায়কোচিত রাজনীতি আর বিএনপি প্রতিষ্ঠা প্রমাণ করেছে যে, এ দেশে হাজার রকমের নিপীড়ন সত্ত্বেও বাংলাদেশি জাতীয়তাবাদের রাজনীতি অক্ষুণ্ণ থাকবে ইনশা আল্লাহ। শত নিপীড়ন সহ্য করেও বিএনপি সর্বাপেক্ষা বড় ও ♦ লেখক : বিএনপির সাবেক তথ্য ও গবেষণা সম্পাদক